গণহত্যার বিচারে বাংলাদেশ ও বিশ্বসমাজের একতা by মফিদুল হক
ফেব্রুয়ারি
ও মার্চ মাসের সন্ধিক্ষণের তিনটি দিন সিরডাপের আধুনিক সম্মেলনকেন্দ্রে
বাংলাদেশে সংঘটিত একাত্তরের গণহত্যার সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এক
বিশ্বজনীনতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত তিন
দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন দৃঢ়ভাবে মেলে ধরল এই সত্য যে চার দশকেরও
আগে বাংলার শ্যামল প্রান্তর যারা রক্তলাল করেছিল, সেই আন্তর্জাতিক অপরাধে
দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য এ দেশবাসীর জাতীয় উদ্যোগ বিশ্বসভার মনোযোগ
কেড়েছে বড়ভাবে এবং বাংলাদেশের এই প্রয়াস ও অর্জন সংবেদনশীল আলোচনা ও
বিশ্লেষণের নতুন ধারা সূচিত করেছে।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বাংলাদেশে ইতিহাসের যে পালাবদল শুরু হয়েছিল, তা নানাভাবে সমালোচিত ও হেয় করে তুলতে গণহত্যাকারী সংগঠন ও তাদের দোসররা চেষ্টার কোনো কসুর করেনি, কিন্তু সব ধূম্রজাল ছিন্ন করে গণহত্যার বিচারে ন্যায়নিষ্ঠ সত্যানুসন্ধানী অগ্রগণ্য ব্যক্তি, সংস্থা ও উদ্যোগের কাছে বাংলাদেশের বার্তা যে সঠিকভাবে পেঁৗছে গেছে, তারই প্রতীক হয়ে উঠেছিল তিন দিনজুড়ে আটটি অধিবেশনে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাতের সম্মেলনের মাধ্যমে।
সম্মেলন উপলক্ষে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছিলেন গণহত্যা নিরোধবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ উপদেষ্টা অ্যাডামা দিয়ং। তিনি একাত্তরের গণহত্যায় ব্যাপক মানুষের জীবনে বয়ে আনা দুর্ভোগ ও জীবনাবসানের বেদনা নতুনভাবে মেলে ধরে বিচারের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিধানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অবস্থানের পুনরুল্লেখ করেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। সম্মেলনের উদ্বোধনকালে সুচিন্তিত যে ভাষণ প্রদান করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, সেখানেও তিনি দেশের অবস্থান পরিষ্কার করে তুলেছেন। তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রসঙ্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য পাওলো কাসাকার উক্তি উদ্ধৃত করেন, সেখানে কাসাকা বলেছিলেন, আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী, তবে যখন প্রশ্ন ওঠে যে অভিযোগে আসামি অভিযুক্ত, তা আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে কি না সে ক্ষেত্রে আমার জবাব হবে ‘হ্যাঁ’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে আমাদের প্রত্যাশা যে বিশ্বসম্প্রদায় এই বিচার–প্রক্রিয়াকে বড় ক্যানভাসে বিবেচনা করবে, কেবল প্রমাণিত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কী শাস্তি প্রদত্ত হলো সেই সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।’
‘ভিকটিমস ভয়েস’ শীর্ষক অধিবেশনে শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর বাবার লাশের সন্ধান না পাওয়ার বেদনার কথা বলেন, বলেন আকস্মিক বৈধব্যবরণকারী মায়ের সংগ্রামের কথা, যে বেদনা ও সংগ্রামকে তিনি যখন মিলিয়ে নেন আরও লাখো শহীদ পরিবারের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে, তখন শ্রোতৃমণ্ডলী বিচলিত না হয়ে পারে না। সবশেষে আসিফ মুনীর উত্থাপন করেন প্রশ্ন, মৃত্যুদণ্ডের বিধানের কারণে কি বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে বিশ্বসমাজ? অন্য সব অপরাধে দেশে দেশে যেসব মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে, সেখানে বড়ভাবে প্রশ্ন তোলা না হলেও গণহত্যার মতো চরম ঘৃণিত অপরাধে দণ্ডিত গুটিকয় মহা-অপরাধীর ক্ষেত্রে কেন এমন সোচ্চার বিরোধিতা ঘটবে?
