রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার বাতিল কোন যুক্তিতে? by জি. মুনীর
গত
ডিসেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব
দেয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এর প্রতিবাদে সে দেশের
বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় নেমে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করে।
এর মূল নেতা উগ্র বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা অশিন উইরাথো। মিয়ানমারে মুসলমানবিরোধী
দাঙ্গা-সন্ত্রাসের মূল হোতা তিনিই। টাইম ম্যাগাজিন তাকে নিয়ে ‘ফেস অব
বুড্ডিস্ট টেরর’ শিরোনামে একটি কভারস্টোরি করে। তিনি নিজে তাকে অভিহিত করেন
‘বার্মিজ বিন লাদেন’ নামে। মিয়ানমারে এদের মতো উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চলমান
আন্দোলনের জের হিসেবে গত ১১ ফেব্রুয়ারি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও একই সাথে
প্রেসিডেন্টের পদ দখল করা সাবেক সেনাপ্রধান থেইন সেইন রোহিঙ্গা মুসলমানদের
ভোটাধিকার বাতিল করেছেন। এরা বলেছেন, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের দেয়া অস্থায়ী
সিটিজেন কার্ড মার্চ শেষে বাতিল হয়ে যাবে। এর আগে সাময়িকভাবে সাবেক সামরিক
জান্তা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী নাগরিক কার্ড দিয়েছিল নাগরিকত্বের আবেদনের
প্রক্রিয়া হিসেবে। এই কার্ড বাতিলের ফলে রোহিঙ্গারা সে দেশে তাদের
নাগরিকত্ব লাভের অধিকার ও ভোটাধিকার কার্যত হারিয়ে ফেলল। মিয়ানমারের এই
কার্ড বাতিল করার সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকারবিষয়ক শীর্ষদূত টম
ম্যালিনয়স্কি এ ব্যাপারে তার উদ্বেগের কথা প্রকাশ করে টুইট বার্তা দেন। এ
বার্তায় তিনি লেখেন, কথাকথিত এই কার্ড বাতিল করে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে
সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও বিদ্যমান বিরোধ নিষ্পত্তির আশাকে ব্যাহত করা
হয়ছে।
২০১১ সালে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে মিয়ানমারে সামরিক সরকারের অপসারণের পর বড় ধরনের আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিলÑ সে দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে। কারণ, তখন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু কি ও আরো অনেক রাজনীতিবিদ মুক্তি পান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। কেননা, ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসানে এটিকে বিবেচনা করা হয় শান্তিপ্রক্রিয়ার একটি উদ্যোগ হিসেবে। এর ফলে মিয়ানমারের সব দল-মত ও ধর্মমতের মানুষ সম-অধিকার নিয়ে সে দেশে বসবাসের সুযোগ পাবে।
দেশটিতে ২০১৫ সালের মে মাসে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক সংস্কারকল্পে একটি গণভোটও অনুষ্ঠিত হতে পারে, এমন কথাও উঠেছে। কিন্তু এমনি এক সময়ে দেশটির সার্বিক চিত্র কেমন জানি বদলে যাচ্ছে। সম্প্রদায়গত সমালোচনামূলক তিরস্কার বাড়ছে। শান্তিপ্রক্রিয়া থেমে গেছে। সংখ্যালঘু রেহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দমনপীড়ন বেড়ে গেছে। এদের বাধ্য করা হচ্ছে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে। দেশ ছেড়ে পালাতে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী নাগরিক কার্ড বাতিল করে কেড়ে নেয়া হলো এদের ভোটের অধিকার। এখন নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছেÑ মিয়ানমারে এখন এসব কী ঘটছে? ২০১৫ সালের বাকি সময়টায় আরো কী ঘটবে? সে দেশে কি সবার অংশগ্রহণে কোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? জাতীয় নির্বাচন কি আদৌ অনুষ্ঠিত হবে? রেহিঙ্গারা কি তাদের ভোটের অধিকার ও নাগরিকত্ব পাবে? রোহিঙ্গাবিরোধী জাতিগত বিতাড়নপ্রক্রিয়া কি আরো বেড়ে যাবে? বাকি দুনিয়া বা জাতিসঙ্ঘ কি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার পাওয়ার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে? এমনি বিভিন্ন প্রশ্ন এখন মিয়ানমারকে ঘিরে।
