জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায় কেন? by এরশাদ মজুমদার
চলমান অবস্থায় নয়া দিগন্তের সম্পাদকীয়
পাতায় আমি অনুপস্থিত। দেহটা অসুস্থ, তাই। পুরো দেহ নয়। বেশ কিছু দিন হলো
হাতের কব্জি ও আঙুল রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিজে আক্রান্ত। চব্বিশ ঘণ্টা ব্যথা।
হাতের কাজগুলো করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু মনটা ছটফট করছে। দেশের এমন
দুর্দিনে আমার হাতের এমন অবস্থা আমাকে কাতর করে ফেলেছে। অপর দিকে আমার
বিবিজান খুবই খুশি। বন্ধুদের বলছেন, সাহেব লিখতে পারছেন না, আমি খুবই খুশি।
তা না হলে আরেক জ্বালা হতো। সরকার বাহাদুর কখন গোস্সা হয়ে যান, এই চিন্তায়
থাকতে হতো।
আমি তো সারা জীবন দেশ ( রাষ্ট্র নয়) ও দেশের মানুষের জন্য ভেবেছি আর কিছু করার চেষ্টা করেছি। আমার স্বপ্নের দেশকে আজো দেখিনি। সব সময় দেখেছি রাষ্ট্র নামের এ যন্ত্রটি কখনোই দেশের মানুষের কল্যাণ চায়নি। এ কারণেই পাকিস্তান টেকেনি। মাত্র ২৩ বছরে পাকিস্তানি পতাকা নেমে গেল এই ভূখণ্ডে। পুরো পাকিস্তান এখন অর্ধেক।
ষোলোআনা ভেজালহীন খাঁটি বাঙালি হওয়ার জন্য ’৭১ সালে বাঙালিদের জন্য নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নতুন রাষ্ট্র এখন জাতিসঙ্ঘের সদস্য, জাতীয় সঙ্গীত ও পতাকা আছে। ৪৩ বছর পার হয়ে গেছে, আমরা নাকি ষোলোআনা বাঙালি হতে পারিনি। জগতের মালিক আল্লাহ তায়ালা, কিন্তু বাংলাদেশের মালিক শুধুই বাঙালিরা। এখানে খোদাকে সার্বভৌম বলা যাবে না। তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। জেল জুলুম ফাঁসি হতে পারে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের জনগণের ওপর অত্যাচার করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি টিকে থাকতে চেয়েছিল। শক্তি প্রয়োগ করে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে পাকিস্তান টিকতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।
আমি অবাক হয়ে সারা জীবন দেখেছি, রাষ্ট্র ও সরকার দেশে ও জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেকে রা করার চেষ্টা করে আসছে। কারণ সরকার ও সংবিধান মনে করে মানুষের চেয়ে রাষ্ট্র বড়। মানুষের চেয়ে আইন ও আদালত বড়। মোঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আইন প্রায় একই। ল্য মানুষকে কঠোরভাবে দমন করা। মনে হয়, মানুষের চেয়ে রাষ্ট্র ও সরকার বড়। অথচ জনগণের নামেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় আর সেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এক ধরনের সংবিধানের মাধ্যমে যেনতেনভাবে নির্বাচিত সরকার দিয়ে। এর নাম নাকি গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র আর সরকারকে রার জন্য বিভিন্ন ধরনের বাহিনী লাগে। বিভিন্ন বাহিনী পালনের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়।
এ বিষয়ে আমি এর আগেও বহুবার লিখেছি। মূল বিষয়টি হচ্ছে, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক বা জনগণকে সম্মান করতে কোনো আইন আমাদের দেশে নেই। আমাদের আইন প্রণেতারা নাগরিক অধিকারের কথা চিন্তা না করে রাষ্ট্রের অধিকারের কথা বেশি চিন্তা করেছেন। ফলে রাষ্ট্র নির্দয় হয়ে যাওয়ার সুযোগ সব সময় থেকে যায়। আর অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রে সরকার ছাড়া আর কারো অধিকার থাকে না। আমেরিকায় ‘সিটিজেনস চার্টার অব রাইটস’, যা আমেরিকার নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার রা করে। আমেরিকার সংবিধান এই চার্টারকে অতিক্রম করতে পারে না।
