একুশের চেতনায় আসুক সুস্থ রাজনৈতিক চৈতন্য by ড. মাহফুজ পারভেজ
বায়ান্নর
মহান ভাষা আন্দোলনের ৬৩ বছরে বাংলাদেশ অতিক্রম করছে রাজনীতির সঙ্কুল পথ।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিময় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস তো বটেই, এবারের একুশে
ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পরস্পর বিরোধিতার যুদ্ধংদেহী
পরিস্থিতির মধ্যে। ভাষাচেতনার সুউচ্চ স্তম্ভ একুশে ফেব্রুয়ারি যে
সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিময়তা সৃষ্টি করে জাতিসত্তাকে ঐক্যবদ্ধ
শক্তিতে পরিণত করেছিল, যে ঐক্য পরে স্বাধীনতার ভিত রচনা করেছিল, আজ তেমন
জাতীয় ঐক্যবোধের বড়ই প্রয়োজন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারায় লক্ষ্য
করলে দেখা যাবে, স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতি ও বিকাশের পেছনে একুশের অবদান
চিরন্তন। বর্তমানেও যে অচলাবস্থা, বিভেদের রাজনীতি এবং শক্তিমত্তার
প্রদর্শন চলছে, সেটাকে সঠিক গতিপথে ফিরিয়ে আনতে একুশের চেতনা কার্যকর হতে
পারে। একুশের সুমহান ও শাশ্বত চেতনা সুস্থ রাজনৈতিক চৈতন্য বিকাশে সহায়তা
করতে পারে। এ বছর তাই সবাই প্রত্যাশা করছে, একুশের চেতনায় সুস্থ রাজনৈতিক
চৈতন্য প্রতিষ্ঠার জন্য। বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক অতীত আর ঐতিহ্যের সংগ্রামী
পথ ধরে এগিয়ে এসেছে, বর্তমান সঙ্কট ও অচলাবস্থা তার সঙ্গে মোটেও খাপ খায়
না। বাংলাদেশের জাতিসত্তা বৃটিশ বা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক-দখলদার
শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই-সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের
রাজনৈতিক ইতিহাসে আত্মকলহ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ঘটনা একটিও নেই বললেই
চলে। অতীতের সেই ঐক্য ধারা দিনে দিনে কেন এবং কিভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে, সেটা
আরেক আলোচনার বিষয়। কিন্তু এখন বাংলাদেশে যা চলছে, সেটা আত্মঘাতী এবং নিজের
শক্তি হানিকর। এমন নেতিবাচক ধারা জাতীয় ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও সেই
ক্ষতির পথেই চলছে সংশ্লিষ্টরা। এ ধারা অবশ্যই থামাতে হবে। আর এটা থামাতে
অতীতের ঐতিহ্যের আলোয় সবাইকে স্নাত হতে হবে। বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তরের
মহান ঐক্যবোধ ও চেতনাপ্রবাহের স্রোতে মিলিত হয়েই বিভেদ আর আত্মকলহের কালো
অধ্যায়ের চির অবসান ঘটানো দরকার। গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী, উন্নয়নমুখী
বাংলাদেশের জন্য আত্মহানিকর লড়াই-সংঘাত নয়, ঐক্যই একমাত্র কাম্য। একবিংশ
শতাব্দীর পৃথিবীতে চলমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার আদর্শে সবাই ঐক্য আর সমঝোতার
পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন শত্রুতা আর বিবাদ ঝেড়ে ফেলে
গ্রহণ করছে মৈত্রী ও মিলনের পন্থা। বাংলাদেশকেও অগ্রগতি-উন্নতির মাধ্যমে
একবিংশ শতাব্দীর বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে
বিভেদের কালো ক্ষত মুছে ফেলতে হবে। ঐক্যের যে চেতনা আমাদের গৌরবময় অতীতে
এবং একুশের চেতনার মর্মমূলে নিহিত রয়েছে, সেই চেতনায় আলোকিত হয়ে সুস্থ
রাজনীতি ও জনঐক্যের বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত করাই হোক এবারের একুশের প্রতীতি।
আশাবাদী মানুষ, অগ্রসরমান জনতা, এ দেশের নারী ও পুরুষ, মূলস্রোত ও ক্ষুদ্র
জাতিসত্তা, নানা পথ ও মতের ব্যক্তিসত্তা বাংলাদেশ নামক রাজনৈতিক ঠিকানার
অন্তরে ঐক্যের মিলিত শক্তিতে জাগরণের প্রাণপ্রবাহ নিয়ে জয় করবে অনাগতকালে
শত চ্যালেঞ্জ। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে বিশ্বসভায় সসম্মানে। একুশ সতত এমন
প্রেরণাই দিয়ে যায়। ভাষা আন্দোলন আর ভাষা শহীদদের অম্লান স্মৃতিকে স্মরণীয়
এবং সুপ্রতিষ্ঠিত করতে ঐক্যের মোহনায় সম্মিলিত হয়ে বিভেদ, অসুস্থতা আর
হানিহারি চির-অবসানই হোক এবারের প্রত্যয়।
No comments