কভি খুশি কভি গম by মাহবুব তালুকদার
বাসায় বসে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র দেখছিলাম টেলিভিশনে। চাচা টেলিফোন করে জিজ্ঞাসা করলেন, কী করছো?
একটা মুভি দেখছি। আমি বললাম, ‘কভি খুশি কভি গম’।
তোমরা গম নিয়ে আর কত রাজনীতি করবে?
বুঝলাম চাচা আমার কথা বুঝতে পারেননি। বললাম, এই গম সেই গম নয়। এটা হিন্দি গম-এর অর্থ বেদনা। আপনি সম্ভবত গম কেলেঙ্কারির কথা বলতে চাচ্ছেন।
তুমি কত সহজে কেলেঙ্কারি শব্দটা জুড়ে দিলে। অথচ গম নিয়ে কোন কেলেঙ্কারিই হয়নি। খাদ্য অধিদপ্তর হাইকোর্টের নির্দেশে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তাতে বলা হয়েছে ব্রাজিল থেকে আনা গম খাওয়ার উপযোগী।
এটা স্বস্তিকর কথা। তবে হাইকোর্ট এ বিষয়ে কী নির্দেশ দেন, এখন তা-ই দেখার বিষয়।
গম নিয়ে তো কম তোলপাড় হলো না। মিডিয়ায় ব্রাজিলের গমের যে ছবি ছাপা হয়েছে, তাতে গমগুলো নষ্ট মনে হয়েছে। সেদিন কুমারখালীর সংসদ সদস্য নিজে গম পরীক্ষা করে তার এলাকার সরকারি খাদ্য গুদামে ওই গম তুলতে দেননি। খুলনার আটাকল মালিকরা বলেছেন, ব্রাজিলের গম দুর্গন্ধযুক্ত এবং এতে আটা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করলে লোকসান হবে।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই গমে কুঁচকানো ও ভাঙা দানার পরিমাণ সরকার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। পুলিশও এই গম নিতে চাইছে না। এরকম আরও কতো কী? এখন দেখা যাক, হাইকোর্টের নির্দেশ শেষপর্যন্ত কী দাঁড়ায়?
চাচার আমন্ত্রণে বিকালে তার বাসায় গেলাম। দেখি চাচাও তখন টেলিভিশন দেখায় ব্যস্ত। এরকম দৃশ্য কমই দেখা যায়। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকলে চাচা টিভিতে মেতে থাকেন। আমাকে দেখে বললেন, দেশে কত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। বাংলাদেশকে এখন বিশ্ববাসী সমীহের চোখে দেখছে। এটা কত বড় অর্জন, কল্পনা করতে পারো?
বললাম, বাংলাদেশের অর্জন দিকে দিকে। ক্রিকেট খেলায় অর্জন, সীমানা বিজয়ে অর্জন, সমুদ্র বিজয়ে অর্জন, আপনি কোন অর্জনের কথা বলছেন?
চাচা আর ভণিতা করলেন না। জানালেন, বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হয়েছে। এটা আমরা দাবি করছি না, বিশ্বব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে।
চাচা! নিঃসন্দেহে খবরটা আনন্দের। আমিও খবরটা আগেই জেনেছি। তবে এই খবরে রবীন্দ্রনাথের ‘পুরসকার’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেল। কবি রাজসভা থেকে রাজার গলার পুষ্পমালা উপহার নিয়ে বাসায় ফিরছেন। কবির স্ত্রী দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হলেও শেষে রাজমাল্যটিকে গলায় পরে নেন। এটা ছিল রাজার কাছে আর স্ত্রীর কাছে কবির স্বীকৃতি।
তোমার এসব কথার কোন অর্থই বুঝলাম না।
আমি বলতে চাইছি, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হলাম, রাজার কাছ থেকে পুরস্কারও পেলাম। এর ফলাফল কী?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাবো। বুঝতেই পারছো, আমাদের অর্থনীতির এখন শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হচ্ছে।
আমার সেই হিন্দি ছবিটার নাম আবার মনে হচ্ছে: ‘কভি খুশি কভি গম’। অর্থ হচ্ছে: কখনো খুশি কখনো বেদনা। আমাদের অর্থনীতির খুশির চেয়ে বেদনার দিকটি বেশি ভারি।
অর্থনীতি নিয়ে নৈরাশ্য যাতনায় কেন ভুগছো?
সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনের বেদনা বেড়েছে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী যে সত্য কথাটি প্রকাশ করেছেন এবং যেহেতু তা প্রকাশ করতে পেরেছেন, সে জন্য তিনি সবার ধন্যবাদার্হ।
মুহিত স্যারের কোন কথা?
সংসদে তিনি বলেছেন, ‘নিজের দলীয় লোকদের সমর্থনের কারণে সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।’ তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘এটা নিয়ে আমি খুব ক্ষুব্ধ।’
তাহলে তো হয়েই গেল। মুহিত স্যার ঠিক কথাই বলেছেন।
বললাম, অর্থমন্ত্রীর ‘আমি খুব ক্ষুব্ধ’ বললেই কথাটা শেষ হয়ে যায় না। বিএনপি বলেছে, ‘রাষ্ট্রীয় ব্যাংক লুটপাটকারীদের নাম প্রকাশ করুন’।
এদিকে সোনালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ কেলেঙ্কারি ও অর্থ লোপাটের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কিন্তু এর আর পর নেই। প্রত্যেকের ক্ষুব্ধ হওয়ার মধ্যে দুঃখ ও বেদনা আছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কোন পদক্ষেপ নেই। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত সম্পর্কে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ঐতিহাসিক বক্তব্যটি মনে পড়ে যায়- শেয়ারের ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়, কারণ তারা খুবই প্রভাবশালী। প্রভাবশালীরাই এদেশের মালিক ও এদেশের রাজা, আমরা আমজনতা শুধু তাদের প্রজা।
আমি অর্থনীতিবিদ নই বা ব্যাংকারও নই। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে যেসব অনাচার ও ভ্রষ্টাচার চলছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রথম আমি বুঝতে অক্ষম রাজনৈতিক কারণে কাউকে ব্যাংক উপহার দেয়া হয় কেন? কাউকে যদি দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে হয় তাহলে তাকে রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত করা যেতে পারে। আর্থিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কেন? দ্বিতীয়ত, লোন দেয়ার কথা ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টের, বোর্ড কেন লোন দেবে? লোন দেয়ার সময় প্রকল্পের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেয়া হয় না। বোর্ডের তদবিরে লোন দেয়া হয়। মনে হয় বোর্ডের কাজ কেবল লুটপাটে সহযোগী হওয়া। তৃতীয়ত. বোর্ডে আত্মীয় থাকার কথা নয়, কিন্তু যেখানে তা মানা হয় না, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কি কিছু করণীয় নেই। চতুর্থত. বাংলাদেশ ব্যাংক অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে কখনও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয় না। যাদের ধরা হয়, তাদের শাস্তির দীর্ঘসূত্রতায় অপকর্ম উৎসাহিত হয়।
আরও মজার ব্যাপার আছে। বড় বড় ঋণ খেলাপিদের সুদ মাফ করার প্রবণতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। সম্প্রতি ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে রি-সিডিউল করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কী মহৎ উদ্যোগ। এরপর এখন থেকে ৫০০ কোটি টাকার খেলাপির সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানেন ব্যাংকে যেহেতু জনগণের টাকা আমানত থাকে, সেহেতু ঋণ খেলাপি হলে কোন অসুবিধা নেই। সর্বোচ্চ কতবার রি-সিডিউল করা যাবে, তার কোন নীতিমালা আছে কি? বড় ঋণগ্রহীতারা জানেন, তারা ‘টু পাওয়ার ফুল টু কন্ট্রোল’। ফলে সরকার যেন তাদের কাছে বাঁধা।
এসব কথা চাচাকে বলবো কিনা ভাবছিলাম। চাচা বললেন, দেশের আর্থিক অবস্থা এখন কত ভালো, তার দিকে তোমার কোন দৃষ্টি নেই।
আর্থিক অবস্থা ভালো মানে?
গত অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স দেড় হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ভাবতে পারো, এটা কত বড় অর্জন?
