খালেদার ওপর হামলা- আজ বিক্ষোভ, কাল হরতাল
কাওরান বাজারে নির্বাচনী পথসভায় এভাবেই চলে অতর্কিত হামলা ছবি: মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন |
সিটি
নির্বাচনের প্রচারণায় নেমে রাজধানীর কাওরান বাজারে হামলার শিকার হয়েছেন
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বৃষ্টির মতো ইট নিক্ষেপ করা হয়েছে
তাকে লক্ষ্য করে। এ হামলায় খালেদা জিয়া অক্ষত থাকলেও তার গাড়ির কাচ ভেঙে
গেছে। আহত হয়েছেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ও সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন।
ভাঙচুর করা হয়েছে বহরের বেশির ভাগ গাড়ি। দলীয় প্রধানের ওপর হামলার জন্য
সরকারকে দায়ী করেছে বিএনপি। গতকাল সন্ধ্যায় নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয়ে এক
সংবাদ সম্মেলনে হামলার প্রতিবাদে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলের
স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া আজ
সারা দেশে বিক্ষোভ ও আগামীকাল সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেন
তিনি। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যত বাধাই আসুক কিছুতেই সিটি নির্বাচনের
প্রচারণা বন্ধ হবে না। এদিকে খালেদা জিয়ার ওপর হামলার পরও তিনি রাত
পর্যন্ত প্রচারণা চালিয়েছেন রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায়। গতকাল তিনি প্রথম
দিনের মতো ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে নির্বাচনী
প্রচারণা চালান। খালেদা জিয়ার ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল তাৎক্ষণিকভাবে দেশের
বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও
বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে আগের দিন পর্যন্ত পুলিশি নিরাপত্তা পেলেও গতকাল
হঠাৎ করেই তার বাসা থেকে পুলিশি নিরাপত্তা তুলে নেয়া হয়। কোন ধরনের সরকারি
নিরাপত্তা ছাড়াই গতকাল তিনি নির্বাচনী প্রচারে বের হয়েছিলেন। যদিও হামলার
ঘটনার পর প্রচারণা চালানোর সময় বিপুলসংখ্যক পুলিশকে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহর
এর আশপাশে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।
গতকাল বিকালে তৃতীয় দিনের মতো সিটি নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় বের হন খালেদা জিয়া। গুলশানের বাসা থেকে বের হয়ে বিকাল পাঁচটার পর কাওরান বাজারের এইচআরসি ভবনের পাশ থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। খালেদা জিয়া গাড়িতে বসেই রাস্তার দুই পাশের লোকজনকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। তার গাড়ির পেছনে ছিল চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী, কর্মকর্তা ও মিডিয়াকর্মীদের কয়েকটি গাড়ি। গাড়ি বহর ধীরে ধীরে কিচেন মার্কেটের দিকে এগোতে থাকে। বাপেক্স ভবনের সামনে গাড়ি বহর থামানোর পর সেখানে স্থানীয় লোকজন ও নেতাকর্মীরা জড়ো হন। এ সময় খালেদা জিয়া গাড়ির ওপরের কাচ সরিয়ে হ্যান্ডমাইকে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। বক্তৃতা চলাকালেই আশপাশের ভবনের ওপর থেকে খালেদা জিয়ার অবস্থান লক্ষ্য করে ইটের টুকরো ছোড়া শুরু হয়। বিষয়টি লক্ষ্য করে খালেদা জিয়া নিজেই হামলাকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘গুন্ডামি বন্ধ করেন। না হলে পরিণতি খারাপ হবে। এরপরও ইটপাটকেল ছোড়া বন্ধ হয়নি। এ সময় আওয়ামী লীগের কর্মীরা ‘জয় বাংলা’সহ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী ও দলের কর্মীরা তৎপর হলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা কিছুটা পেছনে চলে যান। তাদের একটি অংশ ওয়াসা ভবনের সামনের ও সামিট ভবনের সামনের রাস্তায় মিছিল করছিল। একপর্যায়ে তারা সংঘবন্ধ হয়ে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরের পেছন থেকে হামলা ও ভাঙচুর শুরু করে। লাঠি, রড, সড়কের পাশে রাখা নিরাপত্তা স্ট্যান্ড নিয়ে তারা গাড়ি কাচ ভাঙতে শুরু করে। এ সময় চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও ডাবের খোসা ছোড়া হয় গাড়ি বহর লক্ষ্য করে। অবস্থা বেগতিক দেখে খালেদা জিয়াকে গাড়িতে রেখে চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীরা। বহরে থাকা অন্য নেতাকর্মীরাও গাড়িতেই অবস্থান নেন। হামলার সময় সিএসএফ সদস্যদের ওপর ইট পাটকেল পড়লে খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার, তার নিরাপত্তা দল সিএসএফের সদস্য ফজলুল