খাদে পড়তেই যাচ্ছে বাংলাদেশ! by মাসুম খলিলী
বাংলাদেশের
রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন বিশ্ব প্রচারমাধ্যমের একটি প্রধান বিষয়ে পরিণত
হচ্ছে। কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে হয়তো ততটা মাথা
ঘামাতো না বিশ্ব সম্প্রদায়। স্নায়ুযুদ্ধে সক্রিয় বিশ্বশক্তি এবং আঞ্চলিক
শক্তিগুলোর মনোযোগের রাডারে মূলত সীমিত থাকত বাংলাদেশ। এখন সেই পরিস্থিতি
নেই। বিশ্বের অন্যতম প্রধান পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নানা
সময়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে স্থান করে নিতে দেখা যাচ্ছে। ১৬ কোটি মানুষের এই
দেশটি ভৌগোলিকভাবেও এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যে অঞ্চলটি বিশ্ব শক্তিগুলোর
কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে কেউই
সেভাবে উপেক্ষা করতে পারছে না। তবে এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া এবং একই সাথে
বিশ্ব রাজনীতি এমন এক জটিল আবর্তে পড়ে গেছে যাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট
নিয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন বিশ্বের প্রভাবশালী পরাশক্তির পক্ষেও সহজ হয়ে
উঠছে না।
এর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের অন্য দিকগুলোকে ছাড়িয়ে মুখ্য হয়ে উঠছে এর অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতির দিকটি। এ ক্ষতি অব্যাহত থাকলে দেশটি যেভাবে দ্রুত অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটি বড় রকম বাধার মুখে পড়তে পারে এমন পূর্বাভাস বিশ্বের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো বাংলাদেশের সার্বক্ষণিক উন্নয়ন অংশীদাররাও উদ্বেগ প্রকাশ করছে এই সঙ্কটে। যদিও তাদের সামনে এ রকম একটি শঙ্কাও কাজ করে যে বাংলাদেশে বর্তমান যে সরকার রয়েছে তাতে এখানকার অবস্থা সম্পর্কে মুক্তভাবে মন্তব্যের নানা ধরনের বিপদাপদ রয়েছে। এখানে বাস্তবে যা ঘটছে তা আড়াল করার এমন এক পেশাদারী প্রক্রিয়া সক্রিয় রয়েছে যাতে বাস্তব অবস্থার তথ্য-উপাত্ত সব সময় লভ্যও হয়ে ওঠে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ১৩ হাজার কোটি ডলারের মতো। বিশ্বব্যাংক কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতির পর্যালোচনা করেছে। এতে বিশ্ব উন্নয়ন সংস্থাটি বলেছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শুধুই উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে ১৪০ কোটি ডলারের, যা টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ১১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। উৎপাদন ক্ষতির বাইরে আরো নানা ধরনের ক্ষতি আছে যা হিসাবের মধ্যে আনা হলে রাজনৈতিক অস্থিরতার অর্থনৈতিক মূল্য আরো অনেক বেশি হবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) জানুয়ারি মাসের ১৬ দিনের এ ধরনের সার্বিক ক্ষতির একটি হিসাব দিয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে বেসরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ জানুয়ারি মাসের অবরোধজনিত সার্বিক ক্ষতির একটি হিসাব করেছে। এই হিসাব অনুসারে অবরোধের প্রথম মাসে মোট অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৬৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে তৈরী পোশাক খাতের ক্ষতির পরিমাণ হলো ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর বাইরে অবরোধের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ক্ষতির খাত পরিবহনে ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষি খাতে আট হাজার ৬৪১ কোটি টাকা, আবাসন খাতে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা এবং পর্যটনে ছয় হাজার ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
