গণতন্ত্রের সঙ্গে ডুবছে আইনের শাসনও by এ কে এম জাকারিয়া
গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে একদম সুনাম নেই এমন দেশেও আইনের শাসন ভালোভাবেই কাজ করতে পারে। সিঙ্গাপুর এর বড় উদাহরণ। মালয়েশিয়ার অবস্থানও এ ক্ষেত্রে খুব খারাপ নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন এবং এ বছরের ঢাকা সিটি নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক দেশের সুনাম বাংলাদেশও অনেকটাই খুইয়েছে। গণতন্ত্র নিয়ে বড় গলায় কিছু বলার সুযোগ আমরা অনেকটাই হারিয়েছি। সরকার অবশ্য তা চায় বলেও মনে হয় না। ‘গণতন্ত্র’ এখন আর সরকারের প্রাধান্যের মধ্যে নেই। বরং মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর ধরনের গণতন্ত্রকেই আমাদের ভবিষ্যৎ হিসেবে তারা তুলে ধরতে চাইছে। মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর মার্কা গণতন্ত্র না হয় আমরা মেনে নিলাম, আইনের শাসনের অবস্থাটা কি তাহলে তাদের মতো হবে? সে ক্ষেত্রেও কি সরকার তাদের অনুসরণ করবে?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) বছর বছর বিভিন্ন দেশের আইনের শাসন পরিস্থিতি নিয়ে একটি সূচক প্রকাশ করে। এ বছরও করেছে গত মঙ্গলবার। ডব্লিউজেপি রুল অব ল ইনডেক্স, ২০১৫। তাদের দাবি, এই সূচকের মধ্য দিয়ে তারা বিভিন্ন দেশের আইনের শাসন পরিস্থিতির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ তথ্য ও উপাত্ত তুলে ধরেছে। আটটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে তারা কাজটি করেছে। ১. সরকারের ক্ষমতার সীমা, ২. দুর্নীতির অনুপস্থিতি, ৩. উন্মুক্ত সরকার, ৪. মৌলিক অধিকার, ৫. আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, ৬. আইন ও বিধিবিধান প্রয়োগ, ৭. দেওয়ানি বিচার ও ৮. ফৌজদারি বিচার। ১০২টি দেশ তাদের সূচকে জায়গা পেয়েছে। এই দেশগুলোর প্রতিটিতে তিনটি বড় শহরের (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা) এক হাজার নাগরিকের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের মতামতকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই আটটি বিষয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে যে আইনের শাসন বিষয়ে স্থানীয় জনগণের অভিজ্ঞতা কেমন। ডাব্লিউজেপি বলেছে, এ ধরনের সূচকের মধ্যে এই সূচক বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক তথ্যভান্ডারে সমৃদ্ধ এবং শুধু প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে তা করা হয়েছে।
১০২টি দেশের এই সূচকে বাংলাদেশের জায়গা হয়েছে ৯৩ নম্বরে। মানে আইনের শাসনের দিক দিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ কয়েকটি দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। যে আটটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ডব্লিউজেপি কাজ করেছে, তার সবগুলোতেই বাংলাদেশের মান একদম নীচু পর্যায়ে। এই উপমহাদেশের তিন দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের অবস্থান ৪৮, ৫৮ ও ৫৯ নম্বরে। নেপাল ছয়টি বিষয়ে, শ্রীলঙ্কা পাঁচটি বিষয়ে ও ভারত তিনটি বিষয়ে মাঝারি অবস্থানে রয়েছে। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের নিচে, তবে ৮টির মধ্যে একটি বিষয়ে (সরকারের ক্ষমতার সীমা) হলেও তারা মাঝারি অবস্থানে রয়েছে।
গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে যে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরকে আমাদের সরকার এখন আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছে বলে মনে হয়, সেই মালয়েশিয়ার অবস্থান ৩৯ নম্বরে। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে তারা উঁচু পর্যায়ে এবং কয়েকটিতে মাঝারি অবস্থানে রয়েছে। আর সিঙ্গাপুরের অবস্থান ৯ নম্বরে। সবগুলো বিষয়েই তাদের অবস্থান উচ্চ পর্যায়ে। বোঝা গেল, আমাদের সরকারের কাছে শুধু গণতন্ত্র, নির্বাচন বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া অনুসরণীয় হয়ে উঠেছে। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে নয়।