তবে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের কারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ন্যায় ও মানবতার সংগ্রামীরা যে মুখ ঘুরিয়ে নেননি, বরং মতভিন্নতা বজায় রেখেই বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের সংগ্রাম সম্মিলিতভাবে পরিচালনা করতে আগ্রহী, সেই বার্তা সম্মেলনে বারবার শ্রুত হয়েছে। একের পর এক বক্তৃতা মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন নানা দেশের কৃতী ও সংগ্রামী মানুষেরা, তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ যেমন মেলে ধরেছেন, তেমনি জানতে উদ্গ্রীব ছিলেন বাংলাদেশের বিচার–প্রক্রিয়া ও গণহত্যার শিকার বাঙালি জাতির অদম্য জীবনীশক্তির উৎস, যারা চার দশকের বিচারহীনতার অবসান ঘটিয়ে বিচার–প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করে চলেছে। কাজটি যে সহজ ও সুসাধ্য নয়, সেটা তো বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা তাঁদের সামনে মেলে ধরেছিল এবং এর ফলে সম্মেলন অর্জন করেছিল আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য।
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত ১৭ জন গণহত্যা বিশ্লেষক, বিচারিক কার্যক্রমের সদস্য, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে মিলে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও বিশ্লেষণাত্মক আলোকসম্পাত করেন গণহত্যার বিভিন্ন দিকে। সূচনায় আলোচ্য হয়েছিল গণহত্যার শিকার কোনো জাতির বিচারপ্রাপ্তির অধিকার, আলোচিত হয়েছিল কীভাবে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পথ অনুসরণ করে এমনি বিচার সম্পন্ন করছে। আলোচক ছিলেন আইএজিএস বা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স-এর সভাপতি ড্যানিয়েল ফায়ারস্টেইন, নিউইয়র্কভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব সাইটস অব কনশান্সের নির্বাহী পরিচালক এলিজাবেথ সিল্কস এবং বাংলাদেশের আইনজীবী তুরিন আফরোজ। তাঁদের আলোচনায় জাতীয় আদালত কর্তৃক আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের তাৎপর্য বিশেষভাবে উঠে আসে এবং আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পাশাপাশি এসব আদালতের ভূমিকা ও শক্তিময়তার নতুন পরিচয় পাওয়া যায়। বোধ করি এই সুবাদেই ড্যানিয়েল ফায়ারস্টেইন বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও আর্জেন্টিনার জাতীয় ট্রাইব্যুনালসমূহের মধ্যে আরও নিবিড় যোগসূত্র গড়ার লক্ষ্যে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। আর্জেন্টিনা ছাড়াও লাতিন আমেরিকার কতিপয় দেশ চিলি, গুয়াতেমালা, পেরু ও কলম্বিয়ায় জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আদালতের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার বিচারিক কার্যক্রমের মধ্যে সংহতি রচনা করতে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ওপর তিনি বিশেষ জোর দেন। এই লক্ষ্যে ঢাকা সম্মেলন এক ঐতিহাসিক ভূমিকাই পালন করল, যখন বিচারকদের প্যানেল আলোচনায় নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করলেন আর্জেন্টিনার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারক ড্যানিয়েল হোরাসিও ওবলিগাদো, কম্বোডিয়ার ইসিসিসি বা জাতিসংঘ সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত দেশীয় আদালতের পোলিশ বিচারক আগ্নিয়েশকা মিলার্ট ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এ টি এম ফজলে কবির। বিশ্বসমাজের প্রতিনিধি হিসেবেই যে বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ তথা গণহত্যার বিচার সুসম্পন্ন করতে দায়িত্ব পালন করছে, তার প্রত্যক্ষ রূপ ফুটে উঠেছিল এই প্যানেল আলোচনায়।
