কাউন্ট ডাউন ও মান্নার গ্রেফতার by মাসুদ মজুমদার
সরকার
‘খুনির’ সাথে সংলাপ করবে না। শত হত্যার দায় পুলিশের, সরকারের নয়। এগুলো
হত্যা নয়, ক্রসফায়ার। সরকার দৃষ্টিভঙ্গিগত ভুলের ফাঁদে পড়ে পুরো দেশ, জাতি ও
বিশ্বসম্প্রদায়কে অস্বীকার করছে। তাই দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি আজকের আলোচনায়
প্রাধান্য পাবে।
দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, জীবন বদলে যাবে। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। এই দু’টি বাক্য আমার নয়, কোয়ান্টাম মেথডের কেন্দ্রীয় চরিত্র মহাজাতকের। তিনি বহু লোকের জীবন বদলে যেতে সাহায্য করেছেন। রাগ প্রশমনে তার দেয়া নীতিকথাটি অকাট্য। মানুষ রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তখনই ভুল করতে শুরু করে। ভুল পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কৌশল গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও ভুল তাকে তাড়া করে।
রাগ এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টা এখানে টেনে আনার কারণ দুটো, আমাদের রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতিবিদদের রাগ যা হিংসার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তার সুরাহা না হলে সরকার বলবে বিরোধী দলের আন্দোলনের অপমৃত্যু ঘটেছে এবং বিরোধী দল বলবে সরকার পতনের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে।
বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি এ সরকার হেরে যেতে শুরু করেছে। তারা কার্যত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে হেরে গেছেন অনেক আগেই। তারপর নানা কৌশলে টিকে ছিলেন, এখনো টিকে আছেন রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার করে; জনমতের ওপর ভিত্তি করে নয়। এখন তাদের আর কোনো নতুন কৌশল কাজ দেবে না। এখন নিজেদের গুটিয়ে নেবেন, না সময় পরিবেশ পরিস্থিতি তাদের গুটিয়ে যেতে বাধ্য করবে- সেটা শুধু অপেক্ষার ব্যাপার। গণতন্ত্র সামনে রাখলে তাদের কাউন্ট ডাউন শুরু, ক্ষমতার জোর সামনে রাখলেও তাদের পতনপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। প্রথমত, সরকার শক্তি দিয়ে যুক্তির মোকাবেলা করতে চেয়েছে। বাস্তবে যুক্তির মোকাবেলা শক্তি দিয়ে হয় না, যুক্তি দিয়েই করতে হয়। মানুষ বন্যপশুকেও পোষ মানায় কৌশলের মাধ্যমে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন- প্রথমে পুরো জাতিকে বিভক্ত করে দিতে হবে, তারপর তার মতো করে ঐক্যবদ্ধ করবেন। তার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে ব্যবহার করা সহজ ভাবলেন। করলেনও তাই। অথচ তিনি যখন বলেছিলেন তাকে বিজয়ী করে জনগণ স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার করেই ফেলেছে। সেটাই ছিল তার জন্য যথার্থ কৌশল। সাধারণত স্বাধীন দেশের শাসকেরা জাতিকে বিভক্ত করে না। ন্যূনতম ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করে দেশ পরিচালনা করে। ভাগ করো শাসন করো সাম্রাজ্যবাদী কিংবা উপনিবেশবাদী চিন্তার ফসল। জাতিকে বিভক্ত করতে করতে সরকার এখন একেবারে বিভক্তির ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে গেছে। ক্ষমতা ছাড়তেও এখন তাদের ভয়। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চার পাশ থেকে সরে দাঁড়ালে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের পনেরো নেতা কারো কোনো টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে বিরোধী দল মনে করে। তাদের বিভক্তির রাজনীতি তাদেরকেই এখন নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। বাস্তবতা অস্বীকার না করলে দেশ-বিদেশে তারা এখন বন্ধুহীন। এত দিনেও তারা হয়তো বুঝতে চাইবেন না, কয়েকটা ফাঁসি, কয়েক শ’ ক্রসফায়ার, হাজার হাজার গ্রেফতার, ডজন ডজন গুম, শত শত অপহরণ ও রাজনৈতিক মামলা-হামলা তাদের ক্ষমতা নিশ্চিত করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। পুরো বিষয়টি দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এমনটি হতে বাধ্য করেছে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক মোকাবেলা না করে নির্মূল করার ধারণা তাদেরকে চরম মাত্রায় প্রতিহিংসাপরায়ণ করে দিয়েছে। ইতিহাসের সাক্ষ্য হচ্ছে, রাজনীতি থেকে কাউকে কখনো নির্মূল করা যায় না। দমন করে সাময়িক স্বস্তি মেলে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শত শত শত্রুর জন্ম দেয়। ক্ষমতাসীনেরা বিগত ছয় বছরে অসংখ্য সুবিধাভোগী সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু লাখ লাখ মানুষকে শত্রু বানিয়েছেন।
বাংলাদেশের জমিনে কোনো দিন কোনো শাসক আমাদের কওমি ধারার আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখকে ঘাঁটাতে যাননি। ইংরেজরা তাদের সাথে যুদ্ধ করে টেকেনি। কালাপানিয়া তথা আন্দামান নিকোবরে দীপান্তর করে বাঁচতে চেয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত টেকেনি। এই দেশেই গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ও আলী ভাতৃদ্বয়ের খেলাফত আন্দোলনের মেলবন্ধন কিভাবে সম্ভব হয়েছিল সরকারের পরামর্শদাতারা বুঝতে চাননি। কারো শত্রু নয়, কিন্তু দেশের জন্য সামগ্রিক অর্থে কল্যাণকর এ সামাজিক শক্তিটিকে সরকার বিগড়ে দিয়েছে না বুঝেই। হেফাজতকে সৈয়দ আশরাফ যে দিন হুমকি দিয়ে রাজাকার-আলবদরের বাপ-দাদা বলে লেঙ্গুড় তুলে পালানোর হুমকি দিলেন, মধ্যরাতে তোপের মুখেও শাপলা চত্বরে রক্ত বইয়ে দিলেন, সে দিনই এই সরকার তাদের পতনের নি¤œগামী সিঁড়িতে বড় ধরনের একটা সিঁড়িবাঁধ জুড়ে দিলো।
তারা বুঝতে চাননি সামাজিক শক্তি হিসেবে হেফাজতের অবস্থান কতটা গভীরে এবং সাধারণ মানুষের কত গভীর হৃদয়কন্দরে তাদের অবস্থান। তাদের শিকড় কতটা বিস্তৃত এবং বহুমাত্রিক, সেটাও তারা বুঝবার চেষ্টা করলেন না। অথচ বঙ্গবন্ধু ও সৈয়দ নজরুলের রাজনীতির শুরু এ বাংলার মুসলিম মানসের আঁতুড়ঘরে। প্রধানমন্ত্রী তার বাবার ও নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েও বুঝতে চাইলেন নাÑ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বন্দুকের ওপর নির্ভরতার একটা মাত্রা থাকে। সেই মাত্রাটা জনগণই ঠিক করে দেয়। ভারসাম্য করে রাখার শক্তিটাও জনগণ। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন নিশ্চিত করে বিশ্বাস করে, সরকার জনগণের ভালো লাগা-মন্দ লাগার ওপর নির্ভরশীল নয়। আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের পুলিশি-নির্ভরতা ঠুনকো ও ক্ষণভঙ্গুর। সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, ক্ষমতার পাহারাদার সেজে সরকারকে জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এটাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াবে।
দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকার দশটা পজেটিভ কাজ করেছে এবং দশ হাজার নেগেটিভ কাজ করেছে। তাই শেষ বেলায় হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে লাভের খাতায় খড়ি, ক্ষতির খাতায় কেবল কলঙ্কের তিলক। লাল দাগ ও শূন্যের সংখ্যা বেশি। সরকার সাধু হলে জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস দেখানোর সব সুযোগ এখনো অবারিত।
