সাক্ষাৎকার- রাজনীতি ছাড়া পরিবর্তন আসবে না by মাহমুদ মানজুর
ঢাকা উত্তরে সহস্র নাগরিক কমিটি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী আনিসুল হক। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই সরব নির্বাচনী প্রচারণায়। ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও নির্বাচন করছেন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন নিয়ে। মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন নগর নিয়ে তার ভাবনার কথা। নির্বাচনী প্রস্তুতি আর প্রত্যাশার কথাও তুলে ধরেছেন তার ভাষায়।
নির্বাচনে একজন প্রার্থী হিসেবে প্রচার-প্রচারণায় কেমন অনুভব করছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে নতুন নয়। আগেও বহু কঠিন নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। তবে সেগুলো ছিলো ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচন। আর এটাতো জনপ্রতিনিধি হওয়ার নির্বাচন। অল্প সময়ের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের কাছে যেতে হচ্ছে। এই নির্বাচন অবশ্যই আলাদা কিছু, অন্যরকম অভিজ্ঞতা। পরিশ্রম নিয়ে কোন ভয় নেই, জীবনভর পরিশ্রমই করেছি। আমার চিন্তা হচ্ছে সময়মতো সব ভোটারের কাছে পৌঁছাতে পারবো কিনা? খুব সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আপ্রাণ সেই চেষ্টা করছি। মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে, উৎসাহ যোগাচ্ছে, সহানুভূতি, ভালোবাসা দেখাচ্ছে- ফলে কোন সমস্যা হচ্ছে না। বরং ভালোই লাগছে।
এতদিনের প্রচারণায় ভোটারদের প্রত্যাশার মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোটাররা মেয়র হিসেবে এমন কাউকে চাইছেন যে জনগণের হৃদয়ের ভাষা বুঝতে পারবে, জনগণের চাওয়াগুলোকে নিজের মনে করবে, জনগণের স্বপ্ন পূরণের সারথী হবে, বিপদে-আপদে পাশে থাকবে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে, পেছন থেকে সাহস দেবে, পাশে থেকে সামনে এগুনোর অনুপ্রেরণা জোগাবে। যে কারণে আমি শুরু থেকেই বলছি জনগণ জিতলে আমরা জিতবো। আমার স্বপ্ন তো জনগণেরই স্বপ্ন।
প্রায় প্রতিদিন ঢাকার অলিতে-গলিতে ঘুরছেন। নিশ্চয়ই নতুন করে ঢাকাকে আবিষ্কার করছেন। এমন কোন বিষয় চোখে পড়েছে যা দেখে আপনি অবাক হয়েছেন, এমন প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, প্রতিদিন অবাক হওয়ার মতো নানা বিষয় লক্ষ্য করছি। এতো মানুষ আমাকে চেনে, এতো ভালোবাসে নির্বাচনে অংশ না নিলে কোনদিন জানা হতো না। কত জায়গা থেকে কত রকমের মানুষ আসছে; সহযোগিতা করতে চাইছে, পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, প্রখর রোদ আর তীব্র গরমের মধ্যে আমার সঙ্গে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটছে। নিজেদের মতো করে টেবিল ঘড়ি মার্কায় ভোট চাইছে। অবিশ্বাস্য। তবে একটা জিনিস ভীষণ পীড়া দিচ্ছে, সেটা হলো দারিদ্র্য। দরিদ্র মানুষের কষ্ট। কত শত হাজার মানুষ সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় শহরে এসে যে এতো কষ্ট করে, বস্তিগুলোতে না গেলে বুঝতেই পারতাম না। অবশ্য নির্বাচনী ইশতেহারে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আমরা স্বাস্থ্যকর বসতি নির্মাণসহ নানা কর্মসূচি রেখেছি। শহরে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমি মনে করি এই মানুষগুলোর জীবনের উন্নতি ঘটাতে না পারলে শহরের উন্নতি হবে না। ফলে অতিদরিদ্র, দরিদ্র, বস্তিবাসী, ভাসমান মানুষদের জন্য সবাই মিলে অনেক কাজ করতে হবে। যদিও এই জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের অনেক কর্মসূচি আছে, এই মানুষগুলোর জন্য আমাদের অনেক কিছু করার সুযোগ আছে।
