বন্ধুত্বই বাঁচিয়েছে শামীমের প্রাণ by খলিল রহমান
শামীম আহমদ |
টাইটানিকের
মতো বড় জাহাজ। জাহাজের ভেতরে খেলার মাঠ। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ।
আরাম-আয়েশে থাকা, দামি খাবার-দাবারের ব্যবস্থা। মালয়েশিয়া যেতে সময় লাগবে
মাত্র দুই দিন। এরপর সেখানে ভালো কাজ, মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতন।
এমন গল্প শোনানো হয়েছিল সুনামগঞ্জের শামীম আহমদকে (২৩)। এক বিকেলে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন তিনি। কিন্তু কক্সবাজার নিয়ে তাঁকে পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয় দালাল আছদ্দর আলী। এরপর ‘টাইটানিক জাহাজ’ নয়, ট্রলারে করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় অকূল সাগরে।
ট্রলারে বেশি নড়াচড়া করলে, খাওয়ার পানির জন্য চাপাচাপি করলে রাবারের চাবুক দিয়ে পেটানো হতো। খাবার বলতে ছিল দুই বেলা দুমুঠো করে ভাত, সঙ্গে দুটি করে পোড়া মরিচ। কয়েকজন অসুস্থ হয়ে খুব কাতর হয়ে পড়েন। তাঁদের ফেলে দেওয়া হলো সাগরে। ওই অবস্থা থেকে বেঁচে আসতে পেরেছেন, এখন এটাই শামীমের কাছে বড় বিস্ময়।
শামীম আহমদের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জগাইরগাঁও গ্রামে। বাবা মো. খলিলুর রহমান কৃষক। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। পড়েছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। একদিন বাজারে পরিচয় হয় পুরান গৌরারং গ্রামের আছদ্দর আলীর সঙ্গে। যে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর দালাল হিসেবে পরিচিত। আছদ্দর প্রস্তাব দেয় যে মালয়েশিয়ায় ভালো বেতনের চাকরি আছে, সাগরপথে যাত্রা, আগাম টাকা লাগবে না, মালয়েশিয়া পৌঁছে টাকা দিলেই হবে। শামীমের কাছে এটা ছিল এক লোভনীয় প্রস্তাব।
শামীম বলেন, তিনি গত ২৯ এপ্রিল আছদ্দর আলীর সঙ্গে সুনামগঞ্জ থেকে রওনা হন। পরদিন কক্সবাজারে পৌঁছান। সেখানে একটি আবাসিক হোটেলে তাঁকে অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যায় আছদ্দর। শামীমকে হোটেলের যে কক্ষে রাখা হয়, তাতে আগে থেকে আনা আরও ছয়জন ছিলেন। তাঁদের কাছে জেনেছেন, তাঁকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে এই চক্রের কাছে। এরপর পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শামীমসহ সাতজনকে ওই রাতেই জোরপূর্বক একটি ইঞ্জিন নৌকায় আটকে রাখা হয়। দুই দিন পর আরেকটি নৌকায় তোলা হয়। সেটি দুই দিন চলার পর একটি বড় ট্রলারের কাছে পৌঁছায়। সাতজনকে ওই ট্রলারে তোলা হয়। দেখতে কার্গো জাহাজের মতো ওই ট্রলারের পেছন দিকটা দোতলা। মাঝখানের পাটাতনে তাঁদের রাখা হয়। গাদাগাদি করে সব মিলিয়ে ১৮০ জনের মতো ছিলেন তাঁরা। কিছু নারী-শিশুও ছিল। পাহারায় ছিল পাচারকারী চক্রের লোকজন।