মান্না-খোকার টেলিফোনে আড়িপাতার কোনো দরকার ছিল না। দেশে গণতন্ত্র থাকলে টেলিফোনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আড়িপাতার জন্য ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির মতো অভিযুক্ত হতেন। এখন হচ্ছে উল্টো। অথচ মান্না-খোকা কোনো অপরাধ করেননি। তারা রাজনৈতিক ও আন্দোলনের কৌশল নিয়ে মতবিনিময় করতেই পারেন। মাহমুদুর রহমান মান্নাকে কাছে থেকে জানি, তার রাজনীতির পূর্বাপর পর্যবেক্ষকও। আমাদের সময়ের মানুষ। এ দেশের ছাত্ররাজনীতির বরপুত্র। মান্নার অপরাধ, আরো যারা জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন তাদের মতো বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার তিনি হয়ে যাননি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের কাতারের মানুষ হিসেবে এত দিনে মান্না অর্জন করলেন তার প্রাপ্যটা। তার রাজনীতি নিয়ে যেকোনো মানুষের দ্বিমত থাকতে পারে কিন্তু যে কারণে তাকে গ্রেফতার করা হলো সেটা বাহানা মাত্র। মান্না এখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। মিডিয়ার দলকানা অংশ তার ওপর তথ্য সন্ত্রাস চালাচ্ছে। তারা মান্নার কপালে কলঙ্ক তিলক দিতে গিয়ে নিজেদের পেশাদারিত্বকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করছেন নাÑ পুরো পেশাদার সাংবাদিক সমাজকে কলঙ্কিত করছেন। যে দিন নিজের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ুণœ হবে সে দিন টের পাবেন তারা কতটা ছোট হয়ে গেলেন। অবস্থান পরিবর্তন না করলে প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন করে তিনি অর্জনের খাতায় আরো একটি পয়েন্ট যোগ করলেন। সেই সাথে তার মুকুটে যোগ হলো আরো একটি পালক। কারণ তার কথাবার্তায় রাজনীতিবিদের সীমা অতিক্রম করেনি। তিনি অসংযতও হননি। তার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা রাজনীতিবিদদের সাজে মিডিয়ার সাজে না। যত ভুল ব্যাখ্যাই করা হোক তিনি আজকের সময়কে ধারণ করেছেন মাত্র। এ হয়রানি তাকে আরো সম্মানিত করবে।
পুরো মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, ভোটারবিহীন নির্বাচনের এমপি, এমনকি আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরাও কথায় কথায় ক্ষেপে যাচ্ছেন। চোখ টাটিয়ে, হাতা গুটিয়ে, গলার রগ ফুলিয়ে, উচ্চকণ্ঠে তারা ক্ষ্যাপা মানুষের মতো অঙ্গভঙ্গি করছেন। ছায়ার বিরুদ্ধে শুধু যুদ্ধ করছেন না, কামানও দাগাচ্ছেন। যুক্তির থলি এখন শূন্য। গোছালো বক্তব্যের ভাণ্ডারও খালি। তাই রেগে যান, স্বভাবতই রেগে গেলে মানুষ হেরে যায়, অসঙ্গত আচরণ করে।
ক্ষমতা মানুষকে দুর্বিনীতি করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। ঔদ্ধত্য প্রকাশের ইন্ধন জোগায়। সেই সাথে খেই হারিয়ে ফেলতেও সাহায্য করে। জনগণ সব দেখতে পাচ্ছে অথচ তারা চোখ থাকতে অন্ধ, কান থাকতেও বধির হতে বাধ্য হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জেলে, মাঠ শূন্য, কেউ বা আত্মগোপনে, গুলি, অপহরণ ও ক্রসফায়ার-ভীতি তাবৎ বিরোধী দলকে তাড়িয়ে ফিরছে; তার পরও সরকারদলীয় নেতাদের আস্ফালন ও শূন্যে গদা ঘুরানোর শেষ নেইÑ কেন? এটা ভীতির লক্ষণ না মানসিক বৈকল্যের একধরনের উপসর্গ! গতানুগতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার রাজনীতি পুরোটাই কৌশলের খেলা। শত্রু কমিয়ে বন্ধু বাড়ানোর এই খেলায় আওয়ামী লীগ বন্ধু বাড়ায়নি। শত্রু বাড়িয়েছে। সুবিধাভোগী সৃষ্টি করেছে, সুহৃদ সৃষ্টি করেনি। কাককে কোকিল সাজিয়েছে, কাকের লেজে ময়ূরের পুচ্ছ গুঁজে দিতে চেয়েছে, আখেরে তারা নিঃসঙ্গ। সেই শেয়ারবাজার থেকে শত খুনের মাতম পর্যন্ত লাখো মানুষ বিগড়ে আছে। লোপাটতন্ত্রের কাছে হারমানা মানুষেরা সুখে নেই। তারা প্রহর গুনেই চলেছেন।
