নিষ্পাপ নিধনের কাল by ফারুক ওয়াসিফ

সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে পিছপা হন না কোনো মা-বাবা। নিজের সন্তানের লাশ থানা থেকে নিজেই চিনে নিয়েছিলেন রাজনের মা। হয়তো হত্যার ভিডিওটিও না দেখে উপায় নেই তাঁর। সন্তানের অন্তিম মুহূর্তের মরণ আর্তনাদ তিনি মনে রাখবেন, কোনো দিন ভুলবেন না। কিন্তু আমরা পারি না। আমরা ভুলে যেতে চাই। আমরা না পারি সইতে, না পারি কইতে। নিষ্পাপের মৃত্যুর উন্মত্ত মহড়া তবু আমাদের দেখে যেতেই হয়। পেছনে আবহসংগীত হিসেবে বাজে মধ্যম আয়ের মধুর বাঁশি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে...অধিকতর উন্নয়ন আর তুমুল অমানবিকতার দিকে।
বীর আর কসাইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী? গুলি বা চাপাতি, জবাই, কাটা, ফাঁস, পেটানো, টুকরা টুকরা করা, পেট্রলে পোড়া, সামনে বা পেছনে কোপ, গুম, ক্রসফায়ার, লিচুতে বিষ, খাবারে ফরমালিনসহ হত্যার কত কত পদ্ধতি। হত্যার এই সব পদ্ধতি যুদ্ধে প্রয়োগ করলে বলে বীর। প্রায়ই যে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়, তাদের পিঠ চাপড়ে দেওয়ার লোক অনেক। পিটিয়ে সাপ বা শিয়াল মারার মধ্যেও হিংস্রতা থাকে। সেই হিংস্রতা কখনো যখন মানুষ হত্যার খাতে বয়ে যায়, তখন আমরা চমকে উঠি। কিন্তু দাপটের উচ্চসিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ঘরের লোক, কাজের লোক, রিকশাওয়ালা-শ্রমিকসহ নিচের লোককে আমরা কি আহত করি না? আমি যখন মাস্টার, তখন বেতের ব্যবহার করি না কি শিশুর গায়ে? কাজের বুয়ার গায়ে আগুনের ছেঁকা দিই না কি, আমি যখন গৃহকর্ত্রী?
আমরা চোর বলে শিশু বা ভবঘুরেকে পিটিয়ে অভ্যস্ত, কিন্তু ব্যাংকচোর, গমচোর, ভোটচোরদের জন্য রয়েছে লালগালিচা, সোনার পুত্তলিকা। আমাদের অদৃশ্য লেজটি তাদের সামনে ভক্তিতে হাতপাখার মতো দোলে। যাদের অবহেলায় ওয়াসার সুড়ঙ্গে পড়ে জিহাদ নামক শিশুটি মরে গিয়েছিল, তাদের কি যথাযথ শাস্তি হয়েছে? শাস্তি দাবির বেলায়ও আমরা এখন আগে দেখে নিই অপরাধী কোন দলের!
কাউকে রিমান্ডে নিয়ে বা গুম করে জেরার নামে নির্যাতন করা হলে কি বিচার হয়? জেরার নামে অত্যাচারের যেসব গল্প শুনি, তারাও তো নারায়ণগঞ্জের ত্বকীর খুনিদের মতো, রাজনের ঘাতকদের মতো। তারাও তো শরীরের নাজুক জায়গায় হাঁটুতে কষ্ট দিয়ে দিয়ে হত্যার বীভৎস আনন্দে হাসে। হত্যার আগে ত্বকীর অণ্ডকোষ থ্যাঁতলানো হয়েছিল! বিগত বছরগুলোতে মেঘনায়, গাজীপুরে, মুন্সিগঞ্জে যখন অহরহ অপঘাতের লাশ মিলত; সেসবের হত্যাকারীদের কে খুঁজেছে? আমাদের নেতা-নেত্রীরা জনসভায়, টেলিভিশনে, লিখিতভাবে প্রতিপক্ষকে বিনাশের হুমকি যখন দেন, তখন যে মুহুর্মুহু স্লোগান ও জয়ধ্বনি ওঠে, সেগুলো কারা দেয়? আমাদেরই কেউ কেউ নয় কি? ক্রমিক খুনি রসু খাঁরা আমাদের মধ্যেই বাস করে। ত্বকী থেকে বিশ্বজিৎ, অভিজিৎ থেকে রাজন পর্যন্ত কেবলই নিরপরাধের মৃত্যু।
কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে তা তো দেখবই, কিন্তু আমরাই বা কেমন, সেটা ভুলে থাকলে চলবে কী করে? প্রতি তিনজন শিশুর দুজনই মা-বাবার মারধরের শিকার (প্রথম আলো, ৬ জুলাই)। ভুললে চলবে কী করে দেশে (দশ বছর আগের জরিপে) কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা ৭৪ লাখ, আর সরাসরি শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৩৪ লাখ (সূত্র: ইউনিসেফ ও আইএলও)। এবং আমার-আপনার শিশুরা যখন কোমল শৈশব পার করছে, তখন এরা পড়ে থাকছে নির্যাতন-মৃত্যু আর যৌন সন্ত্রাসের হুমকির মুখে।
মানুষ অমৃতের সন্তান নয়। সেমেটিক ধর্মমতে ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের খুনই আদিতম হত্যাকাণ্ড। হিংস্রতা, জিঘাংসা, অসূয়া আমাদের সহজাত। তা সামলাতে আমরা আইন বানিয়েছি, রাষ্ট্র বানিয়েছি, সংস্কৃতির সাধনা করে আসছি, ধর্ম দিয়ে অধর্ম ঠেকাতে গিয়েছি। ভেবেছি, এগুলোই আমাদের ভেতরের শয়তানকে সামলাবে। সহজাত হিংস্রতাকে নীতি ও শাসনের শিকলে আটকে রাখবে। কিন্তু সেই আশার গুড়ে কেবলই বিষ। আজ আমাদের সৃষ্টিই কি আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নেই?
