অগ্রপথিক এবিএম মূসা by সাখাওয়াত আলী খান

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে যখন পাকিস্তান হলো, তখন পূর্ব পাকিস্তানের (সে সময় বলা হতো পূর্ববঙ্গ প্রদেশ) রাজধানী ঢাকায় কোনো দৈনিক সংবাদপত্রই ছিল না। পরে ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে দৈনিক আজাদ পত্রিকা ঢাকায় নিয়ে আসা হলো এবং আরও পরে ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হলো ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার। এতে বোঝা যায়, এ দেশে তখন সাংবাদিকতার অবস্থা কতটা অনুন্নত ছিল। সে দুরবস্থা ক্রমেই কেটে যেতে থাকে এবং এখানেই তৈরি হতে থাকে সাংবাদিকদের এদেশীয় এক নতুন প্রজন্ম। এই নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের হাতেই এ দেশে সাংবাদিকতার এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। এ নতুন ধারার নব প্রজন্মের একজন সাংবাদিক ছিলেন এবিএম মূসা।
সাড়ে ছয় দশকের বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা এ দেশের বর্তমান সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মূসা ভাইয়েরাই পাইওনিয়ার বা অগ্রপথিক। তাঁর সাংবাদিকতার জীবনের মধ্যে এ দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস অনেকটাই প্রতিফলিত হয়ে আছে। ব্যক্তিগতভাবে মূসা ভাই নিজস্ব উদ্যোগে এ দেশের ইংরেজি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অনেক পরীক্ষামূলক বিষয় চালু করেছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর নতুন উদ্যোগ এ দেশের সাংবাদিকতায় স্থায়ী রূপ পেয়েছে। তাঁর রক্তেই সাংবাদিকতা ছিল। প্রেসক্লাবকে তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নিজের দ্বিতীয় বাড়ি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
সাংবাদিকতায় মূসা ভাইয়ের সবচেয়ে নামডাক ছিল একজন জাঁদরেল নিউজ এডিটর হিসেবে। জুনিয়ররা তাঁকে ভীষণ মেজাজি বলে জানত। তবে দৃশ্যত রাগী মানুষটির ভেতরে তাঁর জুনিয়রদের জন্য অনেক স্নেহ সঞ্চিত ছিল। তাঁর বাহ্যিক রাগী রাগী চেহারার অন্তরালে অসাধারণ রসবোধসম্পন্ন একটি মন ছিল। সন্দেহ নেই যে মূসা ভাইয়ের মহাপ্রয়াণে একজন মনীষী সাংবাদিককে আমরা হারিয়েছি, কিন্তু কেন জানি আজ তাঁর পেশাগত পরিচয়ের বাইরেও তাঁকে সংবেদনশীল দরদি মানুষ হিসেবেই বেশি মনে পড়ছে। তাঁর স্নেহধন্য শিষ্য সাংবাদিক আতাউস সামাদের স্মরণসভায় তাঁর চোখে আমি পানি দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা তাঁর বইয়ে মহান নেতার সঙ্গে স্নেহের সম্পর্কটাই বড় হয়ে উঠেছে। এমনকি সাংবাদিকতা পেশাটিকেও তিনি ভালোবেসে গ্রহণ করেছিলেন, মাঝে অন্য পেশায় চলে গিয়েও আবার এই ভালোবাসার টানেই ফিরে এসেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনুষ্ঠানে মূসা ভাই ঘোষণা করলেন যে দেশের বরেণ্য সাংবাদিক প্রয়াত আবদুস সালাম এবং এই বিভাগেরই সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রয়াত আতাউস সামাদের নামে দুটি স্কলারশিপ প্রবর্তনের জন্য বিভাগে তিনি ৪০ লাখ টাকা দান করবেন। তাঁর এই বদান্যতায় যখন উপস্থিত সবাই অভিভূত, ঠিক তখনই তিনি শর্ত আরোপ করলেন এই যে তাঁর এই অনুদানের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচার করা যাবে না। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের মাধ্যমে সব গণমাধ্যমের সব কর্মকর্তাকে তাঁর এই অনুরোধ রক্ষা করার আবেদন জানালেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় মূসা ভাইয়ের অবস্থানের কারণেই সম্ভবত তাঁর এই অনুরোধ রক্ষিত হয়েছিল। তিনি প্রয়াত হওয়ার কিছুদিন পর বিভাগের চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে এই বিষয়টি প্রথম জানান।
মূসা ভাইয়ের রাজনৈতিক বিশ্বাস একটি স্থির বিন্দুতে স্থায়ী থাকেনি বলে মনে হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি একবার আওয়ামী লীগের টিকিটে ফেনী থেকে সাংসদও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির (সংক্ষেপে আরএসপি নামে পরিচিত) কোনো প্রকাশ্য তৎপরতা না থাকলেও জানা যায় যে কিছু সাংবাদিক এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, নির্মল সেন, মোজাম্মেল হক, আবদুল খালেক খান এবং আরও কেউ কেউ পার্টির আদর্শে বিশ্বাসী বলে ধারণা করা হতো। মূসা ভাইয়ের নামও এই তালিকায় ছিল বলে আমি শুনেছিলাম এবং কিছুদিন আগে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকায় এলে তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি মূসা ভাইয়ের আরএসপির সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করেন।
