শহীদ মিনারই প্রেরণার উৎস by কেয়া চৌধুরী
পৃথিবীর
বুকে অনেক দেশ আছে। প্রতিটি দেশের মানুষের মুখেই অনেক রকমের ভাষা আছে।
কিন্তু বাঙালি বিশ্বের একমাত্র জাতি, যারা মায়ের ভাষার জন্য জীবন দিতে
পারে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন রফিক,
সালাম, বরকত ও সালামসহ অনেকেই। বায়ান্নর শহীদরা আমাদের অহঙ্কার। মাতৃভাষা
মানবজাতির জন্য এক মূল্যবান নিয়ামত। কারণ প্রতিটি মানুষ তার মুখের ভাষা
দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করে। এছাড়া মানুষের জীবনের সার্বিক কাজকর্মের অন্যতম
মাধ্যম হচ্ছে মাতৃভাষা। তাই প্রত্যেক মানুষের কাছে তার মাতৃভাষা অতি প্রিয়।
মায়ের প্রতি যেমন আন্তরিক শ্রদ্ধা, তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও মানুষের গভীর
অনুরাগ-শ্রদ্ধা ও খাঁটি ভালবাসা থাকতে হবে। এই ভালবাসা নিয়ে প্রত্যেক
মানুষকে তার ভাষা শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। দেশ-বিদেশে, আমরা যে
যেখানেই থাকি না কেন নিজের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় অনেক যত্নশীল হওয়া
বাঞ্ছনীয়। বাংলার বর্ণমালায় সাজানো ভাষার দিবসটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস। ভাষা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি একদিনে আসেনি। তার জন্য রক্ত দিতে
হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। জানুয়ারি মাসে আমার নিজ উপজেলা বাহুবলে
স্নানঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম। তখন বিদ্যালয়
প্রাঙ্গণে স্থাপিত শহীদ মিনারটির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে
গেল। যখন শহীদ মিনারে সিঁড়ি ভেঙে বেদিতে উঠতে গেলাম, দেখলাম কোমলমতি
শিক্ষার্থীরা পায়ে থাকা জুতা নিয়েই এগিয়ে আসছে বেদির দিকে। তখনই মনে হলো
এখানে আমার কিছু করার আছে। শিক্ষার্থীদের বললাম, বিদ্যালয় থেকে একটি ঝাড়ু
নিয়ে আসতে। প্রধান শিক্ষকসহ সবাই তখন ইতস্তত বোধ করছিলেন। শহীদদের স্মরণে
স্থাপিত শহীদ মিনার আমাদের চেতনার অহঙ্কার। শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়,
প্রতিদিনের জীবন চর্চায় আমাদের আশপাশে স্থাপিত শহীদ মিনারগুলোকে মায়ের মতোই
যত্ন করতে হবে। একটি শহীদ মিনার অপরিচ্ছন্ন, অযত্নে থাকার অর্থ হলো,
আমাদের মাকে অযত্নে রাখার সামিল। এ বিশ্বাস থেকে স্নানঘাট সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্থাপিত শহীদ মিনারটির পরিচ্ছন্ন করার কাজ শুরু
করেছিলাম। একে একে সবাই এগিয়ে এলো। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, এ বিদ্যালয়ের ভবন
সংস্কারের সঙ্গে শহীদ মিনারের সংস্কারের কাজে ব্যবস্থা নেব। চলতি বছরের
২৯শে জানুয়ারি স্নানঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৩ টন চাল বরাদ্দ
দিয়েছি। ঝাড়ু হাতে শহীদ মিনার বেদি পরিষ্কার করার দৃশ্য দেখে, যেসব শিক্ষক
ইতস্তত বোধ করছিলেন এবার তারা নিজেরাও এ কাজে হাত বাড়াতে আমার দিকে এগিয়ে
আসলেন। এই ঘটনার মাধ্যমে উপস্থিত সবাইকে আমি যে বার্তা দিতে চেয়েছি তাহলো-
কাজের কোন নির্দিষ্ট গণ্ডি নেই। আর কাজের ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র নেই।
দেশের জন্য যে কোন কাজে আত্মনিয়োগ করার ক্ষেত্রে এক ধরনের গৌরব থাকে। এই
গৌরবের উপলব্ধির নামই ‘দেশপ্রেম’। যার মধ্যে মা, মাটি ও মাতৃভূমির জন্য
গৌরব নেই, তার মধ্যে কোন দেশপ্রেম থাকতে পারে না। যার মধ্যে কোন দেশপ্রেম
নেই, তার দ্বারা দেশ ও জনগণের উন্নয়নে ছোট-বড় কোন ধরনের কাজই করা সম্ভব নয়।
আসুন, আমাদের নতুন প্রজন্মকে দেশ গড়ার কাজে হাত লাগাতে শেখাই। বর্ণমালার
রঙিন রঙে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মুখে শব্দ তুলি, শুদ্ধ উচ্চারণে। ‘মা’
শব্দটির সঙ্গে শুধু মাটি, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষারই তুলনা করা যায়। এই উপলব্ধি
নিয়ে বেড়ে উঠতে দেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। আসুন, আমরা সবাই মিলে
আমাদের চেতনার প্রতীক পবিত্র শহীদ মিনারের মর্যাদা সহসা রক্ষা করি। নিজে
যত্নশীল হয়ে অন্যকে অনুসরণ করাতে সাহায্য করি। শুধুমাত্র দিবস ভিত্তিক
ভালবাসায় নয়। আন্তরিক শ্রদ্ধা-ভালবাসায় স্মরণ করি ভাষা শহীদদের। প্রাণভরে
নিঃশ্বাস নিয়ে গলায়, সুর ধরি- ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা ’।
কেয়া চৌধুরী |
No comments