অনেক ক্যানসারই নিরাময়যোগ্য by মমতাজ বেগম
সাগর,
বয়স ১৫ বছর। এই বয়সে কৈশোরের চাঞ্চল্য নিয়ে সে স্কুলে যাবে, মাঠে
খেলবে, নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু নিয়তির নির্মমতা তাকে বাধ্য
করেছে বিছানায় শুয়ে থাকতে। তার অবস্থা এমন যে অন্যের সাহায্য ছাড়া পাশও
ফিরতে পারে না। তার চলার ছন্দ থেমে গেছে প্রায় দুই বছর। কারণ, ক্যানসার
মস্তিষ্ক থেকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। ওর যখন প্রথম দিকে
তীব্র মাথাব্যথা, বমি—এসব হতো, তখন শুধু এগুলোর চিকিৎসা নিয়ে সাময়িক ভালো
থাকত। পরবর্তী সময়ে আর যখন চিকিৎসায় কাজ হচ্ছিল না, তখন বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ধরা পড়ে ওর ব্রেন টিউমার। তত দিনে রোগ অনেক দূর
ছড়িয়েছে।
রোগ নির্ণয় হওয়ার পর বাবা ধরেই নিয়েছেন এই ছেলের জন্য সময় ও টাকা খরচ শুধুই অপচয়। তাই আর ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেননি। অসহায় মা অনেকের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। যখন শুনলাম সে তার মাকে বলছে, ‘একটা হুইলচেয়ার হলে আমি একটু বিছানা ছেড়ে বাইরে যেতে পারতাম’, তখন তাকে আমরা একটা হুইলচেয়ার কিনে দিলাম। চেয়ার দেখে সে কী যে খুশি! বিছানা ছেড়ে যখন পরিপাটি হয়ে চেয়ারে বসল, তখন মনে হচ্ছিল ওর কষ্ট অনেকটাই কমে গেছে, ও ভালো হয়ে গেছে। বাস্তবে তা-ই হওয়া উচিত। কারণ, এখন বাচ্চাদের ক্যানসার (childhood maligancy) অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। তবে সে জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসা করা।
এই বাস্তবতার নিরিখে ২০০২ সাল থেকে বিশ্বের ৯৯টি দেশের ১৭৭ সংগঠন মিলে ১৫ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব শিশু ক্যানসার দিবস (International Childhood Cancer Day) হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও বাংলাদেশে এখনো এই দিবসটি ততটা পরিচিতি পায়নি। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হলো সবার কাছে বার্তা পৌঁছানো যে বাচ্চাদের অনেক ক্যানসারই সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। তা ছাড়া, এই দিবসটি পালনের ফলে ক্যানসারে আক্রান্ত পরিবারগুলোর মধ্যে এই বোধ তৈরি হয় যে তাদের এই কঠিন যাত্রাপথে সবার সহমর্মিতা আছে। সাধারণত কিছু লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হলে বাচ্চাদের ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা সম্ভব হয়। যেমন, বাচ্চা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অনেক দিন থেকে কাশি, শ্বাসকষ্ট কিংবা রাতে ঘাম হওয়া, জ্বর আসা কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া।
তা ছাড়া আরও কিছু লক্ষণ যেমন বাচ্চার চোখের মণি সাদা হয়ে যাওয়া, চোখ জ্বল জ্বল করা, চোখের চারপাশ কাল হয়ে যাওয়া অথবা চোখ বাইরের দিকে বের হয়ে আসা, হাতে-পায়ে কিংবা হাড়সহ সারা শরীরে ব্যথা, আঘাত ছাড়াই শরীরের কোনো অংশ ফুলে যাওয়া, কালচে নীল দাগ হওয়া কিংবা শরীর থেকে রক্ত পড়া, বাচ্চার পেটে চাকা অনুভব করা কিংবা পেট ফুলে যাওয়া, তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা ও বমি—এসব লক্ষণও অবহেলা না করে তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার।
একটা ব্যাপার এখানে বলা দরকার যে যখন কোনো বাচ্চার জ্বর আসছে মনে হয় তখন তা থার্মোমিটার দিয়ে মেপে নেওয়া ও সময়সহ তা লিখে রাখা দরকার। এতে চিকিৎসকের পক্ষে যে রোগের কারণে জ্বর সে রোগ অনুমান করতে সুবিধা হয়। আবার যদি মনে হয় বাচ্চার ওজন কমে যাচ্ছে সে ক্ষেত্রেও ওজনটা ঠিকমতো মেপে তারিখসহ লিখে রাখা দরকার। এতে পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকের বুঝতে সুবিধা হয় ওজন কমার হার আর রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব শিশু ক্যানসার দিবস পালন কিংবা এ লেখার উদ্দেশ্য সবাইকে বাচ্চাদের ক্যানসার সম্পর্কে সচেতন করা, আতঙ্কিত করা নয়। কারণ, একজন সচেতন মানুষই পারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে, আতঙ্কিত মানুষ নয়।
শিশু মা-বাবার কাছে যেমন মহামূল্যবান সম্পদ, তেমনি সমাজ ও দেশের জন্যও মূল্যবান সম্পদ। তাই বাচ্চাদের ক্যানসারের সচেতনতা তৈরি করতে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয় ‘গোল্ডেন রিবন’ বা ‘সোনালি ফিতা’। ১৯৯৯ সালে আমেরিকার একদল মা-বাবা গোল্ডেন রিবনকে সচেতনতা তৈরিতে সর্বজনীনভাবে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন। আমরা অর্থাৎ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু ক্যানসার বিভাগের উদ্যোগে দুই বছর যাবৎ বিশ্ব শিশু ক্যানসার দিবস উপলক্ষে আমাদের চিকিৎসাধীন বাচ্চাদের নিয়ে চিত্রাঙ্কনের আয়োজন করি। সেখানে দেখি কিছু বাচ্চা, যারা কখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছবি আঁকা শেখার সুযোগ পায়নি, আবার অসুস্থ; তারাও সঠিক রং ব্যবহার করে কী সুন্দর সুন্দর দৃশ্য এঁকেছে! তখন মনে হয়, ওদের মধ্যে কত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। এই আশা নিয়ে শেষ করছি, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন সবার সচেতনতা ও সহযোগিতার ফলে আমাদের সব বাচ্চার জীবন হবে সুন্দর, রোগমুক্ত আর আনন্দময়।
ডা. মমতাজ বেগম: বিভাগীয় প্রধান, শিশু ক্যানসার বিভাগ, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।
রোগ নির্ণয় হওয়ার পর বাবা ধরেই নিয়েছেন এই ছেলের জন্য সময় ও টাকা খরচ শুধুই অপচয়। তাই আর ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেননি। অসহায় মা অনেকের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। যখন শুনলাম সে তার মাকে বলছে, ‘একটা হুইলচেয়ার হলে আমি একটু বিছানা ছেড়ে বাইরে যেতে পারতাম’, তখন তাকে আমরা একটা হুইলচেয়ার কিনে দিলাম। চেয়ার দেখে সে কী যে খুশি! বিছানা ছেড়ে যখন পরিপাটি হয়ে চেয়ারে বসল, তখন মনে হচ্ছিল ওর কষ্ট অনেকটাই কমে গেছে, ও ভালো হয়ে গেছে। বাস্তবে তা-ই হওয়া উচিত। কারণ, এখন বাচ্চাদের ক্যানসার (childhood maligancy) অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। তবে সে জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসা করা।