শামীম জানান, তাঁদের ট্রলারসহ ১০-১২টি বড় ট্রলার পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে নোঙর করা ছিল। সবগুলোতেই তাঁদের মতো লোকজন এনে জড়ো করা হচ্ছিল। যে ট্রলার লোকে ভরে যাচ্ছে, সেটি ছাড়ছে। তাঁদের ট্রলারটি রয়ে গেছে। ট্রলারে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় নুরুল হোসেন নামের একজনের, যাঁর বাড়ি কক্সবাজারে। দুই বন্ধু মিলে একসঙ্গে থাকেন, বাড়ির কথা মনে করে কাঁদেন।
এক বিকেলে তাঁরা খবর পান, থাইল্যান্ড থেকে ট্রলারের মালিকের ফোন এসেছে চালকের কাছে। জানানো হয়েছে, থাইল্যান্ডে মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ট্রলারটি থাইল্যান্ডে গেলে সমস্যা হবে, সেটি সাগরে ডুবিয়ে দিতে হবে। এ কথা শুনে সবাই কান্নাকাটি শুরু করেন। চালকসহ ট্রলারে থাকা পাচারকারীর লোকজনকে হাতে-পায়ে ধরে বাঁচার আকুতি জানান। শামীম যে সময়ের কথা বলছেন, সেটা থাইল্যান্ডে গণকবর উদ্ধার ও মানব পাচারবিরোধী অভিযান শুরুর পরের ঘটনা। অবশ্য সাগরে ভাসমান থাকা অবস্থায় শামীমেরা এসব কিছুই জানতেন না।
শামীম জানান, তাঁদের কান্নাকাটির একপর্যায়ে ট্রলারে থাকা পাচারকারীদের দয়া হয়। তারা যোগাযোগ করে পাচারকারী চক্রের মিয়ানমারের দালালদের সঙ্গে। ওই দালালেরা ছোট ট্রলার পাঠিয়ে নারী-শিশুসহ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যায়। এরপর যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশের দালালদের সঙ্গে। কিন্তু তারা জানায়, এখানকার পরিস্থিতি খারাপ। বাংলাদেশে কাউকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাতে তারা ধরা পড়ে যাবে। প্রয়োজনে সবাইকে সাগরে ভাসিয়ে দিতে বলা হয়। এরপর আবার কান্নার রোল ওঠে বাংলাদেশিদের মধ্যে। রাত পেরিয়ে সকাল হয়। ট্রলারের চালকেরা জানায়, তাদের হাতে সময় কম। ট্রলার ডুবিয়ে তাদের ভাগতে হবে। এর কিছুক্ষণ পর চট্টগ্রাম থেকে খবর যায়, ট্রলারে থাকা একজনকে বাঁচাতে হবে। তিনি এক দালালের ভাতিজা। তাঁর জন্য একটি ইঞ্জিন নৌকা পাঠানো হচ্ছে। সেটিতে যেন তাঁকেসহ কেবল চট্টগ্রাম এলাকার যতজন লোক পারা যায়, তাঁদের তুলে দেওয়া হয়।
এ খবরে কক্সবাজারের নুরুলের চোখেমুখে খুশির ভাব এলেও শামীম ভেঙে পড়েন। নুরুল তাঁকে আশ্বস্ত করেন, তিনি বাঁচলে শামীমও বাঁচবেন। এরপর থেকে দুই বন্ধু কাছাকাছি থাকেন। পরদিন মধ্যরাতে একটি ইঞ্জিন নৌকা আসতে দেখেন তাঁরা। তখন অনেকেই নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কারও দাঁড়ানোর শক্তি নেই। চট্টগ্রাম এলাকার ৪০ জনের মতো লোককে ট্রলারের পেছন দিকে একত্র করা হয়। ততক্ষণে জেগে ওঠা অন্য এলাকার লোকেরাও নৌকায় উঠতে মরিয়া। নৌকাটি ট্রলারের পাশে ভিড়েছে।