চাচা! এটা অবশ্যই অর্থনীতির জন্য একটা বিরাট সুখবর। কিন্তু এর পাশাপাশি বাংলাদেশীদের কত হাজার কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে পাচার করা হয়েছে, সেই খবরটি এ ধরনের অর্জনকে ম্লান করে দেয়। সেজন্যই আমি বলছিলাম, অর্থনীতিতে আমাদের অবস্থা ‘কভি খুশি, কভি গম’।
তোমার মতো নেতিবাচক চিন্তা আমার নেই। চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করবেন। অর্থনীতির ফাঁক-ফোকরগুলো নিশ্চয়ই তিনি সামলে নেবেন। তার ওপর আস্থা আছে আমার।
আস্থা আমারও আছে। সেদিন তিনি সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী ও চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের আরও সোচ্চার হতে বলেছেন। আমি মনে করি, একই সঙ্গে অর্থ লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বললে ভালো হতো।
সেটা কী সম্ভব?
কেন সম্ভব নয়?
সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী চোরাকারবারিরা সরকারের বাইরে থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অপকর্ম করে। কিন্তু যাদের তুমি অর্থ লুটপাটকারী বলছো, তারা কাজ করে সরকারের ভেতরে বসে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে আইন অনুযায়ী হতে হবে।
সব বিষয়েই আইন অনুযায়ী চলতে হবে। আমি জানালাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, আইন অমান্যকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে, তা সে যে দলেরই হোক।
প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন।
তাহলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ব্যবস্থা নিতে পারছেন না কেন? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের সঙ্গে তার বক্তব্য খাপ খায় না। দু’জনের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী।
চাচা সহসা কথার মোড় পরিবর্তন করে বললেন, রাজনৈতিক বাস্তবতা বলে একটা কথা আছে।
সেটাই বলুন। রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে নৈতিক বাস্তবতা মার খেয়ে যাচ্ছে।
আমার কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে ওঠায় চাচা তার কণ্ঠস্বর নামিয়ে আনলেন। শান্তকণ্ঠে বললেন, তোমার উদ্বেগ কিছুটা বুঝতে পারছি। তবে চিন্তা করো না। খুব শিগগিরই আর্থিক খাতের সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আর্থিক খাত তো একটা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু আর্থিক খাত ধরে অগ্রসর হলে হবে না। দেশে সামগ্রিকভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
ঠিক আছে। তোমার কথাই মেনে নিলাম। চাচা বললেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী করতে হবে?
দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বেশ। তারপর? রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি অবাধ নিরপেক্ষ সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার।
সর্বজনগ্রহণযোগ্য বলে কোন কথা নেই। অধিকাংশ লোক যা মেনে নেয়, তাই-ই সর্বজনগ্রহণযোগ্য। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন সবাই মেনে না নিলেও অধিকাংশ মানুষ তা মেনে নিয়েছে। দু’একটি দেশ ছাড়া বিদেশীরাও আর কোন কথা বলছে না।
আপনার তথ্য ঠিক নয়।
তোমার তথ্যটা কি?
চাচা: ক’দিন আগে জাতিসংঘ এক চিঠি দিয়ে ‘নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’ বন্ধ করে দিয়েছে।
ভারি অন্যায়! জাতিসংঘের এটা করা উচিত হয়নি। কি কারণে তারা এটা করলো?
তারা কোন কারণ দর্শায়নি। তবে যেসব দেশ এই প্রকল্পের অর্থ যোগানদাতা ছিল, তারা হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তারা অর্থ দিতে আর আগ্রহী নয়।
চাচা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, এসব দেশ কি চায় না বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী হোক?
তারা মুখ না খুললেও বোঝা যায়, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তারা খুব হতাশ। এ জন্যই তারা প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
যাকগে। আমরা এখন আর বিদেশীদের দিকে তাকিয়ে নেই। আমরা এখন আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছি। দেখলে না নিজেদের অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতু পর্যন্ত তৈরি করতে পারছি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাবো আমরা। তারপর উচ্চ আয়ের দেশ।
এসব কথা শুনতে বেশ ভালো লাগে। আমিও আশাবাদী হতে চাই। আমি বললাম, কিন্তু আমাদের অবস্থা সেই হিন্দি গানের মতো: ‘কভি খুশি কভি গম’।
একটা মুভি দেখছি। আমি বললাম, ‘কভি খুশি কভি গম’।
তোমরা গম নিয়ে আর কত রাজনীতি করবে?
