ইয়েমেন-লিবিয়ার অস্থিরতা by মাসুমুর রহমান খলিলী
মধ্যপ্রাচ্যে
সঙ্ঘাত, হানাহানি ও অস্থিরতায় নতুন মাত্রা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। একই সাথে
বিশ্বের উত্তপ্ত এই অঞ্চলে নতুন মেরুকরণের লক্ষণও ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
দীর্ঘকালের রণক্ষেত্র সিরিয়ার পাশাপাশি যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যাপক
রক্তক্ষয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে লিবিয়া ও ইয়েমেনে। সিরীয় পরিস্থিতিও নতুন
দিকে মোড় নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রকাশ্যে
এখানকার সমস্যার সমাধান নিয়ে নানা দৌড়ঝাঁপ করলেও এর কার্যকর সমাধান চাইছে
কি না, সেটি নিয়ে দেখা দেয় নানা সংশয়। এখন সঙ্ঘাত-সহিংসতা এক দেশ থেকে আরেক
দেশে বিস্তৃত হচ্ছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার নিকট কোনো সম্ভাবনাই যেন দেখা
যাচ্ছে না। আরব বসন্তের ঢেউ লাগার পর থেকে ইয়েমেনে শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক
অস্থিরতা। অব্যাহত আন্দোলনের মুখে দেশটির দীর্ঘ সময়ের শাসক আলী আব্দুল্লাহ
সালেহ শর্তসাপেক্ষে ক্ষমতা ছাড়েন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের
মধ্যস্থতায়। সালেহ সরে দাঁড়ানোর পর ক্ষমতায় আসেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দ
রাব্বো মনসুর হাদি। প্রেসিডেন্ট মনসুর সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে নিজের
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু
করার প্রয়াস নেন। তবে অন্য ক’টি আরব দেশের মতোই তার এই প্রচেষ্টা নানা
কারণে বাধাগ্রস্ত হয়।
প্রশাসন ও রাজনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি নিজ দলের একটি অংশ এবং ইসলামপন্থী আল ইসলাহের সহযোগিতা পান। কিন্তু তার বিপক্ষে অবস্থান নেয় সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ সালেহ, তার ছেলে ও পদচ্যুত রিপাবলিকান কমান্ডার আহমদ আলী সালেহ ও শিয়া হুতি বিদ্রোহীরা। এই হুতিরা সালেহর বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মিসরে সেনা-অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মিসর-আমিরাত-সৌদি আরবের প্রভাবশালী একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলিম ব্রাদারহুড ও মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের উৎখাতের প্রচেষ্টা শুরু করার পর ইয়েমেনে তাদের লক্ষ্যবস্তু হয় আল ইসলাহ পার্টি। আল ইসলাহের বিরুদ্ধে হুতি ও আলী আব্দুল্লাহ সালেহর অনুগতদের আঁতাত করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত এক গোপন প্রয়াস নেয়। এর পাশাপাশি প্রশাসন থেকে আল ইসলাহ সমর্থকদের বের করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে হাদি প্রশাসনের ওপর। এই উদ্যোগের ফলে সালেহ অনুগামী ও হুতিদের মধ্যে পূর্বশত্রুতার অবসান ঘটে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হয়। অন্য দিকে আল ইসলাহের সাথে দূরত্ব এবং প্রশাসন ও দলের মধ্যে সালেহ অনুগতদের বিরোধিতায় হাদির সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শিয়া হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানায় অগ্রাভিযান শুরু করে। সালেহ অনুগতদের গোপন সমর্থনের কারণে মনসুর হাদির পক্ষে কোনো বাধা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আল ইসলাহ পার্টিও হুতিদের অগ্রাভিযান প্রতিরোধে কার্যকর কোনো বাধা তৈরি করেনি।
এতে শেষ পর্যন্ত মনসুর হাদি ও তার মন্ত্রিসভা চাপের মুখে নিজেদের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেয়। হুতিদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় রাজধানী সানায়। তারা একটি বিকল্প প্রশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। দক্ষিণের চারটি সুন্নিপ্রধান প্রদেশ হুতিদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা পৃথক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির উদ্যোগ না নিলেও প্রেসিডেন্ট হাদি সানা থেকে পালিয়ে গিয়ে দক্ষিণের এডেন পৌঁছে নিজেকে পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এর আগে তার দেয়া পদত্যাগপত্র তিনি তুলে নেন। এর পর থেকে ইয়েমেনে কার্যত দু’টি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সূত্রপাত ঘটল। একটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলো প্রেসিডেন্ট হাদির নেতৃত্বে সুন্নি গোষ্ঠীর। আরেকটির নিয়ন্ত্রণে থাকল মূলত শিয়া হুতিরা।