শামীম বলেন, ‘আমার এক হাতে শক্ত করে ধরে আছে নুরুল। তাঁর এক পা ইঞ্জিন নৌকায়, আমি পা বাড়াব এমন সময় পেছন থেকে দালালের লোক আমার শার্ট টেনে ধরে। নুরুল আমাকে সব শক্তি দিয়ে টানছে। দালালের লোক আমাকে ধরে রেখেছে। একপর্যায়ে আমি এক হাতে শার্ট খুলে ফেলি। নুরুলের এক টানে নৌকায় গিয়ে পড়ি। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে দেখি, নুরুলের কোলে আমার মাথা।’ এরপর টানা দুই দিন চলার পর রাতের বেলায় তাঁদের বলা হয়, নৌকা কক্সবাজার এসে গেছে, কিন্তু তীরে ভেড়ানো যাবে না। সবাইকে নেমে সাঁতরে তীরে যেতে হবে। শামীম জানান, তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কেউ নামতে চাচ্ছে না। এরপর জোর করে নৌকা থেকে তাঁদের পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। নামার পর দেখেন বুকসম পানি। কোনোরকমে তীরে ওঠেন তাঁরা।
তীরে উঠে সবাই যে যাঁর মতো করে পালাচ্ছেন। শামীম কোনোরকমে বালুচরে এসে পড়ে আছেন। শরীর আর চলছিল না। তিনি একা, ভয় পাচ্ছেন। নুরুল চলে গেছেন। ‘১০-১৫ মিনিট পরে আবার নুরুলের গলা শুনতে পাই। সে আমাকে টেনেহিঁচড়ে সঙ্গে নিয়ে যায়। এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিই।’ বলছিলেন শামীম। ওই বাড়িতে ওঠার পর তাঁরা জানতে পারেন, টেকনাফে আছেন। দুই দিন পর বিজিবির সদস্যরা এসে তাঁদের আটক করে থানায় দেন। চার দিন হাজতবাসের পর বের হন শামীম। চট্টগ্রামে আনসারের চাকরিতে থাকা তাঁর ছোট ভাই এসে তাঁকে নিয়ে যান এবং চিকিৎসা করান। সুস্থ হয়ে ১৩ মে সুনামগঞ্জের বাড়িতে আসেন তিনি।
‘ভাই, ভাবতাম পারছিলাম না আবার ফিইরা আইতাম পারমু। আমার বন্ধুই আমারে বাঁচাইছে। যত দিন বাঁচমু, বিদেশের নাম আর মুখে নিতাম না’—চোখ ছলছল করছিল শামীমের।
এমন গল্প শোনানো হয়েছিল সুনামগঞ্জের শামীম আহমদকে (২৩)। এক বিকেলে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন তিনি। কিন্তু কক্সবাজার নিয়ে তাঁকে পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয় দালাল আছদ্দর আলী। এরপর ‘টাইটানিক জাহাজ’ নয়, ট্রলারে করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় অকূল সাগরে।
ট্রলারে বেশি নড়াচড়া করলে, খাওয়ার পানির জন্য চাপাচাপি করলে রাবারের চাবুক দিয়ে পেটানো হতো। খাবার বলতে ছিল দুই বেলা দুমুঠো করে ভাত, সঙ্গে দুটি করে পোড়া মরিচ। কয়েকজন অসুস্থ হয়ে খুব কাতর হয়ে পড়েন। তাঁদের ফেলে দেওয়া হলো সাগরে। ওই অবস্থা থেকে বেঁচে আসতে পেরেছেন, এখন এটাই শামীমের কাছে বড় বিস্ময়।
শামীম আহমদের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জগাইরগাঁও গ্রামে। বাবা মো. খলিলুর রহমান কৃষক। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। পড়েছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। একদিন বাজারে পরিচয় হয় পুরান গৌরারং গ্রামের আছদ্দর আলীর সঙ্গে। যে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর দালাল হিসেবে পরিচিত। আছদ্দর প্রস্তাব দেয় যে মালয়েশিয়ায় ভালো বেতনের চাকরি আছে, সাগরপথে যাত্রা, আগাম টাকা লাগবে না, মালয়েশিয়া পৌঁছে টাকা দিলেই হবে। শামীমের কাছে এটা ছিল এক লোভনীয় প্রস্তাব।