বুঝলাম চাচা আমার কথা বুঝতে পারেননি। বললাম, এই গম সেই গম নয়। এটা হিন্দি গম-এর অর্থ বেদনা। আপনি সম্ভবত গম কেলেঙ্কারির কথা বলতে চাচ্ছেন।
তুমি কত সহজে কেলেঙ্কারি শব্দটা জুড়ে দিলে। অথচ গম নিয়ে কোন কেলেঙ্কারিই হয়নি। খাদ্য অধিদপ্তর হাইকোর্টের নির্দেশে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তাতে বলা হয়েছে ব্রাজিল থেকে আনা গম খাওয়ার উপযোগী।
এটা স্বস্তিকর কথা। তবে হাইকোর্ট এ বিষয়ে কী নির্দেশ দেন, এখন তা-ই দেখার বিষয়।
গম নিয়ে তো কম তোলপাড় হলো না। মিডিয়ায় ব্রাজিলের গমের যে ছবি ছাপা হয়েছে, তাতে গমগুলো নষ্ট মনে হয়েছে। সেদিন কুমারখালীর সংসদ সদস্য নিজে গম পরীক্ষা করে তার এলাকার সরকারি খাদ্য গুদামে ওই গম তুলতে দেননি। খুলনার আটাকল মালিকরা বলেছেন, ব্রাজিলের গম দুর্গন্ধযুক্ত এবং এতে আটা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করলে লোকসান হবে।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই গমে কুঁচকানো ও ভাঙা দানার পরিমাণ সরকার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। পুলিশও এই গম নিতে চাইছে না। এরকম আরও কতো কী? এখন দেখা যাক, হাইকোর্টের নির্দেশ শেষপর্যন্ত কী দাঁড়ায়?
চাচার আমন্ত্রণে বিকালে তার বাসায় গেলাম। দেখি চাচাও তখন টেলিভিশন দেখায় ব্যস্ত। এরকম দৃশ্য কমই দেখা যায়। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকলে চাচা টিভিতে মেতে থাকেন। আমাকে দেখে বললেন, দেশে কত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। বাংলাদেশকে এখন বিশ্ববাসী সমীহের চোখে দেখছে। এটা কত বড় অর্জন, কল্পনা করতে পারো?
বললাম, বাংলাদেশের অর্জন দিকে দিকে। ক্রিকেট খেলায় অর্জন, সীমানা বিজয়ে অর্জন, সমুদ্র বিজয়ে অর্জন, আপনি কোন অর্জনের কথা বলছেন?
চাচা আর ভণিতা করলেন না। জানালেন, বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হয়েছে। এটা আমরা দাবি করছি না, বিশ্বব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে।
চাচা! নিঃসন্দেহে খবরটা আনন্দের। আমিও খবরটা আগেই জেনেছি। তবে এই খবরে রবীন্দ্রনাথের ‘পুরসকার’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেল। কবি রাজসভা থেকে রাজার গলার পুষ্পমালা উপহার নিয়ে বাসায় ফিরছেন। কবির স্ত্রী দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হলেও শেষে রাজমাল্যটিকে গলায় পরে নেন। এটা ছিল রাজার কাছে আর স্ত্রীর কাছে কবির স্বীকৃতি।
তোমার এসব কথার কোন অর্থই বুঝলাম না।
আমি বলতে চাইছি, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হলাম, রাজার কাছ থেকে পুরস্কারও পেলাম। এর ফলাফল কী?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাবো। বুঝতেই পারছো, আমাদের অর্থনীতির এখন শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হচ্ছে।
আমার সেই হিন্দি ছবিটার নাম আবার মনে হচ্ছে: ‘কভি খুশি কভি গম’। অর্থ হচ্ছে: কখনো খুশি কখনো বেদনা। আমাদের অর্থনীতির খুশির চেয়ে বেদনার দিকটি বেশি ভারি।
অর্থনীতি নিয়ে নৈরাশ্য যাতনায় কেন ভুগছো?
সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনের বেদনা বেড়েছে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী যে সত্য কথাটি প্রকাশ করেছেন এবং যেহেতু তা প্রকাশ করতে পেরেছেন, সে জন্য তিনি সবার ধন্যবাদার্হ।
মুহিত স্যারের কোন কথা?
সংসদে তিনি বলেছেন, ‘নিজের দলীয় লোকদের সমর্থনের কারণে সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।’ তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘এটা নিয়ে আমি খুব ক্ষুব্ধ।’
তাহলে তো হয়েই গেল। মুহিত স্যার ঠিক কথাই বলেছেন।
বললাম, অর্থমন্ত্রীর ‘আমি খুব ক্ষুব্ধ’ বললেই কথাটা শেষ হয়ে যায় না। বিএনপি বলেছে, ‘রাষ্ট্রীয় ব্যাংক লুটপাটকারীদের নাম প্রকাশ করুন’।
এদিকে সোনালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ কেলেঙ্কারি ও অর্থ লোপাটের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কিন্তু এর আর পর নেই। প্রত্যেকের ক্ষুব্ধ হওয়ার মধ্যে দুঃখ ও বেদনা আছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কোন পদক্ষেপ নেই। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত সম্পর্কে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ঐতিহাসিক বক্তব্যটি মনে পড়ে যায়- শেয়ারের ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়, কারণ তারা খুবই প্রভাবশালী। প্রভাবশালীরাই এদেশের মালিক ও এদেশের রাজা, আমরা আমজনতা শুধু তাদের প্রজা।
আমি অর্থনীতিবিদ নই বা ব্যাংকারও নই। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে যেসব অনাচার ও ভ্রষ্টাচার চলছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রথম আমি বুঝতে অক্ষম রাজনৈতিক কারণে কাউকে ব্যাংক উপহার দেয়া হয় কেন? কাউকে যদি দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে হয় তাহলে তাকে রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত করা যেতে পারে। আর্থিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কেন? দ্বিতীয়ত, লোন দেয়ার কথা ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টের, বোর্ড কেন লোন দেবে? লোন দেয়ার সময় প্রকল্পের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেয়া হয় না। বোর্ডের তদবিরে লোন দেয়া হয়। মনে হয় বোর্ডের কাজ কেবল লুটপাটে সহযোগী হওয়া। তৃতীয়ত. বোর্ডে আত্মীয় থাকার কথা নয়, কিন্তু যেখানে তা মানা হয় না, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কি কিছু করণীয় নেই। চতুর্থত. বাংলাদেশ ব্যাংক অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে কখনও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয় না। যাদের ধরা হয়, তাদের শাস্তির দীর্ঘসূত্রতায় অপকর্ম উৎসাহিত হয়।
আরও মজার ব্যাপার আছে। বড় বড় ঋণ খেলাপিদের সুদ মাফ করার প্রবণতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। সম্প্রতি ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে রি-সিডিউল করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কী মহৎ উদ্যোগ। এরপর এখন থেকে ৫০০ কোটি টাকার খেলাপির সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানেন ব্যাংকে যেহেতু জনগণের টাকা আমানত থাকে, সেহেতু ঋণ খেলাপি হলে কোন অসুবিধা নেই। সর্বোচ্চ কতবার রি-সিডিউল করা যাবে, তার কোন নীতিমালা আছে কি? বড় ঋণগ্রহীতারা জানেন, তারা ‘টু পাওয়ার ফুল টু কন্ট্রোল’। ফলে সরকার যেন তাদের কাছে বাঁধা।
এসব কথা চাচাকে বলবো কিনা ভাবছিলাম। চাচা বললেন, দেশের আর্থিক অবস্থা এখন কত ভালো, তার দিকে তোমার কোন দৃষ্টি নেই।
আর্থিক অবস্থা ভালো মানে?
গত অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স দেড় হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ভাবতে পারো, এটা কত বড় অর্জন?