আওয়ামী লীগ ও তাদের বাম বন্ধুরা ইতিহাস খুঁড়ে জিয়াকে নির্মূল করতে চাইলেন- ক্ষমতার রাজনীতির জন্য এর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। খালেদাভীতি তাদের এতটা তাড়া করেছে অকারণে। জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে এত রাজনৈতিক অ্যানার্জি খরচ করার কোনো দরকারই ছিল না। অকারণে ড. ইউনূসসহ গ্রহণযোগ্য সুধীদের রুষ্ট করা হলো শুধু জিহ্বার দোষে। সব দিক থেকে নেতিবাচক অবস্থান ও আচরণ করতে গিয়ে সরকারের পুরো মাইন্ড সেটটা ‘না’ সূচক হয়ে গেছে। এখন সংলাপে না, সমঝোতায় না, নির্বাচনে না, জাতিসঙ্ঘ না, ইউরোপীয় ইউনিয়ন না, নরেন্দ্র মোদি না, ক্ষমতা ছাড়ার প্রশ্নে না, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না, জনগণ এত না দেখতে ও শুনতে আর রাজি না। তাই মনের বাঘ ধেয়ে আসছে। নিরাপদ প্রস্থানের পথও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
ডক্টর ইউনূস থেকে ব্যারিস্টার রফিক, টকশো থেকে স্বাধীনচিন্তার মানুষ- সবাইকে গুঁতো দিতে গিয়ে সরকার ভুল করেনি, এ ধারণাটা ভুল। ইলিয়াস আলী থেকে চৌধুরী আলম, তারপর গুমের তালিকা দীর্ঘতর হলো। ফেনীর একরাম হত্যা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, সাগর-রুনির লাশ হয়ে যাওয়াÑ এ তালিকা এখন দীর্ঘতর। সরকার না পারল সামাল দিতে, না পারল লুকাতে। পদ্মা সেতু থেকে রেলের কালো বিড়াল, ব্যাংক লোপাটের কাহিনী থেকে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, সর্বত্র বিডিআর বিদ্রোহের আগুন চাপা দেয়ার মতো ব্যবস্থা হলো।
বিদেশীদের সাহায্য সহযোগিতায় আমরা উন্নয়নের পথে চলি, তাদের দায়দেনাও শোধ করি। কিন্তু মাথা বিক্রি করি না। কূটনীতির ভাষায় দেশ-জাতির স্বার্থে শত্রু-বন্ধু চিহ্নিত করে পথ চলি। অথচ আমরা দলের স্বার্থকে পুরো দেশের স্বার্থের সমার্থক, একদলীয় সরকারকে রাষ্ট্রের সমার্থক মনে করি না। কাউকে আমরা ক্ষ্যাপাই না, আবার বাড়তি তোয়াজও করি না। বিদেশে বন্ধু আছে মানি, শত্রু আছে জানাই না। সরকার বিশ্বব্যাংক থেকে আন্তর্জাতিক সব ফোরামের সাথে শুধু দলীয় কিছু লোককে বাঁচানোর জন্য দূরত্ব সৃষ্টি করল। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যসহ সর্বত্র কূটনৈতিক বন্ধুত্বের ধস নেমেছে। সেটা না বুঝে মধ্যপ্রাচ্যে ‘বুয়া’ পাঠাতে যখন অন্য রাষ্ট্র রাজি হলো না, তখন আমাদের সরকার রাজি হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দরজা খোলার প্রচারণা চালালো। বিনা কারণে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করে মিত্রের সংখ্যা কমাতে কমাতে আমরা শেষ প্রান্তে এসে গেছি। চাটার দল এবং মোসাহেবরা এর নাম দিয়েছে সাহস, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বুক টান করে মাথা উঁচু করার এটাই নাকি আপসহীনতা। এক পরাশক্তির কাছে মাথা বিক্রি করে, অপর সম্প্রসারণবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিকে কুর্নিশ করে তারা ভাবছেন এ যুগের টিটো, নেহরু, নাসের ও ক্যাস্ট্রো হয়ে গেছেন। এই যুগের মাও বা লেনিন হয়ে উঠেছেন তাদের নেত্রী।
দেশে গণতন্ত্র থাকলে, আইনের শাসন নিশ্চিত করা গেলে, ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিয়ে জনগণকে সাথে রাখলে, মানবাধিকার সংরক্ষণ করলে বিদেশীদের যেকোনো দাদাগিরি মোকাবেলায় জনগণ সরকারকে সমর্থন জোগাত। এখন পুরো দেশটা যখন মৃত্যু উপত্যকা, রক্ষকই যখন ভক্ষক, খুন, অপহরণ, ক্রসফায়ার তাড়া করে, মানুষ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় উত্তরণের প্রহর গোনে, তখন যেকোনো মধ্যস্থতা, আপস রফা, শান্তি ও নিরাপত্তার বিনিময়ে জনগণ সেটাকে স্বাগত জানাবে। সারা বিশ্বকে অস্বীকার করে জনগণকে আর আস্থায় নেয়া যাবে না। বিদায়ের বিউগলে করুণ সুর বাজছে। শুনুন, সিদ্ধান্ত নিন, জনগণকে আশ্বস্ত করুন।
দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, জীবন বদলে যাবে। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। এই দু’টি বাক্য আমার নয়, কোয়ান্টাম মেথডের কেন্দ্রীয় চরিত্র মহাজাতকের। তিনি বহু লোকের জীবন বদলে যেতে সাহায্য করেছেন। রাগ প্রশমনে তার দেয়া নীতিকথাটি অকাট্য। মানুষ রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তখনই ভুল করতে শুরু করে। ভুল পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কৌশল গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও ভুল তাকে তাড়া করে।
রাগ এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টা এখানে টেনে আনার কারণ দুটো, আমাদের রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতিবিদদের রাগ যা হিংসার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তার সুরাহা না হলে সরকার বলবে বিরোধী দলের আন্দোলনের অপমৃত্যু ঘটেছে এবং বিরোধী দল বলবে সরকার পতনের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে।
বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি এ সরকার হেরে যেতে শুরু করেছে। তারা কার্যত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে হেরে গেছেন অনেক আগেই। তারপর নানা কৌশলে টিকে ছিলেন, এখনো টিকে আছেন রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার করে; জনমতের ওপর ভিত্তি করে নয়। এখন তাদের আর কোনো নতুন কৌশল কাজ দেবে না। এখন নিজেদের গুটিয়ে নেবেন, না সময় পরিবেশ পরিস্থিতি তাদের গুটিয়ে যেতে বাধ্য করবে- সেটা শুধু অপেক্ষার ব্যাপার। গণতন্ত্র সামনে রাখলে তাদের কাউন্ট ডাউন শুরু, ক্ষমতার জোর সামনে রাখলেও তাদের পতনপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। প্রথমত, সরকার শক্তি দিয়ে যুক্তির মোকাবেলা করতে চেয়েছে। বাস্তবে যুক্তির মোকাবেলা শক্তি দিয়ে হয় না, যুক্তি দিয়েই করতে হয়। মানুষ বন্যপশুকেও পোষ মানায় কৌশলের মাধ্যমে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন- প্রথমে পুরো জাতিকে বিভক্ত করে দিতে হবে, তারপর তার মতো করে ঐক্যবদ্ধ করবেন। তার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে ব্যবহার করা সহজ ভাবলেন। করলেনও তাই। অথচ তিনি যখন বলেছিলেন তাকে বিজয়ী করে জনগণ স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার করেই ফেলেছে। সেটাই ছিল তার জন্য যথার্থ কৌশল। সাধারণত স্বাধীন দেশের শাসকেরা জাতিকে বিভক্ত করে না। ন্যূনতম ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করে দেশ পরিচালনা করে। ভাগ করো শাসন করো সাম্রাজ্যবাদী কিংবা উপনিবেশবাদী চিন্তার ফসল। জাতিকে বিভক্ত করতে করতে সরকার এখন একেবারে বিভক্তির ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে গেছে। ক্ষমতা ছাড়তেও এখন তাদের ভয়। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চার পাশ থেকে সরে দাঁড়ালে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের পনেরো নেতা কারো কোনো টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে বিরোধী দল মনে করে। তাদের বিভক্তির রাজনীতি তাদেরকেই এখন নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। বাস্তবতা অস্বীকার না করলে দেশ-বিদেশে তারা এখন বন্ধুহীন। এত দিনেও তারা হয়তো বুঝতে চাইবেন না, কয়েকটা ফাঁসি, কয়েক শ’ ক্রসফায়ার, হাজার হাজার গ্রেফতার, ডজন ডজন গুম, শত শত অপহরণ ও রাজনৈতিক মামলা-হামলা তাদের ক্ষমতা নিশ্চিত করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। পুরো বিষয়টি দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এমনটি হতে বাধ্য করেছে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক মোকাবেলা না করে নির্মূল করার ধারণা তাদেরকে চরম মাত্রায় প্রতিহিংসাপরায়ণ করে দিয়েছে। ইতিহাসের সাক্ষ্য হচ্ছে, রাজনীতি থেকে কাউকে কখনো নির্মূল করা যায় না। দমন করে সাময়িক স্বস্তি মেলে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শত শত শত্রুর জন্ম দেয়। ক্ষমতাসীনেরা বিগত ছয় বছরে অসংখ্য সুবিধাভোগী সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু লাখ লাখ মানুষকে শত্রু বানিয়েছেন।
বাংলাদেশের জমিনে কোনো দিন কোনো শাসক আমাদের কওমি ধারার আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখকে ঘাঁটাতে যাননি। ইংরেজরা তাদের সাথে যুদ্ধ করে টেকেনি। কালাপানিয়া তথা আন্দামান নিকোবরে দীপান্তর করে বাঁচতে চেয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত টেকেনি। এই দেশেই গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ও আলী ভাতৃদ্বয়ের খেলাফত আন্দোলনের মেলবন্ধন কিভাবে সম্ভব হয়েছিল সরকারের পরামর্শদাতারা বুঝতে চাননি। কারো শত্রু নয়, কিন্তু দেশের জন্য সামগ্রিক অর্থে কল্যাণকর এ সামাজিক শক্তিটিকে সরকার বিগড়ে দিয়েছে না বুঝেই। হেফাজতকে সৈয়দ আশরাফ যে দিন হুমকি দিয়ে রাজাকার-আলবদরের বাপ-দাদা বলে লেঙ্গুড় তুলে পালানোর হুমকি দিলেন, মধ্যরাতে তোপের মুখেও শাপলা চত্বরে রক্ত বইয়ে দিলেন, সে দিনই এই সরকার তাদের পতনের নি¤œগামী সিঁড়িতে বড় ধরনের একটা সিঁড়িবাঁধ জুড়ে দিলো।
তারা বুঝতে চাননি সামাজিক শক্তি হিসেবে হেফাজতের অবস্থান কতটা গভীরে এবং সাধারণ মানুষের কত গভীর হৃদয়কন্দরে তাদের অবস্থান। তাদের শিকড় কতটা বিস্তৃত এবং বহুমাত্রিক, সেটাও তারা বুঝবার চেষ্টা করলেন না। অথচ বঙ্গবন্ধু ও সৈয়দ নজরুলের রাজনীতির শুরু এ বাংলার মুসলিম মানসের আঁতুড়ঘরে। প্রধানমন্ত্রী তার বাবার ও নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েও বুঝতে চাইলেন নাÑ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বন্দুকের ওপর নির্ভরতার একটা মাত্রা থাকে। সেই মাত্রাটা জনগণই ঠিক করে দেয়। ভারসাম্য করে রাখার শক্তিটাও জনগণ। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন নিশ্চিত করে বিশ্বাস করে, সরকার জনগণের ভালো লাগা-মন্দ লাগার ওপর নির্ভরশীল নয়। আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের পুলিশি-নির্ভরতা ঠুনকো ও ক্ষণভঙ্গুর। সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, ক্ষমতার পাহারাদার সেজে সরকারকে জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এটাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াবে।
দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকার দশটা পজেটিভ কাজ করেছে এবং দশ হাজার নেগেটিভ কাজ করেছে। তাই শেষ বেলায় হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে লাভের খাতায় খড়ি, ক্ষতির খাতায় কেবল কলঙ্কের তিলক। লাল দাগ ও শূন্যের সংখ্যা বেশি। সরকার সাধু হলে জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস দেখানোর সব সুযোগ এখনো অবারিত।