আপনি সফল একজন মানুষ। ব্যবসা, নেতৃত্বে, উপস্থাপনায়, সংসারে। সাফল্যের পেছনে কি কাজ করে- আমি সাধারণ মানুষ, মেহনত করি। আমি বিশ্বাস করি কঠোর পরিশ্রম ছাড়া সাফল্য অর্জনের কোন শর্টকার্ট রাস্তা নেই। তাই পরিশ্রম ছাড়া সাফল্যের আর কোন রহস্য নেই। জীবনভর পরিশ্রম করেছি, এখনও দিন-রাত কাজ করি, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই। কতটা সফল হয়েছি তা জানি না। শুধু মনে হয় অনেক কিছু করার ছিলো, কিন্তু করা হয়নি কোন কিছুই। তাছাড়া, সাফল্যের সংজ্ঞা এক একজনের কাছে এক একরকম। আমি যা করি, সততার সঙ্গে করি। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। আমার যদি কোন অর্জন থাকে তার পেছনে আছে পরিশ্রম, সততা এবং আত্মবিশ্বাস।
নির্বাচনে সফলতা নিয়ে আপনি নিজে কতটা আশাবাদী জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ঢাকা উত্তরের নাগরিকরা আমাকে টেবিল ঘড়ি মার্কায় ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে বলে আমার বিশ্বাস। কেননা, যেখানেই যাচ্ছি নাগরিকরা আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে, পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ফলে আমার তো মনে হচ্ছে মানুষ শেষ পর্যন্ত আমাকেই বেছে নেবে।
মেয়র নির্বাচিত হলে কোন তিনটি কাজে অগ্রাধিকার দেবেন- এমন প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, আমরা তো শুরু থেকেই বলে আসছি আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে পরিচ্ছন্ন ঢাকা, সবুজ ঢাকা, মানবিক ঢাকা এবং আলোকিত ঢাকা। যদি জয়ী হই তবে প্রথম কাজ হবে নাগরিকদের মশার উৎপাত থেকে বাঁচানো এবং শহর পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করা।
একজন সিটি মেয়রের যে ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা- এসব উতরে নিজের পরিকল্পনামাফিক কাজ করা কি সম্ভব? আপনি কি মনে করেন মেয়রের আরও বেশি ক্ষমতায়ন প্রয়োজন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আইনে মেয়রের ২৮ ধরনের কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। জনগুরুত্বপূর্ণ এসব কাজ করার ক্ষেত্রে মেয়রের আইনি কর্তৃত্বের অভাব আছে- একথা সবাই বলে। আমিও আইনটি যতটা পড়েছি তাতে মনে হয়েছে সরকার চাইলে নির্বাচিত মেয়রদের আরেকটু ক্ষমতা দিতে পারে। কেননা, মেয়ররা যেসব কাজ করবেন তার সুফল শেষ পর্যন্ত জনগণের এবং ক্রেডিট সরকারের ঘরেই যাবে। তাই, আমার মনে হয় কাজ করার জন্য আইন কোন সমস্যা নয়। ইচ্ছে আর স্পৃহা হলো আসল বিষয়। আপনি কি করতে চান তা নির্ভর করে, আপনার ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব এবং ভিশনের ওপর। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব। জনগণের জন্য কাজ করলে আপনাকে কেউ বাধা দেবে না। আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে আপনি কোথাও আটকে যেতে পারেন, তাই বলে থেমে যেতে পারেন না। চেষ্টা করে চালিয়ে যেতে হবে।
আপনি বার বার বলে আসছেন দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমর্থন পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনও আছে। এই সমর্থন আপনার জয়ে ভূমিকা রাখবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সৌভাগ্যবান যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগসহ বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএ’র মতো শীর্ষ তিন ব্যবসায়ী সংগঠন আমাকে সমর্থন দিয়েছে। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাদের সমর্থন অবশ্যই ভোটারদের মধ্যে টেবিল ঘড়ি প্রতীক বা আমার সম্পর্কে একটা ইতিবাচক বার্তা দেবে।
আপনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। তার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাবিথের বাবা আব্দুল আওয়াল মিন্টু আমার বন্ধু। তাবিথ ভালো ছেলে, কিন্তু তার বয়স অনেক কম। তার সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। পাবলিক অফিসের দায়িত্ব নেয়ার জন্য এখনই সে যথেষ্ট প্রস্তুত নয় বলে আমার ধারণা। যদিও সে একটি বড় দলের সমর্থন পেয়েছে। অন্য প্রার্থীদের প্রসঙ্গে আনিসুল হক বলেন, জনগণ তো এমনই প্রত্যাশা করে। আমরা ভিন্ন মতপথের হতে পারি কিন্তু আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষা একটি সুন্দর ঢাকা। বিশাল এ কাজটি তো একা কেউ করতে পারবে না, সবাই মিলে করতে হবে। ফলে সবার মধ্যে সুসম্পর্ক থাকাটাই তো ভালো।
