পার্বত্য চট্টগ্রাম- এমন আমলারা দেশকে কোথায় নিতে চান? by এ কে এম জাকারিয়া
সময়ের
হিসাবে গত (২০১৪ সাল) ডিসেম্বরে পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছর পার হয়ে গেছে।
১৯৯৭ সালে যখন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। মাঝে
বিরতির পর এখন তারা আবারও ক্ষমতায়। চুক্তির পর এর বাস্তবায়ন কখনো
স্বাভাবিক গতিতে চলেনি, কখনো থেমেই ছিল (বিএনপি-জামায়াত জোটের সময়ে), আর
বাকি সময় চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
চুক্তির পর এর ‘বাস্তবায়নের’ দাবিতে পাহাড়িদের আন্দোলন করতে হচ্ছে সেই শুরু থেকেই। এত সময় পরও চুক্তির ‘পূর্ণ’ বাস্তবায়নের দাবি এবং সে জন্য কঠোর কর্মসূচি পালনের কথা ভাবতে হচ্ছে পাহাড়িদের। কোনো একদিন চুক্তির পুরো বাস্তবায়ন হবে, এমন আশা হয়তো অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন। এভাবেই চলছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন তো দূরের বিষয়, চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার যেন চুক্তির আগের অবস্থায় ফিরে যেতেই উৎসাহী হয়ে উঠেছে। গত ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাতে এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ‘শান্তিচুক্তি-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়’ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তির মন্তব্য, আলোচনা ও শেষে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত বিস্ময়কর, উদ্বেগজনক, এমনকি হাস্যকরও।
বৈঠকে অংশ নেওয়া সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কী ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, সে সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়ার জন্য কয়েকজনের বক্তব্য সভার কার্যবিবরণী থেকে পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সচিব বলেছেন, পার্বত্য চুক্তির চারটি অধ্যায়ে ৭২টি ধারা রয়েছে। অধিকাংশ চুক্তি ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হলেও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা তা স্বীকার করেন না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের বক্তব্য হচ্ছে, বিদেশি নাগরিকদের পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রমণে কোড অব কনডাক্ট প্রণয়ন করা দরকার। অনেক সময় বিদেশি নাগরিক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে শুধু জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপারকে জানিয়ে পার্বত্য অঞ্চল ভ্রমণে যান। এটা সঠিক নয়। বৈঠকে উপস্থিত ডিজিএফআইয়ের প্রতিনিধি বলেন, সিএইচটি কমিশনসহ কিছু সংস্থা স্থানীয় উপজাতীয় নেতাদের সঙ্গে প্রশাসন কিংবা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া বৈঠক ও আলাপ-আলোচনা বেশি পছন্দ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে ঘোষণা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
এসব বক্তব্যের সূত্রে কিছু প্রশ্ন তোলা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সচিব কিসের ভিত্তিতে চুক্তির ৭২টি ধারার অধিকাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন? পার্বত্য চুক্তির একটি পক্ষ যেমন সরকার, অন্য পক্ষটি জনসংহতি সমিতি। চুক্তি নিয়ে তাদের মূল্যায়ন নিশ্চয়ই একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তারা বলছে, এ পর্যন্ত মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। অবাস্তবায়িত রয়েছে ৩৪টি আর আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে ১৩টি। তাদের হিসাব হচ্ছে, চুক্তির ধারাগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। গত বছরের ২ ডিসেম্বর চুক্তির ১৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে জনসংহতি সমিতি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে’ শিরোনামে একটি প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। সেখানে ৭২টি ধারা তুলে ধরে কোন ক্ষেত্রে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, সরকার কী দাবি করছে এবং বাস্তবে কী হয়েছে ও কী হয়নি, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। জনসংহতি সমিতি যেভাবে ধরে ধরে দেখিয়েছে কী বাস্তবায়ন হয়েছে আর কী হয়নি, তা একইভাবে খণ্ডন না করে ‘চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে’ বলাটা দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তা ছাড়া যেসব ধারা পার্বত্য চুক্তির মূল লক্ষ্য অর্জনে অপরিহার্য, তার কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে? বিশেষ করে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার প্রশ্নে কোনো অগ্রগতি তো দূরে থাক, বরং ধারাবাহিকভাবে অবনতিই হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চল থেকে চুক্তি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সেনা প্রত্যাহারের যে অঙ্গীকার রয়েছে, সে ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।
একইভাবে ‘শুধু জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপারকে জানিয়ে’ বিদেশি নাগরিকদের পার্বত্য অঞ্চল ভ্রমণের নিয়ম ‘ঠিক নয়’ বলে যে মন্তব্য পররাষ্ট্রসচিব করলেন, তা তিনি কিসের ভিত্তিতে করলেন? কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু করার থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ বিদেশি নাগরিকদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণে যেতে হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কেন জানাতে হবে?