সিপিডির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রায় বছরব্যাপী যে সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল তার ক্ষতির চেয়ে বর্তমান ক্ষতি অনেক বেশি। আগের রাজনৈতিক অস্থিরতার মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির অঙ্ক হিসাব করা হয়েছিল ৫০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা চেম্বারের হিসাবকে ভিত্তি ধরে সিপিডির হিসাবে দুই মাসে এ ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়াচ্ছে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির সাড়ে সাত শতাংশের মতো। এবারের রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতি যেভাবে নিরূপণ করা হচ্ছে তাতে প্রকৃত ক্ষতির কতটা প্রতিফলন ঘটছে তা নিয়ে কিছুটা মতান্তর হতে পারে। তবে এই অস্থিরতা যে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে তাতে সংশয়ের অবকাশ থাকছে না।
বিশ্বব্যাংক অর্থবছরের যে সাত মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উৎপাদন ক্ষতির হিসাব করেছে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব জিডিপির ওপর পড়বে। এ সময়ের মধ্যে অবরোধ ছিল এক মাসের মতো। বাকি ছয় মাস ছিল পুরোপুরি স্থিতিশীল। এ ছয় মাসে বিরোধী জোটকে সেভাবে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে দেখা যায়নি। বিশ্বব্যাংকের রক্ষণশীল হিসাবেও এ পর্যন্ত যে সময়টাতে অবরোধ হরতাল হয়েছে তা হিসাব করা হলে মোট উৎপাদন ক্ষতি দাঁড়াবে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা জিডিপির আড়াই শতাংশের কাছাকাছি।
সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য ৭.৩ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ লক্ষ্যমাত্রাকে পরে ৬.২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। জানুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যমান পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ হলো জিডিপি কোনোভাবে ৫.৪ শতাংশের বেশি হবে না। মার্চের প্রথম সপ্তাহনাগাদ সেভাবে রাজনৈতিক স্থবিরতা কাটার কোনো লক্ষণ যেখানে দেখা যাচ্ছে না সেখানে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে বলা কঠিন। অবশ্য সরকারের হিসাব নিকাশের নির্ভরতার ব্যাপারে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সংশয় প্রকাশ এখন একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরা একদিকে বলেন হরতাল অবরোধে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে অন্য দিকে আবার দাবি করেন হরতালে দেশের জনজীবনে কোনো প্রভাব নেই। এ ধরনের রেটরিক শুধু রাজনৈতিক সুবিধার জন্য হয়ে থাকলে এর প্রভাব থাকে এক রকমের, কিন্তু পরিসংখ্যানের হিসাব নিকাশকে এর দ্বারা প্রভাবিত করা হলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক।
এক সময় উৎপাদন বেশি দেখাতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ খাদ্যশস্য উৎপাদনের একটি হিসাব দিয়ে তা গ্রহণ করতে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে বাধ্য করত। একইভাবে শিল্প উৎপাদনকেও স্ফীত করে দেখিয়ে মাঠপর্যায় থেকে তথ্য দেয়ার ব্যবস্থা করা হতো। আর সেবা খাতে এমন কিছু উপখাত রয়েছে যেগুলোর উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানো সরকার চাইলে সহজভাবে করা যায়। ফলে অতীতে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ যে ধরনের প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল বাস্তবে সরকারের হিসাবে তার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, এর পেছনে রয়েছে তথ্য-উপাত্তের কারসাজি।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে ডাটা কারসাজির নানা তথ্য আসছে। এর মধ্যে মুদ্রা সরবরাহের মতো স্পর্শকাতর খাতও রয়েছে। প্রাপ্ত অনানুষ্ঠানিক তথ্য অনুসারে রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব যাতে অর্থনৈতিক সূচকে দৃশ্যমান না হয় তার জন্য বাজারে চলন অনুপযোগী টাকার বিপরীতে নতুন টাকার সরবরাহের কথা বলে বাজারে মুদ্রা ছাড়া হচ্ছে। কিন্তু যে পরিমাণ নতুন টাকা বাজারে যাচ্ছে তার বিপরীতে সে অঙ্কের অচল টাকা বাজার থেকে প্রত্যাহার হচ্ছে না। আনুষ্ঠানিক হিসাবেও এই বাড়তি টাকা দেখানো হচ্ছে না।
ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সৃষ্টি করে বিপুল অর্থ পাচারের ব্যাপারে সিপিডির পক্ষ থেকে একাধিকবার সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে আমদানির অর্থ বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে সেই আমদানি পণ্য দেশে না আনা অথবা ঘোষণার চেয়ে কম মূল্যের পণ্য আসা আর রফতানি করার পর সেই টাকা অপ্রত্যাবাসিত থেকে যাওয়াসহ নানাভাবে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। একই সাথে বিভিন্ন ব্যাংকে বিশেষত সরকারনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক ঋণ জালিয়াতির ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু খেলাপি ঋণের চিত্রে এর প্রতিফলন ঘটছে না। এটি আড়াল করতে প্রচলিত নিয়ম শিথিল করে কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়া বড় বড় ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংকিং খাতে ঋণ জালিয়াতির কারণে যে পরিস্থিতি দেশের আর্থিক খাতে সৃষ্টি হচ্ছে তা আনুষ্ঠানিক তথ্য-উপাত্তে সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নির্বাচিত সূচকে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর ২০১৪ শেষে খেলাপি ঋণের হার যেখানে ১১.৬০ শতাংশ ছিল তা ডিসেম্বর ২০১৪ শেষে ৯.৬৯ শতাংশে নেমে আসে। এ সময়ে দেশের আর্র্থিক খাতের কোনো উন্নয়ন আদৌ ছিল না। শুধু হিসাবের মারপ্যাঁচে খেলাপি ঋণকে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। কল মানি মার্কেটে সুদের হার কমিয়ে দেখানোর জন্যও মাঝে মধ্যে কারসাজির আশ্রয় নেয়া হয়।
অর্থনীতির এ ধরনের অবস্থা কোনোভাবেই দীর্ঘ সময়ের জন্য আড়াল করা সম্ভব হবে না। এক সময় এর প্রভাব আর্থিক খাতে ধসের মতো অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত রাজনৈতিক অস্থিরতাকে যেভাবে প্রলম্বিত করা হচ্ছে তাতে যেকোনো সময় এ অবস্থা ঘটতে পারে। এ ছাড়া রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার যদি ক্ষমতায় আসে তাদের পক্ষে অতীত অর্থনৈতিক কারসাজির প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বল্প সময়ে দৈনন্দিন আর্থিক ব্যবস্থাপনা চালিয়ে নেয়াও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের সার্বিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে আশঙ্কা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে আরো বাড়ছে। প্রতিবেশী ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক হিন্দুস্থান টাইমস গত ২ মার্চের এক নিবন্ধে বলেছে, ‘বাংলাদেশের অবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনাকে তার হিস্যার দায় কাঁধে নিতে হবে। যদিও তার শক্তিশালী ধর্মনিরপে গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু তিনি চাপের মুখে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দেখিয়েই চলেছেন। তার ছেলে ও প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট সদস্য, একজন বিশিষ্ট আইনবিদ (পড়ুন ড. কামাল হোসেন) এবং স্টার সম্পাদককে (পড়ুন মাহফুজ আনাম) দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতারের আহ্বান জানিয়েছেন।’ হিন্দুস্থান টাইমস বলেছে, ‘ওই গ্রেফতারের আহ্বান তিনি যে অভিযোগের ভিত্তিতে করেছেন তা স্পষ্টত ভিত্তিহীন। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার উচিত হবে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া থেকে বিরত থাকা এবং দেশকে আরো বেশি নৈরাজ্যের দিকে না ঠেলে দিতে পারে এমন ঝুঁকি না নেয়া।’ পত্রিকাটি আরো বলেছে,‘বাংলাদেশের রাজনীতি ভেঙে পড়েছে। এবং তার আইনের শাসনও দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশটি এত বেশি বিশৃঙ্খলা দেখছে যে, দৈনন্দিন ভিত্তিতে ঠিক কোন ব্যবস্থা কাজ করে তা নির্দিষ্ট করে অনুভব করা কঠিন।’
বিশ্বব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বলেছে বাংলাদেশ তিন ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে যার প্রভাব অর্থনীতির ওপর প্রবলভাবে পড়তে পারে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, স্থিতিশীলতা রক্ষা করা এবং সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করা। দ্বিতীয়টি হলো তৈরী পোশাক শিল্পে যে রূপান্তরপর্ব চলমান রয়েছে সেটি অতিক্রম করা। আর তৃতীয়টি হলো রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়ের ক্রমাবনতি ঠেকানো। বাংলাদেশের এ তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য যে ধরনের পরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন তার কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না এখন। এ কারণে ইকোনমিস্টের মতো বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিনের মন্তব্য হলো- বাংলাদেশ এখন খাদের কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছে। এই কিনারা থেকে চিৎপটাং হয়ে খাদে পড়ার কৃতিত্বটা শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নিয়েই নিচ্ছেন কি না সে সংশয় চার দিকে নানা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