বাংলাদেশের চলমান অবস্থাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে গণতান্ত্রিক মনে করি না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন এক নির্বাচনে চলমান সরকার মতায় এসেছেন। চলমান গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান কথা হলো, যেভাবেই হোক নির্বাচিত হও আর জনগণের নামে মতা দখল করো। তার পরে রাষ্ট্রযন্ত্র নামক অমানবিক সংস্থা সরকারকে রা করে। আমি এভাবেই রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান ও নির্বাচন নিয়ে ভাবি। জানি না, আমার এ চিন্তা নিয়ে আপনারা কতটুকু ভাবেন।
এখন জাতীয় সনদ তৈরির যে দাবি উঠেছে তাতে সবারই একমত হওয়া উচিত। আমি আগেই বলেছি, আমাদের আইনগুলো মানুষের ঊর্ধ্বে। এখানে মানুষের অধিকার, মর্যাদা, আইন সরকার রাষ্ট্রের অনেক নিচে। এখানে মানুষ অমানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান শিকার। তথাকথিত গণতন্ত্র ও নির্বাচনের নামে ২০১৩ সালে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন, দেশের সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। অপর দিকে, সরকার খুবই খুশি। কারণ এরা নাকি জনগণের অধিকার রা করে রাষ্ট্রকে রা করেছে। একই কারণে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে দেশের গোলযোগ শুরু হয়েছে। সরকার বলছে এবং বিশ্ববাসীকে বোঝাবার চেষ্টা করছে সরকারবিরোধী শক্তি জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। তাই জঙ্গিবাদ উৎরাতে সরকারকে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করতে হয়েছে। সন্ত্রাসীদের শাস্তি দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হচ্ছে।
চলমান অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল কারণ হচ্ছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, নির্বাচনব্যবস্থা ও পদ্ধতি। বিরোধী পক্ষ বলছে, তারা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। সরকার মনে করে, নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সংসদে মেজরিটির জোরে সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের আগে সরকার বলেছিল, এটি সংবিধান রার নির্বাচন। এখন বলছে, এরা ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। এটা কি রাজনৈতিক কৌশল, না মিথ্যাচার? আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একটি ব্যর্থ নির্বাচন। জোর করে নির্বাচন করা আর জোর করে মতায় থাকার স্বেচ্ছাচারী মনোভাব থেকেই চলমান সঙ্কটের জন্ম। আর সঙ্কট মোকাবেলা করতে গিয়েই সরকার চলমান দমননীতি গ্রহণ করেছে। রাখাল আর বাঘের গল্পের মতো চিৎকার চলেছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি জঙ্গিবাদী হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্ববাসী কেউ বিশ্বাস করছে না। সমস্যা হচ্ছে নির্বাচন, আর সরকার বলছে জঙ্গিবাদ। আইএস নাকি এর সাথে জড়িত হয়ে গেছে।
সত্তরের একচ্ছত্র জনপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মতায় এসে একদলীয় অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সব খবরের কাগজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতিতে সংযুক্ত করেছিলেন। বায়াত্তরে সমাজতন্ত্রের নামে ভারত ও রাশিয়ার প্ররোচনায় বেসরকারি সব সম্পদ সরকারের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন। ফলে চোয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। আমি নিজেও লাইনে দাঁড়িয়ে শিশুর দুধ সংগ্রহ করেছি। ভারত থেকে আমদানী করা জালের মতো শাড়ি দেখেছি। জাল পরা বাসন্তীর ছবির কথা আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। বঙ্গবন্ধুর পতনের পর দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হয়।