এ দিকে আবার নতুন শঙ্কা। জাতিসঙ্ঘ একজন বিতর্কিত শিক্ষাবিদকে এর রাখাইনবিষয়ক আবাসিক সমন্বয়কের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। জ্যাক লেইডার নামের লুক্সেমবার্গ ইতিহাসবিদ হচ্ছেন এই নবনিয়োজিত উপদেষ্টা। তাকে গত জানুয়ারি মাসে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক ও মানবাধিকারবিষয়ক সমন্বয়ক রেনেটা লক ডেসালিয়েনের সিনিয়র কনসালট্যান্ট করা করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, জ্যাক লেইডার রাখাইনদের প্রতি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। রোহিঙ্গা রাজনীতিবিদেরা এ নিয়োগের নিন্দা জানিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘ গত ১১ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতির মাধ্যমে এ নিয়োগের কথা জানায়। ড. লেইডার উপনিবেশ-পূর্ব সময়ের রাখাইন মারুক-ইউ রাজ্যের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ। কিন্তু রোহিঙ্গা সম্প্রদায় সম্পর্কিত তার অবস্থান তাকে অব্যাহতভাবে বিতর্কিত করে তোলে। এ জন্য তিনি রোহিঙ্গা ও কিছু মানবাধিকার গোষ্ঠীর কাছে একজন অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত। ড. লেইডারের অভিমতÑ ‘রোহিঙ্গা পদবাচ্যটি একটি পলিটিক্যাল লেবেল, কোনো এথনিসিটি নয়। রোহিঙ্গা শব্দটি জনপ্রিয় করে তোলা হয় নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। তার এই অভিমত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের মর্যাদা পাওয়া ও তাদের ভোটের অধিকার পাওয়ার বিষয়টিকে কার্যত আরো বিতর্কিত করে তুলেছে।
মিয়ানমারে রয়েছে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। কিন্তু দেশটির সরকার তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। দেশটিতে গত বছর পরিচালিত আদমশুমারিতেও তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। ২০১২ সালে দেশটির রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের হামলায় নিহত হন কয়েক শ’ রোহিঙ্গা। বাড়িঘর ছাড়েন দেড় লাখ। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর জাতিসঙ্ঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন দেশ থেকে চাপ এলে রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে ভোটাধিকার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। কিন্তু সম্প্রতি তা বাতিল ঘোষণা করায় এ ইস্যুতে নতুন করে সঙ্কট সৃষ্টি করা হলো। সেই সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রশ্নে মনে হয় দেশটির সরকার আবারো উল্টো পথে হাঁটার নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। অথচ শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশটির উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের মতোই সরকারও রোহিঙ্গাদের প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে থাকে। এরা কিছুতেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব মেনে নিতে চাইছে না।
রোহিঙ্গা মিয়ানমারে একটি নৃতাত্ত্বিক জাতি সম্প্রদায়। শত শত বছর ধরে বার্মার তথা আজকের মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে এরা বসবাস করে আসছে। আরাকান প্রদেশটি আজ রাখাইন প্রদেশ নামে পরিচিত। কিন্তু মিয়ানমারের প্রতিটি সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও যাবতীয় মানবাধিকার অস্বীকার করে আসছে। বলছে, এরা ভিনদেশী। বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে এরা বার্মায় গিয়ে অবৈধভাবে সেখানে বসাবস করছে। এরা বার্মায় থাকতে পারবে না। ফলে আজ এরা সেখানে নাগরিক অধিকারহারা। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও অন্যান্য নাগরিক সেবা জোগানোয় মিয়ানমার সরকারের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। নিজ দেশে এরা পরবাসী। এরা ‘রাষ্ট্রহীন’ এক জনগোষ্ঠী। এরা হাজারো বছর ধরে আরাকানে বসবাস করেও সে দেশে নেই এদের সম্পত্তি অর্জনের অধিকার। কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের জমিজমা। অবাধ চলাচলের, লেখাপড়া শেখার, ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকারও নেই এদের। ফলে অমানবিক এক পরিবেশে এদের সে দেশে বসবাস করতে হচ্ছে । তা-ও নেই জীবনের নিরাপত্তা। অব্যাহতভাবে দফায় দফায় শিকার হতে হচ্ছে রাখাইনদের পরিচালিত রোহিঙ্গা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নির্মূল অভিযানের। হতে হচ্ছে দেশছাড়া। রাখাইনদের নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক রোহিঙ্গা আজ শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ আরো কিছু দেশে। ২০১২ সালের হিসাব মতে, রাখাইন প্রদেশে এখনো