বাংলাদেশ এখন সত্যিই বাঘ by উৎপল শুভ্র
আউট হয়ে গেলেন জাদেজা, তাসকিনের পর বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডে অভিষেকেই পাঁচ উইকেট নেওয়ার দ্বিতীয় কীর্তি গড়া হয়ে গেল মুস্তাফিজুরের। বাংলাদেশের তরুণ পেসার তাই সতীর্থদের উদ্যাপনের মধ্যমণি l শামসুল হক |
শূন্যে
লাফিয়ে বুকে বুক লাগিয়ে উদ্যাপন! মাশরাফি বিন মুর্তজা ও তাসকিন আহমেদের
সৌজন্যে যেটি বিখ্যাত হয়ে গেছে ক্রিকেট বিশ্বেই। বাংলাদেশের মানুষের মনে যা
বিশ্বকাপের অমর ছবিও। মাশরাফি-তাসকিন মনে হচ্ছে পুনরাবৃত্তিতে বিশ্বাসী
নন। কাল মিরপুরে ভারত-বধ কাব্য লেখার পর দুজন তাই ভিন্ন কিছু করার
সিদ্ধান্ত নিলেন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কোমর দুলিয়ে নাচ!
গ্যালারিও তখন নাচছে। পুরো বাংলাদেশও কি নয়! যেনতেন জয় হলেও বাতাসে উড়ে বেড়াত আনন্দের রেণু। আর এখানে বাংলাদেশ কি না জিতল ৭৯ রানের বিশাল ব্যবধানে! এমনই দাপুটে জয় যে, আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির অনেক আগেই আসলে ম্যাচের ফল জানা হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ‘টাইগার’ নাম নিয়ে একটা সময় বিস্তর টীকাটিপ্পনী শুনতে হতো। নামে বাঘ, আসলে বিড়াল—এমন অপমানজনক কথাও। অবশেষে কি সেসব ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এল! নামে বাঘ, মাঠের বাংলাদেশও তো এখন বাঘের মতোই ক্ষিপ্রতা আর শক্তির প্রতিচ্ছবি।
মেলবোর্ন ফিরে ফিরে আসছিল। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে বিতর্কিত আম্পায়ারিংয়ের কারণে বাংলাদেশের মানুষের মনে দগদগে এক ক্ষত হয়ে আছে ওই ম্যাচ। এরপর দুই দলের এটাই প্রথম দেখা। প্রথম সুযোগেই সেই ক্ষতে প্রলেপ বোলানোর কাজটা করে ফেললেন মাশরাফিরা। যেটির মাহাত্ম্য শুধুই একটি জয়ে আটকে নেই। সিরিজে এখন যা-ই হোক না কেন, ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে সাত নম্বরে উঠে গেছে বাংলাদেশ। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি অলীক কল্পনা থেকে এখন ঘোরতর বাস্তবের সীমানায়।
এমন দাপুটে জয়টাকে যদি চমক বলেন, সবচেয়ে বড় চমকটা ম্যাচ শুরুর আগেই। এত দিন দেশের মাটিতে বাংলাদেশের ওয়ানডে সাফল্যের রেসিপি ছিল একটাই—স্পিনের ঘূর্ণিজালে প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে ফেলা। সেখান থেকে সরে এসে বাংলাদেশ দলে কিনা চার পেসার!
নতুন কিছু করলে তা নিয়ে সংশয়মিশ্রিত প্রশ্ন থাকবেই। সেটি আরও বড় হয়ে উঠল বাংলাদেশের ইনিংস শেষে। ভারতের তিন পেসারের কাউকে দিয়েই ১০ ওভার করাননি ধোনি। তিনজন মিলে মোট ১৯.৪ ওভার। অনিয়মিত স্পিনার সুরেশ রায়না যেখানে টানা ১০ ওভারে ৪০ রান দিয়ে সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলার। বাংলাদেশ কি তাহলে ভুলই করল? মাশরাফি-রুবেল-তাসকিন ঠিক আছে, আনকোরা মুস্তাফিজুরকেও নামিয়ে দেওয়াটা কি দুঃসাহসী জুয়া খেলাই হয়ে গেল না?
