প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ হওয়া অবাস্তব নয় -বিশেষ সাক্ষাৎকারে: বিনায়ক সেন by ফখরুল ইসলাম
প্রস্তাবিত
বাজেট, দেশের অর্থনীতি, ব্যাংক খাত, দুর্নীতি, সুশাসন, রাজস্ব সংগ্রহসহ ৭
শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা
পরিচালক বিনায়ক সেন।
দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সমতামুখী প্রবৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করছেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের এই সাবেক জ্যেষ্ঠ
অর্থনীতিবিদের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জার্নাল ও বইপত্রে ৫০টিরও বেশি
গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে: সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম
প্রথম আলো : প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো?
বিনায়ক সেন : বাজেট নিয়ে আশির দশকে, এমনকি ষাটের দশকেও সমালোচনা থাকত। এখন তা ছিদ্রান্বেষী নিন্দা ও লাগামছাড়া স্তাবকতা—এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, যেখানে যতটুকু ভালো হয়েছে, তা বলা উচিত। আর মন্দ হলে মন্দ বলতে হবে। একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, শক্তিশালী দিককেও দুর্বলতম বলা হচ্ছে। এই প্রবণতা আমার কাছে পরিহার্য। যেমন ধরুন, আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ধরাটা খুবই বাস্তবোচিত হয়েছে। প্রথমত, প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে একটি স্বাভাবিক বছর পেলে ৭ শতাংশ অর্জন করা অবাস্তব নয়। দ্বিতীয়ত, ঘাটতি বাজেট ১৫ বছর ধরেই ৪-৫ শতাংশের মধ্যে থাকছে। তৃতীয়ত, মূল্যস্ফীতিও ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে আশা করা যায় দেশে ভালো ফলন ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার কারণে।
প্রথম আলো : তিনটি কারণকে বিবেচনায় নিয়েই আপনার এত বড় আশাবাদ? সার্বিকভাবে দেশের মৌলিক বাজেট–শৃঙ্খলা কি ঠিক আছে?
বিনায়ক সেন : আমি বলব সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেট–শৃঙ্খলা একরকম ঠিকই আছে। এখন যদি দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারল না, তখন ব্যয়ের কাঠামো কাটছাঁট করতে হবে। আর এই কাটছাঁটের পরও যদি বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে, প্রবৃদ্ধির হার যদি ৭ শতাংশ অর্জন করা যায়, মূল্যস্ফীতি যদি ৬ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকে, তাহলে আমি এটাকে সময়োচিত ও বাস্তবোচিত বাজেটই বলব। এটা বলার পরই আমি মূল কথাটি বলতে চাইছি।
প্রথম আলো : সেটা কী?
বিনায়ক সেন : মূল কথাটা হচ্ছে আমরা এখনো আলোচনাটা সাধারণ মানের প্রবৃদ্ধির মধ্যেই আটকে রাখছি। সমতামুখী প্রবৃদ্ধি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলছি না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির তিনটি মাত্রা রয়েছে। একটা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা। প্রবৃদ্ধিকে ওঠা–নামা থেকে রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধিকে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে, অর্থাৎ এতে সমাজের সবার ও দেশের সব অঞ্চলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে আয়বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ যত দিন যাচ্ছে, তত আমরা অধিক বৈষম্যমূলক সমাজ থেকে অপেক্ষাকৃত কম বৈষম্যমূলক সমাজে পরিণত হতে পারছি কি না। ২০১০ সালের আয়-ব্যয় জরিপ বলছে, আয়বৈষম্যের সূচক বেশ উঁচু পর্যায়ে চলে গেছে।
প্রথম আলো : সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমরা কতটুকু কী করতে পারছি?
বিনায়ক সেন : প্রথমটি মোটামুটি অর্জিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা অর্জনে ধারাবাহিকতা রয়েছে আমাদের। অনেকেই একে ৬ শতাংশের ফাঁদ বলছেন, কিন্তু আমি ‘ফাঁদ’ বলতে রাজি নই। একনাগাড়ে প্রায় এক দশক ধরে ৬ শতাংশ হার অর্জনের দেশ খুব বেশি নেই। এক দশকে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সংকটও তৈরি হয়েছে। সবকিছুর পরও স্থায়িত্বশীলতার নিক্তিতে আমাদের অর্জন বেশ ভালোই বলা যায়।
প্রথম আলো : বাকি দুটির অবস্থা তাহলে ভালো নয়?