এর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের অন্য দিকগুলোকে ছাড়িয়ে মুখ্য হয়ে উঠছে এর অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতির দিকটি। এ ক্ষতি অব্যাহত থাকলে দেশটি যেভাবে দ্রুত অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটি বড় রকম বাধার মুখে পড়তে পারে এমন পূর্বাভাস বিশ্বের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো বাংলাদেশের সার্বক্ষণিক উন্নয়ন অংশীদাররাও উদ্বেগ প্রকাশ করছে এই সঙ্কটে। যদিও তাদের সামনে এ রকম একটি শঙ্কাও কাজ করে যে বাংলাদেশে বর্তমান যে সরকার রয়েছে তাতে এখানকার অবস্থা সম্পর্কে মুক্তভাবে মন্তব্যের নানা ধরনের বিপদাপদ রয়েছে। এখানে বাস্তবে যা ঘটছে তা আড়াল করার এমন এক পেশাদারী প্রক্রিয়া সক্রিয় রয়েছে যাতে বাস্তব অবস্থার তথ্য-উপাত্ত সব সময় লভ্যও হয়ে ওঠে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ১৩ হাজার কোটি ডলারের মতো। বিশ্বব্যাংক কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতির পর্যালোচনা করেছে। এতে বিশ্ব উন্নয়ন সংস্থাটি বলেছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শুধুই উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে ১৪০ কোটি ডলারের, যা টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ১১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। উৎপাদন ক্ষতির বাইরে আরো নানা ধরনের ক্ষতি আছে যা হিসাবের মধ্যে আনা হলে রাজনৈতিক অস্থিরতার অর্থনৈতিক মূল্য আরো অনেক বেশি হবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) জানুয়ারি মাসের ১৬ দিনের এ ধরনের সার্বিক ক্ষতির একটি হিসাব দিয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে বেসরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ জানুয়ারি মাসের অবরোধজনিত সার্বিক ক্ষতির একটি হিসাব করেছে। এই হিসাব অনুসারে অবরোধের প্রথম মাসে মোট অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৬৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে তৈরী পোশাক খাতের ক্ষতির পরিমাণ হলো ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর বাইরে অবরোধের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ক্ষতির খাত পরিবহনে ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষি খাতে আট হাজার ৬৪১ কোটি টাকা, আবাসন খাতে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা এবং পর্যটনে ছয় হাজার ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
সিপিডির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রায় বছরব্যাপী যে সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল তার ক্ষতির চেয়ে বর্তমান ক্ষতি অনেক বেশি। আগের রাজনৈতিক অস্থিরতার মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির অঙ্ক হিসাব করা হয়েছিল ৫০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা চেম্বারের হিসাবকে ভিত্তি ধরে সিপিডির হিসাবে দুই মাসে এ ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়াচ্ছে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির সাড়ে সাত শতাংশের মতো। এবারের রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতি যেভাবে নিরূপণ করা হচ্ছে তাতে প্রকৃত ক্ষতির কতটা প্রতিফলন ঘটছে তা নিয়ে কিছুটা মতান্তর হতে পারে। তবে এই অস্থিরতা যে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে তাতে সংশয়ের অবকাশ থাকছে না।