করিম, ফারুক হোসেন ও গাড়িচালক শাহজাদাসহ কয়েকজন আহত হন। তাদের দুজনের মাথা ফেটে যায়। খালেদা জিয়ার গাড়ি ঘিরে থাকা আহত এক সদস্যের গায়ের রক্তের ফোটা গাড়ির সামনের অংশে লেগে গড়িয়ে পড়ে। হামলার সময় ওই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পথচারীরা যে যেদিকে পারেন পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। হামলা চলাকালেই খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরের কাছেই কয়েকজন পুলিশ সদস্য অবস্থান করছিলেন। ওই এলাকা আগে থেকে দায়িত্বে থাকা ওই পুলিশ সদস্যরা প্রথমে হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করে তোপের মুখে পড়েন। একপর্যায়ে তারাও সেখান থেকে সরে যান। হামলা চলাকালেই খালেদা জিয়ার গাড়ি বহর পেট্রোবাংলা ভবনের দিকে নিরাপদে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে সামনের রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা থাকায় হামলাকারীরা বেশ কিছুক্ষণ বহরের পিছু পিছু ধাওয়া করে। হামলার সময় ছবি তুলতে গেলে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলার শিকার হন কয়েকজন ফটো সাংবাদিক। একপর্যায়ে গাড়ি বহর চলতে শুরু করলে হামলাকারীরা পেছন ফিরে মিছিল শুরু করে। ‘কাওরান বাজারের মাটি, ছাত্রলীগের ঘাঁটি’ বলে তাদের মিছিল দিতে দেখা যায়। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বিজিএমইএ ভবন-এর সামনের রাস্তা দিয়ে মগবাজার হয়ে কাকরাইলের দিকে চলে যায়। এসময় ওই এলাকার রাস্তায় কয়েক দফা ঘুরে বেইলি রোড থেকে ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন। এ সময় তার বহরে দলীয় নেতাকর্মীরাও যোগ দেন। বেইলি রোড থেকে মালিবাগ মোড় হয়ে শাহজাহানপুর মোড়ে পৌঁছান খালেদা জিয়া। সেখানে দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অবস্থান করছিলেন। পরে খিলগাঁও রেলগেট, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ও আশপাশের এলাকায় প্রচারণা চালান খালেদা জিয়া। পথে পথে নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্লোগান দেন। হামলার পর নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও খালেদা জিয়া তার গাড়ি থেকে নামেননি। এ দিকে রাতে আহতদের দেখতে ইউনাইটেড হাসপাতালে যান খালেদা জিয়া। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগের আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে খোঁজখবর নেন।
আজ বিক্ষোভ, কাল হরতাল
নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় রাজধানীর কাওরান বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার প্রতিবাদে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাড়া সারা দেশে আজ বিক্ষোভ ও আগামীকাল হরতাল কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় কাওরান বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়িবহরে ভাঙচুর ও সশস্ত্র হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। এমনকি তারা অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করেছে। এটি সরকারের ফ্যাসিবাদী ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা পুলিশের সহযোগিতায় খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচার অভিযানের প্রতিটি স্থানে বাধা দেয়া সত্ত্বেও তিনি তার প্রচার অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। মওদুদ আহমেদ বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসার সামনে থেকে পুলিশি প্রহরা প্রত্যাহার এবং তার গাড়িবহর থেকে পুলিশি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা থেকেই বুঝা যায় তার ওপর হামলা সরকারের পূর্বপরিকল্পনারই অংশ। বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরামের এ সদস্য বলেন, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনেই সরকার এ ধরনের ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসী তাণ্ডবের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এটি সরকারের দুর্বলতারই প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা অতি সমপ্রতি বিএনপি চেয়ারপারসনকে নির্বাচনী প্রচারণায় বেরুলে প্রতিহত করার যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাই তাদের সশস্ত্র গুণ্ডাদের আজকের সন্ত্রাসী হামলায় উস্কানি দিয়েছে। পুলিশের আইজিপিও নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় তার বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রতিহত করতে প্রয়োজনে আইন প্রণয়নের জন্য ওপেন বক্তব্য দিয়েছে। আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনীকে খালেদা জিয়ার ওপর হামলা করার জন্য এই উস্কানি দিয়েছে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম ব্যতীত সারা দেশে ২০ দলীয় জোটের উদ্যোগে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি শহর ছাড়া সারা দেশে আগামীকাল বুধবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হবে। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, আমরা সরকারকে স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে আমাদেরকে ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্য করবেন না। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, যত বাধা আসুক না কেন, নির্বাচনী প্রচারণা চলবে। এটা কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না। সমর্থনের যে স্রোত দেখা যাচ্ছে তিন সিটিতেই বিজয় লাভ করবে বিএনপি প্রার্থীরা। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ, যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, দপ্তরের দায়িত্ব আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী আসাদ, সহ-দপ্তর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীন উপস্থিতি ছিলেন। এদিকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার প্রতিবাদে রাজধানীর হাতিরপুল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহসভাপতি মামুনুর রশীদ মামুনের নেতৃত্বে এ মিছিলে শতাধিক ছাত্রদল নেতাকর্মী অংশ নেন। এদিকে এ হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল এনডিপি। গতকাল এক বিবৃতিতে এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসা বলেন, খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে কাওরান বাজারে তাকে হত্যা করার উদ্দেশে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার না করলে সরকারকে কঠিন মাশুল গুনতে হবে। আর জনগণ আগামী ২৮শে এপ্রিল তিন সিটি নির্বাচনে গুলি, বুলেট, রক্তের জবাব ব্যালটের মাধ্যমে দেবে।
‘উলটাপালটা’ বক্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএনপির আহ্বান
এদিকে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ নিয়ে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের ‘অশালীন’ ও ‘উলটাপালটা’ বক্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের দপ্তরের দায়িত্ব পালনকারী আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রোববার উত্তরায় নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় খালেদা জিয়াকে কালো পতাকা প্রদর্শন ও পথে পথে তার গাড়িবহরকে বাধা দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার মাধ্যমে শাসক দল নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। এ সময় বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের গ্রেপ্তার, প্রার্থীদের প্রচারে বাধা দেয়ার ঘটনারও নিন্দা জানান তিনি। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মে. জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান, শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসাইন ও বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল বিকালে তৃতীয় দিনের মতো সিটি নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় বের হন খালেদা জিয়া। গুলশানের বাসা থেকে বের হয়ে বিকাল পাঁচটার পর কাওরান বাজারের এইচআরসি ভবনের পাশ থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। খালেদা জিয়া গাড়িতে বসেই রাস্তার দুই পাশের লোকজনকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। তার গাড়ির পেছনে ছিল চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী, কর্মকর্তা ও মিডিয়াকর্মীদের কয়েকটি গাড়ি। গাড়ি বহর ধীরে ধীরে কিচেন মার্কেটের দিকে এগোতে থাকে। বাপেক্স ভবনের সামনে গাড়ি বহর থামানোর পর সেখানে স্থানীয় লোকজন ও নেতাকর্মীরা জড়ো হন। এ সময় খালেদা জিয়া গাড়ির ওপরের কাচ সরিয়ে হ্যান্ডমাইকে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। বক্তৃতা চলাকালেই আশপাশের ভবনের ওপর থেকে খালেদা জিয়ার অবস্থান লক্ষ্য করে ইটের টুকরো ছোড়া শুরু হয়। বিষয়টি লক্ষ্য করে খালেদা জিয়া নিজেই হামলাকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘গুন্ডামি বন্ধ করেন। না হলে পরিণতি