মান্না-খোকার টেলিফোনে আড়িপাতার কোনো দরকার ছিল না। দেশে গণতন্ত্র থাকলে টেলিফোনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আড়িপাতার জন্য ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির মতো অভিযুক্ত হতেন। এখন হচ্ছে উল্টো। অথচ মান্না-খোকা কোনো অপরাধ করেননি। তারা রাজনৈতিক ও আন্দোলনের কৌশল নিয়ে মতবিনিময় করতেই পারেন। মাহমুদুর রহমান মান্নাকে কাছে থেকে জানি, তার রাজনীতির পূর্বাপর পর্যবেক্ষকও। আমাদের সময়ের মানুষ। এ দেশের ছাত্ররাজনীতির বরপুত্র। মান্নার অপরাধ, আরো যারা জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন তাদের মতো বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার তিনি হয়ে যাননি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের কাতারের মানুষ হিসেবে এত দিনে মান্না অর্জন করলেন তার প্রাপ্যটা। তার রাজনীতি নিয়ে যেকোনো মানুষের দ্বিমত থাকতে পারে কিন্তু যে কারণে তাকে গ্রেফতার করা হলো সেটা বাহানা মাত্র। মান্না এখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। মিডিয়ার দলকানা অংশ তার ওপর তথ্য সন্ত্রাস চালাচ্ছে। তারা মান্নার কপালে কলঙ্ক তিলক দিতে গিয়ে নিজেদের পেশাদারিত্বকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করছেন নাÑ পুরো পেশাদার সাংবাদিক সমাজকে কলঙ্কিত করছেন। যে দিন নিজের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ুণœ হবে সে দিন টের পাবেন তারা কতটা ছোট হয়ে গেলেন। অবস্থান পরিবর্তন না করলে প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন করে তিনি অর্জনের খাতায় আরো একটি পয়েন্ট যোগ করলেন। সেই সাথে তার মুকুটে যোগ হলো আরো একটি পালক। কারণ তার কথাবার্তায় রাজনীতিবিদের সীমা অতিক্রম করেনি। তিনি অসংযতও হননি। তার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা রাজনীতিবিদদের সাজে মিডিয়ার সাজে না। যত ভুল ব্যাখ্যাই করা হোক তিনি আজকের সময়কে ধারণ করেছেন মাত্র। এ হয়রানি তাকে আরো সম্মানিত করবে।
পুরো মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, ভোটারবিহীন নির্বাচনের এমপি, এমনকি আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরাও কথায় কথায় ক্ষেপে যাচ্ছেন। চোখ টাটিয়ে, হাতা গুটিয়ে, গলার রগ ফুলিয়ে, উচ্চকণ্ঠে তারা ক্ষ্যাপা মানুষের মতো অঙ্গভঙ্গি করছেন। ছায়ার বিরুদ্ধে শুধু যুদ্ধ করছেন না, কামানও দাগাচ্ছেন। যুক্তির থলি এখন শূন্য। গোছালো বক্তব্যের ভাণ্ডারও খালি। তাই রেগে যান, স্বভাবতই রেগে গেলে মানুষ হেরে যায়, অসঙ্গত আচরণ করে।
ক্ষমতা মানুষকে দুর্বিনীতি করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। ঔদ্ধত্য প্রকাশের ইন্ধন জোগায়। সেই সাথে খেই হারিয়ে ফেলতেও সাহায্য করে। জনগণ সব দেখতে পাচ্ছে অথচ তারা চোখ থাকতে অন্ধ, কান থাকতেও বধির হতে বাধ্য হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জেলে, মাঠ শূন্য, কেউ বা আত্মগোপনে, গুলি, অপহরণ ও ক্রসফায়ার-ভীতি তাবৎ বিরোধী দলকে তাড়িয়ে ফিরছে; তার পরও সরকারদলীয় নেতাদের আস্ফালন ও শূন্যে গদা ঘুরানোর শেষ নেইÑ কেন? এটা ভীতির লক্ষণ না মানসিক বৈকল্যের একধরনের উপসর্গ! গতানুগতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার রাজনীতি পুরোটাই কৌশলের খেলা। শত্রু কমিয়ে বন্ধু বাড়ানোর এই খেলায় আওয়ামী লীগ বন্ধু বাড়ায়নি। শত্রু বাড়িয়েছে। সুবিধাভোগী সৃষ্টি করেছে, সুহৃদ সৃষ্টি করেনি। কাককে কোকিল সাজিয়েছে, কাকের লেজে ময়ূরের পুচ্ছ গুঁজে দিতে চেয়েছে, আখেরে তারা নিঃসঙ্গ। সেই শেয়ারবাজার থেকে শত খুনের মাতম পর্যন্ত লাখো মানুষ বিগড়ে আছে। লোপাটতন্ত্রের কাছে হারমানা মানুষেরা সুখে নেই। তারা প্রহর গুনেই চলেছেন।