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এখন সেই পথেই চলতে শুরু করেছেন, অতি সাবধানী ও কৌশলী পদক্ষেপ। ২০০৬ সালে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক মতবাদ ও শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে। তারই আন্দোলনের ফসল হিসেবে এক-এগারোর সেনাবাহিনীর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আসলে মতায় ছিল ভারত। জেনারেল মঈন ছিলেন ভারতের সমর্থিত জেনারেল। এই সরকারের ল্য ছিল শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা এবং তার প্রতিপক্ষকে রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় করা। সেই ধারা এখনো চলছে। এর মানে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের চাবিও ছিল দিল্লিতে। ওই আন্দোলনের ল্য ছিল অনির্বাচিত সেনা সমর্থক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। খালেদা জিয়াই জেনারেল মঈনকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু তিনি হয়তো জানতেন না জেনারেল মঈন ততণে দিল্লির অধীনে চলে গেছেন। সেই ভুলের খেসারতে খালেদা জিয়াকে এখনো ভুগতে হচ্ছে। আর কতদিন ভুগতে হবে তা আমরা জানি না। ২০০৬ থেকে ২০০১৫-এর জানুয়ারি নাগাদ বাংলাদেশ দিল্লির প্রভাবেই রয়েছে। আর দিল্লি চায় বাংলাদেশ ভারতের অনুগত বন্ধুতে পরিণত হোক। তাই তারা বাংলাদেশে একটি স্থায়ী অনুগত রাজনৈতিক দল চায়।
সাতচল্লিশ থেকেই দিল্লির লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে ধ্বংস করার, যা একাত্তরে করেছে। মাওলানা আজাদও বলেছিলেন পাকিস্তান টিকবে না। নেহরুজী নিজেও বলেছেন, পাকিস্তান একটি অবাস্তব কল্পনা। একাত্তরে বিজয়ের পর ইন্দিরাজী বলেছিলেন ‘হাজার বছরের বদলা নিলাম’। কিসের বদলা, কেন এই বদলা তা আমাদের নেতাদের বোঝার মতা নেই। আর ওভাবে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও চিন্তা করেননি। মমতাজী এসেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে ভারতের একটি রাজ্য বা প্রদেশের সাথে সাংস্কৃতিক চুক্তি করতে। অর্থাৎ পরাধীন বাঙালিদের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশীদের একই মর্যাদায় চুক্তি করা। লোকে বলে বাংলাদেশ এ হচ্ছে স্বাধীন আর পরাধীন বাঙালির মেলবন্ধন। শুরুতেই বলেছি, দিল্লি চায় বাংলাদেশের মুসলমানেরা কম মুসলমান হোক আর বেশি বাঙালি হলে মেলবন্ধনটা ভালো হবে। মুসলমান শব্দটাকে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সাম্প্রদায়িক শব্দ বলে প্রচার করেন। এরা নিজেদের মুসলমান বাঙালি বলতেও লজ্জাবোধ করে। সাতচল্লিশে যাদের বাপ-দাদারা হিন্দু ভারত ত্যাগ করে পূর্বপাকিস্তান চলে এসেছে এবং যাবতীয় সুখ আনন্দ ভোগ করেছে, এরাও এখন দিল্লির দাস হতে চায়। এরা জ্ঞানপাপী এবং অন্ধ।
শাসক হিসেবে ইংরেজদের আসার আগে ভারতে বা অখণ্ড বাংলায় শাসন ও সামাজিকতায় হিন্দু মুসলমান বলে কিছুই ছিল না। এ ধারণা বা আলোচনাটা আসতে শুরু করেছে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও শোষণের কারণে। ইংরেজ আমলে মুসলমানেরা সীমাহীন নির্যাতন ও শোষণের শিকার হয়েছে। আর ইংরেজদের সহযোগিতা করে আনুকূল্য লাভ করেছে হিন্দুসমাজ। জিন্নাহসহ অনেক বড় বড় মুসলমান নেতা অখণ্ড ভারত চেয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দু নেতারা মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার অস্বীকার করায় খণ্ড ভারতের চিন্তা সামনে আসতে থাকে। তারই ফল হলো পাকিস্তান। অপর দিকে, অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব উত্থাপিত হলে গান্ধীজী ও নেহরুজী এর বিরোধিতা করেন। কারণ, অখণ্ড বাংলায় মুসলমানেরা মেজরিটি ছিলেন।
১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হলে হিন্দু নেতারা এর বিরোধিতা করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত হিন্দু নেতাদের আন্দোলনের ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। পূর্ববঙ্গ আবার কলকাতার অধীনে চলে যায়। ১৯৪৭ সালে অখণ্ড বাংলার দাবি হিন্দু নেতারা গ্রহণ করেননি। এর কারণ ও রহস্য বোঝার মতো ধ্যানজ্ঞান-চিন্তা আমাদের রাজনীতিক ও তরুণ সমাজের নেই। কারণ এরা নিজেদের বাপ-দাদার ইতিহাস ঐতিহ্যকে ত্যাগ করেছে বা করতে চায়। জানতে হবে কারা তাদের বিপথে পরিচালিত করছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের রহস্য লুকিয়ে আছে দিল্লির আগ্রাসী নীতির ভেতর।
