সৌদি আরবের ‘চেকবই কূটনীতি’ ফাঁস- ‘ধনবান চাচা’র কাছে হাত পাতে সবাই

উইকিলিকস
অর্থাভাবে দেহরক্ষীদের বেতন দিতে পারছিলেন না লেবাননের একজন রাজনীতিক। শেষমেশ তিনি ধরনা দেন সৌদি আরবের কাছে। ‘নানা সমস্যায় পতিত’ হয় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা। সেসব সমস্যার সমাধানে সৌদির কাছে দুই হাজার মার্কিন ডলারের জন্য হাত পাতে তারা।
মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই সৌদি আরবের কাছে একটা চাওয়া ছিল মোহাম্মদ মুরসির। অবশ্য ইসলামপন্থী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) এই নেতার চাওয়াটা ছিল নিতান্ত ছোট: নিজের পরিবারকে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিতে ভিসা প্রদান।
উইকিলিকস গত শুক্রবার সৌদি আরবের ৬০ হাজারের বেশি নথি ফাঁস করেছে। এসব নথিতে এ রকম ছোটখাটো নানা বিষয় উঠে এসেছে। এতে প্রতিফলিত হয়েছে, সৌদি আরবের ‘চেকবই কূটনীতি’। ‘মধ্যপ্রাচ্যের ধনবান চাচা’ সৌদির কাছে সবাই-ই কিছু না কিছু চায়। সৌদিরাও প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতে সেসব দাবি মিটিয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস গতকাল রোববার এ বিষয়টি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ফাঁস হওয়া নথিগুলোর অনেকগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থির সময়গুলোর ওপরে আলোকপাত করা হয়েছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া গণ-আন্দোলনে আরব নেতাদের উৎখাত হওয়া থেকে শুরু করে চলতি বছরের শুরুর দিকের ঘটনাগুলোও এর মধ্যে রয়েছে। অনেক নথিতে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী শিয়া ইরানের প্রভাব মোকাবিলায় সুন্নি সৌদি আরবের নানা প্রচেষ্টার বিষয়টি স্পষ্ট। পাশাপাশি লেবাননের হিজবুল্লাহর মতো ইরানপন্থী শিয়া সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোকে মদদ দেওয়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে।
ইরাক-সংশ্লিষ্ট তারবার্তাগুলোতে তৎকালীন ইরাকি শিয়া প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকির বিরোধী রাজনীতিকদের সৌদি সমর্থনের প্রমাণ মিলেছে। একটি বার্তায় দেখা গেছে, ইরানের ঘনিষ্ঠ মালিকির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আয়াদ আলাবিকে বিতরণের জন্য দুই হাজার হজ ভিসা দেওয়া হয়েছে। কাতার-সংশ্লিষ্ট আরেক তারবার্তায় অভিযোগ করা হয়েছে, সৌদি আরবের প্রতিবেশী ইয়েমেনে চলমান সংকটের জন্য কাতার দায়ী। উপসাগরীয় দেশ কাতারও অর্থভিত্তিক কূটনীতি চালিয়ে থাকে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আব্দুল খালেক আব্দুল্লা কমবেশি ১০০টি তারবার্তায় পড়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, সৌদি আরব যে ‘চেকবই কূটনীতি’র আশ্রয় নিয়ে থাকে, সেটা সবাই জানে। তবে এখন এমন কূটনীতিতে তাদের কাতার, কুয়েত ও ইউএইর মতো ধনী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে, সে বিষয়টি এসব তারবার্তায় পরিষ্কার।
সৌদি সরকারের সঙ্গে মিসরের ইসলামপন্থী সংগঠন ব্রাদারহুডের সম্পর্ক গোড়া থেকেই ভালো নয়। তবে দীর্ঘদিনের মিত্র মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে বাঁচাতে সৌদিরা ব্রাদারহুডের সঙ্গেও আপস করতে চেয়েছিল বলে ফাঁস হওয়া কিছু তারবার্তায় স্পষ্ট। গণ-আন্দোলনে মোবারক উৎখাতের পর মিসরে ক্ষমতায় আসে ব্রাদারহুড।
একটি নথিতে দেখা যায়, ব্রাদারহুডের এক নেতা সৌদিকে বলেছে, রিয়াদ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিলে মোবারককে জেলে না পাঠানোর বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। অবশ্য ওই নথির ওপরে হাতে লেখা একটি নোটে বলা হয়েছে, মোবারকের জন্য ‘ঘুষ’ দেওয়ার বিষয়টি ‘ভালো বুদ্ধি’ নয়। কারণ, ব্রাদারহুড তাঁর কারাবরণ ঠেকাতে পারবে না।
নথিগুলোর ভেতরে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, লেবাননের বিতর্কিত গায়িকা ন্যান্সি আজরামকে ভিসা প্রদান। বেশ কিছু গানের ভিডিওর কারণে রক্ষণশীল মুসলমানরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত। ফাঁস হওয়া নথিপত্র মোতাবেক, সব শিল্পী ও গায়ক-গায়িকার ভিসা আগে সৌদির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুমোদন করাতে হয়। কিন্তু নিয়ম না মেনেই গায়িকা আজরামকে ভিসা দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মক্কা অফিস পরে বলেছে, গায়িকা আজরাম তাঁর স্বামীর সঙ্গে ভ্রমণের জন্য ওই ভিসা পান। তিনি ব্যক্তিগত সফরে এসেছিলেন, গায়িকা হিসেবে নয়।

No comments

Powered by Blogger.