বিনায়ক সেন : না, সেটা না। যেমন অংশগ্রহণমূলক দিক থেকে আমি বলব আংশিক সাফল্য এসেছে। দুই দশক আগেও শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ১৫ শতাংশ। এখন ৩৩-৩৪ শতাংশ। এটা ৬০ শতাংশে উন্নীত করা গেলে প্রবৃদ্ধি যেমন ত্বরান্বিত হবে, আয়ও বাড়বে। আবার যুবশক্তির মধ্যে পোশাক ও কৃষি খাতের অদক্ষ-আধা দক্ষ শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান যথেষ্ট। কিন্তু স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণ থেকে সাফল্য পাইনি। কারণ, আমাদের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার সব কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে চালিত। এবারের বাজেট বক্তব্যে অবশ্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে বণ্টনবৈষম্য দূর করার ইঙ্গিত রয়েছে। স্থানীয় সরকারের অর্থায়নে একটা আলাদা কৌশলপত্র হওয়ার কথা। সেটা যদি সত্যি হয়, এবার থেকেই যেন বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের জন্য রাখা হয়। ভারতের কেরালায় যা আছে এক-তৃতীয়াংশ।
প্রথম আলো : সে হিসাবে বাজেটের মোট আকার থেকে স্থানীয় সরকারের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিচ্ছেন?
বিনায়ক সেন : হ্যাঁ। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের জন্য থাকতে পারে। বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা থাকতে পারে নগরাঞ্চলের জন্য। এতে লাভ যেটা হবে, প্রতিবছর বাজেট বাস্তবায়ন করতে না পারার যে সমালোচনা আছে, সেটা দূর হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) যতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে না, ততটুকু বরাদ্দ দিলেও একটা কাজ হবে। আর তাতে দরিদ্র অঞ্চল, বিশেষ করে হাওর, লবণাক্তপ্রবণ, বন ও পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষও সমানভাবে উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে।
প্রথম আলো : বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি নিয়ে কিছু বললেন না?
বিনায়ক সেন : বাজেট বক্তব্যে এটি প্রায় অনুপস্থিত। দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্যের তুলনায় বেশি হারে বাড়ছে সম্পদবৈষম্য। সম্পদবৈষম্যকে যদি আঘাত করতে হয়, তাহলে সম্পদের ওপর আয়কর সারচার্জ সংগ্রহের বিদ্যমান দুর্বলতা দূর করতে হবে। বড় দুর্বলতা হলো সম্পদের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না। ভিত্তি ধরা হচ্ছে সম্পদ ক্রয়মূল্যকে, ন্যায্য বাজারমূল্যকে নয়। ফলে মাত্র ১০ হাজার লোক এই আয়কর সারচার্জ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পদের মালিক মাত্র ১০ হাজার লোক—এটা অবিশ্বাস্য।
প্রথম আলো : সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন থেকে সরকার কীভাবে লাভবান হতে পারে?
বিনায়ক সেন : এতে রাজস্ব আয় বাড়বে, যা বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি কয়েক বছরে দেশে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। বিশেষ করে নগরাঞ্চলে। তাঁদের কাছ থেকে আয়কর সারচার্জ এবং/অথবা প্রত্যক্ষ সম্পদ-করের মাধ্যমে (যা এখনো বাজেটে নেই) অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা বেশি আয় করা সম্ভব। তবে দুই বছর ধরেই একটি ভালো দিক লক্ষ করছি। এখন প্রত্যক্ষ বা আয়করকে রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগ সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনেরই উদ্যোগ। পোশাকশিল্পসহ প্রতিষ্ঠিত রপ্তানি খাতগুলো থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর ১ শতাংশ হারে কর বসানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা প্রবৃদ্ধিকে সমতামুখী করবে। আর শিশু-শিল্প হলে কর-রেয়াত দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যারা ভালো প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, তাদের থেকে কিছুটা আয়কর আদায় করা জরুরি।
প্রথম আলো : কিন্তু মানুষের প্রথম চাওয়া হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন ও যানজট নিরসন। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