এভাবে ইরানের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে সৌদি আরবের সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইয়েমেনের উত্তরাংশে শিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। ঠিক এ সময়টিতে সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ পরলোক গমন করেন। নতুন বাদশা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিস্টদের প্রতি নমনীয় মনোভাবের সালমান বিন আব্দুল আজিজ। কট্টর পাশ্চাত্যপন্থী উপদেষ্টাদের প্রভাবে বাদশাহ আব্দুল্লাহ তার শাসনের শেষ দিকে মুসলিম ব্রাদারহুড ও মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপে নিজ দেশে বৈরী জনমতের মুখে পড়েন। মুসলিম জনগণের মধ্যেও সৌদিনীতি নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। বিশেষত মিসরে নির্মম গণহত্যা ও হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় ইসরাইলি নির্মমতায় অনেকখানি সরব-নীরব সমর্থন দেয়ায় আরব জনমত সৌদিনীতির বিপক্ষে চলে যায়। অন্য দিকে এর ফলে সৌদি সীমান্তবর্তী ইরাক-সিরীয় ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ (আইএস) নিজেদের সংহত করার সুযোগ পায়। এমনকি একপর্যায়ে সৌদি সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে বৈরিতাকে প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপ দিতে চেষ্টা করে আইএস। এভাবে ইয়েমেন-ইরাক দুই সীমান্তে বৈরী শক্তি হুমকি হয়ে দাঁড়ানোয় বাদশাহ সালমান তার পূর্ববর্তী সরকারের নীতি পর্যালোচনা করে নতুন কৌশল ঠিক করেন।
নতুন কৌশলের অংশ হিসেবে মধ্যপন্থী ইসলামিস্ট ও মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি বৈরী মনোভাবের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেন নতুন বাদশাহ। ক্ষমতায় আসার পরপরই ইসলামিস্টদের প্রতি বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে উদার মনোভাবের ইসলামিস্টদের সেখানে বসান তিনি। এরপর সৌদি প্রবীণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল ফয়সাল সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে ব্রাদারহুডের প্রতি তার সরকারের নতুন ও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটান। ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করার পর দলটির সাথে যুক্ত যাদের জেলে নেয়া হয়েছিল তাদের অনেককে মুক্তি দেয়া হয়। শিথিল করা হয় তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার। সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে ব্রাদারহুডকে বাদ দেয়া হতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। ড. ইউসুফ কারজাবির নেতৃত্বাধীন যে আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্কলার্স ফোরামকে আরব আমিরাত সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, সেই সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেলকে মক্কায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ইসলামিস্টদের প্রতি নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির সর্বশেষ প্রকাশ ঘটে মক্কায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ বা রাবেতায়ে আল আলম আল ইসলামির এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। মক্কায় অনুষ্ঠিত এই বৈশ্বিক সম্মেলনে বাদশাহ সালমানের বক্তব্য উপস্থাপন করেন মক্কার গভর্নর ও বাদশাহর উপদেষ্টা খালেদ আল ফয়সাল।
সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের ওপর আয়োজিত এ ধরনের সম্মেলনে সাধারণত বিভিন্ন দেশের ইসলামি থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিনিধি ও স্কলারদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এবার সম্মেলনে মধ্যপন্থী ইসলামি দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। যাদের মধ্যে পাকিস্তান জামায়াতের আমির সিরাজুল হক, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ইসলামি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন।