বিশ্বব্যাংক অর্থবছরের যে সাত মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উৎপাদন ক্ষতির হিসাব করেছে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব জিডিপির ওপর পড়বে। এ সময়ের মধ্যে অবরোধ ছিল এক মাসের মতো। বাকি ছয় মাস ছিল পুরোপুরি স্থিতিশীল। এ ছয় মাসে বিরোধী জোটকে সেভাবে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে দেখা যায়নি। বিশ্বব্যাংকের রক্ষণশীল হিসাবেও এ পর্যন্ত যে সময়টাতে অবরোধ হরতাল হয়েছে তা হিসাব করা হলে মোট উৎপাদন ক্ষতি দাঁড়াবে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা জিডিপির আড়াই শতাংশের কাছাকাছি।
সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য ৭.৩ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ লক্ষ্যমাত্রাকে পরে ৬.২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। জানুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যমান পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ হলো জিডিপি কোনোভাবে ৫.৪ শতাংশের বেশি হবে না। মার্চের প্রথম সপ্তাহনাগাদ সেভাবে রাজনৈতিক স্থবিরতা কাটার কোনো লক্ষণ যেখানে দেখা যাচ্ছে না সেখানে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে বলা কঠিন। অবশ্য সরকারের হিসাব নিকাশের নির্ভরতার ব্যাপারে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সংশয় প্রকাশ এখন একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরা একদিকে বলেন হরতাল অবরোধে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে অন্য দিকে আবার দাবি করেন হরতালে দেশের জনজীবনে কোনো প্রভাব নেই। এ ধরনের রেটরিক শুধু রাজনৈতিক সুবিধার জন্য হয়ে থাকলে এর প্রভাব থাকে এক রকমের, কিন্তু পরিসংখ্যানের হিসাব নিকাশকে এর দ্বারা প্রভাবিত করা হলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক।
এক সময় উৎপাদন বেশি দেখাতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ খাদ্যশস্য উৎপাদনের একটি হিসাব দিয়ে তা গ্রহণ করতে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে বাধ্য করত। একইভাবে শিল্প উৎপাদনকেও স্ফীত করে দেখিয়ে মাঠপর্যায় থেকে তথ্য দেয়ার ব্যবস্থা করা হতো। আর সেবা খাতে এমন কিছু উপখাত রয়েছে যেগুলোর উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানো সরকার চাইলে সহজভাবে করা যায়। ফলে অতীতে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ যে ধরনের প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল বাস্তবে সরকারের হিসাবে তার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, এর পেছনে রয়েছে তথ্য-উপাত্তের কারসাজি।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে ডাটা কারসাজির নানা তথ্য আসছে। এর মধ্যে মুদ্রা সরবরাহের মতো স্পর্শকাতর খাতও রয়েছে। প্রাপ্ত অনানুষ্ঠানিক তথ্য অনুসারে রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব যাতে অর্থনৈতিক সূচকে দৃশ্যমান না হয় তার জন্য বাজারে চলন অনুপযোগী টাকার বিপরীতে নতুন টাকার সরবরাহের কথা বলে বাজারে মুদ্রা ছাড়া হচ্ছে। কিন্তু যে পরিমাণ নতুন টাকা বাজারে যাচ্ছে তার বিপরীতে সে অঙ্কের অচল টাকা বাজার থেকে প্রত্যাহার হচ্ছে না। আনুষ্ঠানিক হিসাবেও এই বাড়তি টাকা দেখানো হচ্ছে না।
ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সৃষ্টি করে বিপুল অর্থ পাচারের ব্যাপারে সিপিডির পক্ষ থেকে একাধিকবার সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে আমদানির অর্থ বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে সেই আমদানি পণ্য দেশে না আনা অথবা ঘোষণার চেয়ে কম মূল্যের পণ্য আসা আর রফতানি করার পর সেই টাকা অপ্রত্যাবাসিত থেকে যাওয়াসহ নানাভাবে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। একই সাথে বিভিন্ন ব্যাংকে বিশেষত সরকারনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক ঋণ জালিয়াতির ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু খেলাপি ঋণের চিত্রে এর প্রতিফলন ঘটছে না। এটি আড়াল করতে প্রচলিত নিয়ম শিথিল করে কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়া বড় বড় ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংকিং খাতে ঋণ জালিয়াতির কারণে যে পরিস্থিতি দেশের আর্থিক খাতে সৃষ্টি হচ্ছে তা আনুষ্ঠানিক তথ্য-উপাত্তে সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নির্বাচিত সূচকে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর ২০১৪ শেষে খেলাপি ঋণের হার যেখানে ১১.