এই প্রশ্নের উত্তর কী দুর্দান্তভাবেই না দিলেন লিকলিকে এই তরুণ! বাংলাদেশের ক্রিকেটে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব বললে মাশরাফি বিন মুর্তজার কথাই মনে পড়ে। মুস্তাফিজুরের গল্পও তো এর চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। বছর দুয়েক আগে সাতক্ষীরা থেকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে পেস বোলিং ট্রায়াল দিতে এসে প্রথম দৃশ্যপটে। সেখান থেকে দ্রুতই অনূর্ধ্ব-১৯ ও ‘এ’ দলে। গত এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অভিষেক। তখন কজনই বা তাঁকে চিনত! চিনিয়ে দিলেন প্রথম ম্যাচেই। ২০ রানে ২ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে প্রথম উইকেট শহীদ আফ্রিদি। ওয়ানডেতে প্রথম উইকেটটিও কম বড় নাম নয়। ওয়ানডেতে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির একমাত্র মালিক ও বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে পোড়ানো রোহিত শর্মা।
বাঁহাতি পেসারদের সহজাত কোনাকুনি বলটা এমন দারুণ জায়গায় ফেলেন যে, ডানহাতি ব্যাটসম্যানরা তাতে হাবুডুবু খেতে বাধ্য। এর সঙ্গে আততায়ী এক কাটার, কালকের ম্যাচের পর যে কাটার এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথার অংশ। ৫টি উইকেটই কাটারে। এর মধ্যে পরপর দুই বলে রায়না ও অশ্বিনকে আউট করে সম্ভাবনা জাগালেন হ্যাটট্রিকেরও। এক বছর এক দিন আগে এই মিরপুরে এই ভারতের বিপক্ষেই অভিষেকে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তাসকিন আহমেদ। তাসকিনের সেই আনন্দ পূর্ণতা পায়নি দল হেরে গিয়েছিল বলে। কাল মুস্তাফিজুরের সেই দুঃখও থাকল না। অভিষেকে ৫ উইকেট, দলের জয় এবং তাঁর হাতে ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফি। স্বপ্নের দিন বোধ হয় এমনই হয়!
বাংলাদেশ দলকে যদি বাঘের সঙ্গে মেলান, মুস্তাফিজুরকে তো মেলানো যায় আরও বেশি। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন তো তাঁর বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। মুস্তাফিজুরকে নামিয়ে দিয়ে তাঁর হাতে নতুন বল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা মাশরাফির বলেই ধরে নেওয়া যায়। সে জন্য তাঁর করতালি প্রাপ্য। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশের প্রথম ওভারটি করেছেন। সিদ্ধান্তটা তাই সহজ ছিল না।
মেলবোর্নের সঙ্গে মেলানো হচ্ছে মিরপুরকে। হবেই। দশ বছর আগে-পরের ১৮ জুনে দারুণ আরেকটি মিলও কিন্তু আছে। ২০০৫ সালের এই দিনেই কার্ডিফে লেখা হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের অমর এক কাব্য। সে সময়ের অজেয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে জয় ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনগুলোর মধ্যে থাকে। পার্থক্য বলতে কালকের জয়কে অঘটন বলার উপায় নেই। নামে বড় দলগুলোর বিপক্ষে জয়টাকে বাংলাদেশ এমনই নিয়মিত বানিয়ে ফেলেছে যে, এখন ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ কখনো কখনো অঘটনের শিকার হয়, নিজেদের জয় আর অঘটন বলে বিবেচিত হয় না।
ম্যাচের আগের দিন দুই অধিনায়কই মেলবোর্নকে ভুলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। মনে মনে বোধ হয় ঠিকই ছিল ওই স্মৃতি। নইলে মাঠে এমন বারুদ ছুটবে কেন! আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমশ ঝাঁজালো হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে ধোনি বলেছিলেন, সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো, মাঠে কখনো অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। ধোনিই কিনা সেই ‘অপ্রীতিকর কিছু’ ঘটালেন! বোলিং করে মুস্তাফিজুর রহমান এর আগেও একবার ব্যাটসম্যানের দৌড়ের পথে চলে গিয়েছিলেন। আবারও তা করায় ধোনি কনুই দিয়ে এমনই প্রবল এক ধাক্কা দিলেন যে, শরীরে-স্বাস্থ্যে–শক্তিতে ধোনির অর্ধেক মুস্তাফিজুরকে ওভার অসমাপ্ত রেখেই বেরিয়ে যেতে হলো মাঠ ছেড়ে।