শিশু রাজনের হত্যার দুই দিন পরের সংবাদ: হিজড়াকে পিটিয়ে হত্যা, ডাকাত সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা, ঘুমন্ত বস্তিতে আগুনে দুই শিশু অঙ্গার, চরে যুবকের মাথাকাটা লাশ উদ্ধার ইত্যাদি। রাজনীতি থেকে শুরু করে পরিবার পর্যন্ত হিংস্রতার বান। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ চাই, ক্রিকেটে বিশ্বসেরা হওয়ার সাধ আমাদের, চেতনায় চেতে উঠে চিৎকার করি আমরা, কিন্তু মধ্যম মানের মানবিকতা অর্জনে কত দেউলিয়া, সেই হুঁশ নেই! এ এমন এক দেশ, যেখানে ঘটনা ঘটে চলে, কিন্তু প্রতিক্রিয়া হয় বেছে বেছে। ভিডিও–বাস্তবতায় আমরাও হয়েছি এমন আসক্ত, সচিত্র না দেখলে আমরা নড়েচড়ে বসি না।
ইমানুয়েল লেভিনাস ফরাসি দার্শনিক। তিনি বোঝাচ্ছেন: কেউ কাছে এলে মানুষ মুখের দিকেই তাকায়। অচেনা সেই মুখ প্রথমেই তার মধ্যে জাগিয়ে তোলে আদিম ভীতি: ও কি আমার শত্রু, ঘাতক? কিন্তু ভালো করে তাকালে সে দেখে, প্রতিটি আনমনা মুখই কত নির্বিরোধী, কত সহজ। পাশবিকতাকে ঘুম পাড়াতে পারলে প্রতিটি মানুষই ঘুমন্ত মুখের মতো সরল ও সহজ। এই অনুভূতি থেকে তখন আমরা আবার মুখের দিকে দেখি, মায়া জাগে। আমাদের সভ্যতায় এই মায়া আজ গরহাজির।
নিষ্পাপের মৃত্যুর উন্মত্ত মহড়া তবু আমাদের দেখে যেতেই হয়। পেছনে আবহসংগীত হিসেবে বাজে মধ্যম আয়ের মধুর বাঁশি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে...অধিকতর উন্নয়ন আর তুমুল অমানবিকতার দিকে সবেরই কারণ আছে। মানুষের ভেতরের বীভৎস বীরের ছায়াটা যে বেরিয়ে আসছে বেশি করে, কারণ আইন-শাসন-নজরদারি-জবাবদিহি মারাত্মক শিথিল। অনেক ক্ষেত্রে রক্ষকেরাই ভক্ষণের পৈশাচিকতা চালায়। কেন এমনটা হচ্ছে, তার সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এটা সামাজিকভাবে দীর্ঘদিন ধরেই আছে—পোস্ট কলোনিয়াল (সদ্যস্বাধীন) সোসাইটিতে আগ্রাসী বা ধ্বংস করার মনোবৃত্তি থেকে মানুষের মধ্যে এ আচরণ দেখা যায়...জনগণের ভেতর যে হতাশা বা উন্মাদনা থাকে, তার প্রভাবে এই আগ্রাসী আচরণ বেরিয়ে আসে।...শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এমনটা ঘটে। কিন্তু যে রাষ্ট্রে এসব আচরণ নিরুৎসাহিত করার কোনো প্রবণতা বা সিস্টেম থাকে না, সেখানে এসব আচরণ বেশি প্রকাশ পায়।’ বাংলাদেশের ঘটনাগুলো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন গ্লোবালাইজেশনের একটা ট্রানজিশনাল পিরিয়ড পার করছে। সুতরাং এখানকার অনেক মানুষ এসব আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।’ অন্যদিক থেকে একে বলা যায় ট্রানফার্ড অ্যাগ্রেশন বা স্থানান্তরিত ক্রোধ। এক জায়গার হতাশা আমরা আরেক জায়গায় প্রকাশ করি।