শামীম বলেন, তিনি গত ২৯ এপ্রিল আছদ্দর আলীর সঙ্গে সুনামগঞ্জ থেকে রওনা হন। পরদিন কক্সবাজারে পৌঁছান। সেখানে একটি আবাসিক হোটেলে তাঁকে অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যায় আছদ্দর। শামীমকে হোটেলের যে কক্ষে রাখা হয়, তাতে আগে থেকে আনা আরও ছয়জন ছিলেন। তাঁদের কাছে জেনেছেন, তাঁকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে এই চক্রের কাছে। এরপর পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শামীমসহ সাতজনকে ওই রাতেই জোরপূর্বক একটি ইঞ্জিন নৌকায় আটকে রাখা হয়। দুই দিন পর আরেকটি নৌকায় তোলা হয়। সেটি দুই দিন চলার পর একটি বড় ট্রলারের কাছে পৌঁছায়। সাতজনকে ওই ট্রলারে তোলা হয়। দেখতে কার্গো জাহাজের মতো ওই ট্রলারের পেছন দিকটা দোতলা। মাঝখানের পাটাতনে তাঁদের রাখা হয়। গাদাগাদি করে সব মিলিয়ে ১৮০ জনের মতো ছিলেন তাঁরা। কিছু নারী-শিশুও ছিল। পাহারায় ছিল পাচারকারী চক্রের লোকজন।
শামীম জানান, তাঁদের ট্রলারসহ ১০-১২টি বড় ট্রলার পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে নোঙর করা ছিল। সবগুলোতেই তাঁদের মতো লোকজন এনে জড়ো করা হচ্ছিল। যে ট্রলার লোকে ভরে যাচ্ছে, সেটি ছাড়ছে। তাঁদের ট্রলারটি রয়ে গেছে। ট্রলারে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় নুরুল হোসেন নামের একজনের, যাঁর বাড়ি কক্সবাজারে। দুই বন্ধু মিলে একসঙ্গে থাকেন, বাড়ির কথা মনে করে কাঁদেন।
এক বিকেলে তাঁরা খবর পান, থাইল্যান্ড থেকে ট্রলারের মালিকের ফোন এসেছে চালকের কাছে। জানানো হয়েছে, থাইল্যান্ডে মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ট্রলারটি থাইল্যান্ডে গেলে সমস্যা হবে, সেটি সাগরে ডুবিয়ে দিতে হবে। এ কথা শুনে সবাই কান্নাকাটি শুরু করেন। চালকসহ ট্রলারে থাকা পাচারকারীর লোকজনকে হাতে-পায়ে ধরে বাঁচার আকুতি জানান। শামীম যে সময়ের কথা বলছেন, সেটা থাইল্যান্ডে গণকবর উদ্ধার ও মানব পাচারবিরোধী অভিযান শুরুর পরের ঘটনা। অবশ্য সাগরে ভাসমান থাকা অবস্থায় শামীমেরা এসব কিছুই জানতেন না।
শামীম জানান, তাঁদের কান্নাকাটির একপর্যায়ে ট্রলারে থাকা পাচারকারীদের দয়া হয়। তারা যোগাযোগ করে পাচারকারী চক্রের মিয়ানমারের দালালদের সঙ্গে। ওই দালালেরা ছোট ট্রলার পাঠিয়ে নারী-শিশুসহ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যায়। এরপর যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশের দালালদের সঙ্গে। কিন্তু তারা জানায়, এখানকার পরিস্থিতি খারাপ। বাংলাদেশে কাউকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাতে তারা ধরা পড়ে