বসবাস করছে আট লাখ রোহিঙ্গা। রাখাইন রাজ্যটি বাংলাদেশের লাগোয়া। তাই যখনই এখান থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, তখনই এরা বাংলাদেশে এসে শরণার্থী হয়। জাতিসঙ্ঘের মতে, এরা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এরা বিশ্ববাসীর কাছে ভুলে যাওয়া এক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে আছে তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী, অন্য হিসেবে পাঁচ লাখেরও বেশি। পাকিস্তানে দুই লাখ, থাইল্যান্ডে এক লাখ আর মালয়েশিয়ায় ২৪ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। তবে অনেকেই মনে করেন, প্রকৃত হিসাবে এসব দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী কমপক্ষে আরো ৫০ শতাংশ বেশি। তা ছাড়া ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো অনেক দেশেই বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রোহিঙ্গা ঠাঁই নিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যটি রোহিঙ্গাদের নয়, রাখাইনদেরÑ এ দাবি পাকাপোক্ত করার জন্য ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার আরাকান রাজ্যের বা প্রদেশের নাম পাল্টে রাখে রাখাইন প্রদেশ। নাগরিকত্ব ও সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নেয়ার মতো জঘন্য অপরাধ বার্মা তথা আজকের মিয়ানমারের প্রতিটি সরকার করে আসছে, দেশটি ১৯৪৮ সালে ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। বিশেষ করে জেনারেল নে উইন ক্ষমতায় আসার পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর হয়রানি আর নির্যাতনের মাত্রা হাজার গুণে বেড়ে যায়। থেমে থেমে বিভিন্ন অজুহাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে চলে রোহিঙ্গা নির্মূল তথা এথনিক কিনসিং। এ উদ্দেশ্যেই ১৯৮২ সালে করা হয় মিয়ানমার নতুন নাগরিকত্ব আইন।
মিয়ানমারের সরকার জানাতে চায় না, অন্যদের জানতে দিতে চায় নাÑ সে দেশের রোহিঙ্গাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি। মিয়ানমারে এদের শেকড় গভীরভাবে প্রোথিত। সে দেশে এরা নাগরিকত্ব হারিয়ে কোনো বিবেচনায়ই ‘রাষ্ট্রহীন’ থাকতে পারে না। শত শত বছর ধরে সে দেশে বসবাস করে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়া এ এক চরম অন্যায়। ন্যায়নীতি ও আন্তর্জাতিক আইনকানুনের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা। কিন্তু গায়ের জোরে মিয়ানমার এদের বিদেশী বলে অপপ্রচার চালিয়ে তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে এদের ঠেলে দিয়েছে ‘রাষ্ট্রহীন’ মর্যাদায়।
রোহিঙ্গা শব্দটি এসেছে ‘রোহাঙ্গ’ শব্দ থেকে। আরাকান রাজ্যের মূল নাম ছিল রোহাঙ্গ। মধ্যযুগের আরাকান ও চট্টগ্রামের করিরা- আলাওল, দৌলত কাজী, মরদান, শমসের আলী, আইনুদ্দিন, আবদুল গনি ও অন্যরা তাদের লেখায় আরাকানকে বারবার উল্লেখ করেছেন রোসাং, রোসাঙ্গো দেশ ও রোসাঙ্গো শর (শহর) নামে। রোহাঙ্গের মূল অধিবাসীদের মধ্যে ছিল হিন্দু, বৌদ্ধ ও অ্যানিমিস্ট বা সর্বপ্রাণবাদীরা। অ্যানিমিস্টদের বিশ্বাস বৃক্ষ, পাথর, বায়ু প্রভৃতি সব বস্তুর প্রাণ আছে। প্রাক-ইসলামি আমল থেকেই এই অঞ্চলটি আরব সমুদ্র-অভিযাত্রীদের কাছে সুপরিচিত ছিল। তখন এখানে আসা অনেক আরব স্থানীয় লোকদের সাথে মিশে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন আরাকান তথা রোহাঙ্গ রাজ্যে। এরাই আজ রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। কিছু ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন, আরাকানে প্রথম যে মুসলমান বসবাস শুরু করেন, এরা আরব। এরা সপ্তম শতাব্দীতে আরাকানে আসেন মোহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার নেতৃত্বে। তিনি রানী কৈয়াপুরিকে বিয়ে করলে রানী মুসলমান হয়ে যান। সাথে সাথে দলবদ্ধভাবে তার কৈয়াপুরির প্রজরা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। যে পাহাড়চূড়ায় এরা বসবাস করতেন, তা আজো হানাফিয়া টঙ্কি ও কৈয়াপুরি টঙ্কি নামে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তাই যদি সত্যি হয়, তবে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের শেকড় প্রোথিত হয় সেই সপ্তম শতাব্দীতে। তাহলে সেখানে তাদের বসবাস আজ ১৪০০ বছর ধরে। তাহলে এদের বাংলাদেশী প্রত্যাবাসী বলে তাদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার বাতিল করা কোন যুক্তিতে?
