কচ্ছপ by জাহিদ হায়দার
বাবা কখনো কাছিম বলেন না, বলেন কচ্ছপ।
অনেক সময় লক্ষ করেছি, কোনো প্রসঙ্গে আলোচনা অথবা কথা-কাটাকাটি শুরু হলে, ওই প্রসঙ্গ বা কথার মধ্যে ডান হাতের তর্জনী সোজা করে কিছু বলার জন্য যেন সুযোগ খোঁজেন বাবা। বলেন, ‘এক্কেবারে কচ্ছপের মতো।’ একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এর মধ্যে কাছিমের মতো কী দেখলেন?’ সে কথা জিজ্ঞেস করাও যেন অপরাধ। বাবা সুযোগ পেয়ে যেতেন। তারপর এক ঘণ্টার চার ভাগের তিন ভাগ সময় নিয়ে চলত চুলচেরা ব্যাখ্যা। স্কুলশিক্ষক বাবা ঝাড়া ৪৫ মিনিট ধরে বিষয়ের বুকের ওপরে বসে বিষয়কে কাবু করতে না পারলে শান্ত হতেন না।
একদিন বিপদে পড়েছিল আমার বড় বোন হেনা। মায়ের সঙ্গে বাবার কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল, যা প্রায়ই হয়। মাকে বাবা বললেন, ‘তুমি একটা মাদি কচ্ছপ।’
কথা-কাটাকাটি কিংবা অন্য কোনো প্রসঙ্গের চূড়ান্ত রায় বাবা কখন দেবেন, আমরা জেনে ফেলেছিলাম—যখনই তিনি ‘কচ্ছপ’ বলে বাক্য শেষ করতেন বুঝতাম, নিজের ঘৃণা কিংবা তুচ্ছার্থ প্রকাশের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছেন তিনি। ‘একটা মাদি কচ্ছপ’ বলার পরেই হেনা আপা হেসে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাছিমের স্ত্রীলিঙ্গ কী?’ এর ফল হলো বিশ্রী। বাবা এক লাফে উঠে গিয়ে হেনা আপার কোঁকড়ানো চুল ধরে টানতে টানতে বারান্দা থেকে নিয়ে গেলেন ঘরে। মা চিৎকার করে বললেন, ‘ওর কী দোষ, ওকে কি মেরে ফেলবে? দরজা খোলো।’ আমরা অবাক হয়ে শুনলাম হেনা আপাকে বাবা বলছেন, এই হচ্ছে খাতা, এই কলম, এক ঘণ্টা সময়, কচ্ছপের ওপর ৩০০ শব্দের মধ্যে একটা রচনা লিখতে হবে, স্ত্রী-কচ্ছপকে এক শব্দে কী বলা হয় সেটারও ব্যাখ্যা চাই, এ ছাড়া তোকে কে রেহাই দেয়, দেখে নেব।’
দরজায় শিকল দিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন। আমার হাসি পেল। বাবার একবারও মনে হলো না, শিকল যে কেউ একটু পরেই খুলে দেবে। মা আমাকে বললেন, ‘যা, তোর বাবাকে ডেকে আন।’ আমি বলি, ‘কেন?’ মা আমার কথার জবাব দেন না। মনে হলো, কেঁদে ফেলবেন, তার বদলে বাজার থেকে কী কী আনতে হবে তার একটা ফর্দ আর ৫০০ টাকা দিয়ে চলে যান মা।
ঘরের ভেতর থেকে হেনা আপা দরজা ধাক্কাচ্ছে। আমি শিকল খুলে দিলে মা বললেন, ‘দরজাটা আমি খুললে ভালো হতো।’ মায়ের কথা শুনে আপা আর আমি পরস্পরের দিকে তাকালাম। মা চান, আমরা যেন বাবাকে ভয় পাই।
আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে তপনের ছোট শিরিন দশম শ্রেণির মধ্যমানের ছাত্রী, বাবাকে একটু বেশি ভয় পায়। এই জন্য বাবা বোধ হয় ওকে খানিকটা বেশিই স্নেহ করেন। আমার ছোট তপন পড়ে কলেজের প্রথম বর্ষে। বারবার আয়নার সামনে গিয়ে চুল আঁচড়ায়, কোনো কথা বোঝে না অথচ ইংরেজি গান শোনে। বাবার ব্যক্তিত্বকে আমলই দেয় না। বাবা কখনো কিছু বললে উঁচু গলায় সে জবাব দেবেই; এবং সেই উত্তর বাবা যা বলবেন হবে তার উল্টো। আমার মনে হয়, বাবা ওর প্রতিবাদে ভয় পান। মা একদিন নরম গলায় তপনকে বললেন, ‘তোর বাবার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে পারিস না?’ তপনের মেজাজ তখন ভালো ছিল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল সে। হাতের চিরুনি মাথার পেছনে, আয়নায় স্থির দেখাচ্ছে ওর চোখ দুটি। মনে হলো, সঠিক একটা জবাব খুঁজছে ও। বলল, ‘বাবার মতো লোকদের কথার জবাব জোরে না দিলে তারা মরে যাবে, তুমি বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো তঁাকে আমি কতটা ভালোবাসি আর বাবাও আমাকে...এই বাসায় চিৎকার করার একজন মানুষ তো চাই।’ তপনের কথা শুনে এই প্রথম আমার মনে হলো, ও বিশ্লেষণ করা শিখছে, আগে ওকে কখনো এভাবে গুছিয়ে কথা বলতে শুনিনি।