সামপ্রতিক সময়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোর প্রচারণা চালিয়েছে- ‘আনিসুল হকের পিতা রাজাকার ছিলেন’। এমন প্রচারণা বিষয়ে আপনার কোন বক্তব্য আছে কিনা জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর তো বহুবার দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল থেকে এ বিষয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। যিনি ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘স্মৃতিতে অমলিন’ নামে বাবার একটি স্মৃতিচারণামূলক বই আছে। আপনারা পড়ে দেখতে পারেন। নির্বাচনের মাঠে হেয় করতেই এমন নিউজ করানো হয়েছিলো বলে আমার ধারণা।
প্রচারণায়ও আপনাকে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কাছ থেকে তীর্যক বক্তব্য আসছে- এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন প্রার্থী আরেকজন প্রার্থী সম্পর্কে কুৎসা রটাবেন, এটাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি বোধ হয়। এটাই এদেশে স্বাভাবিক ব্যাপার, তবে আমি সেটা করবো না। তারা যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে এসেছেন, যে রাজনৈতিক শিক্ষা পেয়েছেন, তাতে কুৎসা প্রচারই তাদের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু আমি শুধু আমার কথাই বলবো, আমার নির্বাচনী ইশতেহার ও জনসেবার প্রস্তাবগুলো জনগণের কাছে নিয়ে যাবো, কুৎসা প্রচারের অপসংস্কৃতি চর্চা করবো না। কথা দিলাম। সিটি করপোরেশন এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ির সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে জনগণের সেবা করা সম্ভব নয়।
আপনি একজন ব্যবসায়ী, অনেকে বলেন, মেয়র নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের কথা ভুলে যাবেন? আনিসুল হককে এমন প্রশ্ন ছুড়লে তিনি বলেন, যারা এইসব বলে, তারা জানে না আমার জীবনের কষ্ট। তারা জানে না আমার মা কষ্ট করে আমার বাবার প্যান্ট রিফু করে দিতেন, একটা প্যান্ট কিনতেন না। তারা জানে না যে আমি বাবার ৬৪ হাজার টাকা নিয়ে জীবন শুরু করতে গিয়ে এক রাতে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম। আমিতো সেই গরিব জীবনটাকে ভুলে যাইনি। বরং এখন যারা গরিব, যারা জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন- তাদের মাঝেই আমি আমাকে খুঁজে পাই।
ব্যবসার মাঠ থেকে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনীতি ছাড়া তো কোন পরিবর্তন আসবে না। রাজনীতিবিদরাই আমাদের নেতৃত্ব দেন। তারাই দেশ চালান। পরিকল্পনা করেন, সে অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তাদের অবদান তো অস্বীকার করা যাবে না। তাছাড়া, আপনি কোন সিস্টেম বদলাতে চাইলে আপনাকে সেই সিস্টেমের নেতা হতে হবে। আসলে কি, আমরা এভাবে ভাবি বলেই রাজনীতি বদলায় না। ইতিবাচক হন, দেখবেন সব বদলে যাবে।
নিজের সামাজিক উদ্যোগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শারাফ আমাদের সন্তান। অনেক আগে মারা গেছে। তার স্মৃতি ধরে রাখতে আমরা আমাদের গার্মেন্টস কর্মীদের সন্তানদের জন্য ‘শারাফের পাঠশালা’ নামে প্রি স্কুল পরিচালনা করছি। এই স্কুলে আমরা বিনা বেতনে বা ফ্রি শিক্ষা দিয়ে থাকি। এ মুহূর্তে আমরা দুটি স্কুল করছি। ভবিষ্যতে আরো স্কুল করবো ইনশাআল্লাহ। এই মুহূর্তে গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য স্বল্পমূল্যে বসতি নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছি। এর বাইরেও আমরা আরো কিছু কাজ করি সেগুলো একান্তই আমাদের নিজস্ব, যা সবার সঙ্গে শেয়ার করতে চাই না। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মানুষ এই মূল্যায়ন করবে। যেভাবেই হোক মানুষের কল্যাণই আমার লক্ষ্য। সে কাজটাই জীবনভর করছি। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে অতি নগণ্য হলেও ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি। মেয়র নির্বাচিত হলে আরেকটু বড় পরিসরে কাজ করতে পারবো। এই যা।
