পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে by এ কে এম শাহনাওয়াজ
ছোটবেলায়
যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, তখন দারুণ পুলিশভীতি ছিল। আমার ভয়ের প্রধান
কারণ ছিল পুলিশের খাকি পোশাক, হাতে লাঠি, কাঁধে রাইফেল। আমাদের স্কুলে
যাওয়ার পথে একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। এখনও আছে। সে সময় রিকশায় করে স্কুলে
পাঠানোর বিলাসিতা অনেক পরিবারেরই ছিল না। আমাদেরও তাই। হেঁটেই যেতে হতো।
মনে পড়ে আসা-যাওয়ার পথে পুলিশ ফাঁড়িটি নজরে আসতেই বুক ধক করে উঠত। চোখ
প্রায় বন্ধ করে কোনোভাবে ফাঁড়ি এলাকা পার হতাম। একই কারণে সম্ভবত খাকি
পোশাক পরা পাটকলের দারোয়ানকেও পুলিশ ভেবে ভয় পেতাম। পরে শৈশবেই ধীরাজ
ভট্টাচার্যের ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ বইটি পড়ি। ওই সময় থেকেই সম্ভবত পুলিশের
প্রতি ভয় কাটতে থাকে। পুলিশকে মানবিক হিসেবেই দেখতে থাকি। অনেক দিন থেকেই
আমাদের সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, নাটকে পুলিশকে খল চরিত্রে দেখানো হয়।
উপস্থাপন করা হয় দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে। সাহিত্যে জীবনের ছবিই প্রতিফলিত হয়।
হয়তো ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ আছে বলেই কোনো কোনো পুলিশ সদস্য ক্ষমতার
অপব্যবহার করে থাকতে পারেন।
অনেক বছর আগের কথা। বিশেষ প্রয়োজনে সাভার থানায় যেতে হয়েছিল। এর আগে থানায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার প্রয়োজন ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলার। তিনি বিশেষ কাজে বাইরে ছিলেন। চলে আসবেন। পরিচয় জেনে এসআই পদমর্যাদার একজন সমাদর করে বসালেন। চা খেতে খেতে কথা বলছিলাম। গরমের দিন। ঘরে একটি বৈদ্যুতিক পাখা ছিল। নষ্ট থাকায় থেমে আছে। আসবাবপত্রের অবস্থা ভালো না। জোড়াতালি দেয়া। দীনহীন অবস্থা। জানলাম সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতার কথা। বুঝলাম অপরাধীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে প্রয়োজন মেটাতে হয়। তা ছাড়া দায়িত্ব অনুযায়ী পুলিশের বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সম্মানজনক নয়। এসব কারণেই সম্ভবত কোনো কোনো পুলিশ সদস্য দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তবে সামগ্রিকভাবে পুলিশকে নেতিবাচক চরিত্রে উপস্থাপন করা খুব বাস্তবসম্মত হবে না।
পুলিশের প্রতি বড় শ্রদ্ধা তৈরি হল মুক্তিযুদ্ধের সময়। রাজারবাগে পুলিশের যে বীরোচিত ভূমিকা রাখার কথা জেনেছি, তাতে তাদের দেশপ্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। পুলিশের প্রতি আমার মনে শ্রদ্ধার আসন অনেক বেড়ে গিয়েছিল তখন। তাই যখন পুলিশ সদস্যদের কোনো বড় স্খলনের কথা সামনে আসে, তখন খুব কষ্ট পাই। মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেয়া বীর পুলিশ সদস্যদের কথা ভেবে ভীষণ বিব্রত হই।
কয়েক বছর আগের কথা। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে একজন অসাধারণ মেধাবী ছাত্রকে পাই। মাশরুর ওর নাম। ছ’ ফুটের ওপর লম্বা, সুদর্শন ছেলে। ও প্রায় দিনই ক্লাসের পর সুযোগ পেলে আমার কাছে আসত। নানা বিষয়ে কথা হতো। প্রচুর পড়াশোনা করত মাশরুর। আমার কাছ থেকে অনেক বইয়ের খোঁজ নিত। ওর কাছ থেকেও অনেক বইয়ের সন্ধান পেতাম। কথায় বুঝতাম দেশের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ওর। মাশরুরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষের দিকে তখন। ও জানাল বিসিএস পরীক্ষা দেবে। আমার পরামর্শ ও পরিচর্যা চায়। আমাকে বিস্মিত করে জানাল ওর একমাত্র লক্ষ্য পুলিশ ক্যাডারে চাকরি করা। কারণ জানতে চাইলাম। বলল, স্যার মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগে পুলিশের বীরত্বগাথা শুনে আমি গর্ববোধ করি। যখন নানা কারণে পুলিশের প্রতি মানুষ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে, আমার তখন খুব খারাপ লাগে। আমি চাই পুলিশে যোগ দিয়ে পুলিশের সম্মান ফিরিয়ে আনায় ভূমিকা রাখতে। ওর কথায় আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। মাশরুরের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এএসপি হিসেবে রাজধানীর এক মডেল থানায় দায়িত্বরত ছিল। আমি জেনেছি বেশ কিছু অসাধারণ সাফল্যে ও পুলিশ বিভাগে অনেকের নজর কেড়েছে। জানলাম এখন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে রয়েছে।