আজ শেষ বিকেলে পলিথিনের হলুদ ব্যাগ হাতে বাবা বাসায় ফিরলেন ভিজতে ভিজতে। বাসা থেকে সকালে হেনা আপাকে ঘরে শিকল দিয়ে রেগে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিন জায়গায় সেলাই দেওয়া ছাতাটা নিয়ে যাননি। বাবার হাতে ব্যাগ দেখেই মা গজরাতে শুরু করলেন। মায়ের মুখের ভেতর কথাগুলো ভেঙে ভেঙে যা বের হয়ে এল তা এমন: ‘এই মানুষটার আর আক্কেল হলো না, সকালে যে বাজারের টাকা দিয়ে গেছে মনে নেই।’ সব শুনে একটু হাসলেন বাবা। এ রকম হাসি দেখলে মা আর আমরা বুঝি তাঁর মেজাজ ভালো। বললেন, ‘মাছগুলি তাজা তাই।’ ‘তাজা’ কথাটা মাছ কিনে আনার বাবা পর বলবেনই; এবং মা উত্তরে বলবেন, ‘সে তো প্রতিদিনই বলো।’ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে শুনে আসছি অবেলায় বাবার বাজার করা মা পছন্দই করেন না। কিন্তু বাজার আনার পর মা-ই বেশ যত্নে রান্না করেন গরম-গরম ঝোল, বাবার সামনে বসে পাতে তুলে দিয়ে তাঁকে খাওয়ান। অসহায় মানুষকে আরেকজন মানুষ ভালোবাসছে, দুজনের চোখমুখই তৃপ্ত—দৃশ্যটি মন্দ নয়।
অনেক সময় লক্ষ করেছি, কোনো প্রসঙ্গে আলোচনা অথবা কথা-কাটাকাটি শুরু হলে, ওই প্রসঙ্গ বা কথার মধ্যে ডান হাতের তর্জনী সোজা করে কিছু বলার জন্য যেন সুযোগ খোঁজেন বাবা। বলেন, ‘এক্কেবারে কচ্ছপের মতো।’ একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এর মধ্যে কাছিমের মতো কী দেখলেন?’ সে কথা জিজ্ঞেস করাও যেন অপরাধ। বাবা সুযোগ পেয়ে যেতেন। তারপর এক ঘণ্টার চার ভাগের তিন ভাগ সময় নিয়ে চলত চুলচেরা ব্যাখ্যা। স্কুলশিক্ষক বাবা ঝাড়া ৪৫ মিনিট ধরে বিষয়ের বুকের ওপরে বসে বিষয়কে কাবু করতে না পারলে শান্ত হতেন না।
একদিন বিপদে পড়েছিল আমার বড় বোন হেনা। মায়ের সঙ্গে বাবার কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল, যা প্রায়ই হয়। মাকে বাবা বললেন, ‘তুমি একটা মাদি কচ্ছপ।’
কথা-কাটাকাটি কিংবা অন্য কোনো প্রসঙ্গের চূড়ান্ত রায় বাবা কখন দেবেন, আমরা জেনে ফেলেছিলাম—যখনই তিনি ‘কচ্ছপ’ বলে বাক্য শেষ করতেন বুঝতাম, নিজের ঘৃণা কিংবা তুচ্ছার্থ প্রকাশের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছেন তিনি। ‘একটা মাদি কচ্ছপ’ বলার পরেই হেনা আপা হেসে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাছিমের স্ত্রীলিঙ্গ কী?’ এর ফল হলো বিশ্রী। বাবা এক লাফে উঠে গিয়ে হেনা আপার কোঁকড়ানো চুল ধরে টানতে টানতে বারান্দা থেকে নিয়ে গেলেন ঘরে। মা চিৎকার করে বললেন, ‘ওর কী দোষ, ওকে কি মেরে ফেলবে? দরজা খোলো।’ আমরা অবাক হয়ে শুনলাম হেনা আপাকে বাবা বলছেন, এই হচ্ছে খাতা, এই কলম, এক ঘণ্টা সময়, কচ্ছপের ওপর ৩০০ শব্দের মধ্যে একটা রচনা লিখতে হবে, স্ত্রী-কচ্ছপকে এক শব্দে কী বলা হয় সেটারও ব্যাখ্যা চাই, এ ছাড়া তোকে কে রেহাই দেয়, দেখে নেব।’
দরজায় শিকল দিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন। আমার হাসি পেল। বাবার একবারও মনে হলো না, শিকল যে কেউ একটু পরেই খুলে দেবে। মা আমাকে বললেন, ‘যা, তোর বাবাকে ডেকে আন।’ আমি বলি, ‘কেন?’ মা আমার কথার জবাব দেন না। মনে হলো, কেঁদে ফেলবেন, তার বদলে বাজার থেকে কী কী আনতে হবে তার একটা ফর্দ আর ৫০০ টাকা দিয়ে চলে যান মা।