আওয়ামী লীগ ও তাদের বাম বন্ধুরা ইতিহাস খুঁড়ে জিয়াকে নির্মূল করতে চাইলেন- ক্ষমতার রাজনীতির জন্য এর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। খালেদাভীতি তাদের এতটা তাড়া করেছে অকারণে। জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে এত রাজনৈতিক অ্যানার্জি খরচ করার কোনো দরকারই ছিল না। অকারণে ড. ইউনূসসহ গ্রহণযোগ্য সুধীদের রুষ্ট করা হলো শুধু জিহ্বার দোষে। সব দিক থেকে নেতিবাচক অবস্থান ও আচরণ করতে গিয়ে সরকারের পুরো মাইন্ড সেটটা ‘না’ সূচক হয়ে গেছে। এখন সংলাপে না, সমঝোতায় না, নির্বাচনে না, জাতিসঙ্ঘ না, ইউরোপীয় ইউনিয়ন না, নরেন্দ্র মোদি না, ক্ষমতা ছাড়ার প্রশ্নে না, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না, জনগণ এত না দেখতে ও শুনতে আর রাজি না। তাই মনের বাঘ ধেয়ে আসছে। নিরাপদ প্রস্থানের পথও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
ডক্টর ইউনূস থেকে ব্যারিস্টার রফিক, টকশো থেকে স্বাধীনচিন্তার মানুষ- সবাইকে গুঁতো দিতে গিয়ে সরকার ভুল করেনি, এ ধারণাটা ভুল। ইলিয়াস আলী থেকে চৌধুরী আলম, তারপর গুমের তালিকা দীর্ঘতর হলো। ফেনীর একরাম হত্যা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, সাগর-রুনির লাশ হয়ে যাওয়াÑ এ তালিকা এখন দীর্ঘতর। সরকার না পারল সামাল দিতে, না পারল লুকাতে। পদ্মা সেতু থেকে রেলের কালো বিড়াল, ব্যাংক লোপাটের কাহিনী থেকে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, সর্বত্র বিডিআর বিদ্রোহের আগুন চাপা দেয়ার মতো ব্যবস্থা হলো।
বিদেশীদের সাহায্য সহযোগিতায় আমরা উন্নয়নের পথে চলি, তাদের দায়দেনাও শোধ করি। কিন্তু মাথা বিক্রি করি না। কূটনীতির ভাষায় দেশ-জাতির স্বার্থে শত্রু-বন্ধু চিহ্নিত করে পথ চলি। অথচ আমরা দলের স্বার্থকে পুরো দেশের স্বার্থের সমার্থক, একদলীয় সরকারকে রাষ্ট্রের সমার্থক মনে করি না। কাউকে আমরা ক্ষ্যাপাই না, আবার বাড়তি তোয়াজও করি না। বিদেশে বন্ধু আছে মানি, শত্রু আছে জানাই না। সরকার বিশ্বব্যাংক থেকে আন্তর্জাতিক সব ফোরামের সাথে শুধু দলীয় কিছু লোককে বাঁচানোর জন্য দূরত্ব সৃষ্টি করল। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যসহ সর্বত্র কূটনৈতিক বন্ধুত্বের ধস নেমেছে। সেটা না বুঝে মধ্যপ্রাচ্যে ‘বুয়া’ পাঠাতে যখন অন্য রাষ্ট্র রাজি হলো না, তখন আমাদের সরকার রাজি হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দরজা খোলার প্রচারণা চালালো। বিনা কারণে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করে মিত্রের সংখ্যা কমাতে কমাতে আমরা শেষ প্রান্তে এসে গেছি। চাটার দল এবং মোসাহেবরা এর নাম দিয়েছে সাহস, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বুক টান করে মাথা উঁচু করার এটাই নাকি আপসহীনতা। এক পরাশক্তির কাছে মাথা বিক্রি করে, অপর সম্প্রসারণবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিকে কুর্নিশ করে তারা ভাবছেন এ যুগের টিটো, নেহরু, নাসের ও ক্যাস্ট্রো হয়ে গেছেন। এই যুগের মাও বা লেনিন হয়ে উঠেছেন তাদের নেত্রী।
দেশে গণতন্ত্র থাকলে, আইনের শাসন নিশ্চিত করা গেলে, ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিয়ে জনগণকে সাথে রাখলে, মানবাধিকার সংরক্ষণ করলে বিদেশীদের যেকোনো দাদাগিরি মোকাবেলায় জনগণ সরকারকে সমর্থন জোগাত। এখন পুরো দেশটা যখন মৃত্যু উপত্যকা, রক্ষকই যখন ভক্ষক, খুন, অপহরণ, ক্রসফায়ার তাড়া করে, মানুষ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় উত্তরণের প্রহর গোনে, তখন যেকোনো মধ্যস্থতা, আপস রফা, শান্তি ও নিরাপত্তার বিনিময়ে জনগণ সেটাকে স্বাগত জানাবে। সারা বিশ্বকে অস্বীকার করে জনগণকে আর আস্থায় নেয়া যাবে না। বিদায়ের বিউগলে করুণ সুর বাজছে। শুনুন, সিদ্ধান্ত নিন, জনগণকে আশ্বস্ত করুন।
No comments