সরকার আমাদের এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে ‘উন্নয়ন’ চাইলে নির্বাচন বা গণতন্ত্রে ছাড় দিতে হবে। মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর এসবে ছাড় দিয়েছে এবং তারা যথেষ্ট উন্নতি করেছে। কিন্তু আইনের শাসনের ক্ষেত্রে এই দেশ দুটি যে ছাড় দিচ্ছে না এবং তাদের উন্নয়নের পেছনে যে এর বড় ভূমিকা রয়েছে, তা আমাদের সরকারের বিবেচনায় আছে বলে মনে হয় না। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে দেশ দুটির খারাপ দিকটি অনুসরণে আমাদের সরকার যত আগ্রহী, তাদের ভালো দিকগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে ততটাই অনিচ্ছুক।
আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কেন এত শোচনীয়, সেটা নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়েই টের পাই। খুবই সাম্প্রতিক দুটি বিষয় তুলে ধরছি। ডব্লিউজেপির প্রতিবেদন প্রকাশের আগের দিন (গত সোমবার) রানা প্লাজা ধসের মামলার যে চার্জশিট আদালতে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে ইউএনওকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, সরকার তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি দেয়নি। অথচ মামলার এজাহারে তাঁর নাম এসেছিল। রানা প্লাজাকে যখন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়েছিল, তখন এই ইউএনও বলেছিলেন, রানা প্লাজা নিরাপদ আছে, সেখানে কোনো সমস্যা নেই। পত্র–পত্রিকায় তাঁর এই বক্তব্য ছাপা হয়েছে। তিনি সত্যিই যদি এমন কথা বলে থাকেন (যেটা তাঁকে আসামি করা হলে আদালতে নিষ্পত্তি হতো), তবে রানা প্লাজায় ১ হাজার ১৩৪ জন মৃত্যুর দায় থেকে তিনি কি মুক্তি পেতে পারেন? এতে যে বার্তা পাওয়া গেল, তা কতটুকু আইনের শাসনের পক্ষে গেল? মালয়েশিয়ায় বা সিঙ্গাপুরে এ ধরনের ঘটনার পর শুধু সরকারি কর্মকর্তা বিবেচনায় কারও দায়মুক্তি ঘটবে, তা বিশ্বাস করা কঠিন। ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের সূচকে তাদের অবস্থান যেখানেই থাক, আইনের শাসনের সূচকে তাদের এগিয়ে থাকার কারণটি পরিষ্কার।
আর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাজকর্ম দেখলেই তো দেশের দুর্নীতির অবস্থা টের পাওয়া যায়। দুর্নীতি দমনের কাজ বাদ দিয়ে এই কমিশন এখন ‘দায়মুক্তি’ দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। এই দায়মুক্তি অবশ্য খাটে কেবল সরকারি দলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য। হয় তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান বা সাবেক মন্ত্রী, অথবা সাংসদ, তাঁদের স্ত্রী বা সরকারের নিজের লোক হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি। ‘স্বাধীন’ ও ‘সাংবিধানিক’ এই প্রতিষ্ঠানকে অনেকেই এখন ব্যঙ্গ করে ‘দায়মুক্তি কমিশন’ বলেন। দুদক দিনের পর দিন যা করছে, তা না বলে আর উপায় কী! গত মঙ্গলবার (২ জুন) দুদক দায়মুক্তি দিল পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান হোসেন মনসুরকে।
কর্ণফুলী গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে এবং দুদকের অনুসন্ধানে তার সত্যতা মিলেছে। অনুসন্ধান শেষে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমিশন চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে বাকি পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতি দেয়। কেন তা জানতে গবেষক হওয়ার দরকার নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের এই শিক্ষক পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন সরকারের ‘কাছের লোক’ হিসেবে। এখন দুর্নীতির অভিযোগ থেকে তাঁকে মুক্তি না দিয়ে উপায় কী! সরকারের ইচ্ছা–অনিচ্ছাই যে দুদকের ইচ্ছা–অনিচ্ছায় পরিণত হয়েছে।
এ ধরনের যে শাসন দেশে চলছে, তার সঙ্গে আর যাই হোক, আইনের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। আর সাধারণ লোকজন বিপদ-আপদে থানা-পুলিশে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন, বিচার চাইতে গিয়ে যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছেন, তাতে আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশের এই অবস্থানে চমকে ওঠার সুযোগ আছে কি!
গণতন্ত্র নিভু নিভু, সঙ্গে আইনের শাসনও তো মনে হয় ডুবছে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) বছর বছর বিভিন্ন দেশের আইনের শাসন পরিস্থিতি নিয়ে একটি সূচক প্রকাশ করে। এ বছরও করেছে গত মঙ্গলবার। ডব্লিউজেপি রুল অব ল ইনডেক্স, ২০১৫। তাদের দাবি, এই সূচকের মধ্য দিয়ে তারা বিভিন্ন দেশের আইনের শাসন পরিস্থিতির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ তথ্য ও উপাত্ত তুলে ধরেছে। আটটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে তারা কাজটি করেছে। ১. সরকারের ক্ষমতার সীমা, ২. দুর্নীতির অনুপস্থিতি, ৩. উন্মুক্ত সরকার, ৪. মৌলিক অধিকার, ৫. আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, ৬. আইন ও বিধিবিধান প্রয়োগ, ৭. দেওয়ানি বিচার ও ৮. ফৌজদারি বিচার। ১০২টি দেশ তাদের সূচকে জায়গা পেয়েছে। এই দেশগুলোর প্রতিটিতে তিনটি বড় শহরের (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা) এক হাজার নাগরিকের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের মতামতকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই আটটি বিষয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে যে আইনের শাসন বিষয়ে স্থানীয় জনগণের অভিজ্ঞতা কেমন। ডাব্লিউজেপি বলেছে, এ ধরনের সূচকের মধ্যে এই সূচক বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক তথ্যভান্ডারে সমৃদ্ধ এবং শুধু প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে তা করা হয়েছে।
১০২টি দেশের এই সূচকে বাংলাদেশের জায়গা হয়েছে ৯৩ নম্বরে। মানে আইনের শাসনের দিক দিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ কয়েকটি দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। যে আটটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ডব্লিউজেপি কাজ করেছে, তার সবগুলোতেই বাংলাদেশের মান একদম নীচু পর্যায়ে। এই উপমহাদেশের তিন দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের অবস্থান ৪৮, ৫৮ ও ৫৯ নম্বরে। নেপাল ছয়টি বিষয়ে, শ্রীলঙ্কা পাঁচটি বিষয়ে ও ভারত তিনটি বিষয়ে মাঝারি অবস্থানে রয়েছে। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের নিচে, তবে ৮টির মধ্যে একটি বিষয়ে (সরকারের ক্ষমতার সীমা) হলেও তারা মাঝারি অবস্থানে রয়েছে।
গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে যে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরকে আমাদের সরকার এখন আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছে বলে মনে হয়, সেই মালয়েশিয়ার অবস্থান ৩৯ নম্বরে। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে তারা উঁচু পর্যায়ে এবং কয়েকটিতে মাঝারি অবস্থানে রয়েছে। আর সিঙ্গাপুরের অবস্থান ৯ নম্বরে। সবগুলো বিষয়েই তাদের অবস্থান উচ্চ পর্যায়ে। বোঝা গেল, আমাদের সরকারের কাছে শুধু গণতন্ত্র, নির্বাচন বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া অনুসরণীয় হয়ে উঠেছে। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে নয়।
সরকার আমাদের এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে ‘উন্নয়ন’ চাইলে নির্বাচন বা গণতন্ত্রে ছাড় দিতে হবে। মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর এসবে ছাড় দিয়েছে এবং তারা যথেষ্ট উন্নতি করেছে। কিন্তু আইনের শাসনের ক্ষেত্রে এই দেশ দুটি যে ছাড় দিচ্ছে না এবং তাদের উন্নয়নের পেছনে যে এর বড় ভূমিকা রয়েছে, তা আমাদের সরকারের বিবেচনায় আছে বলে মনে হয় না। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে দেশ দুটির খারাপ দিকটি অনুসরণে আমাদের সরকার যত আগ্রহী, তাদের ভালো দিকগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে ততটাই অনিচ্ছুক।
আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কেন এত শোচনীয়, সেটা নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়েই টের পাই। খুবই সাম্প্রতিক দুটি বিষয় তুলে ধরছি। ডব্লিউজেপির প্রতিবেদন প্রকাশের আগের দিন (গত সোমবার) রানা প্লাজা ধসের মামলার যে চার্জশিট আদালতে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে ইউএনওকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, সরকার তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি দেয়নি। অথচ মামলার এজাহারে তাঁর নাম এসেছিল। রানা প্লাজাকে যখন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়েছিল, তখন এই ইউএনও বলেছিলেন, রানা প্লাজা নিরাপদ আছে, সেখানে কোনো সমস্যা নেই। পত্র–পত্রিকায় তাঁর এই বক্তব্য ছাপা হয়েছে। তিনি সত্যিই যদি এমন কথা বলে থাকেন (যেটা তাঁকে আসামি করা হলে আদালতে নিষ্পত্তি হতো), তবে রানা প্লাজায় ১ হাজার ১৩৪ জন মৃত্যুর দায় থেকে তিনি কি মুক্তি পেতে পারেন? এতে যে বার্তা পাওয়া গেল, তা কতটুকু আইনের শাসনের পক্ষে গেল? মালয়েশিয়ায় বা সিঙ্গাপুরে এ ধরনের ঘটনার পর শুধু সরকারি কর্মকর্তা বিবেচনায় কারও দায়মুক্তি ঘটবে, তা বিশ্বাস করা কঠিন। ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের সূচকে তাদের অবস্থান যেখানেই থাক, আইনের শাসনের সূচকে তাদের এগিয়ে থাকার কারণটি পরিষ্কার।
আর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাজকর্ম দেখলেই তো দেশের দুর্নীতির অবস্থা টের পাওয়া যায়। দুর্নীতি দমনের কাজ বাদ দিয়ে এই কমিশন এখন ‘দায়মুক্তি’ দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। এই দায়মুক্তি অবশ্য খাটে কেবল সরকারি দলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য। হয় তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান বা সাবেক মন্ত্রী, অথবা সাংসদ, তাঁদের স্ত্রী বা সরকারের নিজের লোক হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি। ‘স্বাধীন’ ও ‘সাংবিধানিক’ এই প্রতিষ্ঠানকে অনেকেই এখন ব্যঙ্গ করে ‘দায়মুক্তি কমিশন’ বলেন। দুদক দিনের পর দিন যা করছে, তা না বলে আর উপায় কী! গত মঙ্গলবার (২ জুন) দুদক দায়মুক্তি দিল পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান হোসেন মনসুরকে।
কর্ণফুলী গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে এবং দুদকের অনুসন্ধানে তার সত্যতা মিলেছে। অনুসন্ধান শেষে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমিশন চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে বাকি পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতি দেয়। কেন তা জানতে গবেষক হওয়ার দরকার নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের এই শিক্ষক পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন সরকারের ‘কাছের লোক’ হিসেবে। এখন দুর্নীতির অভিযোগ থেকে তাঁকে মুক্তি না দিয়ে উপায় কী! সরকারের ইচ্ছা–অনিচ্ছাই যে দুদকের ইচ্ছা–অনিচ্ছায় পরিণত হয়েছে।
এ ধরনের যে শাসন দেশে চলছে, তার সঙ্গে আর যাই হোক, আইনের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। আর সাধারণ লোকজন বিপদ-আপদে থানা-পুলিশে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন, বিচার চাইতে গিয়ে যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছেন, তাতে আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশের এই অবস্থানে চমকে ওঠার সুযোগ আছে কি!
গণতন্ত্র নিভু নিভু, সঙ্গে আইনের শাসনও তো মনে হয় ডুবছে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
Nawka duibai ace
ReplyDelete