ঘরের ভেতর থেকে হেনা আপা দরজা ধাক্কাচ্ছে। আমি শিকল খুলে দিলে মা বললেন, ‘দরজাটা আমি খুললে ভালো হতো।’ মায়ের কথা শুনে আপা আর আমি পরস্পরের দিকে তাকালাম। মা চান, আমরা যেন বাবাকে ভয় পাই।
আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে তপনের ছোট শিরিন দশম শ্রেণির মধ্যমানের ছাত্রী, বাবাকে একটু বেশি ভয় পায়। এই জন্য বাবা বোধ হয় ওকে খানিকটা বেশিই স্নেহ করেন। আমার ছোট তপন পড়ে কলেজের প্রথম বর্ষে। বারবার আয়নার সামনে গিয়ে চুল আঁচড়ায়, কোনো কথা বোঝে না অথচ ইংরেজি গান শোনে। বাবার ব্যক্তিত্বকে আমলই দেয় না। বাবা কখনো কিছু বললে উঁচু গলায় সে জবাব দেবেই; এবং সেই উত্তর বাবা যা বলবেন হবে তার উল্টো। আমার মনে হয়, বাবা ওর প্রতিবাদে ভয় পান। মা একদিন নরম গলায় তপনকে বললেন, ‘তোর বাবার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে পারিস না?’ তপনের মেজাজ তখন ভালো ছিল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল সে। হাতের চিরুনি মাথার পেছনে, আয়নায় স্থির দেখাচ্ছে ওর চোখ দুটি। মনে হলো, সঠিক একটা জবাব খুঁজছে ও। বলল, ‘বাবার মতো লোকদের কথার জবাব জোরে না দিলে তারা মরে যাবে, তুমি বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো তঁাকে আমি কতটা ভালোবাসি আর বাবাও আমাকে...এই বাসায় চিৎকার করার একজন মানুষ তো চাই।’ তপনের কথা শুনে এই প্রথম আমার মনে হলো, ও বিশ্লেষণ করা শিখছে, আগে ওকে কখনো এভাবে গুছিয়ে কথা বলতে শুনিনি।
আজ শেষ বিকেলে পলিথিনের হলুদ ব্যাগ হাতে বাবা বাসায় ফিরলেন ভিজতে ভিজতে। বাসা থেকে সকালে হেনা আপাকে ঘরে শিকল দিয়ে রেগে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিন জায়গায় সেলাই দেওয়া ছাতাটা নিয়ে যাননি। বাবার হাতে ব্যাগ দেখেই মা গজরাতে শুরু করলেন। মায়ের মুখের ভেতর কথাগুলো ভেঙে ভেঙে যা বের হয়ে এল তা এমন: ‘এই মানুষটার আর আক্কেল হলো না, সকালে যে বাজারের টাকা দিয়ে গেছে মনে নেই।’ সব শুনে একটু হাসলেন বাবা। এ রকম হাসি দেখলে মা আর আমরা বুঝি তাঁর মেজাজ ভালো। বললেন, ‘মাছগুলি তাজা তাই।’ ‘তাজা’ কথাটা মাছ কিনে আনার বাবা পর বলবেনই; এবং মা উত্তরে বলবেন, ‘সে তো প্রতিদিনই বলো।’ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে শুনে আসছি অবেলায় বাবার বাজার করা মা পছন্দই করেন না। কিন্তু বাজার আনার পর মা-ই বেশ যত্নে রান্না করেন গরম-গরম ঝোল, বাবার সামনে বসে পাতে তুলে দিয়ে তাঁকে খাওয়ান। অসহায় মানুষকে আরেকজন মানুষ ভালোবাসছে, দুজনের চোখমুখই তৃপ্ত—দৃশ্যটি মন্দ নয়।
হেনা আপা সত্যি সত্যি কাছিমের ওপর ৩০০ শব্দের মধ্যে একটি রচনা লিখেছে। ও কি ভেবেছিল বাবা বাইরে থেকে এসেই ওর রচনা দেখতে চাইবেন? আমাকে কিছু কাগজ এগিয়ে দিয়ে হেনা আপা বলল, ‘এই দ্যাখ লিখেছি, বাবাকে দেব?’ আমি বললাম, ‘না, বাবা যদি তোমার রচনা দেখতে না চান, তুমি যদি নিজে থেকে দাও তবে তাঁকে অপমান করা হবে। মনে হয় ব্যাপারটা বাবা ভুলেই গেছেন।’ কথা শুনে আপা একটু হাসল, মনে হয়, বাবার মনটা বিচার করে নিল। ওদিকে ততক্ষণে রচনাটি পড়তে আরম্ভ করেছি আমি।