এ দেশে রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে কোনো সরকারই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে প্রশাসনের সর্বত্র। ক্ষমতার রাজনীতি কলুষিত করছে চারপাশের সব প্রতিষ্ঠানকে। সব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা পুলিশ প্রশাসনকে তাদের রাজনীতির হাতিয়ার বানাতে চেয়েছে। ভেতরে ভেতরে রাজনীতিকরণও সম্পন্ন হয়েছে। পুলিশের উচ্চতর পদে পদ-পদায়ন, পদোন্নতিতে নাকি রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে পারস্পরিক ক্ষোভ ও হতাশা। অন্যান্য দিক ছাড়াও পুলিশের নিয়োগ বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। এ অবস্থা পুলিশের ভেতরকার শক্তিকে অনেক বেশি দুর্বল করে দেয়। রাজনীতিকরণের কুফল চারিত্রিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে পুলিশকে। এর দীর্ঘ কুপ্রভাব বয়ে বেড়াতে হবে এই প্রতিষ্ঠানকে। ‘ক্রস ফায়ার’ নামের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নির্দেশনাতেই হয়।
পুলিশকে অনেককাল ধরেই ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলনের হাতিয়ার হিসেবে। এর পথ ধরে গ্রেফতার বাণিজ্য, ঘুষ বাণিজ্যের কথা আজকাল অনেক বেশি শোনা যাচ্ছে। সৎ পুলিশ অফিসার ও সদস্যরা এসব কারণে মানসিক পীড়নে ভুগছেন।
অনেক স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে নিকট অতীতে, যার কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এর পেছনে তিনটি কারণের কথা অনেকেই বলে থাকেন। এক. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব, দুই. পুলিশের দুর্নীতিপরায়ণতা এবং তিন. পুলিশের সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় নানা দিক থেকে পুলিশের সক্ষমতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর প্রশ্নটি অনেক বেশি সামনে চলে এসেছে। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেননি। পেট্রলবোমা মারা আর ককটেল ফোটানোর মাঝখানেই এবার বইমেলা হয়ে গেল। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চয়তা দিয়েছিল তারা নিñিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। উপরন্তু অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকির ব্যাপারটি পুলিশকে অবহিত করা হয়েছিল আগেই। সেই প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বলয়ের ভেতর লোকারণ্যে ক’জন খুনি আড়াল থেকে গুলি নয়- অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করল, তার স্ত্রীকে আহত করা হল, তারপর খুনিরা বিনা চ্যালেঞ্জে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল! কাছেপিঠে নিরাপত্তা বলয়ে নিয়োজিত পুলিশ থাকলেও কেউ এগিয়ে এলো না। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে পুলিশের নিরাপত্তার আশ্বাসে মানুষ আশ্বস্ত হবে কীভাবে! আরও দু-একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। বুঝলাম বোমাবাজদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারা দেশে পুলিশ নজরদারি করতে পারবে না। কিন্তু বলতেই হয়, হরতাল-অবরোধের প্রথম থেকেই বারবার নীলক্ষেত-নিউমার্কেট এলাকায় ককটেল মারা হচ্ছে, মানুষ আহত হচ্ছে, সেখানে পুলিশি তৎপরতা নেই কেন? ধরা পড়ছে না কেন হত্যাকারী? একইভাবে লক্ষ্মীবাজার-বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় উপর্যুপরি কয়েকবার বোমা হামলা হল, আগুনে পোড়ানো হল গাড়ি। একাধিক মানুষ আহত হল। পুলিশি কার্যকর নজরদারি থাকলে একই জায়গায় অপরাধীদের বারবার অপরাধ সংঘটনের সাহস থাকত না। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এই চিহ্নিত বিশেষ এলাকাটি পুলিশি নজরদারির বাইরে রয়ে গেল কেমন করে? আমাদের দুর্ভাগ্য, কেতাবি ভাষায় পুলিশ জনগণের সেবক হলেও এসবের কোনো ব্যাখ্যা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায় না।
এসব কারণে আমাদের সামনে পুলিশি নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সত্যিই কি আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনী এতটা দুর্বল? পুলিশের উল্লেখ করার মতো অনেক সাফল্য আছে। তাহলে কি পুলিশ বাধ্য হচ্ছে ব্যর্থতার কলংক তিলক কপালে পরতে? পূর্বসূরিদের গৌরবময় ঐতিহ্য ধারণ না করে নিজেদের নিষ্প্রভ করে তুলছে?