এ এলাকায় মুসলমানদের বড় ধরনের আরেকটি আগমন ঘটে অষ্টম শতাব্দীর দিকে। ব্রিটিশ বার্মা গেজেটিয়ারে (১৯৫৭) মতে, ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মাহাতেইং সানদিয়া ভেসালির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পুরনো রামাওয়াদির জায়গায় নতুন নগর ভেসালি গড়ে তোলেন। তিনি বাইশ বছর রাজত্ব করার পর মারা যান। তার শাসনামলে বেশ কয়েকটি জাহাজ রামব্রি দ্বীপে এসে ধ্বংস হয়ে যায়। এসব জাহাজের নাবিকেরা ছিল মুসলমান। তাদের পাঠানো হয় আরাকান সদরে। এরা সেখানে কয়েকটি গ্রামে বসবাস গড়ে তোলেন। এরা ছিল মুর আরব মুসলমান।
তৃতীয় আরেকটি মুসলমান জনগোষ্ঠী আরাকানে আসে ১৪০৪ সালের পর, যখন আরাকানি রাজা বার্মিজদের কাছে সিংহাসনচ্যুত হয়ে বাংলার রাজধানী গৌড়ে আশ্রয় নেন। সিংহাসনচ্যুত এই রাজা সিংহাসন ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহের সহায়তা চান। সুলতান হাজার হাজার সৈন্য পাঠান আরাকান বিজয়ের জন্য। এসব সৈন্যের অনেকেই সেখানে থেকে যান ও স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।
আরো পরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীÑ যেমন মোগল (মোগল যুবরাজ শাহ সুজার যুদ্ধের মাধ্যমে), তুর্কি, পার্সি, মধ্য এশীয়, পাঠান ও বাঙালিরাও আরাকানে এসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। আরাকানে ও বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে ইসলামের প্রসার ঘটে সমুদ্রপথে এ অঞ্চলে আসা সুফি ও আরব বণিকদের মাধ্যমে। এর সত্যতা মেলে আরাকান ও বার্মার সুদীর্ঘ উপকূল বরাবর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সুফি-আউলিয়া-দরবেশের দরগাহ ও মাজারের উপস্থিতি থেকে। বার্মিজ ইতিহাসবিদ ইউ. কাইয়ি লিখে গেছেন ‘The superior morality of Muslims attracted large number of people towards Islam, who embraced it en masse.’ (The History of Burma, By U. Kyi, page-160).
আরাকান নামে মধ্যযুগের এ রাজ্যটি বার্মিজরা ১৭৮৪ সালে দখল করে এটিকে বার্মার একটি প্রদেশে পরিণত করে। অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গা মুসলমানেরা সেই সপ্তম শতাব্দী থেকে আরাকানে তথা আজকের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। এরা এমন এক জাতি সম্প্রদায়, যার সৃষ্টি বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সমন্বয়ের মাধমে। কোনো উপজাতি থেকে এর উদ্ভব ঘটেনি। চৌদ্দ শ’ বছর ধরে যাদের বসবাস এ দেশে, সে দেশে এরা নাগরিকত্বহারা হতে পারে না। পেতে পারে না ‘রাষ্ট্রহীন’ পরিচয়। হতে পারে না রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। কোনো বিবেচনায়ই তাদের বিরুদ্ধে চলতে পারে না জাতিগত উচ্ছেদ বা নির্মূল অভিযান।
সার্বিক বিবেচনায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সন্তান। এরা মিয়ানমারে স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার রাখে। অথচ দেশটির বৌদ্ধবাদী সামরিক সরকারগুলো নির্মম ব্যবহার করেছে রোহিঙ্গাদের সাথে। এরা কখনোই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। বরং সরকার নিজেই রোহিঙ্গা নিধন-নির্যাতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রতিটি সরকার রোহিঙ্গাদের যাবতীয় নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এদের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে নিজ দেশে পরবাসী করা হয়েছে। সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী নাগরিক কার্ডও বাতিল করে ভোটের অধিকার বাতিল করেছে। অতএব মিয়ানমার সরকার নিজে থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের মৌল অধিকার বাস্তবায়ন করবে, তেমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