পরবর্তী আলোচ্য ছিল নারী নির্যাতনের স্বরূপ এবং নির্যাতনের শিকার নারীদের ক্ষত উপশম বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার অভিজ্ঞতা মেলে ধরেন আদালতের জনতথ্য বিভাগের সাবেক পরিচালক ও গণহত্যা অধ্যয়নবিদ ড. হেলেন জারভিস। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক পীড়নামলে নারী নির্যাতনের চিত্র মেলে ধরেন সিলভিনা আলোনসো। বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষক উম্মে ওয়ারা। বীরাঙ্গনাদের যে স্বীকৃতি ও সম্মাননা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ে বিধৃত হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতি যে আহ্বান আদালত জানিয়েছেন দুটি রায়ের অংশবিশেষ পাঠ করে, সেই পরিচয় প্রদান করেন উম্মে ওয়ারা। বাংলাদেশের আদালত এবং সরকার বীরাঙ্গনাদের জাতীয় স্বীকৃতি প্রদান ও সার্বিক সামাজিক পুনর্বাসনের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, তা আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের দ্বারা বিশেষভাবে অভিনন্দিত হয় এবং এই পর্যবেক্ষণ ও রায়ের ব্যাপক প্রচার ও অধ্যয়নের পক্ষে তাঁরা মতপ্রকাশ করেন।
স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশে গণহত্যা ও ন্যায়বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বিভিন্ন মাত্রা তুলে ধরা দুরূহ, তবে এখান থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হবে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সম্মেলনে মার্কিন গণহত্যা অধ্যয়নবিদ এবং সেটন হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক আন্দ্রেই বারতোলি যে কথা উচ্চারণ করেছিলেন, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। পাওয়ার পয়েন্টে তৈরি করে আনা উপস্থাপনার সূচনায় তিনি ঢাকায় বসে আরও একটি স্লাইড যুক্ত করেন বাংলা ভাষায়, যদিও বাংলা তিনি কিছুই জানেন না। তবে এটা ছিল তাঁর অন্তর থেকে উৎসারিত আকুতির প্রকাশ, সম্মেলন যেদিন শুরু হবে তার আগের রাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় মুক্তমনা চিন্তক অভিজিৎ রায়কে। আন্দ্রেই বারতোলি লিখেছিলেন, ‘আমি অভিজিৎ, আমি মুক্তমনে বিশ্বাসী, আমি শান্তি ও সম্প্রীতিতে আস্থাবান, আপনারা সবাই আমার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সন্ত্রাসের বিপরীতে শান্তির পক্ষে সোচ্চার হোন।’ তাঁর হয়ে এই বাংলা বক্তব্য পাঠ করেন একজন স্বেচ্ছাকর্মী।
এরপর বারতোলি তাঁর উপস্থাপনা শুরু করলেন ‘আই অ্যাম অভিজিৎ’ ঘোষণা দ্বারা। তিনি আন্তর্জাতিক সহিংসতা ও উগ্রবাদের প্রসারের পটভূমিকায় বাংলাদেশের গণহত্যার পেছনে ধর্মীয় উগ্রবাদের ভূমিকা বিশ্লেষণে সচেষ্ট হলেন। তিনি বলেন, একাত্তরে বাংলাদেশে মুসলিম দ্বারা ব্যাপকভাবে মুসলিম নিধন ঘটেছিল, ধর্মের নামেই সংঘটিত হয়েছিল নৃশংসতা। এর বিপরীতে আরেক ইসলামের পরিচয় তিনি মেলে ধরলেন আলজেরিয়ায় ফরাসি উপনিবেশীকরণের বিপরীতে প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাস থেকে। ফরাসিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সুফি সাধক আলী কদর, কিন্তু ফরাসি বাহিনীর নৃশংসতার মুখে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি, ভেবেছিলেন এর ফলে হয়তো দেশবাসীকে হত্যালীলা থেকে রক্ষা করা