আপনাদের অবশ্যই বুঝতে হবে কেন হিন্দু নেতারা ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ নামে নতুন প্রদেশ গঠনের বিরোধিতা করে এক বাংলা চেয়েছিলেন। আবার কেনইবা ’৪৭ সালে খণ্ডিত বাংলা চাইলেন? আপনারা ইতিহাসসচেতন হন। নিজেদের ঐতিহ্য ও বায়া দলিলের খোঁজ নিন। আবার ’৭১-এ দিল্লি কেন আমাদের সমর্থন করেছে। আমি জানি আমাদের তরুণ সমাজ এখন বিভ্রান্ত ও ভুল পথে পরিচালিত। বারবার বলে চলেছি দিল্লি বাংলাদেশে একটি খাঁটি বাঙালির রাষ্ট্র চায়, যার ভেতর ইসলাম বা মুসলমানিত্বের কোনো ছাপ থাকবে না। অথবা শুধু নামের মুসলমানের একটি দেশ চায়। যাদের আরবি নাম থাকবে; কিন্তু মুসলমান নয়। যারা শুধুই বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করবে, যা ভারতীয় বাঙালিরা চর্চা করে। আপনারা কি জানেন, একসময় অফিস-আদালতে মুসলমানেরা ধুতি পরত। ১৭৫৭ সালের পর বাংলার মুসলমানের অবস্থা কী হয়েছিল তা জানার জন্য হান্টারের ‘দ্য মুসলমান’ বইটি পড়ুন।
এতণ ইতিহাসের পেছনের কথা বলেছি। তাহলে বাংলাদেশের চলমান সঙ্কটের সাথে ইতিহাসের কী সম্পর্ক আছে? তা হলো ভারত বাংলাদেশে এমন একটি সরকার চায়, যা ভারতের স্বার্থে কাজ করবে। যে সরকার অনুগত বন্ধু হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশকে ভারতের বাজার হিসেবে গড়ে তুলবে। যে মুসলমানিত্বের কারণে তারা পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল তা চিরতরে মুছে দিতে হবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে। আপনারা কি ল করেছেন, মমতা ব্যানার্জির সাথে নাগরিক নামে যারা কথা বলেছেন, তারা এরা? এরা বাংলা ও আরবি নামধারী কিছু বাঙালি। এদের কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব মানে ভারতের অনুগত বন্ধুত্ব। এদের পাসপোর্টে বাংলাদেশী কথাটা লেখা থাকলেও তা মানে না।
চলমান সরকার ভারতের সেবা করার ব্যাপরে সবচেয়ে বেশি পরীতি। ভারতে পাঁচ বছর থাকাকালে তিনি ওই পরীক্ষায় ডাবল প্লাস পেয়েছেন। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থক সরকার এক তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে চলমান সরকারকে মতায় বসিয়েছে। ৫ জানুয়ারির ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে জোর করে শেখ হাসিনাকে মতায় বসিয়েছে। সেই ভুয়া নির্বাচনের কারণেই চলমান সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনের আগে দু-তিন শ’ মানুষ মারা গেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আর এখন ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। নির্বাচনের দাবিকে দাবিয়ে রেখে সরকার বলছে এটা জঙ্গি ও সন্ত্রাসী। মিডিয়া সরকারি বক্তব্যকে উদারভাবে প্রচার করছে, আর বিরোধী দলকে দমনের জন্য সরকারকে উদ্ধার করছে। বিদেশী বা জাতিসঙ্ঘকে দলে টানার জন্য সরকার প্রচার করছে বিরোধী দলের আন্দোলন গণতন্ত্রের জন্য নয়, বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য।
আমি সব সময় বলে থাকি, জনগণের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহের বাইরে বা উপরে কোনো আইন থাকতে পারে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন এখন জনআকাঙ্ক্ষা বিরোধী। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে কেয়ার টেকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তখনো বহু মানুষ মারা গেছে। আপনরাই প্রশ্ন করুন সে সময়ে আওয়ামী লীগ কেন কেয়ার টেকার সরকার চেয়েছিল? তাদের লক্ষ্য কী ছিল? পরে কেনইবা আওয়ামী লীগ কেয়ার টেকার ব্যবস্থা বাতিল করল? এ ব্যাপারে আমাদের সাংবাদিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা প্রশ্ন তোলেন না। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, জনআকাক্সাবিরোধী কোনো আইনই আইন নয়। সমস্যাটা এতই সহজ যে, তা সমাধানের জন্য রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে লাভ হবে না। সবাই এটা বোঝেন। কিন্তু সরকার ও রাষ্ট্রশক্তির ভয়ে একমঞ্চে একবাক্যে কথা বলতে পারছেন না।