বাদশাহ আব্দুল্লাহর আমলে আইএস আলকায়েদার মতো কট্টরপন্থীদের সাথে ব্রাদারহুডের মতো মধ্যপন্থীদের একই কাতারে ফেলে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করা হয়। একই সাথে ইরানের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে সৌদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা নেয়া হয়। ইরানের সাথে সমঝোতার সে চেষ্টা তো সফল হয়নি, বরং তুরস্ক ও কাতারের মতো মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের সমর্থনকারী দেশের সাথেও তৈরি হয় দূরত্ব। উগ্র সেকুলারিস্টদের পাশে পেতে নমনীয় ইসলামিস্টদের শত্রুশিবিরে ঠেলে দেয়া হয়। সৌদি আরবের এই নীতির পরিবর্তনের যেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল তা আরো স্পষ্ট হয় রাবেতার এই বিশ্ব সম্মেলনে।
এই নীতি পরিবর্তনের সাথে ইয়েমেন পরিস্থিতির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র। প্রেসিডেন্ট হাদি এডেনে পৌঁছে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণার প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে রিয়াদের। এই সময়েই জাতিসঙ্ঘ হুতিদের ক্ষমতা গ্রহণ ও তাদের সাথে পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহর আঁতাতের ওপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ৬০ বিলিয়ন ডলারের মতো অবৈধ সম্পদ সালেহ অর্জন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়, যার একটি অংশ তিনি হুতিদের সানা দখলের সময় ব্যয় করেছেন। তিনি ইয়েমেনের পরবর্তী নির্বাচনে ছেলে আহমদ আলী সালেহকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী করতে চান বলেও খবর বেরিয়েছে। এসব বিষয় দেশটিকে আরো সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সৌদিনীতির পরিবর্তন হতে সাধারণভাবে বেশ সময় নেয়। নতুন বাদশাহ দায়িত্ব গ্রহণের পর অপেক্ষাকৃত দ্রুত নীতি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মিসরের সিসি সরকারের প্রতি রিয়াদের সমর্থন প্রত্যাহার হয়ে যাবে, এমনটি পর্যবেক্ষকেরা আশা করেন না। তবে সিসি সরকারের প্রতি যে অর্থনৈতিক সহায়তা সৌদি আরব দিয়ে যাচ্ছিল, তাতে টান পড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় উপসাগরীয় দেশগুলোর আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের জন্য ২১ কপটিক খ্রিষ্টানের শিরশ্ছেদ কাহিনী এবং এর জের ধরে লিবিয়ায় বিমান হামলার ঘটনাটি ঘটায় কায়রো।
নতুন পরিস্থিতিতে লিবিয়ার অবস্থা ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এখন রাজধানী ত্রিপলি ও অন্যতম বৃহৎ শহর মিসরাতাসহ দেশটির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে নিউ জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস ও তার মিত্ররা। জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস (জিএনসি) ২০১২ সালে নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। এ নির্বাচনে সেকুলারিস্ট-লিবারেলিস্টরা বেশি আসন লাভ করে। পরে জিএনসি প্রভাবিত লিবিয়ান সুপ্রিম কোর্ট ২০১২ সালের সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুরনো সংসদকে বৈধ ও কার্যকর ঘোষণা করে। অন্য দিকে দেশটির সীমান্ত নগরী তবরুকে যে সরকার রয়েছে তার সমর্থকেরা তবরুকসহ দেশের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। সুপ্রিম কোর্টের বাতিল ঘোষণাকে তবরুকের সরকার প্রত্যাখ্যান করে তাদের সরকার ও সংসদকে বৈধ বলে দাবি করে। এ সরকারের সমর্থনে রয়েছে মিসরের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল সিসির ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেনারেল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এ সরকারকে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজির কিছু অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কট্টরপন্থী