কচ্ছপ একটি সরীসৃপ প্রাণী। কচ্ছপের স্ত্রী-লিঙ্গ কচ্ছপী। নখযুক্ত চার পায়ে, বুকে ভর দিয়ে হাঁটে। এরা উভচর। ডিম পাড়ার সময় ডাঙায় আসে। অনেক ডিম পাড়ে। একবারে ১৫০-২০০টি। সাধারণত নদী, ডোবা বা পুকুরের পাশে যথাক্রমে কাশবন, জঙ্গল বা বাঁশঝাড়ের মধ্যে গর্ত করে হেমন্তের শেষে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো গোল গোল, সাদা, পিংপং বলের মতো। অনেকে কাছিমের ডিম ভেজে খায়। আমরা কখনো খাইনি। চরিত্র আত্মমর্যাদাশীল। কখনো কখনো আত্মসম্মান প্রদর্শনের জন্য ‘রেস’-এ প্রতিযোগিতা করে। আপাতভাবে মনে হয়, পরিশ্রমী কিন্তু অলস। শীতকালে খুব বিলাসী মেজাজে ডাঙায় উঠে রোদ পোহায়। দলবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে। এতে মনে হয়, কিছুটা ভিতু। কচ্ছপের মাংস অনেকে খায়। শুনেছি, নরম মাংসের খুব স্বাদ। পৃথিবীর যে কয়টা প্রাণীর নিজের ঘর বা আশ্রয়স্থান নিজেরই শরীরে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কচ্ছপ। খুব সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করে। প্রথমে নিজের খোলের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে মাথাটা বের করে, তারপর ঠান্ডা চোখে চারদিকে তাকায় এবং যখন মনে করে সামনে এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ, ঠিক তখনই বুকে ভর দিয়ে চার পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যাওয়ার মাঝখানে যদি হঠাৎ বিপদের আভাস পায়, তৎক্ষণাৎ গলাসমেত মাথাটা নিজের খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়; এবং সম্ভবত ভাবতে থাকে আমি বিপদমুক্ত। ভাবনাটা বেশির ভাগ সময় সঠিক হয় না। মানসিকতায় মধ্যবিত্ত, স্মৃতিবিলাসী।
আগেই বলেছি, কাছিম কখনো কখনো ‘রেস’-এ প্রতিযোগিতা করে। অনেক অনেক দিন আগে একবার এক খরগোশের সঙ্গে কাছিমের দৌড় প্রতিযোগিতা হয়েছিল। খরগোশের তাচ্ছিল্যের ভাব দেখে কাছিম খুব রেগে যায় এবং রাজি হয় দৌড় প্রতিযোগিতায়। প্রতিযোগিতা শুরু হলে খরগোশ কয়েক লাফেই অনেক দূর এগিয়ে যায়। বেচারা কাছিম প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। ওর বুকের নরম চামড়া রাস্তায় ঘষা খেতে খেতে রক্তাক্ত হয়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে গলা এত দূর পর্যন্ত বের হয় যে দর্শকদের মনে হয়, মুখে গ্যাজা তুলে মরবে এক্ষুনি। এদিকে খরগোশ অনেক দূর গিয়ে বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত। ভাবখানা এমন, এই পর্যন্ত আসতেই প্রাণ ফেটে মরে যাবে কাছিম, রেসে জিতবে কী? কিন্তু দর্শকেরা অবাক হয়ে দেখল, গন্তব্যের একেবারে কাছে চলে এসেছে কাছিম। দর্শকদের চিৎকারে বিশ্রাম ভেঙে লাফিয়ে উঠে প্রাণপণে দৌড় দিল খরগোশ। ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে বিজয়ী হয়ে গেছে কাছিম। কাছিমের এই বিজয়ের গল্প শুধু কাছিমকুলই গর্ভভরে নিজেদের উত্তরপুরুষদের কাছে বলে না, মানবসমাজের মধ্যে একটি শ্রেণিও, যারা ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত, বংশপরম্পরায় অনেক বিশেষণ দিয়ে বলে আসছে।
ঘরে কলম খুঁজতে এসে আমাকে দেখে বাবা বললেন, ‘কী পড়ছিস?’ বললাম, ‘হেনা আপার লেখা কাছিমের রচনা।’ ভেবেছিলাম, আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে কাগজগুলো নিয়ে নেবেন তিনি। কিন্তু না, তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল মুহূর্তেই। চোখ দুটি ঠান্ডা। তিনি কেঁদে ফেলবেন নাকি? কিছু না বলে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন বাবা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এর মধ্যে বাবার সামনে কলম রেখে মা বলল, ‘তোমার পকেটেই তো ছিল।’ তবে কলমটি ছুঁয়েও দেখলেন না বাবা। শুধু বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা কোথায়?’ তাঁকে তখন কি খুব অসহায় দেখাচ্ছিল?