আর ডিজিএফআই প্রতিনিধির বক্তব্য অনুযায়ী, সিএইচটি কমিশন বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান কেন প্রশাসন বা সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে পাহাড়িদের সঙ্গে কথা বলবে? তাদের কাজ হচ্ছে পাহাড়িদের নানা সমস্যা নিয়ে কাজ করা, সেখানকার ভুক্তভোগী বা নির্যাতন-বৈষম্যের শিকার পাহাড়িদের বক্তব্য শোনা। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের সামনে বসিয়ে রেখে সিএইচটি কমিশন পাহাড়িদের সঙ্গে কথা বলবে—এ ধরনের দাবিকে হাস্যকর ছাড়া আর কীই-বা বলা যায়?
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের এসব মন্তব্যে একধরনের পুরোনো ও ঔপনিবেশিক মনমানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সভ্য দুনিয়ায় যেখানে আদিবাসী কোনো গোষ্ঠী ও জনসমাজের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখানো হয়, আদিবাসীসহ সব জাতিগোষ্ঠীর সমান অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়, সেখানে আমাদের আমলাদের বক্তব্যের মধ্যে বিদ্বেষের ভাবটি স্পষ্ট। অনেকটা বর্ণবাদীও।
এ ধরনের আলোচনার পর সেদিনের সভায় ১১টি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত দুটি সিদ্ধান্ত খুবই আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য। এ নিয়ে এরই মধ্যে গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্তগুলো পার্বত্য চুক্তির আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়া হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। সচেতন নাগরিক ও মানবাধিকার গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ও তা প্রত্যাহারের দাবি তোলা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত দুটি অনেক পাঠকেরই জানা, এর পরও কারও জানার বাইরে থাকতে পারে, সেই বিবেচনা থেকে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। সভায় নেওয়া ৫ নম্বর সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, কূটনীতিক ছাড়া কোনো বিদেশি নাগরিকের পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘুরতে যেতে হলে অন্তত এক মাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্য আবেদন করতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থা যাচাই-বাছাই করে অনুমতি দেবে। অনুমতি পেলে জেলা প্রশাসন বা পুলিশ সুপারের কাছে ভ্রমণসূচি দিয়ে তবেই ভ্রমণ করতে হবে। ৬ নম্বর সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, দেশি-বিদেশি ব্যক্তি বা সংস্থার কেউ পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘উপজাতীয়দের’ সঙ্গে সাক্ষাৎ কিংবা বৈঠক করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী বা বিজিবির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কি দেশের বাইরের কোনো এলাকা? সেখানে যেতে হলে বিদেশি নাগরিককে কেন এক মাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্য আবেদন করতে হবে? পার্বত্য চুক্তির আগে যখন সেখানে সশস্ত্র আন্দোলন চলছিল, তখন বিদেশিদের সেখানে ভ্রমণে এ ধরনের বিধিবিধান ছিল। চুক্তির পর উঠে যাওয়া এ ধরনের বিধান আবার চালু করার কী যুক্তি থাকতে পারে? পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সচিব তবে কিসের ভিত্তিতে দাবি করলেন যে পার্বত্য চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে? আর ১৭ বছরে ‘অধিকাংশ’ কেন, পুরোটাই তো বাস্তবায়িত হওয়ার কথা।
আর ৬ নম্বর সিদ্ধান্তটি তো বাংলাদেশের পাহাড়ি বা বাঙালি সবার নাগরিক অধিকারের বারোটা বাজানোর জন্য যথেষ্ট। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার যেমন ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, তেমনি নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে এবং আমাদের সংবিধানে দেওয়া সব নাগরিকের সমান অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে পাহাড়ি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সময় কি আমাদের সেনাবাহিনী বা বিজিবির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে? ঢাকা বা বাংলাদেশের আর কোনো জায়গায় যদি তা করতে না হয়, তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন তা করতে হবে? আর বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে একজন পাহাড়িকে কেন তাঁর দেশেরই অন্য অঞ্চলের একজন নাগরিকের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে?
এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের বাইরের নাগরিকদের বাকস্বাবাধীনতাসহ মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারকে যেমন ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, তেমনি সেখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে স্পষ্টতই ছোট করার চেষ্টা হয়েছে। সংবিধানের সঙ্গে বেমানান এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি অবৈধ। দেশের আইনকানুন বা সংবিধান সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। অথচ সরকার ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপস্থিতিতেই এ ধরনের একটি অবৈধ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের আমলারা দেশটাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান?