ইসলামিস্ট আনসার আল শরিয়ার। বেনগাজি ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য খলিফা হাফতারের বাহিনী ও আনসার আল শরিয়ার মধ্যে নিয়মিত যুদ্ধ হয়। এর আগে শুরা কাউন্সিল অব বেনগাজির বিপ্লবীরা বেনগাজি ও ডেরনার নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বেনগাজির কিছু অংশ দখল করে। অন্য দিকে ডেরনা নোফালিয়া ও সিরতের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভ্যান্ড (আইসিল)। আইসিলের ২১ জন মিসরীয় কপটিক খ্রিষ্টান অপহরণ এবং পরে এসংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রকাশের পর মিসরীয় বিমানবাহিনী সেখানে হামলা চালায়। যদিও ভিডিওটিতে যেভাবে তাদের শিরশ্ছেদ করা হয় বলে দেখানো হয়, তাতে এটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। সিসির কড়া সমর্থক আমিরাত পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, ভিডিওটি দেখে মনে হয় হলিউডের উচ্চ প্রযুক্তি সহায়তায় তৈরি করা কোনো সিনেমা দেখছি।
আইএস নিজেকে সংহত করতে যুদ্ধকে বিস্তৃত করতে চায় নানাভাবে। ঠিক একইভাবে সিসি ও তার সরকার আন্তর্জাতিকভাবে যে গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কটে পড়েছে তা থেকে উদ্ধার পেতে কথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যুক্ত হতে চায়। এ ক্ষেত্রে লিবীয় তেলের প্রতি যে তার লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে, সে সংশয় থাকায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উৎসাহ দেখতে পায়নি সিসি। বিশেষত সিসির কথোপকথনের যে রেকর্ড প্রকাশ হয়েছে তাতে তার পক্ষে নিজের মিশনকে এগিয়ে নেয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে।
জাতিসঙ্ঘ লিবিয়ার বিবধমান প্রধান দুই পক্ষের মধ্যে যে সমঝোতার আলোচনা করছে তার সাফল্য চায় না সিসি। দেশটি নিজের অভ্যন্তরীণ গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কট কাটাতে লিবিয়ায় আইসিল-বিরোধী যুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের আশায় লিবিয়ায় তাৎক্ষণিক হামলা চালায় বলে ধারণা করা হয়। সিসি সরকার আশা করেছিল, আইএসের লিবীয় শাখার ২১ কপটিক খ্রিষ্টান হত্যার প্রতিশোধ নিতে যে বিমান হামলা চালানো হয়েছে, তার প্রতি সমর্থন দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই নির্মম সেনাকর্মকর্তার পেছনে দাঁড়িয়ে যাবে। বাস্তবে সেটি ঘটেনি। আরব লিগ এই হামলার বিরোধিতা না করলেও সেভাবে উৎসাহও দেখায়নি। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ সিসির এই কর্মকাণ্ডে কোনো ধরনের সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবরুক সরকারের সমর্থনে তিনি একটি আরব সেনাবাহিনী গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তার সাথে একমত হতে পারেনি অন্য অনেক দেশ। আলজেরিয়ার মতো দেশ এর বিরোধিতা করেছে। মিসরের অভ্যন্তরীণ জনমতও আইএসের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে দেশটির বিপর্যস্ত জনগণের ওপর আরো দুর্দশা ডেকে আনতে চাইছে না। আমিরাতের এ ব্যাপারে বাড়তি আগ্রহ থাকলেও সৌদি আরবের এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনো উদ্যোগ বা উৎসাহ দেখা যায় না।
ইয়েমেন বা লিবিয়া- কোনো দেশের সঙ্কটের আশু সমাধান হওয়ার আশা করা যায় না, বরং সেখানকার পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলা হতে পারে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশেরই সমস্যার সমাধান করতে চাইছে বলে মনে হয় না। সিরিয়ার সঙ্কটকে জটিল করে তুলে সেখানে আইএস রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রহস্যজনক উদ্যোগে এই রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর ইসলামের কথা বলে এটি এমন সব কর্মকাণ্ড ও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, যার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান চালানোতে এসবকে কাজে লাগানো হচ্ছে। প্রকাশ্যে যতই বিরোধিতা করা হোক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্ঘাতকে ছড়িয়ে দিতে আইএসকে কোনো অজ্ঞাত উৎস থেকে যে