অতএব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ই এখন রোহিঙ্গাদের শেষ ভরসা হয়ে উঠেছে। জাতিসঙ্ঘের ব্যানারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে না এলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা নিশ্চিত অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সার্র্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য প্রথমেই দরকার জাতিসঙ্ঘের অধীনে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি করা। জাতিসঙ্ঘকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাসহ যাবতীয় নাগরিক অধিকার দিতে। রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়ন ও হত্যা বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনভাবে লেখাপড়া করা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার দিতে হবে। মিয়ানমারের সবখানে তাদের অবাধে যাতায়াত ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে দিতে হবে। সম্পদ অর্জনের অধিকার দিতে হবে। অন্য নাগরিকদের মতো রোহিঙ্গাদের সব ক্ষেত্রে সমসুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরিয়ে আনতে হবে। ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের কেড়ে নেয়া সম্পদ। পুনর্বাসন করতে হবে তাদের ছেড়ে যাওয়া বাড়িঘরে। তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির মূল স্রোতে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রায়ের ভূমিকাই হতে হবে মুখ্য।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
২০১১ সালে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে মিয়ানমারে সামরিক সরকারের অপসারণের পর বড় ধরনের আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিলÑ সে দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে। কারণ, তখন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু কি ও আরো অনেক রাজনীতিবিদ মুক্তি পান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। কেননা, ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসানে এটিকে বিবেচনা করা হয় শান্তিপ্রক্রিয়ার একটি উদ্যোগ হিসেবে। এর ফলে মিয়ানমারের সব দল-মত ও ধর্মমতের মানুষ সম-অধিকার নিয়ে সে দেশে বসবাসের সুযোগ পাবে।
দেশটিতে ২০১৫ সালের মে মাসে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক সংস্কারকল্পে একটি গণভোটও অনুষ্ঠিত হতে পারে, এমন কথাও উঠেছে। কিন্তু এমনি এক সময়ে দেশটির সার্বিক চিত্র কেমন জানি বদলে যাচ্ছে। সম্প্রদায়গত সমালোচনামূলক তিরস্কার বাড়ছে। শান্তিপ্রক্রিয়া থেমে গেছে। সংখ্যালঘু রেহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দমনপীড়ন বেড়ে গেছে। এদের বাধ্য করা হচ্ছে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে। দেশ ছেড়ে পালাতে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী নাগরিক কার্ড বাতিল করে কেড়ে নেয়া হলো এদের ভোটের অধিকার। এখন নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছেÑ মিয়ানমারে এখন এসব কী ঘটছে? ২০১৫ সালের বাকি সময়টায় আরো কী ঘটবে? সে দেশে কি সবার অংশগ্রহণে কোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? জাতীয় নির্বাচন কি আদৌ অনুষ্ঠিত হবে? রেহিঙ্গারা কি তাদের ভোটের অধিকার ও নাগরিকত্ব পাবে? রোহিঙ্গাবিরোধী জাতিগত বিতাড়নপ্রক্রিয়া কি আরো বেড়ে যাবে? বাকি দুনিয়া বা জাতিসঙ্ঘ কি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার পাওয়ার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে? এমনি বিভিন্ন প্রশ্ন এখন মিয়ানমারকে ঘিরে।
এ দিকে আবার নতুন শঙ্কা। জাতিসঙ্ঘ একজন বিতর্কিত শিক্ষাবিদকে এর রাখাইনবিষয়ক আবাসিক সমন্বয়কের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। জ্যাক লেইডার নামের লুক্সেমবার্গ ইতিহাসবিদ হচ্ছেন এই নবনিয়োজিত উপদেষ্টা। তাকে গত জানুয়ারি মাসে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক ও মানবাধিকারবিষয়ক সমন্বয়ক রেনেটা লক ডেসালিয়েনের সিনিয়র কনসালট্যান্ট করা করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, জ্যাক লেইডার রাখাইনদের প্রতি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। রোহিঙ্গা রাজনীতিবিদেরা এ নিয়োগের নিন্দা জানিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘ গত ১১ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতির মাধ্যমে এ নিয়োগের কথা