৬০ শতাংশ ছিল তা ডিসেম্বর ২০১৪ শেষে ৯.৬৯ শতাংশে নেমে আসে। এ সময়ে দেশের আর্র্থিক খাতের কোনো উন্নয়ন আদৌ ছিল না। শুধু হিসাবের মারপ্যাঁচে খেলাপি ঋণকে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। কল মানি মার্কেটে সুদের হার কমিয়ে দেখানোর জন্যও মাঝে মধ্যে কারসাজির আশ্রয় নেয়া হয়।
অর্থনীতির এ ধরনের অবস্থা কোনোভাবেই দীর্ঘ সময়ের জন্য আড়াল করা সম্ভব হবে না। এক সময় এর প্রভাব আর্থিক খাতে ধসের মতো অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত রাজনৈতিক অস্থিরতাকে যেভাবে প্রলম্বিত করা হচ্ছে তাতে যেকোনো সময় এ অবস্থা ঘটতে পারে। এ ছাড়া রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার যদি ক্ষমতায় আসে তাদের পক্ষে অতীত অর্থনৈতিক কারসাজির প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বল্প সময়ে দৈনন্দিন আর্থিক ব্যবস্থাপনা চালিয়ে নেয়াও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের সার্বিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে আশঙ্কা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে আরো বাড়ছে। প্রতিবেশী ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক হিন্দুস্থান টাইমস গত ২ মার্চের এক নিবন্ধে বলেছে, ‘বাংলাদেশের অবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনাকে তার হিস্যার দায় কাঁধে নিতে হবে। যদিও তার শক্তিশালী ধর্মনিরপে গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু তিনি চাপের মুখে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দেখিয়েই চলেছেন। তার ছেলে ও প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট সদস্য, একজন বিশিষ্ট আইনবিদ (পড়ুন ড. কামাল হোসেন) এবং স্টার সম্পাদককে (পড়ুন মাহফুজ আনাম) দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতারের আহ্বান জানিয়েছেন।’ হিন্দুস্থান টাইমস বলেছে, ‘ওই গ্রেফতারের আহ্বান তিনি যে অভিযোগের ভিত্তিতে করেছেন তা স্পষ্টত ভিত্তিহীন। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার উচিত হবে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া থেকে বিরত থাকা এবং দেশকে আরো বেশি নৈরাজ্যের দিকে না ঠেলে দিতে পারে এমন ঝুঁকি না নেয়া।’ পত্রিকাটি আরো বলেছে,‘বাংলাদেশের রাজনীতি ভেঙে পড়েছে। এবং তার আইনের শাসনও দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশটি এত বেশি বিশৃঙ্খলা দেখছে যে, দৈনন্দিন ভিত্তিতে ঠিক কোন ব্যবস্থা কাজ করে তা নির্দিষ্ট করে অনুভব করা কঠিন।’
বিশ্বব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বলেছে বাংলাদেশ তিন ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে যার প্রভাব অর্থনীতির ওপর প্রবলভাবে পড়তে পারে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, স্থিতিশীলতা রক্ষা করা এবং সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করা। দ্বিতীয়টি হলো তৈরী পোশাক শিল্পে যে রূপান্তরপর্ব চলমান রয়েছে সেটি অতিক্রম করা। আর তৃতীয়টি হলো রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়ের ক্রমাবনতি ঠেকানো। বাংলাদেশের এ তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য যে ধরনের পরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন তার কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না এখন। এ কারণে ইকোনমিস্টের মতো বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিনের মন্তব্য হলো- বাংলাদেশ এখন খাদের কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছে। এই কিনারা থেকে চিৎপটাং হয়ে খাদে পড়ার কৃতিত্বটা শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নিয়েই নিচ্ছেন কি না সে সংশয় চার দিকে নানা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
মাসুম খলিলী |
No comments