বিনায়ক সেন : প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে—আমাদের এখন সে ধরনের অবকাঠামো দরকার। আবার প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটাও বড় কথা। মানুষ নগরমুখী হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তা মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ হয়ে যাবে। তাদের সমস্যার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। আগে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ছিল কৃষি অর্থনীতি ও রপ্তানি, এখন প্রবৃদ্ধির সঙ্গে হবে নগর অর্থনীতি ও রপ্তানি। ফলে নগরে ও নগরবাসীর জন্য এখন বেশি হারে বিনিয়োগ করতে হবে। যানজট নগরবাসীর কর্মজীবনের বড় একটা সময় খেয়ে ফেলছে। বাজেটে যানজট নিরসনে বা নগর অর্থনীতি উন্নয়নে তেমন কোনো কৌশলগত নির্দেশনা নেই। ঢাকার বাইরে শহরগুলোর অবকাঠামোগত পরিবেশ আরও খারাপ, অথচ শহরেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি করে জড়ো হচ্ছে। আর অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) পদ্ধতির একটা উদ্যোগ সরকার নিলেও এর কোনো ফল দেখা যায়নি। পিপিপিতে ৪৩টি প্রকল্প নিয়ে অর্থমন্ত্রী আর জানালেন না কোনটির কী হাল? বিদ্যুৎ যেমন জাতীয় তাগিদ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, অবকাঠামো খাতেরও একই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
প্রথম আলো : তাহলেই কি সমতামুখী প্রবৃদ্ধি আসবে?
বিনায়ক সেন : না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির জন্য আরও দরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভালো বরাদ্দ। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্রয়োজনের ধারে-কাছেই তিনি যেতে পারেননি। স্বাস্থ্য খাতেরও একই অবস্থা। এ দুই খাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতায় বিস্মিত না হয়ে পারি না। পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা মাসে ৩০০ টাকা প্রিমিয়াম দিতে রাজি থাকলেও তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা পলিসি চালু করা যায়নি।
শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিও রয়েছে। যেমন মাদ্রাসাশিক্ষা থেকে সবচেয়ে কম ফল (রিটার্ন) পাওয়া যায়। অথচ মাদ্রাসাশিক্ষা-ব্যবস্থায় যদি কারিগরি শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যায়, ভালো ফল পাওয়া যাবে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় আমাদের বুয়েট ভালো, ঢাকা মেডিকেল কলেজও (ডিএমসি) ভালো। দরকার ছিল বুয়েটের মতো আরও পাঁচটা ‘বুয়েট’ করা, ডিএমসির মতো পাঁচটা ‘ডিএমসি’ করা। ভারতে যেমন করে প্রথম সারির বেশ কিছু আইআইএম, আইআইটি ও মেডিকেল কলেজ আছে। সেদিকে আমরা গুরুত্বই দিচ্ছি না। মোটের ওপর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আগামী ১০ বছরে প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রিকার্ডো হাউসম্যান সম্প্রতি হিসাব করে বলেছেন, শ্রমশক্তির মান গড়ে তিন বছর স্কুলশিক্ষা থেকে আট বছর স্কুলশিক্ষার মানে উত্তীর্ণ করতে পারলে জিডিপির আকার শুধু এ কারণেই দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
প্রথম আলো : আমাদের আর্থিক খাত কি ঠিকভাবে চলছে? দুর্নীতি কী করে কমবে, সুশাসনের কী হলো?
বিনায়ক সেন : খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কর-রেয়াত এবং ব্যাংকঋণ—এ দুই বিকল্পের ক্ষেত্রে একজন শিল্পপতি যদি দেখেন ব্যাংকঋণ ফেরত দিতে হচ্ছে না, তখন কর-প্রণোদনা কাজ করবে না। কর-প্রণোদনার নীতি আর্থিক-প্রণোদনার নীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আর্থিক খাতে এখনো শৃঙ্খলার অভাব। উচ্চ খেলাপি ঋণের হার থেকে আমরা বের হতে পারছি না। উচিত হবে সোনালী ব্যাংককে হাতে রেখে বাকিগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া। কেননা, সরকারি খাতেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ বেশি। অন্যদিকে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, বেসরকারীকরণের পর তা যেন গুটি কয়েক মুখচেনা শিল্প-ব্যাংক পরিবারের কাছে চলে না যায়।
দুর্নীতি হ্রাস বা সুশাসন চালু সরকার চাইলে অনেকখানিই পারবে। বলছি না যে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু খাতভিত্তিক সুশাসন তো আমরা চাইতেই পারি; অন্তত কয়েকটি খাতে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে যারা টাকা কামাচ্ছে, তাদেরও ধরা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর যৌথভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) যাবতীয় তথ্য মিলিয়ে নজরদারি করলে অবৈধ উপায়ে টাকা কামানো, কর ফাঁকি দেওয়া ও খেলাপি হওয়া—এসব রোধ করা অনেকখানিই সম্ভব।
প্রথম আলো : করদাতার সংখ্যা সরকার তেমন বাড়াতে পারছে না। কোনো পরামর্শ?