জানায়। ড. লেইডার উপনিবেশ-পূর্ব সময়ের রাখাইন মারুক-ইউ রাজ্যের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ। কিন্তু রোহিঙ্গা সম্প্রদায় সম্পর্কিত তার অবস্থান তাকে অব্যাহতভাবে বিতর্কিত করে তোলে। এ জন্য তিনি রোহিঙ্গা ও কিছু মানবাধিকার গোষ্ঠীর কাছে একজন অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত। ড. লেইডারের অভিমতÑ ‘রোহিঙ্গা পদবাচ্যটি একটি পলিটিক্যাল লেবেল, কোনো এথনিসিটি নয়। রোহিঙ্গা শব্দটি জনপ্রিয় করে তোলা হয় নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। তার এই অভিমত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের মর্যাদা পাওয়া ও তাদের ভোটের অধিকার পাওয়ার বিষয়টিকে কার্যত আরো বিতর্কিত করে তুলেছে।
মিয়ানমারে রয়েছে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। কিন্তু দেশটির সরকার তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। দেশটিতে গত বছর পরিচালিত আদমশুমারিতেও তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। ২০১২ সালে দেশটির রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের হামলায় নিহত হন কয়েক শ’ রোহিঙ্গা। বাড়িঘর ছাড়েন দেড় লাখ। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর জাতিসঙ্ঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন দেশ থেকে চাপ এলে রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে ভোটাধিকার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। কিন্তু সম্প্রতি তা বাতিল ঘোষণা করায় এ ইস্যুতে নতুন করে সঙ্কট সৃষ্টি করা হলো। সেই সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রশ্নে মনে হয় দেশটির সরকার আবারো উল্টো পথে হাঁটার নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। অথচ শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশটির উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের মতোই সরকারও রোহিঙ্গাদের প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে থাকে। এরা কিছুতেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব মেনে নিতে চাইছে না।
রোহিঙ্গা মিয়ানমারে একটি নৃতাত্ত্বিক জাতি সম্প্রদায়। শত শত বছর ধরে বার্মার তথা আজকের মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে এরা বসবাস করে আসছে। আরাকান প্রদেশটি আজ রাখাইন প্রদেশ নামে পরিচিত। কিন্তু মিয়ানমারের প্রতিটি সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও যাবতীয় মানবাধিকার অস্বীকার করে আসছে। বলছে, এরা ভিনদেশী। বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে এরা বার্মায় গিয়ে অবৈধভাবে সেখানে বসাবস করছে। এরা বার্মায় থাকতে পারবে না। ফলে আজ এরা সেখানে নাগরিক অধিকারহারা। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও অন্যান্য নাগরিক সেবা জোগানোয় মিয়ানমার সরকারের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। নিজ দেশে এরা পরবাসী। এরা ‘রাষ্ট্রহীন’ এক জনগোষ্ঠী। এরা হাজারো বছর ধরে আরাকানে বসবাস করেও সে দেশে নেই এদের সম্পত্তি অর্জনের অধিকার। কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের জমিজমা। অবাধ চলাচলের, লেখাপড়া শেখার, ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকারও নেই এদের। ফলে অমানবিক এক পরিবেশে এদের সে দেশে বসবাস করতে হচ্ছে । তা-ও নেই জীবনের নিরাপত্তা। অব্যাহতভাবে দফায় দফায় শিকার হতে হচ্ছে রাখাইনদের পরিচালিত রোহিঙ্গা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নির্মূল অভিযানের। হতে হচ্ছে দেশছাড়া। রাখাইনদের নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক রোহিঙ্গা আজ শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ আরো কিছু দেশে। ২০১২ সালের হিসাব মতে, রাখাইন প্রদেশে এখনো বসবাস করছে আট লাখ রোহিঙ্গা। রাখাইন রাজ্যটি বাংলাদেশের লাগোয়া। তাই যখনই এখান থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, তখনই এরা বাংলাদেশে এসে শরণার্থী হয়। জাতিসঙ্ঘের মতে, এরা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এরা