আমি তো সারা জীবন দেশ ( রাষ্ট্র নয়) ও দেশের মানুষের জন্য ভেবেছি আর কিছু করার চেষ্টা করেছি। আমার স্বপ্নের দেশকে আজো দেখিনি। সব সময় দেখেছি রাষ্ট্র নামের এ যন্ত্রটি কখনোই দেশের মানুষের কল্যাণ চায়নি। এ কারণেই পাকিস্তান টেকেনি। মাত্র ২৩ বছরে পাকিস্তানি পতাকা নেমে গেল এই ভূখণ্ডে। পুরো পাকিস্তান এখন অর্ধেক।
ষোলোআনা ভেজালহীন খাঁটি বাঙালি হওয়ার জন্য ’৭১ সালে বাঙালিদের জন্য নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নতুন রাষ্ট্র এখন জাতিসঙ্ঘের সদস্য, জাতীয় সঙ্গীত ও পতাকা আছে। ৪৩ বছর পার হয়ে গেছে, আমরা নাকি ষোলোআনা বাঙালি হতে পারিনি। জগতের মালিক আল্লাহ তায়ালা, কিন্তু বাংলাদেশের মালিক শুধুই বাঙালিরা। এখানে খোদাকে সার্বভৌম বলা যাবে না। তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। জেল জুলুম ফাঁসি হতে পারে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের জনগণের ওপর অত্যাচার করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি টিকে থাকতে চেয়েছিল। শক্তি প্রয়োগ করে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে পাকিস্তান টিকতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।
আমি অবাক হয়ে সারা জীবন দেখেছি, রাষ্ট্র ও সরকার দেশে ও জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেকে রা করার চেষ্টা করে আসছে। কারণ সরকার ও সংবিধান মনে করে মানুষের চেয়ে রাষ্ট্র বড়। মানুষের চেয়ে আইন ও আদালত বড়। মোঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আইন প্রায় একই। ল্য মানুষকে কঠোরভাবে দমন করা। মনে হয়, মানুষের চেয়ে রাষ্ট্র ও সরকার বড়। অথচ জনগণের নামেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় আর সেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এক ধরনের সংবিধানের মাধ্যমে যেনতেনভাবে নির্বাচিত সরকার দিয়ে। এর নাম নাকি গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র আর সরকারকে রার জন্য বিভিন্ন ধরনের বাহিনী লাগে। বিভিন্ন বাহিনী পালনের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়।
এ বিষয়ে আমি এর আগেও বহুবার লিখেছি। মূল বিষয়টি হচ্ছে, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক বা জনগণকে সম্মান করতে কোনো আইন আমাদের দেশে নেই। আমাদের আইন প্রণেতারা নাগরিক অধিকারের কথা চিন্তা না করে রাষ্ট্রের অধিকারের কথা বেশি চিন্তা করেছেন। ফলে রাষ্ট্র নির্দয় হয়ে যাওয়ার সুযোগ সব সময় থেকে যায়। আর অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রে সরকার ছাড়া আর কারো অধিকার থাকে না। আমেরিকায় ‘সিটিজেনস চার্টার অব রাইটস’, যা আমেরিকার নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার রা করে। আমেরিকার সংবিধান এই চার্টারকে অতিক্রম করতে পারে না।
বাংলাদেশের চলমান অবস্থাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে গণতান্ত্রিক মনে করি না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন এক নির্বাচনে চলমান সরকার মতায় এসেছেন। চলমান গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান কথা হলো, যেভাবেই হোক নির্বাচিত হও আর জনগণের নামে মতা দখল করো। তার পরে রাষ্ট্রযন্ত্র নামক অমানবিক সংস্থা সরকারকে রা করে। আমি এভাবেই রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান ও নির্বাচন নিয়ে ভাবি। জানি না, আমার এ চিন্তা নিয়ে আপনারা কতটুকু ভাবেন।