শক্তি জোগানো হচ্ছে, সেই সন্দেহ এখন আর থাকছে না। শিয়া ও সুন্নি শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে ইয়েমেনকে আবার দ্বিধাবিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়ে সৌদি আরবের জন্য নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করা এবং লিবিয়াকে বহু শক্তির রণক্ষেত্রে পরিণত করার মাধ্যমে ইসরাইলের ‘ইনোন পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের ইঙ্গিতই মিলছে। যার মূল কথা হলো প্রতিবেশী আরব দেশগুলোতে এমনভাবে বিভক্তি ও সঙ্ঘাত লাগিয়ে রাখতে হবে, যাতে এসব দেশ নিরাপত্তার জন্য ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর ইহুদিদের এ দেশটি হয় দাপটশালী আঞ্চলিক পরাশক্তি ও বিশ্ব পরিস্থিতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
প্রশাসন ও রাজনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি নিজ দলের একটি অংশ এবং ইসলামপন্থী আল ইসলাহের সহযোগিতা পান। কিন্তু তার বিপক্ষে অবস্থান নেয় সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ সালেহ, তার ছেলে ও পদচ্যুত রিপাবলিকান কমান্ডার আহমদ আলী সালেহ ও শিয়া হুতি বিদ্রোহীরা। এই হুতিরা সালেহর বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মিসরে সেনা-অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মিসর-আমিরাত-সৌদি আরবের প্রভাবশালী একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলিম ব্রাদারহুড ও মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের উৎখাতের প্রচেষ্টা শুরু করার পর ইয়েমেনে তাদের লক্ষ্যবস্তু হয় আল ইসলাহ পার্টি। আল ইসলাহের বিরুদ্ধে হুতি ও আলী আব্দুল্লাহ সালেহর অনুগতদের আঁতাত করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত এক গোপন প্রয়াস নেয়। এর পাশাপাশি প্রশাসন থেকে আল ইসলাহ সমর্থকদের বের করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে হাদি প্রশাসনের ওপর। এই উদ্যোগের ফলে সালেহ অনুগামী ও হুতিদের মধ্যে পূর্বশত্রুতার অবসান ঘটে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হয়। অন্য দিকে আল ইসলাহের সাথে দূরত্ব এবং প্রশাসন ও দলের মধ্যে সালেহ অনুগতদের বিরোধিতায় হাদির সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শিয়া হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানায় অগ্রাভিযান শুরু করে। সালেহ অনুগতদের গোপন সমর্থনের কারণে মনসুর হাদির পক্ষে কোনো বাধা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আল ইসলাহ পার্টিও হুতিদের অগ্রাভিযান প্রতিরোধে কার্যকর কোনো বাধা তৈরি করেনি।
এতে শেষ পর্যন্ত মনসুর হাদি ও তার মন্ত্রিসভা চাপের মুখে নিজেদের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেয়। হুতিদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় রাজধানী সানায়। তারা একটি বিকল্প প্রশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। দক্ষিণের চারটি সুন্নিপ্রধান প্রদেশ হুতিদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা পৃথক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির উদ্যোগ না নিলেও প্রেসিডেন্ট হাদি সানা থেকে পালিয়ে গিয়ে দক্ষিণের এডেন পৌঁছে নিজেকে পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এর আগে তার দেয়া পদত্যাগপত্র তিনি তুলে নেন। এর পর থেকে ইয়েমেনে কার্যত দু’টি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সূত্রপাত ঘটল। একটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলো প্রেসিডেন্ট হাদির নেতৃত্বে সুন্নি গোষ্ঠীর। আরেকটির নিয়ন্ত্রণে থাকল মূলত শিয়া হুতিরা।