বিনায়ক সেন : ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। আরও চার কোটি মানুষ আছে দারিদ্র্যঝুঁকিতে। বাকি থাকল আট কোটি মানুষ, তথা ১ কোটি ৬০ লাখ পরিবার (পরিবারপ্রতি পাঁচজন হিসাবে)। পরিবারে যদি একজন আয় করেন, তাহলেও আয়করের আওতায় আসতে পারেন ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যক্তি। এর মধ্যে শহরবাসী ৫০ লাখ। অথচ বর্তমানে আয়কর দেন কেবল ১০ লাখ লোক। শুধু নগরমুখী করেও প্রায় পাঁচ গুণ আয়করদাতা বাড়ানো সম্ভব। তাই বলব যে উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস সম্প্রসারিত না করে শহর পর্যায়ে এর কার্যক্রম আরও জোরদার করা হোক।
প্রথম আলো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কীভাবে দেখছেন?
বিনায়ক সেন : নদী আমাদের প্রাণ, ট্রানজিট তাঁদের প্রাণ। কৌশলগত স্বার্থের দিক থেকে আমরা তাঁদের পানির বিনিময়ে ট্রানজিট দিতে পারি।
প্রথম আলো : আপনাকে বাজেট প্রণয়নের দায়িত্ব দিলে কোন খাতে অগ্রাধিকার দিতেন?
বিনায়ক সেন : অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। অবশ্যই সামষ্টিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে। অবকাঠামো উন্নয়নের গুরুত্বের কথা যদি বলি, দেখুন, এক যমুনা সেতুর কারণে আশির দশকের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ থেকে আমরা ২০০০ সালের পর ৫-এর ওপরে উঠেছি। পদ্মা সেতু ও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন হলে নিশ্চয়ই ৭-এর ওপরে ওঠা সহজ হবে। আর নীল (সমুদ্র) অর্থনীতি চাঙা করতে পারলে তো কথাই নেই।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন : ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো?
বিনায়ক সেন : বাজেট নিয়ে আশির দশকে, এমনকি ষাটের দশকেও সমালোচনা থাকত। এখন তা ছিদ্রান্বেষী নিন্দা ও লাগামছাড়া স্তাবকতা—এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, যেখানে যতটুকু ভালো হয়েছে, তা বলা উচিত। আর মন্দ হলে মন্দ বলতে হবে। একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, শক্তিশালী দিককেও দুর্বলতম বলা হচ্ছে। এই প্রবণতা আমার কাছে পরিহার্য। যেমন ধরুন, আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ধরাটা খুবই বাস্তবোচিত হয়েছে। প্রথমত, প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে একটি স্বাভাবিক বছর পেলে ৭ শতাংশ অর্জন করা অবাস্তব নয়। দ্বিতীয়ত, ঘাটতি বাজেট ১৫ বছর ধরেই ৪-৫ শতাংশের মধ্যে থাকছে। তৃতীয়ত, মূল্যস্ফীতিও ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে আশা করা যায় দেশে ভালো ফলন ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার কারণে।
প্রথম আলো : তিনটি কারণকে বিবেচনায় নিয়েই আপনার এত বড় আশাবাদ? সার্বিকভাবে দেশের মৌলিক বাজেট–শৃঙ্খলা কি ঠিক আছে?
বিনায়ক সেন : আমি বলব সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেট–শৃঙ্খলা একরকম ঠিকই আছে। এখন যদি দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারল না, তখন ব্যয়ের কাঠামো কাটছাঁট করতে হবে। আর এই কাটছাঁটের পরও যদি বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে, প্রবৃদ্ধির হার যদি ৭ শতাংশ অর্জন করা যায়, মূল্যস্ফীতি যদি ৬ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকে, তাহলে আমি এটাকে সময়োচিত ও বাস্তবোচিত বাজেটই বলব। এটা বলার পরই আমি মূল কথাটি বলতে চাইছি।
প্রথম আলো : সেটা কী?