রচনা লেখা কাগজগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি। সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস কেন যেন ভালো লাগল। আমাকে চুপচাপ বের হতে দেখে হেনা আপা জানতে চাইল, কী হয়েছে? কোনো উত্তর দিলাম না।
আমার স্কুলশিক্ষক বাবা এখন কী করছেন? আমি জানি, এখন পুরোনো রেডিওতে তিনি বিবিসি শুনছেন। রাত ১০টায় শুনবেন ভয়েস অব আমেরিকা। বিবিসি শোনার পর আমাদের বাসায় থাকা দূরসম্পর্কের চাচার সঙ্গে বিবিসির রাজনৈতিক খবরের চালাকি নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করবেন। আলোচনার মধ্যে একসময় এসে পড়বেন বাবার কোনো বন্ধু। রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা হয়তো বা পৌঁছাবে তর্কে। মনে পড়ে, একদিন পাশের বাসার করিম আলী চাচাকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলেন বাবা। ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ পাঠক গলায় গর্বভাব তুলে বলেছিলেন, কীভাবে সাদ্দামকে ধরা হয়েছে। আমেরিকার এই কাজকে করিম চাচা সমর্থন করেন। তাঁর সমর্থন জানানোর ধরন বাবার পছন্দ হয়নি। চাচা তাঁর ডান হাতের তর্জনী তুলে এমনভাবে কথা বলছিলেন, যেন বাবাকে শাসন করছেন। খেপে গিয়ে বাবা বললেন, ‘আঙুল তুলে কথা বলবেন না, জানেন না, এই আঙুল তুলে কথা বলার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান গুলি খেয়ে মরেছেন? তর্জনী দাঁড়ালে সোজা আর বন্দুকের নলও সোজা, দ্বিতীয় বস্তুটি কোনো সোজা জিনিস পছন্দ করে না।’ বাবার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে সাদ্দামকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক কোথায়, কে জানে? মা সাধারণত যা করেন না, বাবা ও তাঁর বন্ধুদের আলোচনার মধ্যে যান না, তবে সেদিন গিয়েছিলেন এবং মায়ের কথা শুনে চুপসে গিয়েছিলেন উপস্থিত সবাই, ‘আপনারা আমেরিকার বিরুদ্ধে এত যে বলছেন, কিন্তু আমেরিকার কথা না শুনলে গরিব দেশগুলোর অবস্থা কী হয় জানেন তো?’
একটা মিছিল আসছে। আমি মৌচাকের বিপরীত দিকের ফুটপাতে দাঁড়ালাম। এখান থেকে মিছিলটাকে ভালো দেখা যাবে। কোন দলের মিছিল? ‘কোন’ ‘দল’ শব্দ দুটি একসঙ্গে উচ্চারণ করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কের মধ্যে কী শব্দ হতে পারে, আঁচ করা যায়। আগামীকাল হরতাল। কেন হরতাল? হরতালের জন্য যে মিছিল হচ্ছে সেই মিছিলে কি আমার যাওয়া উচিত? তাদের দাবি কি আমার দাবি?
সিদ্ধেশ্বরীর গলির ভেতর থেকে কাছিমের মতো ভক্সওয়াগন গাড়িটি মৌচাকের বড় রাস্তায় আসতে গিয়ে মিছিল দেখে দ্রুত পেছনে চলে গেল সশব্দে ব্রেক কষে; ভয় পেলে কাছিম যেমন নিজের খোলে মাথা ঢোকায়, পালায়, ঠিক তেমনি।
রাত সাড়ে আটটা। আকাশে মেঘ। বৃষ্টি নামতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে আমি অনেক দূর শান্তিনগর আর কাকরাইল মোড়ের মাঝখানে চলে এসেছি, এখন ফিরতে হবে বাসায়, পশ্চিম রামপুরায়। গত ২১ বছরে আমরা নয়টা বাসা বদলেছি বা বদলাতে বাধ্য হয়েছি। শহরের ভালো এলাকাগুলো থেকে, বড় সড়কগুলোর পাশ থেকে ধাক্কা খেতে খেতে বাবা—আমরা চলে গেছি ভালো বাসা থেকে ক্রমেই খারাপ বাসা আর খারাপ গলির ভেতর।
প্যান্টের পেছন পকেটে হেনা আপার কাছিম-বিষয়ক রচনাটা এখনো আছে। কাগজের মাথার কোনা সুড়সুড়ি দিচ্ছে আমার মেরুদণ্ডের কাছাকাছি। বোধ হয় খুঁজছে মেরুদণ্ড। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ভেবেছিলাম, রচনাটি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেব। এতক্ষণ কেন যে ওটা পকেটে রেখেছি! তবে এখন ছেঁড়ার আগে রচনাটি পড়তে ইচ্ছে করল আবার। হলুদ সোডিয়াম আলোর নিচে দাঁড়িয়ে দেখছি লেখাটি, এমন সময় চলন্ত রিকশা থেকে এক বন্ধুর গলা, ‘স্বপন, প্রেমপত্র?’ তাকিয়ে ‘না’ বলতেই ভাঙতে ভাঙতে কানে এল দুটি শব্দ, ‘জী-ব-ন-প-ত্র।’