নির্বাচনে একজন প্রার্থী হিসেবে প্রচার-প্রচারণায় কেমন অনুভব করছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে নতুন নয়। আগেও বহু কঠিন নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। তবে সেগুলো ছিলো ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচন। আর এটাতো জনপ্রতিনিধি হওয়ার নির্বাচন। অল্প সময়ের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের কাছে যেতে হচ্ছে। এই নির্বাচন অবশ্যই আলাদা কিছু, অন্যরকম অভিজ্ঞতা। পরিশ্রম নিয়ে কোন ভয় নেই, জীবনভর পরিশ্রমই করেছি। আমার চিন্তা হচ্ছে সময়মতো সব ভোটারের কাছে পৌঁছাতে পারবো কিনা? খুব সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আপ্রাণ সেই চেষ্টা করছি। মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে, উৎসাহ যোগাচ্ছে, সহানুভূতি, ভালোবাসা দেখাচ্ছে- ফলে কোন সমস্যা হচ্ছে না। বরং ভালোই লাগছে।
এতদিনের প্রচারণায় ভোটারদের প্রত্যাশার মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোটাররা মেয়র হিসেবে এমন কাউকে চাইছেন যে জনগণের হৃদয়ের ভাষা বুঝতে পারবে, জনগণের চাওয়াগুলোকে নিজের মনে করবে, জনগণের স্বপ্ন পূরণের সারথী হবে, বিপদে-আপদে পাশে থাকবে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে, পেছন থেকে সাহস দেবে, পাশে থেকে সামনে এগুনোর অনুপ্রেরণা জোগাবে। যে কারণে আমি শুরু থেকেই বলছি জনগণ জিতলে আমরা জিতবো। আমার স্বপ্ন তো জনগণেরই স্বপ্ন।
প্রায় প্রতিদিন ঢাকার অলিতে-গলিতে ঘুরছেন। নিশ্চয়ই নতুন করে ঢাকাকে আবিষ্কার করছেন। এমন কোন বিষয় চোখে পড়েছে যা দেখে আপনি অবাক হয়েছেন, এমন প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, প্রতিদিন অবাক হওয়ার মতো নানা বিষয় লক্ষ্য করছি। এতো মানুষ আমাকে চেনে, এতো ভালোবাসে নির্বাচনে অংশ না নিলে কোনদিন জানা হতো না। কত জায়গা থেকে কত রকমের মানুষ আসছে; সহযোগিতা করতে চাইছে, পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, প্রখর রোদ আর তীব্র গরমের মধ্যে আমার সঙ্গে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটছে। নিজেদের মতো করে টেবিল ঘড়ি মার্কায় ভোট চাইছে। অবিশ্বাস্য। তবে একটা জিনিস ভীষণ পীড়া দিচ্ছে, সেটা হলো দারিদ্র্য। দরিদ্র মানুষের কষ্ট। কত শত হাজার মানুষ সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় শহরে এসে যে এতো কষ্ট করে, বস্তিগুলোতে না গেলে বুঝতেই পারতাম না। অবশ্য নির্বাচনী ইশতেহারে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আমরা স্বাস্থ্যকর বসতি নির্মাণসহ নানা কর্মসূচি রেখেছি। শহরে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমি মনে করি এই মানুষগুলোর জীবনের উন্নতি ঘটাতে না পারলে শহরের উন্নতি হবে না। ফলে অতিদরিদ্র, দরিদ্র, বস্তিবাসী, ভাসমান মানুষদের জন্য সবাই মিলে অনেক কাজ করতে হবে। যদিও এই জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের অনেক কর্মসূচি আছে, এই মানুষগুলোর জন্য আমাদের অনেক কিছু করার সুযোগ আছে।
আপনি সফল একজন মানুষ। ব্যবসা, নেতৃত্বে, উপস্থাপনায়, সংসারে। সাফল্যের পেছনে কি কাজ করে- আমি সাধারণ মানুষ, মেহনত করি। আমি বিশ্বাস করি কঠোর পরিশ্রম ছাড়া সাফল্য অর্জনের কোন শর্টকার্ট রাস্তা নেই। তাই পরিশ্রম ছাড়া সাফল্যের আর কোন রহস্য নেই। জীবনভর পরিশ্রম করেছি, এখনও দিন-রাত কাজ করি, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই। কতটা সফল হয়েছি তা জানি না। শুধু মনে হয় অনেক কিছু করার ছিলো, কিন্তু করা হয়নি কোন কিছুই। তাছাড়া, সাফল্যের সংজ্ঞা এক একজনের কাছে এক একরকম। আমি যা করি, সততার সঙ্গে করি। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। আমার যদি কোন অর্জন থাকে তার পেছনে আছে পরিশ্রম, সততা এবং আত্মবিশ্বাস।