বিনায়ক সেন : মূল কথাটা হচ্ছে আমরা এখনো আলোচনাটা সাধারণ মানের প্রবৃদ্ধির মধ্যেই আটকে রাখছি। সমতামুখী প্রবৃদ্ধি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলছি না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির তিনটি মাত্রা রয়েছে। একটা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা। প্রবৃদ্ধিকে ওঠা–নামা থেকে রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধিকে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে, অর্থাৎ এতে সমাজের সবার ও দেশের সব অঞ্চলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে আয়বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ যত দিন যাচ্ছে, তত আমরা অধিক বৈষম্যমূলক সমাজ থেকে অপেক্ষাকৃত কম বৈষম্যমূলক সমাজে পরিণত হতে পারছি কি না। ২০১০ সালের আয়-ব্যয় জরিপ বলছে, আয়বৈষম্যের সূচক বেশ উঁচু পর্যায়ে চলে গেছে।
প্রথম আলো : সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমরা কতটুকু কী করতে পারছি?
বিনায়ক সেন : প্রথমটি মোটামুটি অর্জিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা অর্জনে ধারাবাহিকতা রয়েছে আমাদের। অনেকেই একে ৬ শতাংশের ফাঁদ বলছেন, কিন্তু আমি ‘ফাঁদ’ বলতে রাজি নই। একনাগাড়ে প্রায় এক দশক ধরে ৬ শতাংশ হার অর্জনের দেশ খুব বেশি নেই। এক দশকে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সংকটও তৈরি হয়েছে। সবকিছুর পরও স্থায়িত্বশীলতার নিক্তিতে আমাদের অর্জন বেশ ভালোই বলা যায়।
প্রথম আলো : বাকি দুটির অবস্থা তাহলে ভালো নয়?
বিনায়ক সেন : না, সেটা না। যেমন অংশগ্রহণমূলক দিক থেকে আমি বলব আংশিক সাফল্য এসেছে। দুই দশক আগেও শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ১৫ শতাংশ। এখন ৩৩-৩৪ শতাংশ। এটা ৬০ শতাংশে উন্নীত করা গেলে প্রবৃদ্ধি যেমন ত্বরান্বিত হবে, আয়ও বাড়বে। আবার যুবশক্তির মধ্যে পোশাক ও কৃষি খাতের অদক্ষ-আধা দক্ষ শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান যথেষ্ট। কিন্তু স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণ থেকে সাফল্য পাইনি। কারণ, আমাদের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার সব কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে চালিত। এবারের বাজেট বক্তব্যে অবশ্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে বণ্টনবৈষম্য দূর করার ইঙ্গিত রয়েছে। স্থানীয় সরকারের অর্থায়নে একটা আলাদা কৌশলপত্র হওয়ার কথা। সেটা যদি সত্যি হয়, এবার থেকেই যেন বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের জন্য রাখা হয়। ভারতের কেরালায় যা আছে এক-তৃতীয়াংশ।
প্রথম আলো : সে হিসাবে বাজেটের মোট আকার থেকে স্থানীয় সরকারের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিচ্ছেন?
বিনায়ক সেন : হ্যাঁ। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের জন্য থাকতে পারে। বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা থাকতে পারে নগরাঞ্চলের জন্য। এতে লাভ যেটা হবে, প্রতিবছর বাজেট বাস্তবায়ন করতে না পারার যে সমালোচনা আছে, সেটা দূর হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) যতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে না, ততটুকু বরাদ্দ দিলেও একটা কাজ হবে। আর তাতে দরিদ্র অঞ্চল, বিশেষ করে হাওর, লবণাক্তপ্রবণ, বন ও পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষও সমানভাবে উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে।
প্রথম আলো : বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি নিয়ে কিছু বললেন না?
বিনায়ক সেন : বাজেট বক্তব্যে এটি প্রায় অনুপস্থিত। দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্যের তুলনায় বেশি হারে বাড়ছে সম্পদবৈষম্য। সম্পদবৈষম্যকে যদি আঘাত করতে হয়, তাহলে সম্পদের ওপর আয়কর সারচার্জ সংগ্রহের বিদ্যমান দুর্বলতা দূর করতে হবে। বড় দুর্বলতা হলো সম্পদের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না। ভিত্তি ধরা হচ্ছে সম্পদ ক্রয়মূল্যকে, ন্যায্য বাজারমূল্যকে নয়। ফলে মাত্র ১০ হাজার লোক এই আয়কর সারচার্জ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পদের মালিক মাত্র ১০ হাজার লোক—এটা অবিশ্বাস্য।
প্রথম আলো : সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন থেকে সরকার কীভাবে লাভবান হতে পারে?
বিনায়ক সেন : এতে রাজস্ব আয় বাড়বে, যা বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি কয়েক বছরে দেশে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। বিশেষ করে নগরাঞ্চলে। তাঁদের কাছ থেকে আয়কর সারচার্জ এবং/অথবা প্রত্যক্ষ সম্পদ-করের মাধ্যমে (যা এখনো বাজেটে নেই) অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা বেশি আয় করা সম্ভব। তবে দুই বছর ধরেই একটি ভালো দিক লক্ষ করছি। এখন প্রত্যক্ষ বা আয়করকে রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগ সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনেরই উদ্যোগ। পোশাকশিল্পসহ প্রতিষ্ঠিত রপ্তানি খাতগুলো থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর ১ শতাংশ হারে কর বসানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা প্রবৃদ্ধিকে সমতামুখী করবে। আর শিশু-শিল্প হলে কর-রেয়াত দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যারা ভালো প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, তাদের থেকে কিছুটা আয়কর আদায় করা জরুরি।
প্রথম আলো : কিন্তু মানুষের প্রথম চাওয়া হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন ও যানজট নিরসন। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
বিনায়ক সেন : প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে—আমাদের এখন সে ধরনের অবকাঠামো দরকার। আবার প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটাও বড় কথা। মানুষ নগরমুখী হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তা মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ হয়ে যাবে। তাদের সমস্যার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। আগে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ছিল কৃষি অর্থনীতি ও রপ্তানি, এখন প্রবৃদ্ধির সঙ্গে হবে নগর অর্থনীতি ও রপ্তানি। ফলে নগরে ও নগরবাসীর জন্য এখন বেশি হারে বিনিয়োগ করতে হবে। যানজট নগরবাসীর কর্মজীবনের বড় একটা সময় খেয়ে ফেলছে। বাজেটে যানজট নিরসনে বা নগর অর্থনীতি উন্নয়নে তেমন কোনো কৌশলগত নির্দেশনা নেই। ঢাকার বাইরে শহরগুলোর অবকাঠামোগত পরিবেশ আরও খারাপ, অথচ শহরেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি করে জড়ো হচ্ছে। আর অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) পদ্ধতির একটা উদ্যোগ সরকার নিলেও এর কোনো ফল দেখা যায়নি। পিপিপিতে ৪৩টি প্রকল্প নিয়ে অর্থমন্ত্রী আর জানালেন না কোনটির কী হাল? বিদ্যুৎ যেমন জাতীয় তাগিদ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, অবকাঠামো খাতেরও একই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
প্রথম আলো : তাহলেই কি সমতামুখী প্রবৃদ্ধি আসবে?
বিনায়ক সেন : না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির জন্য আরও দরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভালো বরাদ্দ। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্রয়োজনের ধারে-কাছেই তিনি যেতে পারেননি। স্বাস্থ্য খাতেরও একই অবস্থা। এ দুই খাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতায় বিস্মিত না হয়ে পারি না। পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা মাসে ৩০০ টাকা প্রিমিয়াম দিতে রাজি থাকলেও তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা পলিসি চালু করা যায়নি।
শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিও রয়েছে। যেমন মাদ্রাসাশিক্ষা থেকে সবচেয়ে কম ফল (রিটার্ন) পাওয়া যায়। অথচ মাদ্রাসাশিক্ষা-ব্যবস্থায় যদি কারিগরি শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যায়, ভালো ফল পাওয়া যাবে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় আমাদের বুয়েট ভালো, ঢাকা মেডিকেল কলেজও (ডিএমসি) ভালো। দরকার ছিল বুয়েটের মতো আরও পাঁচটা ‘বুয়েট’ করা, ডিএমসির মতো পাঁচটা ‘ডিএমসি’ করা। ভারতে যেমন করে প্রথম সারির বেশ কিছু আইআইএম, আইআইটি ও মেডিকেল কলেজ আছে। সেদিকে আমরা গুরুত্বই দিচ্ছি না। মোটের ওপর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আগামী ১০ বছরে প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রিকার্ডো হাউসম্যান সম্প্রতি হিসাব করে বলেছেন, শ্রমশক্তির মান গড়ে তিন বছর স্কুলশিক্ষা থেকে আট বছর স্কুলশিক্ষার মানে উত্তীর্ণ করতে পারলে জিডিপির আকার শুধু এ কারণেই দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
প্রথম আলো : আমাদের আর্থিক খাত কি ঠিকভাবে চলছে? দুর্নীতি কী করে কমবে, সুশাসনের কী হলো?
বিনায়ক সেন : খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কর-রেয়াত এবং ব্যাংকঋণ—এ দুই বিকল্পের ক্ষেত্রে একজন শিল্পপতি যদি দেখেন ব্যাংকঋণ ফেরত দিতে হচ্ছে না, তখন কর-প্রণোদনা কাজ করবে না। কর-প্রণোদনার নীতি আর্থিক-প্রণোদনার নীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আর্থিক খাতে এখনো শৃঙ্খলার অভাব। উচ্চ খেলাপি ঋণের হার থেকে আমরা বের হতে পারছি না। উচিত হবে সোনালী ব্যাংককে হাতে রেখে বাকিগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া। কেননা, সরকারি খাতেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ বেশি। অন্যদিকে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, বেসরকারীকরণের পর তা যেন গুটি কয়েক মুখচেনা শিল্প-ব্যাংক পরিবারের কাছে চলে না যায়।
দুর্নীতি হ্রাস বা সুশাসন চালু সরকার চাইলে অনেকখানিই পারবে। বলছি না যে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু খাতভিত্তিক সুশাসন তো আমরা চাইতেই পারি; অন্তত কয়েকটি খাতে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে যারা টাকা কামাচ্ছে, তাদেরও ধরা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর যৌথভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) যাবতীয় তথ্য মিলিয়ে নজরদারি করলে অবৈধ উপায়ে টাকা কামানো, কর ফাঁকি দেওয়া ও খেলাপি হওয়া—এসব রোধ করা অনেকখানিই সম্ভব।
প্রথম আলো : করদাতার সংখ্যা সরকার তেমন বাড়াতে পারছে না। কোনো পরামর্শ?
বিনায়ক সেন : ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। আরও চার কোটি মানুষ আছে দারিদ্র্যঝুঁকিতে। বাকি থাকল আট কোটি মানুষ, তথা ১ কোটি ৬০ লাখ পরিবার (পরিবারপ্রতি পাঁচজন হিসাবে)। পরিবারে যদি একজন আয় করেন, তাহলেও আয়করের আওতায় আসতে পারেন ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যক্তি। এর মধ্যে শহরবাসী ৫০ লাখ। অথচ বর্তমানে আয়কর দেন কেবল ১০ লাখ লোক। শুধু নগরমুখী করেও প্রায় পাঁচ গুণ আয়করদাতা বাড়ানো সম্ভব। তাই বলব যে উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস সম্প্রসারিত না করে শহর পর্যায়ে এর কার্যক্রম আরও জোরদার করা হোক।
প্রথম আলো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কীভাবে দেখছেন?
বিনায়ক সেন : নদী আমাদের প্রাণ, ট্রানজিট তাঁদের প্রাণ। কৌশলগত স্বার্থের দিক থেকে আমরা তাঁদের পানির বিনিময়ে ট্রানজিট দিতে পারি।
প্রথম আলো : আপনাকে বাজেট প্রণয়নের দায়িত্ব দিলে কোন খাতে অগ্রাধিকার দিতেন?
বিনায়ক সেন : অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। অবশ্যই সামষ্টিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে। অবকাঠামো উন্নয়নের গুরুত্বের কথা যদি বলি, দেখুন, এক যমুনা সেতুর কারণে আশির দশকের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ থেকে আমরা ২০০০ সালের পর ৫-এর ওপরে উঠেছি। পদ্মা সেতু ও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন হলে নিশ্চয়ই ৭-এর ওপরে ওঠা সহজ হবে। আর নীল (সমুদ্র) অর্থনীতি চাঙা করতে পারলে তো কথাই নেই।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন : ধন্যবাদ।
No comments