আমাদের ধারণা পুলিশি শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে পুলিশের ভেতরের নৈতিক ও আদর্শিক জায়গাটিকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার আমাদের দেশে নতুন নয়। বিএনপির শাসনামলে আমি একটি হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেছি। সহিংস ছাত্র সংঘাতের সময় সশস্ত্র সরকারদলীয় ছাত্রদের কখনও স্পর্শ করতে পারেনি পুলিশ। আওয়ামী লীগের শাসনযুগে ছাত্রলীগের দাপটও একই রকম। এখানেও পুলিশকে নীরব থাকতে হয়েছে। অনেক পুলিশ অফিসার একান্ত আলাপে তাদের অসহায়ত্বের কথা বলে থাকেন।
এভাবে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে গিয়ে বিনিময়ে এদের নৈতিক স্খলনকে প্রশ্রয় দিতে হচ্ছে শাসক দলকে। ফলে শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুলিশকে দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে। দুর্নীতিপরায়ণ করে ফেলা হচ্ছে। এর ফল কখনও ভালো হতে পারে না।
হরতাল-অবরোধ ও সহিংসতায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখা, পরীক্ষা সচল রাখার জন্য আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হলে পুলিশকে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে হবে। এই দৃঢ়তা বাস্তবক্ষেত্রে নেই বলে সরকার আদালতের নির্দেশ পালন করতে পারছে না।
আমরা মনে করি বিশেষ সংকটে বিজিবি, র্যাব ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হলেও আইনশৃংখলা রক্ষায় সাংবাৎসরিক যারা ভূমিকা রাখেন, তারা হচ্ছেন আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্য। এই বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ না হলে দৃঢ় ও আদর্শিক পুলিশ আমরা পাব না। রাজনীতিকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথে হাঁটব।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
অনেক বছর আগের কথা। বিশেষ প্রয়োজনে সাভার থানায় যেতে হয়েছিল। এর আগে থানায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার প্রয়োজন ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলার। তিনি বিশেষ কাজে বাইরে ছিলেন। চলে আসবেন। পরিচয় জেনে এসআই পদমর্যাদার একজন সমাদর করে বসালেন। চা খেতে খেতে কথা বলছিলাম। গরমের দিন। ঘরে একটি বৈদ্যুতিক পাখা ছিল। নষ্ট থাকায় থেমে আছে। আসবাবপত্রের অবস্থা ভালো না। জোড়াতালি দেয়া। দীনহীন অবস্থা। জানলাম সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতার কথা। বুঝলাম অপরাধীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে প্রয়োজন মেটাতে হয়। তা ছাড়া দায়িত্ব অনুযায়ী পুলিশের বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সম্মানজনক নয়। এসব কারণেই সম্ভবত কোনো কোনো পুলিশ সদস্য দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তবে সামগ্রিকভাবে পুলিশকে নেতিবাচক চরিত্রে উপস্থাপন করা খুব বাস্তবসম্মত হবে না।
পুলিশের প্রতি বড় শ্রদ্ধা তৈরি হল মুক্তিযুদ্ধের সময়। রাজারবাগে পুলিশের যে বীরোচিত ভূমিকা রাখার কথা জেনেছি, তাতে তাদের দেশপ্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। পুলিশের প্রতি আমার মনে শ্রদ্ধার আসন অনেক বেড়ে গিয়েছিল তখন। তাই যখন পুলিশ সদস্যদের কোনো বড় স্খলনের কথা সামনে আসে, তখন খুব কষ্ট পাই। মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেয়া বীর পুলিশ সদস্যদের কথা ভেবে ভীষণ বিব্রত হই।