শুধু নৈতিকতার মাইক বাজিয়ে এই বিকার ঠেকানো যাবে না। বাজার অর্থনীতির তুমুল হাওয়ায় পাতলা মেঘের মতো ছিঁড়ে-ফুড়ে উড়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজ। মানুষ এতই আত্মকেন্দ্রিক যে কেউ কাউকে মানেও না, ডাকেও না। আয়ের চাইতেও বেশি বাড়ছে জীবনযন্ত্রণা-অনিশ্চয়তা-ভয়। এসবে অস্থির মানুষ বোধবুদ্ধি হারিয়ে বিকারগ্রস্ত হয়। ঠিক যে, আইনের কঠোর প্রয়োগ লাগবে, বিচারে আস্থা আনতে হবে, পাশাপাশি সমাজের সংহতি ও বন্ধনও জাগাতে হবে। আমাদের আনন্দের জায়গা নিয়েছে বিনোদন। আর বিনোদন মানেই যৌনকাতর হিংসাত্মক সিনেমা, খেলা, ভিডিও ও টেলিবাস্তবতা। এসব না বদলিয়ে মানুষ বদলাবে কী করে?
একদিন সমাজের সামনে যে আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব ছিল, আজ সেগুলো সুবিধাবাদ ও স্বার্থপরতায় ভূলুণ্ঠিত অথবা অকেজো। ভালো মানুষ সব ক্ষেত্রে পরাজিত ও ভীত। দুর্বৃত্ত ও অপরাধীরা রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। নতুন আদর্শ ও নতুন অনুসরণীয় মানুষকে সামনে আনতে না পারলে, রাষ্ট্রটাকে অসুরবিনাশী করতে না পারলে আমাদের আশা নেই।
চরম পৈশাচিকতার মুখে আমরা বিহ্বল হয়ে পড়ি, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। কিন্তু এই মুহূর্তেই প্রশ্ন করতে হবে, ঠিক এই সময়ে পরিকল্পিতভাবে শিশুকে হত্যা করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছিল কি না। কেন পুলিশপ্রধান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও রাজনের মূল ঘাতককে সময় থাকতে পুলিশ আটক করতে পারল না? রাজনের মায়ের দাবি, পুলিশ ও ইমিগ্রেশন এড়িয়ে সে এখন দেশের বাইের।
এদিকে উন্মত্ত ক্রোধে অনেকে খুনিদের ফাঁসি চাইছেন, ক্রসফায়ার দাবি করছেন, পিটিয়ে মারতেও চাইছেন। তা-ই যদি হবে, তাহলে বিচার হবে কার? বিচার মানে দোষীকে শুধু ঝুলিয়ে দেওয়া না। আদালতের সওয়াল-জবাবের মধ্যে, উকিল ও বিশেষজ্ঞদের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে শুধু অপরাধই প্রমাণিত হয় না, অপরাধের কার্যকারণ ও মন-মানসিকতারও হদিস করা হয়। তা থেকেই প্রতিকারের পথেরও সন্ধান মিলতে পারে। তাই হত্যার জবাবে হত্যা নয়, হত্যার বিচারের মাধ্যমে সম্ভাব্য শিকার ও সম্ভাব্য হত্যাকারী উভয়কেই নিহত ও খুনি হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে। এবং এসবকে দলীয় রংচশমায় রাঙানো যাবে না।
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমরা এখন আমাদেরই মারছি ও মরছি। গভীর গভীরতর অসুখ এখন বাংলাদেশের। আমার মানুষ মরছে আগুনে, ভবন ধসে, ক্রসফায়ারে, গুম হচ্ছে, সাগরে ডুবছে, পায়ের তলায় থ্যাঁতলা হচ্ছে—দেশে-বিদেশে। মানুষই এখন মারছে মানুষকে। প্রতিটি অপঘাতের ক্ষত থেকে উঠে আসছে ডুবন্ত জাহাজের নাবিকের শেষ বার্তা: সেভ আওয়ার সোউলস (এসওএস); আমাদের প্রাণ বাঁচাও! বাংলাদেশ এখন চিৎকার করে বলতে চাইছে, ‘আমি মরি যাইয়ার, আমারে কেউ বাঁচাও রে বা!’

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.