ফিরে এসে তিন উইকেট নিয়ে জবাবটা ভালোমতোই দিয়েছেন। আবির্ভাবেই এমন উজ্জ্বল যে, দুটি করে উইকেট নিয়ে তাসকিন ও সাকিব সংগতকারীর বেশি কিছু নন।
বাংলাদেশের ইনিংসে অবশ্য নির্দিষ্ট কাউকে এমন নায়কের আসনে বসানো যাচ্ছে না। অনেকগুলো নাম সেখানে প্রায় সমান জ্বলজ্বলে—তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, সাকিব আল হাসান...। ভারতের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো তিন শ পেরোনোয় অবদান আছে সাব্বির, নাসির ও মাশরাফিরও। তামিম ও সৌম্যর উদ্বোধনী জুটিটিই বেঁধে দিয়েছিল ম্যাচের সুর। তামিমের ব্যাটে রুদ্ররূপের সঙ্গে ক্রিকেট বিশ্বের ভালোই পরিচয় আছে। সৌম্যও নিজেকে ভালোভাবেই চেনাচ্ছেন। নামের সঙ্গে ব্যাটিংয়ের কোনো মিল নেই। ‘সৌম্য’র বদলে নামটা ‘রুদ্র’ হলেই বরং ভালো মানাত!
দুজন পাল্লা দিয়ে শট খেলে মাত্র ৭৯ বলে স্কোরবোর্ডে এক শ তুলে দিলেন। বড় আট দলের বিপক্ষে যা বাংলাদেশের দ্রুততম এক শ। বৃষ্টির কারণে এক ঘণ্টা খেলা বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশের ইনিংস যখন আবার শুরু হলো, নিজের চার ওভারে তিন উইকেট তুলে নিয়ে ইনিংসটাকে বেপথু করে দিয়েছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। সাকিব ও সাব্বিরের ৮৩ রানের জুটিতে যেটি আবার কক্ষপথে ফিরল।
৩০৭ রান করার পরও শঙ্কা ছিল। ওয়ানডেতে এটা এখন আর মোটেই অনতিক্রম্য কোনো স্কোর নয়। তার ওপর ভারতের ওই প্রমত্ত ব্যাটিং লাইনআপ। কে জানত, সেটিকেই এমন তাসের ঘর বানিয়ে দেবেন ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ।
মুস্তাফিজুর রহমান!
গ্যালারিও তখন নাচছে। পুরো বাংলাদেশও কি নয়! যেনতেন জয় হলেও বাতাসে উড়ে বেড়াত আনন্দের রেণু। আর এখানে বাংলাদেশ কি না জিতল ৭৯ রানের বিশাল ব্যবধানে! এমনই দাপুটে জয় যে, আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির অনেক আগেই আসলে ম্যাচের ফল জানা হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ‘টাইগার’ নাম নিয়ে একটা সময় বিস্তর টীকাটিপ্পনী শুনতে হতো। নামে বাঘ, আসলে বিড়াল—এমন অপমানজনক কথাও। অবশেষে কি সেসব ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এল! নামে বাঘ, মাঠের বাংলাদেশও তো এখন বাঘের মতোই ক্ষিপ্রতা আর শক্তির প্রতিচ্ছবি।
মেলবোর্ন ফিরে ফিরে আসছিল। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে বিতর্কিত আম্পায়ারিংয়ের কারণে বাংলাদেশের মানুষের মনে দগদগে এক ক্ষত হয়ে আছে ওই ম্যাচ। এরপর দুই দলের এটাই প্রথম দেখা। প্রথম সুযোগেই সেই ক্ষতে প্রলেপ বোলানোর কাজটা করে ফেললেন মাশরাফিরা। যেটির মাহাত্ম্য শুধুই একটি জয়ে আটকে নেই। সিরিজে এখন যা-ই হোক না কেন, ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে সাত নম্বরে উঠে গেছে বাংলাদেশ। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি অলীক কল্পনা থেকে এখন ঘোরতর বাস্তবের সীমানায়।
এমন দাপুটে জয়টাকে যদি চমক বলেন, সবচেয়ে বড় চমকটা ম্যাচ শুরুর আগেই। এত দিন দেশের মাটিতে বাংলাদেশের ওয়ানডে সাফল্যের রেসিপি ছিল একটাই—স্পিনের ঘূর্ণিজালে প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে ফেলা। সেখান থেকে সরে এসে বাংলাদেশ দলে কিনা চার পেসার!