নির্বাচনে সফলতা নিয়ে আপনি নিজে কতটা আশাবাদী জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ঢাকা উত্তরের নাগরিকরা আমাকে টেবিল ঘড়ি মার্কায় ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে বলে আমার বিশ্বাস। কেননা, যেখানেই যাচ্ছি নাগরিকরা আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে, পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ফলে আমার তো মনে হচ্ছে মানুষ শেষ পর্যন্ত আমাকেই বেছে নেবে।
মেয়র নির্বাচিত হলে কোন তিনটি কাজে অগ্রাধিকার দেবেন- এমন প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, আমরা তো শুরু থেকেই বলে আসছি আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে পরিচ্ছন্ন ঢাকা, সবুজ ঢাকা, মানবিক ঢাকা এবং আলোকিত ঢাকা। যদি জয়ী হই তবে প্রথম কাজ হবে নাগরিকদের মশার উৎপাত থেকে বাঁচানো এবং শহর পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করা।
একজন সিটি মেয়রের যে ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা- এসব উতরে নিজের পরিকল্পনামাফিক কাজ করা কি সম্ভব? আপনি কি মনে করেন মেয়রের আরও বেশি ক্ষমতায়ন প্রয়োজন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আইনে মেয়রের ২৮ ধরনের কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। জনগুরুত্বপূর্ণ এসব কাজ করার ক্ষেত্রে মেয়রের আইনি কর্তৃত্বের অভাব আছে- একথা সবাই বলে। আমিও আইনটি যতটা পড়েছি তাতে মনে হয়েছে সরকার চাইলে নির্বাচিত মেয়রদের আরেকটু ক্ষমতা দিতে পারে। কেননা, মেয়ররা যেসব কাজ করবেন তার সুফল শেষ পর্যন্ত জনগণের এবং ক্রেডিট সরকারের ঘরেই যাবে। তাই, আমার মনে হয় কাজ করার জন্য আইন কোন সমস্যা নয়। ইচ্ছে আর স্পৃহা হলো আসল বিষয়। আপনি কি করতে চান তা নির্ভর করে, আপনার ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব এবং ভিশনের ওপর। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব। জনগণের জন্য কাজ করলে আপনাকে কেউ বাধা দেবে না। আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে আপনি কোথাও আটকে যেতে পারেন, তাই বলে থেমে যেতে পারেন না। চেষ্টা করে চালিয়ে যেতে হবে।
আপনি বার বার বলে আসছেন দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমর্থন পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনও আছে। এই সমর্থন আপনার জয়ে ভূমিকা রাখবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সৌভাগ্যবান যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগসহ বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএ’র মতো শীর্ষ তিন ব্যবসায়ী সংগঠন আমাকে সমর্থন দিয়েছে। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাদের সমর্থন অবশ্যই ভোটারদের মধ্যে টেবিল ঘড়ি প্রতীক বা আমার সম্পর্কে একটা ইতিবাচক বার্তা দেবে।
আপনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। তার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাবিথের বাবা আব্দুল আওয়াল মিন্টু আমার বন্ধু। তাবিথ ভালো ছেলে, কিন্তু তার বয়স অনেক কম। তার সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। পাবলিক অফিসের দায়িত্ব নেয়ার জন্য এখনই সে যথেষ্ট প্রস্তুত নয় বলে আমার ধারণা। যদিও সে একটি বড় দলের সমর্থন পেয়েছে। অন্য প্রার্থীদের প্রসঙ্গে আনিসুল হক বলেন, জনগণ তো এমনই প্রত্যাশা করে। আমরা ভিন্ন মতপথের হতে পারি কিন্তু আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষা একটি সুন্দর ঢাকা। বিশাল এ কাজটি তো একা কেউ করতে পারবে না, সবাই মিলে করতে হবে। ফলে সবার মধ্যে সুসম্পর্ক থাকাটাই তো ভালো।