লেখাটি ছিঁড়ে ফেললাম। রাস্তার ধুলোর মধ্যে কাগজগুলো ঘষা খেতে খেতে আমারই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মালিবাগ মোড় থেকে রামপুরার বাস ধরলাম আমি। টিপ টিপ বৃষ্টি হয়েছে। বাস থেকে নেমে বাসার গলির মুখে ঢুকতেই মানুষের জটলা। নিম্ন মধ্যবিত্তের সীমাহীন কৌতূহল আমাকে যেন ধাক্কা দিল—কী ঘটতে পারে? ‘নিশ্চয়ই এই পচা ডোবা থেকে উঠে এসেছে...’, ‘তোমরা এত মেরেছ কেন?...’, ‘আহ্ পিঠটা থেঁতলে গেছে...’, ‘বড় রাস্তায় উঠে যেতে চাচ্ছিল বোধ হয়।’—জটলার মধ্যে এই শেষ কথাটি বাবার। তিনি সবাইকে সরে যেতে বলছেন। শিক্ষকের কথা এখনো কোনো কোনো মানুষ শোনে। বাবা বললেন, ‘চারদিকে শান্ত হলেই গলা বের করে পরিস্থিতি বুঝে কচ্ছপটা ডোবার দিকে চলে যাবে।’ বাবার চোখ দেখে মনে হলো, পারলে নিজের হাতে কাছিমের পিঠের ক্ষত মুছে দেবেন তিনি।
পরিবেশ শান্ত হলে দেখা গেল, কাছিমটা তার নিজের খোল থেকে ধীরে ধীরে মাথা আর গলা বের করে অসহায় চোখে একবার মানুষগুলোকে দেখল। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করল। কিন্তু বড় রাস্তার দিকে কেন? বাবা রক্তাক্ত, দুর্বল কাছিমকে হাত দিয়ে ডোবার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখনো ভালো শক্তি আছে, বেঁচে যাবে, জানেন তো কচ্ছপের কিন্তু মেরুদণ্ড নেই।’
টিপ টিপ বৃষ্টিতে বাবা আর আমি বাসায় ফিরছি। শরীর ভেজা। বাবা নিচু স্বরে বললেন, ‘হেনার লেখা রচনাটি কোথায়, কচ্ছপের মেরুদণ্ড সম্পর্কে কি লিখেছে?’
কচ্ছপ একটি সরীসৃপ প্রাণী। কচ্ছপের স্ত্রী-লিঙ্গ কচ্ছপী। নখযুক্ত চার পায়ে, বুকে ভর দিয়ে হাঁটে। এরা উভচর। ডিম পাড়ার সময় ডাঙায় আসে। অনেক ডিম পাড়ে। একবারে ১৫০-২০০টি। সাধারণত নদী, ডোবা বা পুকুরের পাশে যথাক্রমে কাশবন, জঙ্গল বা বাঁশঝাড়ের মধ্যে গর্ত করে হেমন্তের শেষে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো গোল গোল, সাদা, পিংপং বলের মতো। অনেকে কাছিমের ডিম ভেজে খায়। আমরা কখনো খাইনি। চরিত্র আত্মমর্যাদাশীল। কখনো কখনো আত্মসম্মান প্রদর্শনের জন্য ‘রেস’-এ প্রতিযোগিতা করে। আপাতভাবে মনে হয়, পরিশ্রমী কিন্তু অলস। শীতকালে খুব বিলাসী মেজাজে ডাঙায় উঠে রোদ পোহায়। দলবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে। এতে মনে হয়, কিছুটা ভিতু। কচ্ছপের মাংস অনেকে খায়। শুনেছি, নরম মাংসের খুব স্বাদ। পৃথিবীর যে কয়টা প্রাণীর নিজের ঘর বা আশ্রয়স্থান নিজেরই শরীরে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কচ্ছপ। খুব সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করে। প্রথমে নিজের খোলের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে মাথাটা বের করে, তারপর ঠান্ডা চোখে চারদিকে তাকায় এবং যখন মনে করে সামনে এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ, ঠিক তখনই বুকে ভর দিয়ে চার পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যাওয়ার মাঝখানে যদি হঠাৎ বিপদের আভাস পায়, তৎক্ষণাৎ গলাসমেত মাথাটা নিজের খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়; এবং সম্ভবত ভাবতে থাকে আমি বিপদমুক্ত। ভাবনাটা বেশির ভাগ সময় সঠিক হয় না। মানসিকতায় মধ্যবিত্ত, স্মৃতিবিলাসী।