এই বাস্তবতার নিরিখে ২০০২ সাল থেকে বিশ্বের ৯৯টি দেশের ১৭৭ সংগঠন মিলে ১৫ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব শিশু ক্যানসার দিবস (International Childhood Cancer Day) হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও বাংলাদেশে এখনো এই দিবসটি ততটা পরিচিতি পায়নি। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হলো সবার কাছে বার্তা পৌঁছানো যে বাচ্চাদের অনেক ক্যানসারই সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। তা ছাড়া, এই দিবসটি পালনের ফলে ক্যানসারে আক্রান্ত পরিবারগুলোর মধ্যে এই বোধ তৈরি হয় যে তাদের এই কঠিন যাত্রাপথে সবার সহমর্মিতা আছে। সাধারণত কিছু লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হলে বাচ্চাদের ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা সম্ভব হয়। যেমন, বাচ্চা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অনেক দিন থেকে কাশি, শ্বাসকষ্ট কিংবা রাতে ঘাম হওয়া, জ্বর আসা কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া।
তা ছাড়া আরও কিছু লক্ষণ যেমন বাচ্চার চোখের মণি সাদা হয়ে যাওয়া, চোখ জ্বল জ্বল করা, চোখের চারপাশ কাল হয়ে যাওয়া অথবা চোখ বাইরের দিকে বের হয়ে আসা, হাতে-পায়ে কিংবা হাড়সহ সারা শরীরে ব্যথা, আঘাত ছাড়াই শরীরের কোনো অংশ ফুলে যাওয়া, কালচে নীল দাগ হওয়া কিংবা শরীর থেকে রক্ত পড়া, বাচ্চার পেটে চাকা অনুভব করা কিংবা পেট ফুলে যাওয়া, তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা ও বমি—এসব লক্ষণও অবহেলা না করে তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার।
একটা ব্যাপার এখানে বলা দরকার যে যখন কোনো বাচ্চার জ্বর আসছে মনে হয় তখন তা থার্মোমিটার দিয়ে মেপে নেওয়া ও সময়সহ তা লিখে রাখা দরকার। এতে চিকিৎসকের পক্ষে যে রোগের কারণে জ্বর সে রোগ অনুমান করতে সুবিধা হয়। আবার যদি মনে হয় বাচ্চার ওজন কমে যাচ্ছে সে ক্ষেত্রেও ওজনটা ঠিকমতো মেপে তারিখসহ লিখে রাখা দরকার। এতে পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকের বুঝতে সুবিধা হয় ওজন কমার হার আর রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব শিশু ক্যানসার দিবস পালন কিংবা এ লেখার উদ্দেশ্য সবাইকে বাচ্চাদের ক্যানসার সম্পর্কে সচেতন করা, আতঙ্কিত করা নয়। কারণ, একজন সচেতন মানুষই পারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে, আতঙ্কিত মানুষ নয়।
শিশু মা-বাবার কাছে যেমন মহামূল্যবান সম্পদ, তেমনি সমাজ ও দেশের জন্যও মূল্যবান সম্পদ। তাই বাচ্চাদের ক্যানসারের সচেতনতা তৈরি করতে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয় ‘গোল্ডেন রিবন’ বা ‘সোনালি ফিতা’। ১৯৯৯ সালে আমেরিকার একদল মা-বাবা গোল্ডেন রিবনকে সচেতনতা তৈরিতে সর্বজনীনভাবে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন। আমরা অর্থাৎ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু ক্যানসার বিভাগের উদ্যোগে দুই বছর যাবৎ বিশ্ব শিশু ক্যানসার দিবস উপলক্ষে আমাদের চিকিৎসাধীন বাচ্চাদের নিয়ে চিত্রাঙ্কনের আয়োজন করি। সেখানে দেখি কিছু বাচ্চা, যারা কখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছবি আঁকা শেখার সুযোগ পায়নি, আবার অসুস্থ; তারাও সঠিক রং ব্যবহার করে কী সুন্দর সুন্দর দৃশ্য এঁকেছে! তখন মনে হয়, ওদের মধ্যে কত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। এই আশা নিয়ে শেষ করছি, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন সবার সচেতনতা ও সহযোগিতার ফলে আমাদের সব বাচ্চার জীবন হবে সুন্দর, রোগমুক্ত আর আনন্দময়।
ডা. মমতাজ বেগম: বিভাগীয় প্রধান, শিশু ক্যানসার বিভাগ, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।
No comments