যাবে। ফরাসিরা তাঁকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে ১৫ বছর আটকে রাখে ফ্রান্সের কারাগারে, পরে প্রেরণ করে সিরিয়ায়। কারাগারেও তিনি মানুষ হিসেবে সবার সম্ভ্রম ও সম্মান আদায় করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের উল্লেখ করে বারতোলি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের জন্য হতে পারে আইকন। যে সংগ্রাম বাংলাদেশ পরিচালনা করছে তাতে পরাভব ঘটতে দেওয়া যায় না, কেননা এই পরাজয় হবে বিশ্বের জন্য পরাজয়।
মফিদুল হক: লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বাংলাদেশে ইতিহাসের যে পালাবদল শুরু হয়েছিল, তা নানাভাবে সমালোচিত ও হেয় করে তুলতে গণহত্যাকারী সংগঠন ও তাদের দোসররা চেষ্টার কোনো কসুর করেনি, কিন্তু সব ধূম্রজাল ছিন্ন করে গণহত্যার বিচারে ন্যায়নিষ্ঠ সত্যানুসন্ধানী অগ্রগণ্য ব্যক্তি, সংস্থা ও উদ্যোগের কাছে বাংলাদেশের বার্তা যে সঠিকভাবে পেঁৗছে গেছে, তারই প্রতীক হয়ে উঠেছিল তিন দিনজুড়ে আটটি অধিবেশনে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাতের সম্মেলনের মাধ্যমে।
সম্মেলন উপলক্ষে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছিলেন গণহত্যা নিরোধবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ উপদেষ্টা অ্যাডামা দিয়ং। তিনি একাত্তরের গণহত্যায় ব্যাপক মানুষের জীবনে বয়ে আনা দুর্ভোগ ও জীবনাবসানের বেদনা নতুনভাবে মেলে ধরে বিচারের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিধানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অবস্থানের পুনরুল্লেখ করেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। সম্মেলনের উদ্বোধনকালে সুচিন্তিত যে ভাষণ প্রদান করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, সেখানেও তিনি দেশের অবস্থান পরিষ্কার করে তুলেছেন। তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রসঙ্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য পাওলো কাসাকার উক্তি উদ্ধৃত করেন, সেখানে কাসাকা বলেছিলেন, আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী, তবে যখন প্রশ্ন ওঠে যে অভিযোগে আসামি অভিযুক্ত, তা আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে কি না সে ক্ষেত্রে আমার জবাব হবে ‘হ্যাঁ’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে আমাদের প্রত্যাশা যে বিশ্বসম্প্রদায় এই বিচার–প্রক্রিয়াকে বড় ক্যানভাসে বিবেচনা করবে, কেবল প্রমাণিত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কী শাস্তি প্রদত্ত হলো সেই সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।’
‘ভিকটিমস ভয়েস’ শীর্ষক অধিবেশনে শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর বাবার লাশের সন্ধান না পাওয়ার বেদনার কথা বলেন, বলেন আকস্মিক বৈধব্যবরণকারী মায়ের সংগ্রামের কথা, যে বেদনা ও সংগ্রামকে তিনি যখন মিলিয়ে নেন আরও লাখো শহীদ পরিবারের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে, তখন শ্রোতৃমণ্ডলী বিচলিত না হয়ে পারে না। সবশেষে আসিফ মুনীর উত্থাপন করেন প্রশ্ন, মৃত্যুদণ্ডের বিধানের কারণে কি বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে বিশ্বসমাজ? অন্য সব অপরাধে দেশে দেশে যেসব মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে, সেখানে বড়ভাবে প্রশ্ন তোলা না হলেও গণহত্যার মতো চরম ঘৃণিত অপরাধে দণ্ডিত গুটিকয় মহা-অপরাধীর ক্ষেত্রে কেন এমন সোচ্চার বিরোধিতা ঘটবে?