চাচা! এটা অবশ্যই অর্থনীতির জন্য একটা বিরাট সুখবর। কিন্তু এর পাশাপাশি বাংলাদেশীদের কত হাজার কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে পাচার করা হয়েছে, সেই খবরটি এ ধরনের অর্জনকে ম্লান করে দেয়। সেজন্যই আমি বলছিলাম, অর্থনীতিতে আমাদের অবস্থা ‘কভি খুশি, কভি গম’।
তোমার মতো নেতিবাচক চিন্তা আমার নেই। চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করবেন। অর্থনীতির ফাঁক-ফোকরগুলো নিশ্চয়ই তিনি সামলে নেবেন। তার ওপর আস্থা আছে আমার।
আস্থা আমারও আছে। সেদিন তিনি সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী ও চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের আরও সোচ্চার হতে বলেছেন। আমি মনে করি, একই সঙ্গে অর্থ লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বললে ভালো হতো।
সেটা কী সম্ভব?
কেন সম্ভব নয়?
সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী চোরাকারবারিরা সরকারের বাইরে থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অপকর্ম করে। কিন্তু যাদের তুমি অর্থ লুটপাটকারী বলছো, তারা কাজ করে সরকারের ভেতরে বসে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে আইন অনুযায়ী হতে হবে।
সব বিষয়েই আইন অনুযায়ী চলতে হবে। আমি জানালাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, আইন অমান্যকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে, তা সে যে দলেরই হোক।
প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন।
তাহলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ব্যবস্থা নিতে পারছেন না কেন? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের সঙ্গে তার বক্তব্য খাপ খায় না। দু’জনের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী।
চাচা সহসা কথার মোড় পরিবর্তন করে বললেন, রাজনৈতিক বাস্তবতা বলে একটা কথা আছে।
সেটাই বলুন। রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে নৈতিক বাস্তবতা মার খেয়ে যাচ্ছে।
আমার কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে ওঠায় চাচা তার কণ্ঠস্বর নামিয়ে আনলেন। শান্তকণ্ঠে বললেন, তোমার উদ্বেগ কিছুটা বুঝতে পারছি। তবে চিন্তা করো না। খুব শিগগিরই আর্থিক খাতের সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আর্থিক খাত তো একটা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু আর্থিক খাত ধরে অগ্রসর হলে হবে না। দেশে সামগ্রিকভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
ঠিক আছে। তোমার কথাই মেনে নিলাম। চাচা বললেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী করতে হবে?
দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বেশ। তারপর? রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি অবাধ নিরপেক্ষ সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার।
সর্বজনগ্রহণযোগ্য বলে কোন কথা নেই। অধিকাংশ লোক যা মেনে নেয়, তাই-ই সর্বজনগ্রহণযোগ্য। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন সবাই মেনে না নিলেও অধিকাংশ মানুষ তা মেনে নিয়েছে। দু’একটি দেশ ছাড়া বিদেশীরাও আর কোন কথা বলছে না।
আপনার তথ্য ঠিক নয়।
তোমার তথ্যটা কি?
চাচা: ক’দিন আগে জাতিসংঘ এক চিঠি দিয়ে ‘নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’ বন্ধ করে দিয়েছে।
ভারি অন্যায়! জাতিসংঘের এটা করা উচিত হয়নি। কি কারণে তারা এটা করলো?
তারা কোন কারণ দর্শায়নি। তবে যেসব দেশ এই প্রকল্পের অর্থ যোগানদাতা ছিল, তারা হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তারা অর্থ দিতে আর আগ্রহী নয়।
চাচা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, এসব দেশ কি চায় না বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী হোক?
তারা মুখ না খুললেও বোঝা যায়, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তারা খুব হতাশ। এ জন্যই তারা প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
যাকগে। আমরা এখন আর বিদেশীদের দিকে তাকিয়ে নেই। আমরা এখন আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছি। দেখলে না নিজেদের অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতু পর্যন্ত তৈরি করতে পারছি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাবো আমরা। তারপর উচ্চ আয়ের দেশ।
এসব কথা শুনতে বেশ ভালো লাগে। আমিও আশাবাদী হতে চাই। আমি বললাম, কিন্তু আমাদের অবস্থা সেই হিন্দি গানের মতো: ‘কভি খুশি কভি গম’।
No comments