খারাপ হবে। এরপরও ইটপাটকেল ছোড়া বন্ধ হয়নি। এ সময় আওয়ামী লীগের কর্মীরা ‘জয় বাংলা’সহ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী ও দলের কর্মীরা তৎপর হলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা কিছুটা পেছনে চলে যান। তাদের একটি অংশ ওয়াসা ভবনের সামনের ও সামিট ভবনের সামনের রাস্তায় মিছিল করছিল। একপর্যায়ে তারা সংঘবন্ধ হয়ে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরের পেছন থেকে হামলা ও ভাঙচুর শুরু করে। লাঠি, রড, সড়কের পাশে রাখা নিরাপত্তা স্ট্যান্ড নিয়ে তারা গাড়ি কাচ ভাঙতে শুরু করে। এ সময় চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও ডাবের খোসা ছোড়া হয় গাড়ি বহর লক্ষ্য করে। অবস্থা বেগতিক দেখে খালেদা জিয়াকে গাড়িতে রেখে চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীরা। বহরে থাকা অন্য নেতাকর্মীরাও গাড়িতেই অবস্থান নেন। হামলার সময় সিএসএফ সদস্যদের ওপর ইট পাটকেল পড়লে খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার, তার নিরাপত্তা দল সিএসএফের সদস্য ফজলুল করিম, ফারুক হোসেন ও গাড়িচালক শাহজাদাসহ কয়েকজন আহত হন। তাদের দুজনের মাথা ফেটে যায়। খালেদা জিয়ার গাড়ি ঘিরে থাকা আহত এক সদস্যের গায়ের রক্তের ফোটা গাড়ির সামনের অংশে লেগে গড়িয়ে পড়ে। হামলার সময় ওই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পথচারীরা যে যেদিকে পারেন পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। হামলা চলাকালেই খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরের কাছেই কয়েকজন পুলিশ সদস্য অবস্থান করছিলেন। ওই এলাকা আগে থেকে দায়িত্বে থাকা ওই পুলিশ সদস্যরা প্রথমে হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করে তোপের মুখে পড়েন। একপর্যায়ে তারাও সেখান থেকে সরে যান। হামলা চলাকালেই খালেদা জিয়ার গাড়ি বহর পেট্রোবাংলা ভবনের দিকে নিরাপদে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে সামনের রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা থাকায় হামলাকারীরা বেশ কিছুক্ষণ বহরের পিছু পিছু ধাওয়া করে। হামলার সময় ছবি তুলতে গেলে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলার শিকার হন কয়েকজন ফটো সাংবাদিক। একপর্যায়ে গাড়ি বহর চলতে শুরু করলে হামলাকারীরা পেছন ফিরে মিছিল শুরু করে। ‘কাওরান বাজারের মাটি, ছাত্রলীগের ঘাঁটি’ বলে তাদের মিছিল দিতে দেখা যায়। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বিজিএমইএ ভবন-এর সামনের রাস্তা দিয়ে মগবাজার হয়ে কাকরাইলের দিকে চলে যায়। এসময় ওই এলাকার রাস্তায় কয়েক দফা ঘুরে বেইলি রোড থেকে ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন। এ সময় তার বহরে দলীয় নেতাকর্মীরাও যোগ দেন। বেইলি রোড থেকে মালিবাগ মোড় হয়ে শাহজাহানপুর মোড়ে পৌঁছান খালেদা জিয়া। সেখানে দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অবস্থান করছিলেন। পরে খিলগাঁও রেলগেট, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ও আশপাশের এলাকায় প্রচারণা চালান খালেদা জিয়া। পথে পথে নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্লোগান দেন। হামলার পর নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও খালেদা জিয়া তার গাড়ি থেকে নামেননি। এ দিকে রাতে আহতদের দেখতে ইউনাইটেড হাসপাতালে যান খালেদা জিয়া। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগের আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে খোঁজখবর নেন।
আজ বিক্ষোভ, কাল হরতাল
নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় রাজধানীর কাওরান বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার প্রতিবাদে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাড়া সারা দেশে আজ বিক্ষোভ ও আগামীকাল হরতাল কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় কাওরান বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়িবহরে ভাঙচুর ও সশস্ত্র হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। এমনকি তারা অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করেছে। এটি সরকারের ফ্যাসিবাদী ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা পুলিশের সহযোগিতায় খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচার অভিযানের প্রতিটি স্থানে বাধা দেয়া সত্ত্বেও তিনি তার প্রচার অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। মওদুদ আহমেদ বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসার সামনে থেকে পুলিশি প্রহরা প্রত্যাহার এবং তার গাড়িবহর থেকে পুলিশি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা থেকেই বুঝা যায় তার ওপর হামলা সরকারের পূর্বপরিকল্পনারই অংশ। বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরামের এ সদস্য বলেন, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনেই সরকার এ ধরনের ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসী তাণ্ডবের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এটি সরকারের দুর্বলতারই প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা অতি সমপ্রতি বিএনপি চেয়ারপারসনকে নির্বাচনী প্রচারণায় বেরুলে প্রতিহত করার যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাই তাদের সশস্ত্র গুণ্ডাদের আজকের সন্ত্রাসী হামলায় উস্কানি দিয়েছে। পুলিশের আইজিপিও নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় তার বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রতিহত করতে প্রয়োজনে আইন প্রণয়নের জন্য ওপেন বক্তব্য দিয়েছে। আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনীকে খালেদা জিয়ার ওপর হামলা করার জন্য এই উস্কানি দিয়েছে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম ব্যতীত সারা দেশে ২০ দলীয় জোটের উদ্যোগে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি শহর ছাড়া সারা দেশে আগামীকাল বুধবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হবে। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, আমরা সরকারকে স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে আমাদেরকে ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্য করবেন না। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, যত বাধা আসুক না কেন, নির্বাচনী প্রচারণা চলবে। এটা কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না। সমর্থনের যে স্রোত দেখা যাচ্ছে তিন সিটিতেই বিজয় লাভ করবে বিএনপি প্রার্থীরা। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ, যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, দপ্তরের দায়িত্ব আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী আসাদ, সহ-দপ্তর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীন উপস্থিতি ছিলেন। এদিকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার প্রতিবাদে রাজধানীর হাতিরপুল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহসভাপতি মামুনুর রশীদ মামুনের নেতৃত্বে এ মিছিলে শতাধিক ছাত্রদল নেতাকর্মী অংশ নেন। এদিকে এ হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল এনডিপি। গতকাল এক বিবৃতিতে এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসা বলেন, খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে কাওরান বাজারে তাকে হত্যা করার উদ্দেশে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার না করলে সরকারকে কঠিন মাশুল গুনতে হবে। আর জনগণ আগামী ২৮শে এপ্রিল তিন সিটি নির্বাচনে গুলি, বুলেট, রক্তের জবাব ব্যালটের মাধ্যমে দেবে।
‘উলটাপালটা’ বক্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএনপির আহ্বান
এদিকে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ নিয়ে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের ‘অশালীন’ ও ‘উলটাপালটা’ বক্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের দপ্তরের দায়িত্ব পালনকারী আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রোববার উত্তরায় নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় খালেদা জিয়াকে কালো পতাকা প্রদর্শন ও পথে পথে তার গাড়িবহরকে বাধা দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার মাধ্যমে শাসক দল নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। এ সময় বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের গ্রেপ্তার, প্রার্থীদের প্রচারে বাধা দেয়ার ঘটনারও নিন্দা জানান তিনি। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মে. জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান, শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসাইন ও বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম উপস্থিত ছিলেন।
No comments