তবে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের কারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ন্যায় ও মানবতার সংগ্রামীরা যে মুখ ঘুরিয়ে নেননি, বরং মতভিন্নতা বজায় রেখেই বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের সংগ্রাম সম্মিলিতভাবে পরিচালনা করতে আগ্রহী, সেই বার্তা সম্মেলনে বারবার শ্রুত হয়েছে। একের পর এক বক্তৃতা মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন নানা দেশের কৃতী ও সংগ্রামী মানুষেরা, তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ যেমন মেলে ধরেছেন, তেমনি জানতে উদ্গ্রীব ছিলেন বাংলাদেশের বিচার–প্রক্রিয়া ও গণহত্যার শিকার বাঙালি জাতির অদম্য জীবনীশক্তির উৎস, যারা চার দশকের বিচারহীনতার অবসান ঘটিয়ে বিচার–প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করে চলেছে। কাজটি যে সহজ ও সুসাধ্য নয়, সেটা তো বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা তাঁদের সামনে মেলে ধরেছিল এবং এর ফলে সম্মেলন অর্জন করেছিল আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য।
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত ১৭ জন গণহত্যা বিশ্লেষক, বিচারিক কার্যক্রমের সদস্য, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে মিলে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও বিশ্লেষণাত্মক আলোকসম্পাত করেন গণহত্যার বিভিন্ন দিকে। সূচনায় আলোচ্য হয়েছিল গণহত্যার শিকার কোনো জাতির বিচারপ্রাপ্তির অধিকার, আলোচিত হয়েছিল কীভাবে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পথ অনুসরণ করে এমনি বিচার সম্পন্ন করছে। আলোচক ছিলেন আইএজিএস বা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স-এর সভাপতি ড্যানিয়েল ফায়ারস্টেইন, নিউইয়র্কভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব সাইটস অব কনশান্সের নির্বাহী পরিচালক এলিজাবেথ সিল্কস এবং বাংলাদেশের আইনজীবী তুরিন আফরোজ। তাঁদের আলোচনায় জাতীয় আদালত কর্তৃক আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের তাৎপর্য বিশেষভাবে উঠে আসে এবং আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পাশাপাশি এসব আদালতের ভূমিকা ও শক্তিময়তার নতুন পরিচয় পাওয়া যায়। বোধ করি এই সুবাদেই ড্যানিয়েল ফায়ারস্টেইন বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও আর্জেন্টিনার জাতীয় ট্রাইব্যুনালসমূহের মধ্যে আরও নিবিড় যোগসূত্র গড়ার লক্ষ্যে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। আর্জেন্টিনা ছাড়াও লাতিন আমেরিকার কতিপয় দেশ চিলি, গুয়াতেমালা, পেরু ও কলম্বিয়ায় জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আদালতের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার বিচারিক কার্যক্রমের মধ্যে সংহতি রচনা করতে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ওপর তিনি বিশেষ জোর দেন। এই লক্ষ্যে ঢাকা সম্মেলন এক ঐতিহাসিক ভূমিকাই পালন করল, যখন বিচারকদের প্যানেল আলোচনায় নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করলেন আর্জেন্টিনার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারক ড্যানিয়েল হোরাসিও ওবলিগাদো, কম্বোডিয়ার ইসিসিসি বা জাতিসংঘ সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত দেশীয় আদালতের পোলিশ বিচারক আগ্নিয়েশকা মিলার্ট ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এ টি এম ফজলে কবির। বিশ্বসমাজের প্রতিনিধি হিসেবেই যে বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ তথা গণহত্যার বিচার সুসম্পন্ন করতে দায়িত্ব পালন করছে, তার প্রত্যক্ষ রূপ ফুটে উঠেছিল এই প্যানেল আলোচনায়।