এভাবে ইরানের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে সৌদি আরবের সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইয়েমেনের উত্তরাংশে শিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। ঠিক এ সময়টিতে সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ পরলোক গমন করেন। নতুন বাদশা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিস্টদের প্রতি নমনীয় মনোভাবের সালমান বিন আব্দুল আজিজ। কট্টর পাশ্চাত্যপন্থী উপদেষ্টাদের প্রভাবে বাদশাহ আব্দুল্লাহ তার শাসনের শেষ দিকে মুসলিম ব্রাদারহুড ও মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপে নিজ দেশে বৈরী জনমতের মুখে পড়েন। মুসলিম জনগণের মধ্যেও সৌদিনীতি নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। বিশেষত মিসরে নির্মম গণহত্যা ও হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় ইসরাইলি নির্মমতায় অনেকখানি সরব-নীরব সমর্থন দেয়ায় আরব জনমত সৌদিনীতির বিপক্ষে চলে যায়। অন্য দিকে এর ফলে সৌদি সীমান্তবর্তী ইরাক-সিরীয় ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ (আইএস) নিজেদের সংহত করার সুযোগ পায়। এমনকি একপর্যায়ে সৌদি সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে বৈরিতাকে প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপ দিতে চেষ্টা করে আইএস। এভাবে ইয়েমেন-ইরাক দুই সীমান্তে বৈরী শক্তি হুমকি হয়ে দাঁড়ানোয় বাদশাহ সালমান তার পূর্ববর্তী সরকারের নীতি পর্যালোচনা করে নতুন কৌশল ঠিক করেন।
নতুন কৌশলের অংশ হিসেবে মধ্যপন্থী ইসলামিস্ট ও মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি বৈরী মনোভাবের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেন নতুন বাদশাহ। ক্ষমতায় আসার পরপরই ইসলামিস্টদের প্রতি বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে উদার মনোভাবের ইসলামিস্টদের সেখানে বসান তিনি। এরপর সৌদি প্রবীণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল ফয়সাল সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে ব্রাদারহুডের প্রতি তার সরকারের নতুন ও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটান। ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করার পর দলটির সাথে যুক্ত যাদের জেলে নেয়া হয়েছিল তাদের অনেককে মুক্তি দেয়া হয়। শিথিল করা হয় তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার। সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে ব্রাদারহুডকে বাদ দেয়া হতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। ড. ইউসুফ কারজাবির নেতৃত্বাধীন যে আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্কলার্স ফোরামকে আরব আমিরাত সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, সেই সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেলকে মক্কায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ইসলামিস্টদের প্রতি নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির সর্বশেষ প্রকাশ ঘটে মক্কায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ বা রাবেতায়ে আল আলম আল ইসলামির এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। মক্কায় অনুষ্ঠিত এই বৈশ্বিক সম্মেলনে বাদশাহ সালমানের বক্তব্য উপস্থাপন করেন মক্কার গভর্নর ও বাদশাহর উপদেষ্টা খালেদ আল ফয়সাল।
সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের ওপর আয়োজিত এ ধরনের সম্মেলনে সাধারণত বিভিন্ন দেশের ইসলামি থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিনিধি ও স্কলারদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এবার সম্মেলনে মধ্যপন্থী ইসলামি দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। যাদের মধ্যে পাকিস্তান জামায়াতের আমির সিরাজুল হক, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ইসলামি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন।
বাদশাহ আব্দুল্লাহর আমলে আইএস আলকায়েদার মতো কট্টরপন্থীদের সাথে ব্রাদারহুডের মতো মধ্যপন্থীদের একই কাতারে ফেলে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করা হয়। একই সাথে ইরানের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে সৌদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা নেয়া হয়। ইরানের সাথে সমঝোতার সে চেষ্টা তো সফল হয়নি, বরং তুরস্ক ও কাতারের মতো মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের সমর্থনকারী দেশের সাথেও তৈরি হয় দূরত্ব। উগ্র সেকুলারিস্টদের পাশে পেতে নমনীয় ইসলামিস্টদের শত্রুশিবিরে ঠেলে দেয়া হয়। সৌদি আরবের এই নীতির পরিবর্তনের যেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল তা আরো স্পষ্ট হয় রাবেতার এই বিশ্ব সম্মেলনে।