লেখাটি শেষ করছি পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন ব্যবসায় নিবেদিত একজনের কথা দিয়ে। বাংলাদেশে পর্যটন, বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে তিনি শুরুর দিকের যোদ্ধা। দ্য গাইড টুরস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান মনসুর বান্দরবানের মিলনছড়িতে একটি রিসোর্ট প্রতিষ্ঠা করে শেষ বয়সে এসে সেখানেই থিতু হয়েছেন। বিদেশিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আসতে এক মাস আগে অনুমতি নিতে হবে, এই সিদ্ধান্তে তিনি রীতিমতো ভেঙে পড়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের পর তিনি একটি চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
‘পর পর তিন বছর ধরে ঠিক পর্যটনের মৌসুমেই সহিংস পরিস্থিতির কারণে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের কোমর ভেঙে গেছে।... এত দিন বিদেশি পর্যটকের পাসপোর্ট ও ভিসার কপি ও ভ্রমণসূচি জমা দেওয়ার যে বিধান ছিল, তার বদলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি এই অনুমোদন সংগ্রহ করতে হবে। এ জন্য মাস খানেক সময় লেগে যাবে। বিদেশি নাগরিকদের জন্য এ ধরনের একটি নিয়ম বহু আগে প্রচলিত ছিল।... যেসব বিদেশি পর্যটক পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে যেতে আগ্রহী, তাঁরা এই অনুমোদন-সংক্রান্ত সয়মসাপেক্ষ ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে চাইবেন না।’ চিঠিটির শেষে তিনি লিখেছেন, বিদেশি পর্যটকদের অনুমতি নেওয়ার নতুন নিয়মটি অদূরদর্শী ও আত্মঘাতী। এতে দীর্ঘ সময় ধরে অর্জিত সব অর্জন ও পরিশ্রম বৃথা যাবে। বিদেশিদের কাছেও আমাদের সীমাহীন লজ্জায় পড়তে হবে।
আমাদের দেশে কিছু আমলা আগপিছ না ভেবে কত সহজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন! দেশ, দেশের সংবিধান, নাগরিক অধিকার বা আইনকানুন—কিছুই যেন তাঁদের বিবেচনায় নেওয়ার নেই। এ ধরনের আমলাদের দিয়ে দেশের সামনে এগোনো তো দূরে থাক, বরং পেছনযাত্রাই জোরদার হবে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
চুক্তির পর এর ‘বাস্তবায়নের’ দাবিতে পাহাড়িদের আন্দোলন করতে হচ্ছে সেই শুরু থেকেই। এত সময় পরও চুক্তির ‘পূর্ণ’ বাস্তবায়নের দাবি এবং সে জন্য কঠোর কর্মসূচি পালনের কথা ভাবতে হচ্ছে পাহাড়িদের। কোনো একদিন চুক্তির পুরো বাস্তবায়ন হবে, এমন আশা হয়তো অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন। এভাবেই চলছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন তো দূরের বিষয়, চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার যেন চুক্তির আগের অবস্থায় ফিরে যেতেই উৎসাহী হয়ে উঠেছে। গত ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাতে এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ‘শান্তিচুক্তি-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়’ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তির মন্তব্য, আলোচনা ও শেষে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত বিস্ময়কর, উদ্বেগজনক, এমনকি হাস্যকরও।
বৈঠকে অংশ নেওয়া সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কী ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, সে সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়ার জন্য কয়েকজনের বক্তব্য সভার কার্যবিবরণী থেকে পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সচিব বলেছেন, পার্বত্য চুক্তির চারটি অধ্যায়ে ৭২টি ধারা রয়েছে। অধিকাংশ চুক্তি ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হলেও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা তা স্বীকার করেন না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের বক্তব্য হচ্ছে, বিদেশি নাগরিকদের পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রমণে কোড অব কনডাক্ট প্রণয়ন করা দরকার। অনেক সময় বিদেশি নাগরিক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে শুধু জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপারকে জানিয়ে পার্বত্য অঞ্চল ভ্রমণে যান। এটা সঠিক নয়। বৈঠকে উপস্থিত ডিজিএফআইয়ের প্রতিনিধি বলেন, সিএইচটি কমিশনসহ কিছু সংস্থা স্থানীয় উপজাতীয় নেতাদের সঙ্গে প্রশাসন কিংবা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া বৈঠক ও আলাপ-আলোচনা বেশি পছন্দ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে ঘোষণা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