আগেই বলেছি, কাছিম কখনো কখনো ‘রেস’-এ প্রতিযোগিতা করে। অনেক অনেক দিন আগে একবার এক খরগোশের সঙ্গে কাছিমের দৌড় প্রতিযোগিতা হয়েছিল। খরগোশের তাচ্ছিল্যের ভাব দেখে কাছিম খুব রেগে যায় এবং রাজি হয় দৌড় প্রতিযোগিতায়। প্রতিযোগিতা শুরু হলে খরগোশ কয়েক লাফেই অনেক দূর এগিয়ে যায়। বেচারা কাছিম প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। ওর বুকের নরম চামড়া রাস্তায় ঘষা খেতে খেতে রক্তাক্ত হয়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে গলা এত দূর পর্যন্ত বের হয় যে দর্শকদের মনে হয়, মুখে গ্যাজা তুলে মরবে এক্ষুনি। এদিকে খরগোশ অনেক দূর গিয়ে বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত। ভাবখানা এমন, এই পর্যন্ত আসতেই প্রাণ ফেটে মরে যাবে কাছিম, রেসে জিতবে কী? কিন্তু দর্শকেরা অবাক হয়ে দেখল, গন্তব্যের একেবারে কাছে চলে এসেছে কাছিম। দর্শকদের চিৎকারে বিশ্রাম ভেঙে লাফিয়ে উঠে প্রাণপণে দৌড় দিল খরগোশ। ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে বিজয়ী হয়ে গেছে কাছিম। কাছিমের এই বিজয়ের গল্প শুধু কাছিমকুলই গর্ভভরে নিজেদের উত্তরপুরুষদের কাছে বলে না, মানবসমাজের মধ্যে একটি শ্রেণিও, যারা ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত, বংশপরম্পরায় অনেক বিশেষণ দিয়ে বলে আসছে।
ঘরে কলম খুঁজতে এসে আমাকে দেখে বাবা বললেন, ‘কী পড়ছিস?’ বললাম, ‘হেনা আপার লেখা কাছিমের রচনা।’ ভেবেছিলাম, আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে কাগজগুলো নিয়ে নেবেন তিনি। কিন্তু না, তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল মুহূর্তেই। চোখ দুটি ঠান্ডা। তিনি কেঁদে ফেলবেন নাকি? কিছু না বলে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন বাবা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এর মধ্যে বাবার সামনে কলম রেখে মা বলল, ‘তোমার পকেটেই তো ছিল।’ তবে কলমটি ছুঁয়েও দেখলেন না বাবা। শুধু বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা কোথায়?’ তাঁকে তখন কি খুব অসহায় দেখাচ্ছিল?
রচনা লেখা কাগজগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি। সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস কেন যেন ভালো লাগল। আমাকে চুপচাপ বের হতে দেখে হেনা আপা জানতে চাইল, কী হয়েছে? কোনো উত্তর দিলাম না।
আমার স্কুলশিক্ষক বাবা এখন কী করছেন? আমি জানি, এখন পুরোনো রেডিওতে তিনি বিবিসি শুনছেন। রাত ১০টায় শুনবেন ভয়েস অব আমেরিকা। বিবিসি শোনার পর আমাদের বাসায় থাকা দূরসম্পর্কের চাচার সঙ্গে বিবিসির রাজনৈতিক খবরের চালাকি নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করবেন। আলোচনার মধ্যে একসময় এসে পড়বেন বাবার কোনো বন্ধু। রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা হয়তো বা পৌঁছাবে তর্কে। মনে পড়ে, একদিন পাশের বাসার করিম আলী চাচাকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলেন বাবা। ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ পাঠক গলায় গর্বভাব তুলে বলেছিলেন, কীভাবে সাদ্দামকে ধরা হয়েছে। আমেরিকার এই কাজকে করিম চাচা সমর্থন করেন। তাঁর সমর্থন জানানোর ধরন বাবার পছন্দ হয়নি। চাচা তাঁর ডান হাতের তর্জনী তুলে এমনভাবে কথা বলছিলেন, যেন বাবাকে শাসন করছেন। খেপে গিয়ে বাবা বললেন, ‘আঙুল তুলে কথা বলবেন না, জানেন না, এই আঙুল তুলে কথা বলার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান গুলি খেয়ে মরেছেন? তর্জনী দাঁড়ালে সোজা আর বন্দুকের নলও সোজা, দ্বিতীয় বস্তুটি কোনো সোজা জিনিস পছন্দ করে না।’ বাবার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে সাদ্দামকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক কোথায়, কে জানে? মা সাধারণত যা করেন না, বাবা ও তাঁর বন্ধুদের আলোচনার মধ্যে যান না, তবে সেদিন গিয়েছিলেন এবং মায়ের কথা শুনে চুপসে গিয়েছিলেন উপস্থিত সবাই, ‘আপনারা আমেরিকার বিরুদ্ধে এত যে বলছেন, কিন্তু আমেরিকার কথা না শুনলে গরিব দেশগুলোর অবস্থা কী হয় জানেন তো?’