যদিও জীবনের শেষভাগে এবিএম মূসা মূলত কলাম লেখক এবং টিভি টক শোর অংশগ্রহণকারী হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়েছিলেন, কিন্তু এ দেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা, শিরোনাম লিখন এবং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাসজ্জার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সংবাদকে বস্তুনিষ্ঠ করতে এবং সংবাদে যথাসম্ভব পুরো সত্য তুলে ধরতে তাঁর নিরন্তর প্রয়াস তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিকতায় নতুন প্রবণতা ও গতি সঞ্চার করেছিল। তিনি দেশের এমন চরম দুঃসময়েও সাংবাদিকতা করেছেন, যখন সাংবাদিকতা করতে যথেষ্ট সাহসী ও কৌশলী হতে হতো। তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি রিপোর্টারদের স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিতেন এই বলে যে সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার অজুহাতই তিনি শুনতে চান না। সংবাদ সম্পাদনা, প্রয়োজনে পুনর্লিখন এবং শিরোনাম প্রদানে তাঁর দক্ষতা সমসাময়িক সাংবাদিকদের বিস্মিত করত। মূসা ভাই পরে অবশ্য বাংলা ভাষাতেই কলাম লিখে যশস্বী হয়েছিলেন এবং এই ভাষার উপস্থাপনাতেও তাঁর দক্ষতা পাঠকের প্রশংসা পেয়েছিল। কেবল একজন খাঁটি প্রতিভারই বোধ হয় এমন রূপান্তর সম্ভব। এ দেশের সাংবাদিকতার একজন প্রধান অগ্রপথিক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা ষোলো আনাই তাঁর নিজস্ব অর্জন। তাঁর যোগ্য শিষ্যরা, যাঁরা এই পেশায় দারুণভাবে সফল হয়েছেন, তাঁরাই মূসার সৃজনশীলতার সাক্ষী। এ দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস এবিএম মূসার অবদানের বিবরণ ও স্বীকৃতি ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
মূসা ভাইয়ের পরিচয় মূলত মুদ্রণমাধ্যমের সাংবাদিক হিসেবেই। যদিও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি একসময় বিটিভির মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সেখানে তিনি খুব একটা স্বস্তি বোধ করেননি বলে নিজেই জানিয়ে গেছেন। তিনি ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষারই জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বিদেশি বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে। সাংবাদিকদের ট্রেনিং প্রদানের ক্ষেত্র প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবেও তাঁর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।
এ দেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মূসা ভাইয়ের অবদান আমরা ভুলতে পারব না। আমরা সাংবাদিকতার শিক্ষকেরা তাঁকে এই প্রক্রিয়ার একজন গুণী শিক্ষক হিসেবেই বিবেচনা করতাম। সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার কাছেই তিনি ছিলেন এক মহিরুহ। খাঁটি পেশাদারি মন নিয়ে যদি এ দেশের সাংবাদিকেরা ঐক্যবদ্ধ পথ চলতে পারেন, তবেই হয়তো মূসা ভাইয়ের মতো দরদি মানুষের স্বপ্ন সফল হবে। মূসা ভাই পাগলের মতো সাংবাদিকদের ঐক্য চেয়ে গেছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য হলেও এ দেশের সাংবাদিকদের অনৈক্যের পথ ছেড়ে ঐক্যের পথে আসা দরকার। এই মহান সাংবাদিকের পথ অনুসরণ করেই এ দেশের সাংবাদিকেরা হয়তো একদিন তাঁদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবেন। সাংবাদিকতাও এগিয়ে যাবে, যাচ্ছে। মনে রাখা দরকার, সময় কারও জন্য বসে থাকে না। মূসা ভাইয়ের মতো মানুষেরা যেমন খোলা মন নিয়ে সব বাধা-বিপত্তির ঊর্ধ্বে ওঠার পথ খুঁজেছেন, সেই আদর্শে উজ্জীবিত হয়েই এ দেশের সাংবাদিকেরাও সঠিক পথটি খুঁজে নেবেন, আজ মূসা ভাইকে স্মরণ করতে গিয়ে সেই কামনাই করছি।
সংক্ষেপিত
সাখাওয়াত আলী খান: অনারারি প্রফেসর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.