নতুন কিছু করলে তা নিয়ে সংশয়মিশ্রিত প্রশ্ন থাকবেই। সেটি আরও বড় হয়ে উঠল বাংলাদেশের ইনিংস শেষে। ভারতের তিন পেসারের কাউকে দিয়েই ১০ ওভার করাননি ধোনি। তিনজন মিলে মোট ১৯.৪ ওভার। অনিয়মিত স্পিনার সুরেশ রায়না যেখানে টানা ১০ ওভারে ৪০ রান দিয়ে সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলার। বাংলাদেশ কি তাহলে ভুলই করল? মাশরাফি-রুবেল-তাসকিন ঠিক আছে, আনকোরা মুস্তাফিজুরকেও নামিয়ে দেওয়াটা কি দুঃসাহসী জুয়া খেলাই হয়ে গেল না?
এই প্রশ্নের উত্তর কী দুর্দান্তভাবেই না দিলেন লিকলিকে এই তরুণ! বাংলাদেশের ক্রিকেটে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব বললে মাশরাফি বিন মুর্তজার কথাই মনে পড়ে। মুস্তাফিজুরের গল্পও তো এর চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। বছর দুয়েক আগে সাতক্ষীরা থেকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে পেস বোলিং ট্রায়াল দিতে এসে প্রথম দৃশ্যপটে। সেখান থেকে দ্রুতই অনূর্ধ্ব-১৯ ও ‘এ’ দলে। গত এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অভিষেক। তখন কজনই বা তাঁকে চিনত! চিনিয়ে দিলেন প্রথম ম্যাচেই। ২০ রানে ২ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে প্রথম উইকেট শহীদ আফ্রিদি। ওয়ানডেতে প্রথম উইকেটটিও কম বড় নাম নয়। ওয়ানডেতে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির একমাত্র মালিক ও বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে পোড়ানো রোহিত শর্মা।
বাঁহাতি পেসারদের সহজাত কোনাকুনি বলটা এমন দারুণ জায়গায় ফেলেন যে, ডানহাতি ব্যাটসম্যানরা তাতে হাবুডুবু খেতে বাধ্য। এর সঙ্গে আততায়ী এক কাটার, কালকের ম্যাচের পর যে কাটার এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথার অংশ। ৫টি উইকেটই কাটারে। এর মধ্যে পরপর দুই বলে রায়না ও অশ্বিনকে আউট করে সম্ভাবনা জাগালেন হ্যাটট্রিকেরও। এক বছর এক দিন আগে এই মিরপুরে এই ভারতের বিপক্ষেই অভিষেকে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তাসকিন আহমেদ। তাসকিনের সেই আনন্দ পূর্ণতা পায়নি দল হেরে গিয়েছিল বলে। কাল মুস্তাফিজুরের সেই দুঃখও থাকল না। অভিষেকে ৫ উইকেট, দলের জয় এবং তাঁর হাতে ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফি। স্বপ্নের দিন বোধ হয় এমনই হয়!