একটা মিছিল আসছে। আমি মৌচাকের বিপরীত দিকের ফুটপাতে দাঁড়ালাম। এখান থেকে মিছিলটাকে ভালো দেখা যাবে। কোন দলের মিছিল? ‘কোন’ ‘দল’ শব্দ দুটি একসঙ্গে উচ্চারণ করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কের মধ্যে কী শব্দ হতে পারে, আঁচ করা যায়। আগামীকাল হরতাল। কেন হরতাল? হরতালের জন্য যে মিছিল হচ্ছে সেই মিছিলে কি আমার যাওয়া উচিত? তাদের দাবি কি আমার দাবি?
সিদ্ধেশ্বরীর গলির ভেতর থেকে কাছিমের মতো ভক্সওয়াগন গাড়িটি মৌচাকের বড় রাস্তায় আসতে গিয়ে মিছিল দেখে দ্রুত পেছনে চলে গেল সশব্দে ব্রেক কষে; ভয় পেলে কাছিম যেমন নিজের খোলে মাথা ঢোকায়, পালায়, ঠিক তেমনি।
রাত সাড়ে আটটা। আকাশে মেঘ। বৃষ্টি নামতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে আমি অনেক দূর শান্তিনগর আর কাকরাইল মোড়ের মাঝখানে চলে এসেছি, এখন ফিরতে হবে বাসায়, পশ্চিম রামপুরায়। গত ২১ বছরে আমরা নয়টা বাসা বদলেছি বা বদলাতে বাধ্য হয়েছি। শহরের ভালো এলাকাগুলো থেকে, বড় সড়কগুলোর পাশ থেকে ধাক্কা খেতে খেতে বাবা—আমরা চলে গেছি ভালো বাসা থেকে ক্রমেই খারাপ বাসা আর খারাপ গলির ভেতর।
প্যান্টের পেছন পকেটে হেনা আপার কাছিম-বিষয়ক রচনাটা এখনো আছে। কাগজের মাথার কোনা সুড়সুড়ি দিচ্ছে আমার মেরুদণ্ডের কাছাকাছি। বোধ হয় খুঁজছে মেরুদণ্ড। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ভেবেছিলাম, রচনাটি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেব। এতক্ষণ কেন যে ওটা পকেটে রেখেছি! তবে এখন ছেঁড়ার আগে রচনাটি পড়তে ইচ্ছে করল আবার। হলুদ সোডিয়াম আলোর নিচে দাঁড়িয়ে দেখছি লেখাটি, এমন সময় চলন্ত রিকশা থেকে এক বন্ধুর গলা, ‘স্বপন, প্রেমপত্র?’ তাকিয়ে ‘না’ বলতেই ভাঙতে ভাঙতে কানে এল দুটি শব্দ, ‘জী-ব-ন-প-ত্র।’
লেখাটি ছিঁড়ে ফেললাম। রাস্তার ধুলোর মধ্যে কাগজগুলো ঘষা খেতে খেতে আমারই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মালিবাগ মোড় থেকে রামপুরার বাস ধরলাম আমি। টিপ টিপ বৃষ্টি হয়েছে। বাস থেকে নেমে বাসার গলির মুখে ঢুকতেই মানুষের জটলা। নিম্ন মধ্যবিত্তের সীমাহীন কৌতূহল আমাকে যেন ধাক্কা দিল—কী ঘটতে পারে? ‘নিশ্চয়ই এই পচা ডোবা থেকে উঠে এসেছে...’, ‘তোমরা এত মেরেছ কেন?...’, ‘আহ্ পিঠটা থেঁতলে গেছে...’, ‘বড় রাস্তায় উঠে যেতে চাচ্ছিল বোধ হয়।’—জটলার মধ্যে এই শেষ কথাটি বাবার। তিনি সবাইকে সরে যেতে বলছেন। শিক্ষকের কথা এখনো কোনো কোনো মানুষ শোনে। বাবা বললেন, ‘চারদিকে শান্ত হলেই গলা বের করে পরিস্থিতি বুঝে কচ্ছপটা ডোবার দিকে চলে যাবে।’ বাবার চোখ দেখে মনে হলো, পারলে নিজের হাতে কাছিমের পিঠের ক্ষত মুছে দেবেন তিনি।
পরিবেশ শান্ত হলে দেখা গেল, কাছিমটা তার নিজের খোল থেকে ধীরে ধীরে মাথা আর গলা বের করে অসহায় চোখে একবার মানুষগুলোকে দেখল। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করল। কিন্তু বড় রাস্তার দিকে কেন? বাবা রক্তাক্ত, দুর্বল কাছিমকে হাত দিয়ে ডোবার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখনো ভালো শক্তি আছে, বেঁচে যাবে, জানেন তো কচ্ছপের কিন্তু মেরুদণ্ড নেই।’
টিপ টিপ বৃষ্টিতে বাবা আর আমি বাসায় ফিরছি। শরীর ভেজা। বাবা নিচু স্বরে বললেন, ‘হেনার লেখা রচনাটি কোথায়, কচ্ছপের মেরুদণ্ড সম্পর্কে কি লিখেছে?’
No comments