এসব বক্তব্যের সূত্রে কিছু প্রশ্ন তোলা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সচিব কিসের ভিত্তিতে চুক্তির ৭২টি ধারার অধিকাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন? পার্বত্য চুক্তির একটি পক্ষ যেমন সরকার, অন্য পক্ষটি জনসংহতি সমিতি। চুক্তি নিয়ে তাদের মূল্যায়ন নিশ্চয়ই একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তারা বলছে, এ পর্যন্ত মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। অবাস্তবায়িত রয়েছে ৩৪টি আর আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে ১৩টি। তাদের হিসাব হচ্ছে, চুক্তির ধারাগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। গত বছরের ২ ডিসেম্বর চুক্তির ১৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে জনসংহতি সমিতি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে’ শিরোনামে একটি প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। সেখানে ৭২টি ধারা তুলে ধরে কোন ক্ষেত্রে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, সরকার কী দাবি করছে এবং বাস্তবে কী হয়েছে ও কী হয়নি, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। জনসংহতি সমিতি যেভাবে ধরে ধরে দেখিয়েছে কী বাস্তবায়ন হয়েছে আর কী হয়নি, তা একইভাবে খণ্ডন না করে ‘চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে’ বলাটা দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তা ছাড়া যেসব ধারা পার্বত্য চুক্তির মূল লক্ষ্য অর্জনে অপরিহার্য, তার কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে? বিশেষ করে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার প্রশ্নে কোনো অগ্রগতি তো দূরে থাক, বরং ধারাবাহিকভাবে অবনতিই হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চল থেকে চুক্তি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সেনা প্রত্যাহারের যে অঙ্গীকার রয়েছে, সে ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।
একইভাবে ‘শুধু জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপারকে জানিয়ে’ বিদেশি নাগরিকদের পার্বত্য অঞ্চল ভ্রমণের নিয়ম ‘ঠিক নয়’ বলে যে মন্তব্য পররাষ্ট্রসচিব করলেন, তা তিনি কিসের ভিত্তিতে করলেন? কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু করার থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ বিদেশি নাগরিকদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণে যেতে হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কেন জানাতে হবে?
আর ডিজিএফআই প্রতিনিধির বক্তব্য অনুযায়ী, সিএইচটি কমিশন বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান কেন প্রশাসন বা সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে পাহাড়িদের সঙ্গে কথা বলবে? তাদের কাজ হচ্ছে পাহাড়িদের নানা সমস্যা নিয়ে কাজ করা, সেখানকার ভুক্তভোগী বা নির্যাতন-বৈষম্যের শিকার পাহাড়িদের বক্তব্য শোনা। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের সামনে বসিয়ে রেখে সিএইচটি কমিশন পাহাড়িদের সঙ্গে কথা বলবে—এ ধরনের দাবিকে হাস্যকর ছাড়া আর কীই-বা বলা যায়?
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের এসব মন্তব্যে একধরনের পুরোনো ও ঔপনিবেশিক মনমানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সভ্য দুনিয়ায় যেখানে আদিবাসী কোনো গোষ্ঠী ও জনসমাজের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখানো হয়, আদিবাসীসহ সব জাতিগোষ্ঠীর সমান অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়, সেখানে আমাদের আমলাদের বক্তব্যের মধ্যে বিদ্বেষের ভাবটি স্পষ্ট। অনেকটা বর্ণবাদীও।
এ ধরনের আলোচনার পর সেদিনের সভায় ১১টি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত দুটি সিদ্ধান্ত খুবই আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য। এ নিয়ে এরই মধ্যে গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্তগুলো পার্বত্য চুক্তির আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়া হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। সচেতন নাগরিক ও মানবাধিকার গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ও তা প্রত্যাহারের দাবি তোলা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত দুটি অনেক পাঠকেরই জানা, এর পরও কারও জানার বাইরে থাকতে পারে, সেই বিবেচনা থেকে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। সভায় নেওয়া ৫ নম্বর সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, কূটনীতিক ছাড়া কোনো বিদেশি নাগরিকের পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘুরতে যেতে হলে অন্তত এক মাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্য আবেদন করতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থা যাচাই-বাছাই করে অনুমতি দেবে। অনুমতি পেলে জেলা প্রশাসন বা পুলিশ সুপারের কাছে ভ্রমণসূচি দিয়ে তবেই ভ্রমণ করতে হবে। ৬ নম্বর সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, দেশি-বিদেশি ব্যক্তি