এখন জাতীয় সনদ তৈরির যে দাবি উঠেছে তাতে সবারই একমত হওয়া উচিত। আমি আগেই বলেছি, আমাদের আইনগুলো মানুষের ঊর্ধ্বে। এখানে মানুষের অধিকার, মর্যাদা, আইন সরকার রাষ্ট্রের অনেক নিচে। এখানে মানুষ অমানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান শিকার। তথাকথিত গণতন্ত্র ও নির্বাচনের নামে ২০১৩ সালে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন, দেশের সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। অপর দিকে, সরকার খুবই খুশি। কারণ এরা নাকি জনগণের অধিকার রা করে রাষ্ট্রকে রা করেছে। একই কারণে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে দেশের গোলযোগ শুরু হয়েছে। সরকার বলছে এবং বিশ্ববাসীকে বোঝাবার চেষ্টা করছে সরকারবিরোধী শক্তি জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। তাই জঙ্গিবাদ উৎরাতে সরকারকে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করতে হয়েছে। সন্ত্রাসীদের শাস্তি দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হচ্ছে।
চলমান অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল কারণ হচ্ছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, নির্বাচনব্যবস্থা ও পদ্ধতি। বিরোধী পক্ষ বলছে, তারা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। সরকার মনে করে, নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সংসদে মেজরিটির জোরে সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের আগে সরকার বলেছিল, এটি সংবিধান রার নির্বাচন। এখন বলছে, এরা ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। এটা কি রাজনৈতিক কৌশল, না মিথ্যাচার? আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একটি ব্যর্থ নির্বাচন। জোর করে নির্বাচন করা আর জোর করে মতায় থাকার স্বেচ্ছাচারী মনোভাব থেকেই চলমান সঙ্কটের জন্ম। আর সঙ্কট মোকাবেলা করতে গিয়েই সরকার চলমান দমননীতি গ্রহণ করেছে। রাখাল আর বাঘের গল্পের মতো চিৎকার চলেছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি জঙ্গিবাদী হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্ববাসী কেউ বিশ্বাস করছে না। সমস্যা হচ্ছে নির্বাচন, আর সরকার বলছে জঙ্গিবাদ। আইএস নাকি এর সাথে জড়িত হয়ে গেছে।
সত্তরের একচ্ছত্র জনপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মতায় এসে একদলীয় অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সব খবরের কাগজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতিতে সংযুক্ত করেছিলেন। বায়াত্তরে সমাজতন্ত্রের নামে ভারত ও রাশিয়ার প্ররোচনায় বেসরকারি সব সম্পদ সরকারের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন। ফলে চোয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। আমি নিজেও লাইনে দাঁড়িয়ে শিশুর দুধ সংগ্রহ করেছি। ভারত থেকে আমদানী করা জালের মতো শাড়ি দেখেছি। জাল পরা বাসন্তীর ছবির কথা আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। বঙ্গবন্ধুর পতনের পর দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হয়।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এখন সেই পথেই চলতে শুরু করেছেন, অতি সাবধানী ও কৌশলী পদক্ষেপ। ২০০৬ সালে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক মতবাদ ও শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে। তারই আন্দোলনের ফসল হিসেবে এক-এগারোর সেনাবাহিনীর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আসলে মতায় ছিল ভারত। জেনারেল মঈন ছিলেন ভারতের সমর্থিত জেনারেল। এই সরকারের ল্য ছিল শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা এবং তার প্রতিপক্ষকে রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় করা। সেই ধারা এখনো চলছে। এর মানে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের চাবিও ছিল