বিশ্ববাসীর কাছে ভুলে যাওয়া এক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে আছে তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী, অন্য হিসেবে পাঁচ লাখেরও বেশি। পাকিস্তানে দুই লাখ, থাইল্যান্ডে এক লাখ আর মালয়েশিয়ায় ২৪ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। তবে অনেকেই মনে করেন, প্রকৃত হিসাবে এসব দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী কমপক্ষে আরো ৫০ শতাংশ বেশি। তা ছাড়া ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো অনেক দেশেই বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রোহিঙ্গা ঠাঁই নিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যটি রোহিঙ্গাদের নয়, রাখাইনদেরÑ এ দাবি পাকাপোক্ত করার জন্য ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার আরাকান রাজ্যের বা প্রদেশের নাম পাল্টে রাখে রাখাইন প্রদেশ। নাগরিকত্ব ও সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নেয়ার মতো জঘন্য অপরাধ বার্মা তথা আজকের মিয়ানমারের প্রতিটি সরকার করে আসছে, দেশটি ১৯৪৮ সালে ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। বিশেষ করে জেনারেল নে উইন ক্ষমতায় আসার পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর হয়রানি আর নির্যাতনের মাত্রা হাজার গুণে বেড়ে যায়। থেমে থেমে বিভিন্ন অজুহাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে চলে রোহিঙ্গা নির্মূল তথা এথনিক কিনসিং। এ উদ্দেশ্যেই ১৯৮২ সালে করা হয় মিয়ানমার নতুন নাগরিকত্ব আইন।
মিয়ানমারের সরকার জানাতে চায় না, অন্যদের জানতে দিতে চায় নাÑ সে দেশের রোহিঙ্গাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি। মিয়ানমারে এদের শেকড় গভীরভাবে প্রোথিত। সে দেশে এরা নাগরিকত্ব হারিয়ে কোনো বিবেচনায়ই ‘রাষ্ট্রহীন’ থাকতে পারে না। শত শত বছর ধরে সে দেশে বসবাস করে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়া এ এক চরম অন্যায়। ন্যায়নীতি ও আন্তর্জাতিক আইনকানুনের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা। কিন্তু গায়ের জোরে মিয়ানমার এদের বিদেশী বলে অপপ্রচার চালিয়ে তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে এদের ঠেলে দিয়েছে ‘রাষ্ট্রহীন’ মর্যাদায়।
রোহিঙ্গা শব্দটি এসেছে ‘রোহাঙ্গ’ শব্দ থেকে। আরাকান রাজ্যের মূল নাম ছিল রোহাঙ্গ। মধ্যযুগের আরাকান ও চট্টগ্রামের করিরা- আলাওল, দৌলত কাজী, মরদান, শমসের আলী, আইনুদ্দিন, আবদুল গনি ও অন্যরা তাদের লেখায় আরাকানকে বারবার উল্লেখ করেছেন রোসাং, রোসাঙ্গো দেশ ও রোসাঙ্গো শর (শহর) নামে। রোহাঙ্গের মূল অধিবাসীদের মধ্যে ছিল হিন্দু, বৌদ্ধ ও অ্যানিমিস্ট বা সর্বপ্রাণবাদীরা। অ্যানিমিস্টদের বিশ্বাস বৃক্ষ, পাথর, বায়ু প্রভৃতি সব বস্তুর প্রাণ আছে। প্রাক-ইসলামি আমল থেকেই এই অঞ্চলটি আরব সমুদ্র-অভিযাত্রীদের কাছে সুপরিচিত ছিল। তখন এখানে আসা অনেক আরব স্থানীয় লোকদের সাথে মিশে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন আরাকান তথা রোহাঙ্গ রাজ্যে। এরাই আজ রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। কিছু ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন, আরাকানে প্রথম যে মুসলমান বসবাস শুরু করেন, এরা আরব। এরা সপ্তম শতাব্দীতে আরাকানে আসেন মোহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার নেতৃত্বে। তিনি রানী কৈয়াপুরিকে বিয়ে করলে রানী মুসলমান হয়ে যান। সাথে সাথে দলবদ্ধভাবে তার কৈয়াপুরির প্রজরা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। যে পাহাড়চূড়ায় এরা বসবাস করতেন, তা আজো হানাফিয়া টঙ্কি ও কৈয়াপুরি টঙ্কি নামে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তাই যদি সত্যি হয়, তবে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের শেকড় প্রোথিত হয় সেই সপ্তম শতাব্দীতে। তাহলে সেখানে তাদের বসবাস আজ ১৪০০ বছর ধরে। তাহলে এদের বাংলাদেশী প্রত্যাবাসী বলে তাদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার বাতিল করা কোন যুক্তিতে?