বাংলাদেশ দলকে যদি বাঘের সঙ্গে মেলান, মুস্তাফিজুরকে তো মেলানো যায় আরও বেশি। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন তো তাঁর বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। মুস্তাফিজুরকে নামিয়ে দিয়ে তাঁর হাতে নতুন বল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা মাশরাফির বলেই ধরে নেওয়া যায়। সে জন্য তাঁর করতালি প্রাপ্য। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশের প্রথম ওভারটি করেছেন। সিদ্ধান্তটা তাই সহজ ছিল না।
মেলবোর্নের সঙ্গে মেলানো হচ্ছে মিরপুরকে। হবেই। দশ বছর আগে-পরের ১৮ জুনে দারুণ আরেকটি মিলও কিন্তু আছে। ২০০৫ সালের এই দিনেই কার্ডিফে লেখা হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের অমর এক কাব্য। সে সময়ের অজেয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে জয় ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনগুলোর মধ্যে থাকে। পার্থক্য বলতে কালকের জয়কে অঘটন বলার উপায় নেই। নামে বড় দলগুলোর বিপক্ষে জয়টাকে বাংলাদেশ এমনই নিয়মিত বানিয়ে ফেলেছে যে, এখন ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ কখনো কখনো অঘটনের শিকার হয়, নিজেদের জয় আর অঘটন বলে বিবেচিত হয় না।
ম্যাচের আগের দিন দুই অধিনায়কই মেলবোর্নকে ভুলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। মনে মনে বোধ হয় ঠিকই ছিল ওই স্মৃতি। নইলে মাঠে এমন বারুদ ছুটবে কেন! আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমশ ঝাঁজালো হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে ধোনি বলেছিলেন, সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো, মাঠে কখনো অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। ধোনিই কিনা সেই ‘অপ্রীতিকর কিছু’ ঘটালেন! বোলিং করে মুস্তাফিজুর রহমান এর আগেও একবার ব্যাটসম্যানের দৌড়ের পথে চলে গিয়েছিলেন। আবারও তা করায় ধোনি কনুই দিয়ে এমনই প্রবল এক ধাক্কা দিলেন যে, শরীরে-স্বাস্থ্যে–শক্তিতে ধোনির অর্ধেক মুস্তাফিজুরকে ওভার অসমাপ্ত রেখেই বেরিয়ে যেতে হলো মাঠ ছেড়ে।
ফিরে এসে তিন উইকেট নিয়ে জবাবটা ভালোমতোই দিয়েছেন। আবির্ভাবেই এমন উজ্জ্বল যে, দুটি করে উইকেট নিয়ে তাসকিন ও সাকিব সংগতকারীর বেশি কিছু নন।
বাংলাদেশের ইনিংসে অবশ্য নির্দিষ্ট কাউকে এমন নায়কের আসনে বসানো যাচ্ছে না। অনেকগুলো নাম সেখানে প্রায় সমান জ্বলজ্বলে—তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, সাকিব আল হাসান...। ভারতের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো তিন শ পেরোনোয় অবদান আছে সাব্বির, নাসির ও মাশরাফিরও। তামিম ও সৌম্যর উদ্বোধনী জুটিটিই বেঁধে দিয়েছিল ম্যাচের সুর। তামিমের ব্যাটে রুদ্ররূপের সঙ্গে ক্রিকেট বিশ্বের ভালোই পরিচয় আছে। সৌম্যও নিজেকে ভালোভাবেই চেনাচ্ছেন। নামের সঙ্গে ব্যাটিংয়ের কোনো মিল নেই। ‘সৌম্য’র বদলে নামটা ‘রুদ্র’ হলেই বরং ভালো মানাত!
দুজন পাল্লা দিয়ে শট খেলে মাত্র ৭৯ বলে স্কোরবোর্ডে এক শ তুলে দিলেন। বড় আট দলের বিপক্ষে যা বাংলাদেশের দ্রুততম এক শ। বৃষ্টির কারণে এক ঘণ্টা খেলা বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশের ইনিংস যখন আবার শুরু হলো, নিজের চার ওভারে তিন উইকেট তুলে নিয়ে ইনিংসটাকে বেপথু করে দিয়েছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। সাকিব ও সাব্বিরের ৮৩ রানের জুটিতে যেটি আবার কক্ষপথে ফিরল।
৩০৭ রান করার পরও শঙ্কা ছিল। ওয়ানডেতে এটা এখন আর মোটেই অনতিক্রম্য কোনো স্কোর নয়। তার ওপর ভারতের ওই প্রমত্ত ব্যাটিং লাইনআপ। কে জানত, সেটিকেই এমন তাসের ঘর বানিয়ে দেবেন ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ।
মুস্তাফিজুর রহমান!
No comments