কয়েক বছর আগের কথা। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে একজন অসাধারণ মেধাবী ছাত্রকে পাই। মাশরুর ওর নাম। ছ’ ফুটের ওপর লম্বা, সুদর্শন ছেলে। ও প্রায় দিনই ক্লাসের পর সুযোগ পেলে আমার কাছে আসত। নানা বিষয়ে কথা হতো। প্রচুর পড়াশোনা করত মাশরুর। আমার কাছ থেকে অনেক বইয়ের খোঁজ নিত। ওর কাছ থেকেও অনেক বইয়ের সন্ধান পেতাম। কথায় বুঝতাম দেশের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ওর। মাশরুরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষের দিকে তখন। ও জানাল বিসিএস পরীক্ষা দেবে। আমার পরামর্শ ও পরিচর্যা চায়। আমাকে বিস্মিত করে জানাল ওর একমাত্র লক্ষ্য পুলিশ ক্যাডারে চাকরি করা। কারণ জানতে চাইলাম। বলল, স্যার মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগে পুলিশের বীরত্বগাথা শুনে আমি গর্ববোধ করি। যখন নানা কারণে পুলিশের প্রতি মানুষ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে, আমার তখন খুব খারাপ লাগে। আমি চাই পুলিশে যোগ দিয়ে পুলিশের সম্মান ফিরিয়ে আনায় ভূমিকা রাখতে। ওর কথায় আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। মাশরুরের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এএসপি হিসেবে রাজধানীর এক মডেল থানায় দায়িত্বরত ছিল। আমি জেনেছি বেশ কিছু অসাধারণ সাফল্যে ও পুলিশ বিভাগে অনেকের নজর কেড়েছে। জানলাম এখন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে রয়েছে।
এ দেশে রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে কোনো সরকারই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে প্রশাসনের সর্বত্র। ক্ষমতার রাজনীতি কলুষিত করছে চারপাশের সব প্রতিষ্ঠানকে। সব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা পুলিশ প্রশাসনকে তাদের রাজনীতির হাতিয়ার বানাতে চেয়েছে। ভেতরে ভেতরে রাজনীতিকরণও সম্পন্ন হয়েছে। পুলিশের উচ্চতর পদে পদ-পদায়ন, পদোন্নতিতে নাকি রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে পারস্পরিক ক্ষোভ ও হতাশা। অন্যান্য দিক ছাড়াও পুলিশের নিয়োগ বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। এ অবস্থা পুলিশের ভেতরকার শক্তিকে অনেক বেশি দুর্বল করে দেয়। রাজনীতিকরণের কুফল চারিত্রিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে পুলিশকে। এর দীর্ঘ কুপ্রভাব বয়ে বেড়াতে হবে এই প্রতিষ্ঠানকে। ‘ক্রস ফায়ার’ নামের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নির্দেশনাতেই হয়।
পুলিশকে অনেককাল ধরেই ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলনের হাতিয়ার হিসেবে। এর পথ ধরে গ্রেফতার বাণিজ্য, ঘুষ বাণিজ্যের কথা আজকাল অনেক বেশি শোনা যাচ্ছে। সৎ পুলিশ অফিসার ও সদস্যরা এসব কারণে মানসিক পীড়নে ভুগছেন।
অনেক স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে নিকট অতীতে, যার কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এর পেছনে তিনটি কারণের কথা অনেকেই বলে থাকেন। এক. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব, দুই. পুলিশের দুর্নীতিপরায়ণতা এবং তিন. পুলিশের সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় নানা দিক থেকে পুলিশের সক্ষমতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর প্রশ্নটি অনেক বেশি সামনে চলে এসেছে। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেননি। পেট্রলবোমা মারা আর ককটেল ফোটানোর মাঝখানেই এবার বইমেলা হয়ে গেল। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চয়তা দিয়েছিল তারা নিñিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। উপরন্তু অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকির ব্যাপারটি পুলিশকে অবহিত করা হয়েছিল আগেই। সেই প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বলয়ের ভেতর লোকারণ্যে ক’জন খুনি আড়াল থেকে গুলি নয়- অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করল, তার স্ত্রীকে আহত করা হল, তারপর খুনিরা বিনা চ্যালেঞ্জে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল! কাছেপিঠে নিরাপত্তা বলয়ে নিয়োজিত পুলিশ থাকলেও কেউ এগিয়ে এলো না। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে পুলিশের নিরাপত্তার আশ্বাসে মানুষ আশ্বস্ত হবে কীভাবে! আরও দু-একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। বুঝলাম বোমাবাজদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারা দেশে পুলিশ নজরদারি করতে পারবে না। কিন্তু বলতেই হয়, হরতাল-অবরোধের প্রথম থেকেই বারবার নীলক্ষেত-নিউমার্কেট এলাকায় ককটেল মারা হচ্ছে, মানুষ আহত হচ্ছে, সেখানে পুলিশি তৎপরতা নেই কেন? ধরা পড়ছে না কেন হত্যাকারী? একইভাবে লক্ষ্মীবাজার-বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় উপর্যুপরি কয়েকবার বোমা হামলা হল, আগুনে পোড়ানো হল গাড়ি। একাধিক মানুষ আহত হল। পুলিশি কার্যকর নজরদারি থাকলে একই জায়গায় অপরাধীদের বারবার অপরাধ সংঘটনের সাহস থাকত না। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এই চিহ্নিত বিশেষ এলাকাটি পুলিশি নজরদারির বাইরে রয়ে গেল কেমন করে? আমাদের দুর্ভাগ্য, কেতাবি ভাষায় পুলিশ জনগণের সেবক হলেও এসবের কোনো ব্যাখ্যা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায় না।
এসব কারণে আমাদের সামনে পুলিশি নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সত্যিই কি আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনী এতটা দুর্বল? পুলিশের উল্লেখ করার মতো অনেক সাফল্য আছে। তাহলে কি পুলিশ বাধ্য হচ্ছে ব্যর্থতার কলংক তিলক কপালে পরতে? পূর্বসূরিদের গৌরবময় ঐতিহ্য ধারণ না করে নিজেদের নিষ্প্রভ করে তুলছে?
আমাদের ধারণা পুলিশি শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে পুলিশের ভেতরের নৈতিক ও আদর্শিক জায়গাটিকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার আমাদের দেশে নতুন নয়। বিএনপির শাসনামলে আমি একটি হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেছি। সহিংস ছাত্র সংঘাতের সময় সশস্ত্র সরকারদলীয় ছাত্রদের কখনও স্পর্শ করতে পারেনি পুলিশ। আওয়ামী লীগের শাসনযুগে ছাত্রলীগের দাপটও একই রকম। এখানেও পুলিশকে নীরব থাকতে হয়েছে। অনেক পুলিশ অফিসার একান্ত আলাপে তাদের অসহায়ত্বের কথা বলে থাকেন।
এভাবে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে গিয়ে বিনিময়ে এদের নৈতিক স্খলনকে প্রশ্রয় দিতে হচ্ছে শাসক দলকে। ফলে শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুলিশকে দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে। দুর্নীতিপরায়ণ করে ফেলা হচ্ছে। এর ফল কখনও ভালো হতে পারে না।
হরতাল-অবরোধ ও সহিংসতায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখা, পরীক্ষা সচল রাখার জন্য আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হলে পুলিশকে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে হবে। এই দৃঢ়তা বাস্তবক্ষেত্রে নেই বলে সরকার আদালতের নির্দেশ পালন করতে পারছে না।
আমরা মনে করি বিশেষ সংকটে বিজিবি, র্যাব ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হলেও আইনশৃংখলা রক্ষায় সাংবাৎসরিক যারা ভূমিকা রাখেন, তারা হচ্ছেন আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্য। এই বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ না হলে দৃঢ় ও আদর্শিক পুলিশ আমরা পাব না। রাজনীতিকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথে হাঁটব।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
No comments