পরবর্তী আলোচ্য ছিল নারী নির্যাতনের স্বরূপ এবং নির্যাতনের শিকার নারীদের ক্ষত উপশম বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার অভিজ্ঞতা মেলে ধরেন আদালতের জনতথ্য বিভাগের সাবেক পরিচালক ও গণহত্যা অধ্যয়নবিদ ড. হেলেন জারভিস। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক পীড়নামলে নারী নির্যাতনের চিত্র মেলে ধরেন সিলভিনা আলোনসো। বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষক উম্মে ওয়ারা। বীরাঙ্গনাদের যে স্বীকৃতি ও সম্মাননা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ে বিধৃত হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতি যে আহ্বান আদালত জানিয়েছেন দুটি রায়ের অংশবিশেষ পাঠ করে, সেই পরিচয় প্রদান করেন উম্মে ওয়ারা। বাংলাদেশের আদালত এবং সরকার বীরাঙ্গনাদের জাতীয় স্বীকৃতি প্রদান ও সার্বিক সামাজিক পুনর্বাসনের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, তা আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের দ্বারা বিশেষভাবে অভিনন্দিত হয় এবং এই পর্যবেক্ষণ ও রায়ের ব্যাপক প্রচার ও অধ্যয়নের পক্ষে তাঁরা মতপ্রকাশ করেন।
স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশে গণহত্যা ও ন্যায়বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বিভিন্ন মাত্রা তুলে ধরা দুরূহ, তবে এখান থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হবে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সম্মেলনে মার্কিন গণহত্যা অধ্যয়নবিদ এবং সেটন হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক আন্দ্রেই বারতোলি যে কথা উচ্চারণ করেছিলেন, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। পাওয়ার পয়েন্টে তৈরি করে আনা উপস্থাপনার সূচনায় তিনি ঢাকায় বসে আরও একটি স্লাইড যুক্ত করেন বাংলা ভাষায়, যদিও বাংলা তিনি কিছুই জানেন না। তবে এটা ছিল তাঁর অন্তর থেকে উৎসারিত আকুতির প্রকাশ, সম্মেলন যেদিন শুরু হবে তার আগের রাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় মুক্তমনা চিন্তক অভিজিৎ রায়কে। আন্দ্রেই বারতোলি লিখেছিলেন, ‘আমি অভিজিৎ, আমি মুক্তমনে বিশ্বাসী, আমি শান্তি ও সম্প্রীতিতে আস্থাবান, আপনারা সবাই আমার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সন্ত্রাসের বিপরীতে শান্তির পক্ষে সোচ্চার হোন।’ তাঁর হয়ে এই বাংলা বক্তব্য পাঠ করেন একজন স্বেচ্ছাকর্মী।
এরপর বারতোলি তাঁর উপস্থাপনা শুরু করলেন ‘আই অ্যাম অভিজিৎ’ ঘোষণা দ্বারা। তিনি আন্তর্জাতিক সহিংসতা ও উগ্রবাদের প্রসারের পটভূমিকায় বাংলাদেশের গণহত্যার পেছনে ধর্মীয় উগ্রবাদের ভূমিকা বিশ্লেষণে সচেষ্ট হলেন। তিনি বলেন, একাত্তরে বাংলাদেশে মুসলিম দ্বারা ব্যাপকভাবে মুসলিম নিধন ঘটেছিল, ধর্মের নামেই সংঘটিত হয়েছিল নৃশংসতা। এর বিপরীতে আরেক ইসলামের পরিচয় তিনি মেলে ধরলেন আলজেরিয়ায় ফরাসি উপনিবেশীকরণের বিপরীতে প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাস থেকে। ফরাসিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সুফি সাধক আলী কদর, কিন্তু ফরাসি বাহিনীর নৃশংসতার মুখে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি, ভেবেছিলেন এর ফলে হয়তো দেশবাসীকে হত্যালীলা থেকে রক্ষা করা যাবে। ফরাসিরা তাঁকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে ১৫ বছর আটকে রাখে ফ্রান্সের কারাগারে, পরে প্রেরণ করে সিরিয়ায়। কারাগারেও তিনি মানুষ হিসেবে সবার সম্ভ্রম ও সম্মান আদায় করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের উল্লেখ করে বারতোলি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের জন্য হতে পারে আইকন। যে সংগ্রাম বাংলাদেশ পরিচালনা করছে তাতে পরাভব ঘটতে দেওয়া যায় না, কেননা এই পরাজয় হবে বিশ্বের জন্য পরাজয়।
মফিদুল হক: লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
No comments