এই নীতি পরিবর্তনের সাথে ইয়েমেন পরিস্থিতির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র। প্রেসিডেন্ট হাদি এডেনে পৌঁছে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণার প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে রিয়াদের। এই সময়েই জাতিসঙ্ঘ হুতিদের ক্ষমতা গ্রহণ ও তাদের সাথে পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহর আঁতাতের ওপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ৬০ বিলিয়ন ডলারের মতো অবৈধ সম্পদ সালেহ অর্জন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়, যার একটি অংশ তিনি হুতিদের সানা দখলের সময় ব্যয় করেছেন। তিনি ইয়েমেনের পরবর্তী নির্বাচনে ছেলে আহমদ আলী সালেহকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী করতে চান বলেও খবর বেরিয়েছে। এসব বিষয় দেশটিকে আরো সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সৌদিনীতির পরিবর্তন হতে সাধারণভাবে বেশ সময় নেয়। নতুন বাদশাহ দায়িত্ব গ্রহণের পর অপেক্ষাকৃত দ্রুত নীতি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মিসরের সিসি সরকারের প্রতি রিয়াদের সমর্থন প্রত্যাহার হয়ে যাবে, এমনটি পর্যবেক্ষকেরা আশা করেন না। তবে সিসি সরকারের প্রতি যে অর্থনৈতিক সহায়তা সৌদি আরব দিয়ে যাচ্ছিল, তাতে টান পড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় উপসাগরীয় দেশগুলোর আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের জন্য ২১ কপটিক খ্রিষ্টানের শিরশ্ছেদ কাহিনী এবং এর জের ধরে লিবিয়ায় বিমান হামলার ঘটনাটি ঘটায় কায়রো।
নতুন পরিস্থিতিতে লিবিয়ার অবস্থা ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এখন রাজধানী ত্রিপলি ও অন্যতম বৃহৎ শহর মিসরাতাসহ দেশটির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে নিউ জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস ও তার মিত্ররা। জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস (জিএনসি) ২০১২ সালে নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। এ নির্বাচনে সেকুলারিস্ট-লিবারেলিস্টরা বেশি আসন লাভ করে। পরে জিএনসি প্রভাবিত লিবিয়ান সুপ্রিম কোর্ট ২০১২ সালের সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুরনো সংসদকে বৈধ ও কার্যকর ঘোষণা করে। অন্য দিকে দেশটির সীমান্ত নগরী তবরুকে যে সরকার রয়েছে তার সমর্থকেরা তবরুকসহ দেশের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। সুপ্রিম কোর্টের বাতিল ঘোষণাকে তবরুকের সরকার প্রত্যাখ্যান করে তাদের সরকার ও সংসদকে বৈধ বলে দাবি করে। এ সরকারের সমর্থনে রয়েছে মিসরের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল সিসির ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেনারেল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এ সরকারকে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজির কিছু অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কট্টরপন্থী ইসলামিস্ট আনসার আল শরিয়ার। বেনগাজি ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য খলিফা হাফতারের বাহিনী ও আনসার আল শরিয়ার মধ্যে নিয়মিত যুদ্ধ হয়। এর আগে শুরা কাউন্সিল অব বেনগাজির বিপ্লবীরা বেনগাজি ও ডেরনার নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বেনগাজির কিছু অংশ দখল করে। অন্য দিকে ডেরনা নোফালিয়া ও সিরতের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভ্যান্ড (আইসিল)। আইসিলের ২১ জন মিসরীয় কপটিক খ্রিষ্টান অপহরণ এবং পরে এসংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রকাশের পর মিসরীয় বিমানবাহিনী সেখানে হামলা চালায়। যদিও ভিডিওটিতে যেভাবে তাদের শিরশ্ছেদ করা হয় বলে দেখানো হয়, তাতে এটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। সিসির কড়া সমর্থক আমিরাত পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, ভিডিওটি দেখে মনে হয় হলিউডের উচ্চ প্রযুক্তি সহায়তায় তৈরি করা কোনো সিনেমা দেখছি।