যাবে। প্রয়োজনে সবাইকে সাগরে ভাসিয়ে দিতে বলা হয়। এরপর আবার কান্নার রোল ওঠে বাংলাদেশিদের মধ্যে। রাত পেরিয়ে সকাল হয়। ট্রলারের চালকেরা জানায়, তাদের হাতে সময় কম। ট্রলার ডুবিয়ে তাদের ভাগতে হবে। এর কিছুক্ষণ পর চট্টগ্রাম থেকে খবর যায়, ট্রলারে থাকা একজনকে বাঁচাতে হবে। তিনি এক দালালের ভাতিজা। তাঁর জন্য একটি ইঞ্জিন নৌকা পাঠানো হচ্ছে। সেটিতে যেন তাঁকেসহ কেবল চট্টগ্রাম এলাকার যতজন লোক পারা যায়, তাঁদের তুলে দেওয়া হয়।
এ খবরে কক্সবাজারের নুরুলের চোখেমুখে খুশির ভাব এলেও শামীম ভেঙে পড়েন। নুরুল তাঁকে আশ্বস্ত করেন, তিনি বাঁচলে শামীমও বাঁচবেন। এরপর থেকে দুই বন্ধু কাছাকাছি থাকেন। পরদিন মধ্যরাতে একটি ইঞ্জিন নৌকা আসতে দেখেন তাঁরা। তখন অনেকেই নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কারও দাঁড়ানোর শক্তি নেই। চট্টগ্রাম এলাকার ৪০ জনের মতো লোককে ট্রলারের পেছন দিকে একত্র করা হয়। ততক্ষণে জেগে ওঠা অন্য এলাকার লোকেরাও নৌকায় উঠতে মরিয়া। নৌকাটি ট্রলারের পাশে ভিড়েছে।
শামীম বলেন, ‘আমার এক হাতে শক্ত করে ধরে আছে নুরুল। তাঁর এক পা ইঞ্জিন নৌকায়, আমি পা বাড়াব এমন সময় পেছন থেকে দালালের লোক আমার শার্ট টেনে ধরে। নুরুল আমাকে সব শক্তি দিয়ে টানছে। দালালের লোক আমাকে ধরে রেখেছে। একপর্যায়ে আমি এক হাতে শার্ট খুলে ফেলি। নুরুলের এক টানে নৌকায় গিয়ে পড়ি। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে দেখি, নুরুলের কোলে আমার মাথা।’ এরপর টানা দুই দিন চলার পর রাতের বেলায় তাঁদের বলা হয়, নৌকা কক্সবাজার এসে গেছে, কিন্তু তীরে ভেড়ানো যাবে না। সবাইকে নেমে সাঁতরে তীরে যেতে হবে। শামীম জানান, তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কেউ নামতে চাচ্ছে না। এরপর জোর করে নৌকা থেকে তাঁদের পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। নামার পর দেখেন বুকসম পানি। কোনোরকমে তীরে ওঠেন তাঁরা।
তীরে উঠে সবাই যে যাঁর মতো করে পালাচ্ছেন। শামীম কোনোরকমে বালুচরে এসে পড়ে আছেন। শরীর আর চলছিল না। তিনি একা, ভয় পাচ্ছেন। নুরুল চলে গেছেন। ‘১০-১৫ মিনিট পরে আবার নুরুলের গলা শুনতে পাই। সে আমাকে টেনেহিঁচড়ে সঙ্গে নিয়ে যায়। এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিই।’ বলছিলেন শামীম। ওই বাড়িতে ওঠার পর তাঁরা জানতে পারেন, টেকনাফে আছেন। দুই দিন পর বিজিবির সদস্যরা এসে তাঁদের আটক করে থানায় দেন। চার দিন হাজতবাসের পর বের হন শামীম। চট্টগ্রামে আনসারের চাকরিতে থাকা তাঁর ছোট ভাই এসে তাঁকে নিয়ে যান এবং চিকিৎসা করান। সুস্থ হয়ে ১৩ মে সুনামগঞ্জের বাড়িতে আসেন তিনি।
‘ভাই, ভাবতাম পারছিলাম না আবার ফিইরা আইতাম পারমু। আমার বন্ধুই আমারে বাঁচাইছে। যত দিন বাঁচমু, বিদেশের নাম আর মুখে নিতাম না’—চোখ ছলছল করছিল শামীমের।
No comments