দিল্লিতে। ওই আন্দোলনের ল্য ছিল অনির্বাচিত সেনা সমর্থক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। খালেদা জিয়াই জেনারেল মঈনকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু তিনি হয়তো জানতেন না জেনারেল মঈন ততণে দিল্লির অধীনে চলে গেছেন। সেই ভুলের খেসারতে খালেদা জিয়াকে এখনো ভুগতে হচ্ছে। আর কতদিন ভুগতে হবে তা আমরা জানি না। ২০০৬ থেকে ২০০১৫-এর জানুয়ারি নাগাদ বাংলাদেশ দিল্লির প্রভাবেই রয়েছে। আর দিল্লি চায় বাংলাদেশ ভারতের অনুগত বন্ধুতে পরিণত হোক। তাই তারা বাংলাদেশে একটি স্থায়ী অনুগত রাজনৈতিক দল চায়।
সাতচল্লিশ থেকেই দিল্লির লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে ধ্বংস করার, যা একাত্তরে করেছে। মাওলানা আজাদও বলেছিলেন পাকিস্তান টিকবে না। নেহরুজী নিজেও বলেছেন, পাকিস্তান একটি অবাস্তব কল্পনা। একাত্তরে বিজয়ের পর ইন্দিরাজী বলেছিলেন ‘হাজার বছরের বদলা নিলাম’। কিসের বদলা, কেন এই বদলা তা আমাদের নেতাদের বোঝার মতা নেই। আর ওভাবে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও চিন্তা করেননি। মমতাজী এসেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে ভারতের একটি রাজ্য বা প্রদেশের সাথে সাংস্কৃতিক চুক্তি করতে। অর্থাৎ পরাধীন বাঙালিদের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশীদের একই মর্যাদায় চুক্তি করা। লোকে বলে বাংলাদেশ এ হচ্ছে স্বাধীন আর পরাধীন বাঙালির মেলবন্ধন। শুরুতেই বলেছি, দিল্লি চায় বাংলাদেশের মুসলমানেরা কম মুসলমান হোক আর বেশি বাঙালি হলে মেলবন্ধনটা ভালো হবে। মুসলমান শব্দটাকে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সাম্প্রদায়িক শব্দ বলে প্রচার করেন। এরা নিজেদের মুসলমান বাঙালি বলতেও লজ্জাবোধ করে। সাতচল্লিশে যাদের বাপ-দাদারা হিন্দু ভারত ত্যাগ করে পূর্বপাকিস্তান চলে এসেছে এবং যাবতীয় সুখ আনন্দ ভোগ করেছে, এরাও এখন দিল্লির দাস হতে চায়। এরা জ্ঞানপাপী এবং অন্ধ।
শাসক হিসেবে ইংরেজদের আসার আগে ভারতে বা অখণ্ড বাংলায় শাসন ও সামাজিকতায় হিন্দু মুসলমান বলে কিছুই ছিল না। এ ধারণা বা আলোচনাটা আসতে শুরু করেছে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও শোষণের কারণে। ইংরেজ আমলে মুসলমানেরা সীমাহীন নির্যাতন ও শোষণের শিকার হয়েছে। আর ইংরেজদের সহযোগিতা করে আনুকূল্য লাভ করেছে হিন্দুসমাজ। জিন্নাহসহ অনেক বড় বড় মুসলমান নেতা অখণ্ড ভারত চেয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দু নেতারা মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার অস্বীকার করায় খণ্ড ভারতের চিন্তা সামনে আসতে থাকে। তারই ফল হলো পাকিস্তান। অপর দিকে, অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব উত্থাপিত হলে গান্ধীজী ও নেহরুজী এর বিরোধিতা করেন। কারণ, অখণ্ড বাংলায় মুসলমানেরা মেজরিটি ছিলেন।
১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হলে হিন্দু নেতারা এর বিরোধিতা করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত হিন্দু নেতাদের আন্দোলনের ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। পূর্ববঙ্গ আবার কলকাতার অধীনে চলে যায়। ১৯৪৭ সালে অখণ্ড বাংলার দাবি হিন্দু নেতারা গ্রহণ করেননি। এর কারণ ও রহস্য বোঝার মতো ধ্যানজ্ঞান-চিন্তা আমাদের রাজনীতিক ও তরুণ সমাজের নেই। কারণ এরা নিজেদের বাপ-দাদার ইতিহাস ঐতিহ্যকে ত্যাগ করেছে বা করতে চায়। জানতে হবে কারা তাদের বিপথে পরিচালিত করছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের রহস্য লুকিয়ে আছে দিল্লির আগ্রাসী নীতির ভেতর।
আপনাদের অবশ্যই বুঝতে হবে কেন হিন্দু নেতারা ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ নামে নতুন প্রদেশ গঠনের বিরোধিতা করে এক বাংলা চেয়েছিলেন। আবার কেনইবা ’৪৭ সালে খণ্ডিত বাংলা চাইলেন? আপনারা ইতিহাসসচেতন হন। নিজেদের ঐতিহ্য ও বায়া দলিলের খোঁজ নিন। আবার ’৭১-এ দিল্লি কেন আমাদের সমর্থন করেছে। আমি জানি আমাদের তরুণ সমাজ এখন বিভ্রান্ত ও ভুল পথে পরিচালিত। বারবার বলে চলেছি দিল্লি বাংলাদেশে একটি খাঁটি বাঙালির রাষ্ট্র চায়, যার ভেতর ইসলাম বা মুসলমানিত্বের কোনো ছাপ থাকবে না। অথবা শুধু নামের মুসলমানের একটি দেশ চায়। যাদের আরবি নাম থাকবে; কিন্তু মুসলমান নয়। যারা শুধুই বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করবে, যা ভারতীয় বাঙালিরা চর্চা করে। আপনারা কি জানেন, একসময় অফিস-আদালতে মুসলমানেরা ধুতি পরত। ১৭৫৭ সালের পর বাংলার মুসলমানের অবস্থা কী হয়েছিল তা জানার জন্য হান্টারের ‘দ্য মুসলমান’ বইটি পড়ুন।
এতণ ইতিহাসের পেছনের কথা বলেছি। তাহলে বাংলাদেশের চলমান সঙ্কটের সাথে ইতিহাসের কী সম্পর্ক আছে? তা হলো ভারত বাংলাদেশে এমন একটি সরকার চায়, যা ভারতের স্বার্থে কাজ করবে। যে সরকার অনুগত বন্ধু হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশকে ভারতের বাজার হিসেবে গড়ে তুলবে। যে মুসলমানিত্বের কারণে তারা পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল তা চিরতরে মুছে দিতে হবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে। আপনারা কি ল করেছেন, মমতা ব্যানার্জির সাথে নাগরিক নামে যারা কথা বলেছেন, তারা এরা? এরা বাংলা ও আরবি নামধারী কিছু বাঙালি। এদের কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব মানে ভারতের অনুগত বন্ধুত্ব। এদের পাসপোর্টে বাংলাদেশী কথাটা লেখা থাকলেও তা মানে না।
চলমান সরকার ভারতের সেবা করার ব্যাপরে সবচেয়ে বেশি পরীতি। ভারতে পাঁচ বছর থাকাকালে তিনি ওই পরীক্ষায় ডাবল প্লাস পেয়েছেন। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থক সরকার এক তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে চলমান সরকারকে মতায় বসিয়েছে। ৫ জানুয়ারির ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে জোর করে শেখ হাসিনাকে মতায় বসিয়েছে। সেই ভুয়া নির্বাচনের কারণেই চলমান সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনের আগে দু-তিন শ’ মানুষ মারা গেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আর এখন ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। নির্বাচনের দাবিকে দাবিয়ে রেখে সরকার বলছে এটা জঙ্গি ও সন্ত্রাসী। মিডিয়া সরকারি বক্তব্যকে উদারভাবে প্রচার করছে, আর বিরোধী দলকে দমনের জন্য সরকারকে উদ্ধার করছে। বিদেশী বা জাতিসঙ্ঘকে দলে টানার জন্য সরকার প্রচার করছে বিরোধী দলের আন্দোলন গণতন্ত্রের জন্য নয়, বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য।
আমি সব সময় বলে থাকি, জনগণের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহের বাইরে বা উপরে কোনো আইন থাকতে পারে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন এখন জনআকাঙ্ক্ষা বিরোধী। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে কেয়ার টেকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তখনো বহু মানুষ মারা গেছে। আপনরাই প্রশ্ন করুন সে সময়ে আওয়ামী লীগ কেন কেয়ার টেকার সরকার চেয়েছিল? তাদের লক্ষ্য কী ছিল? পরে কেনইবা আওয়ামী লীগ কেয়ার টেকার ব্যবস্থা বাতিল করল? এ ব্যাপারে আমাদের সাংবাদিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা প্রশ্ন তোলেন না। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, জনআকাক্সাবিরোধী কোনো আইনই আইন নয়। সমস্যাটা এতই সহজ যে, তা সমাধানের জন্য রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে লাভ হবে না। সবাই এটা বোঝেন। কিন্তু সরকার ও রাষ্ট্রশক্তির ভয়ে একমঞ্চে একবাক্যে কথা বলতে পারছেন না।
লেখক : এরশাদ মজুমদার।কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com
No comments