সামপ্রতিক সময়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোর প্রচারণা চালিয়েছে- ‘আনিসুল হকের পিতা রাজাকার ছিলেন’। এমন প্রচারণা বিষয়ে আপনার কোন বক্তব্য আছে কিনা জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর তো বহুবার দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল থেকে এ বিষয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। যিনি ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘স্মৃতিতে অমলিন’ নামে বাবার একটি স্মৃতিচারণামূলক বই আছে। আপনারা পড়ে দেখতে পারেন। নির্বাচনের মাঠে হেয় করতেই এমন নিউজ করানো হয়েছিলো বলে আমার ধারণা।
প্রচারণায়ও আপনাকে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কাছ থেকে তীর্যক বক্তব্য আসছে- এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন প্রার্থী আরেকজন প্রার্থী সম্পর্কে কুৎসা রটাবেন, এটাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি বোধ হয়। এটাই এদেশে স্বাভাবিক ব্যাপার, তবে আমি সেটা করবো না। তারা যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে এসেছেন, যে রাজনৈতিক শিক্ষা পেয়েছেন, তাতে কুৎসা প্রচারই তাদের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু আমি শুধু আমার কথাই বলবো, আমার নির্বাচনী ইশতেহার ও জনসেবার প্রস্তাবগুলো জনগণের কাছে নিয়ে যাবো, কুৎসা প্রচারের অপসংস্কৃতি চর্চা করবো না। কথা দিলাম। সিটি করপোরেশন এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ির সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে জনগণের সেবা করা সম্ভব নয়।
আপনি একজন ব্যবসায়ী, অনেকে বলেন, মেয়র নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের কথা ভুলে যাবেন? আনিসুল হককে এমন প্রশ্ন ছুড়লে তিনি বলেন, যারা এইসব বলে, তারা জানে না আমার জীবনের কষ্ট। তারা জানে না আমার মা কষ্ট করে আমার বাবার প্যান্ট রিফু করে দিতেন, একটা প্যান্ট কিনতেন না। তারা জানে না যে আমি বাবার ৬৪ হাজার টাকা নিয়ে জীবন শুরু করতে গিয়ে এক রাতে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম। আমিতো সেই গরিব জীবনটাকে ভুলে যাইনি। বরং এখন যারা গরিব, যারা জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন- তাদের মাঝেই আমি আমাকে খুঁজে পাই।
ব্যবসার মাঠ থেকে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনীতি ছাড়া তো কোন পরিবর্তন আসবে না। রাজনীতিবিদরাই আমাদের নেতৃত্ব দেন। তারাই দেশ চালান। পরিকল্পনা করেন, সে অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তাদের অবদান তো অস্বীকার করা যাবে না। তাছাড়া, আপনি কোন সিস্টেম বদলাতে চাইলে আপনাকে সেই সিস্টেমের নেতা হতে হবে। আসলে কি, আমরা এভাবে ভাবি বলেই রাজনীতি বদলায় না। ইতিবাচক হন, দেখবেন সব বদলে যাবে।
নিজের সামাজিক উদ্যোগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শারাফ আমাদের সন্তান। অনেক আগে মারা গেছে। তার স্মৃতি ধরে রাখতে আমরা আমাদের গার্মেন্টস কর্মীদের সন্তানদের জন্য ‘শারাফের পাঠশালা’ নামে প্রি স্কুল পরিচালনা করছি। এই স্কুলে আমরা বিনা বেতনে বা ফ্রি শিক্ষা দিয়ে থাকি। এ মুহূর্তে আমরা দুটি স্কুল করছি। ভবিষ্যতে আরো স্কুল করবো ইনশাআল্লাহ। এই মুহূর্তে গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য স্বল্পমূল্যে বসতি নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছি। এর বাইরেও আমরা আরো কিছু কাজ করি সেগুলো একান্তই আমাদের নিজস্ব, যা সবার সঙ্গে শেয়ার করতে চাই না। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মানুষ এই মূল্যায়ন করবে। যেভাবেই হোক মানুষের কল্যাণই আমার লক্ষ্য। সে কাজটাই জীবনভর করছি। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে অতি নগণ্য হলেও ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি। মেয়র নির্বাচিত হলে আরেকটু বড় পরিসরে কাজ করতে পারবো। এই যা।
No comments