এ এলাকায় মুসলমানদের বড় ধরনের আরেকটি আগমন ঘটে অষ্টম শতাব্দীর দিকে। ব্রিটিশ বার্মা গেজেটিয়ারে (১৯৫৭) মতে, ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মাহাতেইং সানদিয়া ভেসালির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পুরনো রামাওয়াদির জায়গায় নতুন নগর ভেসালি গড়ে তোলেন। তিনি বাইশ বছর রাজত্ব করার পর মারা যান। তার শাসনামলে বেশ কয়েকটি জাহাজ রামব্রি দ্বীপে এসে ধ্বংস হয়ে যায়। এসব জাহাজের নাবিকেরা ছিল মুসলমান। তাদের পাঠানো হয় আরাকান সদরে। এরা সেখানে কয়েকটি গ্রামে বসবাস গড়ে তোলেন। এরা ছিল মুর আরব মুসলমান।
তৃতীয় আরেকটি মুসলমান জনগোষ্ঠী আরাকানে আসে ১৪০৪ সালের পর, যখন আরাকানি রাজা বার্মিজদের কাছে সিংহাসনচ্যুত হয়ে বাংলার রাজধানী গৌড়ে আশ্রয় নেন। সিংহাসনচ্যুত এই রাজা সিংহাসন ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহের সহায়তা চান। সুলতান হাজার হাজার সৈন্য পাঠান আরাকান বিজয়ের জন্য। এসব সৈন্যের অনেকেই সেখানে থেকে যান ও স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।
আরো পরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীÑ যেমন মোগল (মোগল যুবরাজ শাহ সুজার যুদ্ধের মাধ্যমে), তুর্কি, পার্সি, মধ্য এশীয়, পাঠান ও বাঙালিরাও আরাকানে এসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। আরাকানে ও বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে ইসলামের প্রসার ঘটে সমুদ্রপথে এ অঞ্চলে আসা সুফি ও আরব বণিকদের মাধ্যমে। এর সত্যতা মেলে আরাকান ও বার্মার সুদীর্ঘ উপকূল বরাবর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সুফি-আউলিয়া-দরবেশের দরগাহ ও মাজারের উপস্থিতি থেকে। বার্মিজ ইতিহাসবিদ ইউ. কাইয়ি লিখে গেছেন ‘The superior morality of Muslims attracted large number of people towards Islam, who embraced it en masse.’ (The History of Burma, By U. Kyi, page-160).
আরাকান নামে মধ্যযুগের এ রাজ্যটি বার্মিজরা ১৭৮৪ সালে দখল করে এটিকে বার্মার একটি প্রদেশে পরিণত করে। অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গা মুসলমানেরা সেই সপ্তম শতাব্দী থেকে আরাকানে তথা আজকের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। এরা এমন এক জাতি সম্প্রদায়, যার সৃষ্টি বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সমন্বয়ের মাধমে। কোনো উপজাতি থেকে এর উদ্ভব ঘটেনি। চৌদ্দ শ’ বছর ধরে যাদের বসবাস এ দেশে, সে দেশে এরা নাগরিকত্বহারা হতে পারে না। পেতে পারে না ‘রাষ্ট্রহীন’ পরিচয়। হতে পারে না রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। কোনো বিবেচনায়ই তাদের বিরুদ্ধে চলতে পারে না জাতিগত উচ্ছেদ বা নির্মূল অভিযান।
সার্বিক বিবেচনায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সন্তান। এরা মিয়ানমারে স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার রাখে। অথচ দেশটির বৌদ্ধবাদী সামরিক সরকারগুলো নির্মম ব্যবহার করেছে রোহিঙ্গাদের সাথে। এরা কখনোই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। বরং সরকার নিজেই রোহিঙ্গা নিধন-নির্যাতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রতিটি সরকার রোহিঙ্গাদের যাবতীয় নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এদের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে নিজ দেশে পরবাসী করা হয়েছে। সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী নাগরিক কার্ডও বাতিল করে ভোটের অধিকার বাতিল করেছে। অতএব মিয়ানমার সরকার নিজে থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের মৌল অধিকার বাস্তবায়ন করবে, তেমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
অতএব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ই এখন রোহিঙ্গাদের শেষ ভরসা হয়ে উঠেছে। জাতিসঙ্ঘের ব্যানারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে না এলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা নিশ্চিত অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সার্র্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য প্রথমেই দরকার জাতিসঙ্ঘের অধীনে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি করা। জাতিসঙ্ঘকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাসহ যাবতীয় নাগরিক অধিকার দিতে। রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়ন ও হত্যা বন্ধ করতে হবে। স্বাধীনভাবে লেখাপড়া করা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার দিতে হবে। মিয়ানমারের সবখানে তাদের অবাধে যাতায়াত ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে দিতে হবে। সম্পদ অর্জনের অধিকার দিতে হবে। অন্য নাগরিকদের মতো রোহিঙ্গাদের সব ক্ষেত্রে সমসুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরিয়ে আনতে হবে। ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের কেড়ে নেয়া সম্পদ। পুনর্বাসন করতে হবে তাদের ছেড়ে যাওয়া বাড়িঘরে। তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির মূল স্রোতে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রায়ের ভূমিকাই হতে হবে মুখ্য।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
No comments