আইএস নিজেকে সংহত করতে যুদ্ধকে বিস্তৃত করতে চায় নানাভাবে। ঠিক একইভাবে সিসি ও তার সরকার আন্তর্জাতিকভাবে যে গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কটে পড়েছে তা থেকে উদ্ধার পেতে কথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যুক্ত হতে চায়। এ ক্ষেত্রে লিবীয় তেলের প্রতি যে তার লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে, সে সংশয় থাকায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উৎসাহ দেখতে পায়নি সিসি। বিশেষত সিসির কথোপকথনের যে রেকর্ড প্রকাশ হয়েছে তাতে তার পক্ষে নিজের মিশনকে এগিয়ে নেয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে।
জাতিসঙ্ঘ লিবিয়ার বিবধমান প্রধান দুই পক্ষের মধ্যে যে সমঝোতার আলোচনা করছে তার সাফল্য চায় না সিসি। দেশটি নিজের অভ্যন্তরীণ গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কট কাটাতে লিবিয়ায় আইসিল-বিরোধী যুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের আশায় লিবিয়ায় তাৎক্ষণিক হামলা চালায় বলে ধারণা করা হয়। সিসি সরকার আশা করেছিল, আইএসের লিবীয় শাখার ২১ কপটিক খ্রিষ্টান হত্যার প্রতিশোধ নিতে যে বিমান হামলা চালানো হয়েছে, তার প্রতি সমর্থন দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই নির্মম সেনাকর্মকর্তার পেছনে দাঁড়িয়ে যাবে। বাস্তবে সেটি ঘটেনি। আরব লিগ এই হামলার বিরোধিতা না করলেও সেভাবে উৎসাহও দেখায়নি। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ সিসির এই কর্মকাণ্ডে কোনো ধরনের সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবরুক সরকারের সমর্থনে তিনি একটি আরব সেনাবাহিনী গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তার সাথে একমত হতে পারেনি অন্য অনেক দেশ। আলজেরিয়ার মতো দেশ এর বিরোধিতা করেছে। মিসরের অভ্যন্তরীণ জনমতও আইএসের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে দেশটির বিপর্যস্ত জনগণের ওপর আরো দুর্দশা ডেকে আনতে চাইছে না। আমিরাতের এ ব্যাপারে বাড়তি আগ্রহ থাকলেও সৌদি আরবের এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনো উদ্যোগ বা উৎসাহ দেখা যায় না।
ইয়েমেন বা লিবিয়া- কোনো দেশের সঙ্কটের আশু সমাধান হওয়ার আশা করা যায় না, বরং সেখানকার পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলা হতে পারে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশেরই সমস্যার সমাধান করতে চাইছে বলে মনে হয় না। সিরিয়ার সঙ্কটকে জটিল করে তুলে সেখানে আইএস রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রহস্যজনক উদ্যোগে এই রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর ইসলামের কথা বলে এটি এমন সব কর্মকাণ্ড ও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, যার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান চালানোতে এসবকে কাজে লাগানো হচ্ছে। প্রকাশ্যে যতই বিরোধিতা করা হোক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্ঘাতকে ছড়িয়ে দিতে আইএসকে কোনো অজ্ঞাত উৎস থেকে যে শক্তি জোগানো হচ্ছে, সেই সন্দেহ এখন আর থাকছে না। শিয়া ও সুন্নি শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে ইয়েমেনকে আবার দ্বিধাবিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়ে সৌদি আরবের জন্য নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করা এবং লিবিয়াকে বহু শক্তির রণক্ষেত্রে পরিণত করার মাধ্যমে ইসরাইলের ‘ইনোন পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের ইঙ্গিতই মিলছে। যার মূল কথা হলো প্রতিবেশী আরব দেশগুলোতে এমনভাবে বিভক্তি ও সঙ্ঘাত লাগিয়ে রাখতে হবে, যাতে এসব দেশ নিরাপত্তার জন্য ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর ইহুদিদের এ দেশটি হয় দাপটশালী আঞ্চলিক পরাশক্তি ও বিশ্ব পরিস্থিতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
No comments