বা সংস্থার কেউ পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘উপজাতীয়দের’ সঙ্গে সাক্ষাৎ কিংবা বৈঠক করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী বা বিজিবির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কি দেশের বাইরের কোনো এলাকা? সেখানে যেতে হলে বিদেশি নাগরিককে কেন এক মাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্য আবেদন করতে হবে? পার্বত্য চুক্তির আগে যখন সেখানে সশস্ত্র আন্দোলন চলছিল, তখন বিদেশিদের সেখানে ভ্রমণে এ ধরনের বিধিবিধান ছিল। চুক্তির পর উঠে যাওয়া এ ধরনের বিধান আবার চালু করার কী যুক্তি থাকতে পারে? পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সচিব তবে কিসের ভিত্তিতে দাবি করলেন যে পার্বত্য চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে? আর ১৭ বছরে ‘অধিকাংশ’ কেন, পুরোটাই তো বাস্তবায়িত হওয়ার কথা।
আর ৬ নম্বর সিদ্ধান্তটি তো বাংলাদেশের পাহাড়ি বা বাঙালি সবার নাগরিক অধিকারের বারোটা বাজানোর জন্য যথেষ্ট। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার যেমন ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, তেমনি নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে এবং আমাদের সংবিধানে দেওয়া সব নাগরিকের সমান অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে পাহাড়ি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সময় কি আমাদের সেনাবাহিনী বা বিজিবির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে? ঢাকা বা বাংলাদেশের আর কোনো জায়গায় যদি তা করতে না হয়, তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন তা করতে হবে? আর বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে একজন পাহাড়িকে কেন তাঁর দেশেরই অন্য অঞ্চলের একজন নাগরিকের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে?
এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের বাইরের নাগরিকদের বাকস্বাবাধীনতাসহ মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারকে যেমন ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, তেমনি সেখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে স্পষ্টতই ছোট করার চেষ্টা হয়েছে। সংবিধানের সঙ্গে বেমানান এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি অবৈধ। দেশের আইনকানুন বা সংবিধান সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। অথচ সরকার ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপস্থিতিতেই এ ধরনের একটি অবৈধ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের আমলারা দেশটাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান?
লেখাটি শেষ করছি পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন ব্যবসায় নিবেদিত একজনের কথা দিয়ে। বাংলাদেশে পর্যটন, বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে তিনি শুরুর দিকের যোদ্ধা। দ্য গাইড টুরস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান মনসুর বান্দরবানের মিলনছড়িতে একটি রিসোর্ট প্রতিষ্ঠা করে শেষ বয়সে এসে সেখানেই থিতু হয়েছেন। বিদেশিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আসতে এক মাস আগে অনুমতি নিতে হবে, এই সিদ্ধান্তে তিনি রীতিমতো ভেঙে পড়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের পর তিনি একটি চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
‘পর পর তিন বছর ধরে ঠিক পর্যটনের মৌসুমেই সহিংস পরিস্থিতির কারণে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের কোমর ভেঙে গেছে।... এত দিন বিদেশি পর্যটকের পাসপোর্ট ও ভিসার কপি ও ভ্রমণসূচি জমা দেওয়ার যে বিধান ছিল, তার বদলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি এই অনুমোদন সংগ্রহ করতে হবে। এ জন্য মাস খানেক সময় লেগে যাবে। বিদেশি নাগরিকদের জন্য এ ধরনের একটি নিয়ম বহু আগে প্রচলিত ছিল।... যেসব বিদেশি পর্যটক পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে যেতে আগ্রহী, তাঁরা এই অনুমোদন-সংক্রান্ত সয়মসাপেক্ষ ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে চাইবেন না।’ চিঠিটির শেষে তিনি লিখেছেন, বিদেশি পর্যটকদের অনুমতি নেওয়ার নতুন নিয়মটি অদূরদর্শী ও আত্মঘাতী। এতে দীর্ঘ সময় ধরে অর্জিত সব অর্জন ও পরিশ্রম বৃথা যাবে। বিদেশিদের কাছেও আমাদের সীমাহীন লজ্জায় পড়তে হবে।
আমাদের দেশে কিছু আমলা আগপিছ না ভেবে কত সহজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন! দেশ, দেশের সংবিধান, নাগরিক অধিকার বা আইনকানুন—কিছুই যেন তাঁদের বিবেচনায় নেওয়ার নেই। এ ধরনের আমলাদের দিয়ে দেশের সামনে এগোনো তো দূরে থাক, বরং পেছনযাত্রাই জোরদার হবে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments