তিন মাসের রাজনীতির লাভ-ক্ষতি by কামাল আহমেদ
বিএনপির
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে
যাওয়ার মধ্য দিয়ে জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। কেননা, এর মধ্য দিয়ে
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে। তবে, তা
রাজনৈতিক সংকটের টেকসই সমাধানের পথ প্রশস্ত করবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে
বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। সরকার এবং দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল
বিএনপির মধ্যে তিন মাস ধরে যে টানাপোড়েন চলেছে, সেটি ছিল মূলত ক্ষমতার
লড়াই। একদিকে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদায়ের দাবি, অন্যদিকে, ৫
জানুয়ারির বিতর্কিত ভোটারবিহীন নির্বাচনকে জায়েজ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক দল
হিসেবে বিএনপিকে সাধ্যমতো দুর্বল ও বশীভূত করার চেষ্টা। স্পষ্টতই, কোনো
পক্ষ তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়নি। তবে, তাদের এই ঠেলাঠেলির বেশ চড়া মূল্য
দিতে হয়েছে সাধারণ নাগরিকদের।
৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ভোটারবিহীন নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে বিএনপিকে ঢাকায় সমাবেশ করতে না দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকারের তরফ থেকে আরোপিত অবরোধ কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই লুফে নেন বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া। বাস্তবে অবরোধ ও হরতালের কোনো কার্যকারিতা না থাকলেও দিনের পর দিন ওই সব কর্মসূচি অব্যাহত রেখে দলটি প্রায় এক হাস্যকর করুণার রাজনীতি অনুশীলনে নিয়োজিত ছিল।
পেট্রলবোমা ও ককটেলের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং কথিত সন্দেহভাজন নাশকতাকারীদের দমন অভিযানে সারা দেশে প্রাণ দিয়েছেন ১৩১ জন। এঁদের মধ্যে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৭৫ জন, আর প্রায় তার অর্ধেক ৩৩ জন শিকার হয়েছেন কথিত বন্দুকযুদ্ধের। গুম বা অন্তর্ধানের সংখ্যা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। আহত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভোগান্তিতে পড়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ এবং তাঁদের পরিবারগুলো। ১৫ লাখ এসএসসি ও সমমােনর পরীক্ষার্থী একটি পরীক্ষাও তাদের পূর্বঘোষিত রুটিন অনুযায়ী দিতে পারেনি। রাজনীতিকদের প্রতি এসব পরীক্ষার্থীর যে বিতৃষ্ণা তৈরি হবে, তা তঁারা কখনো কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না বলা মুশকিল। ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ শীর্ষ বণিক সভা এফবিসিসিআইয়ের দাবিমতে ন্যূনতম ৬০ হাজার কোটি টাকা। তবে, শীর্ষস্থানীয় স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের হিসাবে (মধ্য মার্চ পর্যন্ত সময়ে, আড়াই মাসে) মোট জাতীয় উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, সরকারের দমন–পীড়ন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তাঁরা স্বীকার করেছেন যে সরকার তাঁদের দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে দমন–পীড়ন চালাবে, এমনটি তাঁরা অনুমান করলেও যে মাত্রায় তা করা হয়েছে, সেটি তাঁরা কল্পনাও করেননি। কথাটি সম্ভবত অনেকাংশেই সত্য। তাঁদের খুব কমসংখ্যকই গত তিন মাসে নিজেদের বাড়িতে ঘুমাতে পেরেছেন। সালাহ উদ্দিন আহমদের মতো পরিচিত নেতাও গুম হয়েছেন এবং জেলে রয়েছেন হাজার হাজার নেতা–কর্মী।
ওই নেতারা অবশ্য এটিও স্বীকার করে নিয়েছেন যে তাঁদের দলের সাংগঠনিক কাঠামো মোটেও নির্ভরযোগ্য নয় এবং সে কারণে দলের নেতা–কর্মীদের দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে ধরে রাখার মতো সামর্থ্য তাঁদের নেই। পেট্রলবোমা বা নাশকতায় বিএনপির কেউ জড়িত নয় বলে খালেদা জিয়া তাঁর একমাত্র সংবাদ সম্মেলনে যে দাবি করেছিলেন, সেই দাবিটি বিশ্বাস করানোর কাজটিতেও যে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন, সেই বাস্তবতাও তাঁরা উপলব্ধি করছেন। অর্থাৎ, নাশকতায় জড়িত না থাকলেও তাঁদের কর্মসূচির কারণে তার দায় যে তাঁদেরকেই বহন করতে হবে, সেটি হয়তো ভবিষ্যতের যেকোনো পদক্ষেপের সময় তাঁরা মনে রাখবেন। যদিও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমাদের রাজনীতিকেরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না।
বিপরীতে, আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করতে পারেন যে সরকার নাশকতা দমনের প্রশ্নে এক বিন্দুও ছাড় দেয়নি এবং সরকারের কঠোর নীতির কাছে বিএনপি হার মানতে বাধ্য হয়েছে। সরকারের একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্যে ইতিমধ্যেই এই দাবি করা হয়েছে। এমনকি, বিএনপির ওপর চাপ অব্যাহত রাখার কৌশল হিসেবে নৌমন্ত্রীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের নামে সরকার–সমর্থকেরা ঢাকায় গণমিছিলও করেছেন। বাস্তবতা অবশ্য তা সমর্থন করে না।
সরকারের কঠোর নীতির কথিত সাফল্য যে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীও সংসদে বলেছিলেন যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা হবে। কিন্তু, ৪০ দিনেও আদালতের পরোয়ানা কার্যকর হয়নি। শুধু গ্রেপ্তারই বা কেন, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তল্লাশি চালানোর জন্যও পুলিশ আদালত থেকে পরোয়ানা নিয়েছিল। কিন্তু সেটিও শুধু ভয় দেখানোর কৌশল বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে, আইনের সমান প্রয়োগ এবং আদালতের স্বাধীনতার বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দূষণের কুদৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে।
শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে যে কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব নয়, সেটা জানার পরও দেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগের রাজনীতিকেরা রাজনৈতিক সমাধান না খুঁজে দমন নীতির কৌশল নিয়ে যে নজির স্থাপন করেছেন, সেটিও সুখকর নয়। প্রথমে ‘কয়েক দিন’ এবং পরে ‘সপ্তাহ খানেকের মধ্যে’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার অঙ্গীকার করে তিন মাসেও সরকার সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। রাতের বেলা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থেকেছে কয়েক সপ্তাহ। এমনকি, যখন পেট্রলবোমার ব্যবহার কিছুটা কমে এসেছে, তখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগের ছাপ লক্ষ করা গেছে। আর এই আতঙ্ক ও উদ্বেগের প্রভাব ঢাকায় যতটা দৃশ্যমান হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকট ছিল ঢাকার বাইরে ছোট ছোট শহর ও গ্রামে। সম্ভবত, এ কারণেই সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদও একপর্যায়ে দাবি করে বসেছেন যে ‘তিনিই ছিলেন সবচেয়ে গণতান্ত্রিক শাসক’। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী—বিজিবি এবং পুলিশ ও র্যাব—এই তিনটি বাহিনীর প্রধানেরা থেকে শুরু করে মধ্যম সারির অধিকর্তারাও যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে করে ওই সব বাহিনীর জন্য যে উদাহরণ তৈরি হলো, সেগুলো ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। এমন কথাও উঠেছে যে সরকারের কাছ থেকে বাড়তি আনুকূল্য পাওয়ার উদ্দেশ্যেই এঁরা অযাচিতভাবে এসব কথার্বাতা বলেছেন।
এসবের পাশাপাশি বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টাতেও কোনো ফল হয়নি। প্রথমে আসল বিএনপি নামে কতিপয় অচেনা মুখের আবির্ভাব। আর, তারপর বিএনপির সাবেক দুই সাংসদের (শহীদুল হক জামাল ও আবু হেনা) নেতৃত্বে বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা। বলা হয় যে খালেদা জিয়া তাঁর ছোট ছেলের মৃত্যুর পরও কথিত ‘অবরুদ্ধ অবস্থা’ থেকে বের হননি কিংবা প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে তাঁর কবরে যাননি, একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার এবং ছাব্বিশে মার্চে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন শুধু এই আশঙ্কায় যে তিনি নিজের কার্যালয় থেকে উচ্ছেদ হবেন। দল ভাঙার ভয় দেখিয়ে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পণ ভাঙার কৌশল যে কতটা বালখিল্য ছিল, তা উপলব্ধির পর নিশ্চয়ই তাঁদের অনেকে এখন মাথার চুল ছিঁড়ছেন।
দীর্ঘায়িত সংকটকালে বিদেশি বন্ধু ও উন্নয়ন–সহযোগীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান যেভাবে উপেক্ষিত হয়েছে, তাও নজিরবিহীন। সরকার বিদেশিদের উদ্বেগের মুখে অব্যাহতভাবে নির্বিকার উপেক্ষার নীতি অনুসরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং, অনেক দায়িত্বশীল মন্ত্রীও প্রকাশ্যে সংলাপের প্রস্তাবকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। অবশ্য বিদেশে নিজেদের অবস্থানের পক্ষে সমর্থনলাভের আশায় প্রচার-প্রচারণায় সরকার একটুও পিছিয়ে থাকেনি। বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের মোড়কে উপস্থাপনের চেষ্টা চলেছে নিরন্তর। সে ক্ষেত্রেও যে সরকারের তেমন কোনো সাফল্য রয়েছে তা নয়; বরং, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের সুযোগ সংকোচন এবং দমন–পীড়নের বিষয়ে অব্যাহতভাবে তাদের উদ্বেগ জানিয়ে এসেছে। বিএনপির প্রতি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার আহ্বান, যা গত ২০১৪ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক প্রস্তাবে প্রথম বলা হয়েছিল, বিদেশিরা শুধু সেটারই পুনরুচ্চারণ করেছেন।
ইতিমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অছিলায় রাজনীতির ধারায় কিছুটা হলেও পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। অনেকের ধারণা, এর পেছনে রয়েছে একধরনের সীমিত সমঝোতা। নেপথ্যের এই সমঝোতায় বিদেশিদের অথবা নাগরিক সমাজের কারও কারও কিছু একটা ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। এর ফলে, নাগরিককুল সাময়িক স্বস্তি পেলেও পেতে পারে। কিন্তু, একটা টেকসই সমাধান ছাড়া উদ্বেগ দূর হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, রাজনৈতিক বিরোধ ও রেষারেষির সবচেয়ে বেশি মূল্য গুনেছেন সাধারণ মানুষ।
কামাল আহমেদ, সাংবাদিক।
৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ভোটারবিহীন নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে বিএনপিকে ঢাকায় সমাবেশ করতে না দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকারের তরফ থেকে আরোপিত অবরোধ কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই লুফে নেন বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া। বাস্তবে অবরোধ ও হরতালের কোনো কার্যকারিতা না থাকলেও দিনের পর দিন ওই সব কর্মসূচি অব্যাহত রেখে দলটি প্রায় এক হাস্যকর করুণার রাজনীতি অনুশীলনে নিয়োজিত ছিল।
পেট্রলবোমা ও ককটেলের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং কথিত সন্দেহভাজন নাশকতাকারীদের দমন অভিযানে সারা দেশে প্রাণ দিয়েছেন ১৩১ জন। এঁদের মধ্যে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৭৫ জন, আর প্রায় তার অর্ধেক ৩৩ জন শিকার হয়েছেন কথিত বন্দুকযুদ্ধের। গুম বা অন্তর্ধানের সংখ্যা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। আহত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভোগান্তিতে পড়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ এবং তাঁদের পরিবারগুলো। ১৫ লাখ এসএসসি ও সমমােনর পরীক্ষার্থী একটি পরীক্ষাও তাদের পূর্বঘোষিত রুটিন অনুযায়ী দিতে পারেনি। রাজনীতিকদের প্রতি এসব পরীক্ষার্থীর যে বিতৃষ্ণা তৈরি হবে, তা তঁারা কখনো কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না বলা মুশকিল। ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ শীর্ষ বণিক সভা এফবিসিসিআইয়ের দাবিমতে ন্যূনতম ৬০ হাজার কোটি টাকা। তবে, শীর্ষস্থানীয় স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের হিসাবে (মধ্য মার্চ পর্যন্ত সময়ে, আড়াই মাসে) মোট জাতীয় উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, সরকারের দমন–পীড়ন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তাঁরা স্বীকার করেছেন যে সরকার তাঁদের দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে দমন–পীড়ন চালাবে, এমনটি তাঁরা অনুমান করলেও যে মাত্রায় তা করা হয়েছে, সেটি তাঁরা কল্পনাও করেননি। কথাটি সম্ভবত অনেকাংশেই সত্য। তাঁদের খুব কমসংখ্যকই গত তিন মাসে নিজেদের বাড়িতে ঘুমাতে পেরেছেন। সালাহ উদ্দিন আহমদের মতো পরিচিত নেতাও গুম হয়েছেন এবং জেলে রয়েছেন হাজার হাজার নেতা–কর্মী।
ওই নেতারা অবশ্য এটিও স্বীকার করে নিয়েছেন যে তাঁদের দলের সাংগঠনিক কাঠামো মোটেও নির্ভরযোগ্য নয় এবং সে কারণে দলের নেতা–কর্মীদের দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে ধরে রাখার মতো সামর্থ্য তাঁদের নেই। পেট্রলবোমা বা নাশকতায় বিএনপির কেউ জড়িত নয় বলে খালেদা জিয়া তাঁর একমাত্র সংবাদ সম্মেলনে যে দাবি করেছিলেন, সেই দাবিটি বিশ্বাস করানোর কাজটিতেও যে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন, সেই বাস্তবতাও তাঁরা উপলব্ধি করছেন। অর্থাৎ, নাশকতায় জড়িত না থাকলেও তাঁদের কর্মসূচির কারণে তার দায় যে তাঁদেরকেই বহন করতে হবে, সেটি হয়তো ভবিষ্যতের যেকোনো পদক্ষেপের সময় তাঁরা মনে রাখবেন। যদিও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমাদের রাজনীতিকেরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না।
বিপরীতে, আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করতে পারেন যে সরকার নাশকতা দমনের প্রশ্নে এক বিন্দুও ছাড় দেয়নি এবং সরকারের কঠোর নীতির কাছে বিএনপি হার মানতে বাধ্য হয়েছে। সরকারের একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্যে ইতিমধ্যেই এই দাবি করা হয়েছে। এমনকি, বিএনপির ওপর চাপ অব্যাহত রাখার কৌশল হিসেবে নৌমন্ত্রীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের নামে সরকার–সমর্থকেরা ঢাকায় গণমিছিলও করেছেন। বাস্তবতা অবশ্য তা সমর্থন করে না।
সরকারের কঠোর নীতির কথিত সাফল্য যে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীও সংসদে বলেছিলেন যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা হবে। কিন্তু, ৪০ দিনেও আদালতের পরোয়ানা কার্যকর হয়নি। শুধু গ্রেপ্তারই বা কেন, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তল্লাশি চালানোর জন্যও পুলিশ আদালত থেকে পরোয়ানা নিয়েছিল। কিন্তু সেটিও শুধু ভয় দেখানোর কৌশল বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে, আইনের সমান প্রয়োগ এবং আদালতের স্বাধীনতার বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দূষণের কুদৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে।
শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে যে কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব নয়, সেটা জানার পরও দেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগের রাজনীতিকেরা রাজনৈতিক সমাধান না খুঁজে দমন নীতির কৌশল নিয়ে যে নজির স্থাপন করেছেন, সেটিও সুখকর নয়। প্রথমে ‘কয়েক দিন’ এবং পরে ‘সপ্তাহ খানেকের মধ্যে’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার অঙ্গীকার করে তিন মাসেও সরকার সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। রাতের বেলা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থেকেছে কয়েক সপ্তাহ। এমনকি, যখন পেট্রলবোমার ব্যবহার কিছুটা কমে এসেছে, তখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগের ছাপ লক্ষ করা গেছে। আর এই আতঙ্ক ও উদ্বেগের প্রভাব ঢাকায় যতটা দৃশ্যমান হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকট ছিল ঢাকার বাইরে ছোট ছোট শহর ও গ্রামে। সম্ভবত, এ কারণেই সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদও একপর্যায়ে দাবি করে বসেছেন যে ‘তিনিই ছিলেন সবচেয়ে গণতান্ত্রিক শাসক’। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী—বিজিবি এবং পুলিশ ও র্যাব—এই তিনটি বাহিনীর প্রধানেরা থেকে শুরু করে মধ্যম সারির অধিকর্তারাও যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে করে ওই সব বাহিনীর জন্য যে উদাহরণ তৈরি হলো, সেগুলো ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। এমন কথাও উঠেছে যে সরকারের কাছ থেকে বাড়তি আনুকূল্য পাওয়ার উদ্দেশ্যেই এঁরা অযাচিতভাবে এসব কথার্বাতা বলেছেন।
এসবের পাশাপাশি বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টাতেও কোনো ফল হয়নি। প্রথমে আসল বিএনপি নামে কতিপয় অচেনা মুখের আবির্ভাব। আর, তারপর বিএনপির সাবেক দুই সাংসদের (শহীদুল হক জামাল ও আবু হেনা) নেতৃত্বে বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা। বলা হয় যে খালেদা জিয়া তাঁর ছোট ছেলের মৃত্যুর পরও কথিত ‘অবরুদ্ধ অবস্থা’ থেকে বের হননি কিংবা প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে তাঁর কবরে যাননি, একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার এবং ছাব্বিশে মার্চে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন শুধু এই আশঙ্কায় যে তিনি নিজের কার্যালয় থেকে উচ্ছেদ হবেন। দল ভাঙার ভয় দেখিয়ে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পণ ভাঙার কৌশল যে কতটা বালখিল্য ছিল, তা উপলব্ধির পর নিশ্চয়ই তাঁদের অনেকে এখন মাথার চুল ছিঁড়ছেন।
দীর্ঘায়িত সংকটকালে বিদেশি বন্ধু ও উন্নয়ন–সহযোগীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান যেভাবে উপেক্ষিত হয়েছে, তাও নজিরবিহীন। সরকার বিদেশিদের উদ্বেগের মুখে অব্যাহতভাবে নির্বিকার উপেক্ষার নীতি অনুসরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং, অনেক দায়িত্বশীল মন্ত্রীও প্রকাশ্যে সংলাপের প্রস্তাবকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। অবশ্য বিদেশে নিজেদের অবস্থানের পক্ষে সমর্থনলাভের আশায় প্রচার-প্রচারণায় সরকার একটুও পিছিয়ে থাকেনি। বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের মোড়কে উপস্থাপনের চেষ্টা চলেছে নিরন্তর। সে ক্ষেত্রেও যে সরকারের তেমন কোনো সাফল্য রয়েছে তা নয়; বরং, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের সুযোগ সংকোচন এবং দমন–পীড়নের বিষয়ে অব্যাহতভাবে তাদের উদ্বেগ জানিয়ে এসেছে। বিএনপির প্রতি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার আহ্বান, যা গত ২০১৪ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক প্রস্তাবে প্রথম বলা হয়েছিল, বিদেশিরা শুধু সেটারই পুনরুচ্চারণ করেছেন।
ইতিমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অছিলায় রাজনীতির ধারায় কিছুটা হলেও পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। অনেকের ধারণা, এর পেছনে রয়েছে একধরনের সীমিত সমঝোতা। নেপথ্যের এই সমঝোতায় বিদেশিদের অথবা নাগরিক সমাজের কারও কারও কিছু একটা ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। এর ফলে, নাগরিককুল সাময়িক স্বস্তি পেলেও পেতে পারে। কিন্তু, একটা টেকসই সমাধান ছাড়া উদ্বেগ দূর হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, রাজনৈতিক বিরোধ ও রেষারেষির সবচেয়ে বেশি মূল্য গুনেছেন সাধারণ মানুষ।
কামাল আহমেদ, সাংবাদিক।
No comments