মহাকাব্যের কথা by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
মহাকাব্য
বস্তুটি কী? মহাকাব্য বড় কাব্য। অবশ্যই। কিন্তু কত বড়? তা অনেক বড় হতে
পারে বৈকি। সব মহাকাব্য সমান বড় নয়, কিন্তু মহাকাব্য মানেই বড় কাব্য। যেমন
‘মহাভারত’। প্রাচীন ভারতীয় এ মহাকাব্যটি অসম্ভব বড়। গ্রিক মহাকাব্য
‘ইলিয়াড’ ও ‘অডিসি’কে যদি একত্র করা যায়, একত্র করে ৮ দিয়ে গুণ করা যায়,
তাহলে তারা ‘মহাভারতে’র সমান হবে আয়তনে। আট লাখ স্তবক নিয়ে এর গঠন। শুরুতে
অবশ্য অত বড় ছিল না, শুরুতে ছিল চব্বিশ হাজার স্তবক। তারপর ধীরে ধীরে বছরের
পর বছর ধরে, যুগ পেরিয়ে যুগান্তরে যোগ হয়েছে নতুন উপাদান, দীর্ঘ হয়েছে
পুরনো কাহিনী, সমুদ্রের দিকে যত এগোয় নদী ততই যেমন বেড়ে যায় তার আয়তন তেমনি
বাড়তে বাড়তে যা ছিল চব্বিশ হাজার স্তবের রচনা, তা পরিণত হয়েছে আট লাখ
স্তবকের কাব্যে। সাতশ’-আটশ’ বছর ধরে চলেছে এ বৃদ্ধি। মহাভারতের বর্তমান রূপ
খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর ঘটনা। তবে কেবল আয়তনে নয়, মহাকাব্য বড় আরও এক
দিক দিয়ে। মহাকাব্য হচ্ছে বীরত্বের গাথা। বীরের কাহিনীই এর ভিত্তি। বীরের
মাহাত্ম্য, তার বীরত্ব, অসামান্যত্ব- সব ধরা পড়ে একটি মহাকাব্যে। মহাকাব্যে
বীর থাকে বড় একজন বীর, তাকে ঘিরেই কাহিনী।
এরপরও কিন্তু বাকি থাকে কিছু। কেবল বড় নয়, কেবল বীরত্বপূর্ণ নয়, মহাকাব্যের কাহিনী জনপদের কাহিনী। একজন বিশেষ মানুষের গল্প শুধু নয়, গল্প একটি জনজীবনের, বিশেষ একটি সভ্যতার। এ ক্ষেত্রেও ওই নদীর মতোই। নদী যে লোকালয়ের ভেতর দিয়ে যায় সেই লোকালয়েরই নদী হয়ে ওঠে। মহাকাব্যের গল্পও তেমনি। লোকালয়ের গল্প। একজন মানুষের কাহিনী হয়েও অনেক মানুষের কাহিনী। ওই একজন- যাকে আমরা বীর বলি, তিনি অনেক মানুষের প্রতিনিধি।
সাহিত্যে এ ব্যাপারটা সব সময়েই ঘটে থাকে। একজন মানুষ অনেক মানুষের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। আর সেই জন্যই ওই একজন মানুষ বিশেষভাবে মূল্যবান। ট্রাজেডিতে এটা খুব স্পষ্টভাবে ঘটে। যেমন ধরুন শেকসপীয়রের ট্রাজেডির নায়কেরা। তারা একক মানুষ কি? হ্যাঁ, হ্যামলেট তো একজন বিশেষ মানুষই বটে। ডেনমার্কের রাজপুত্র তিনি। তার কালের মানুষ, তার মতো মানুষ তার আশপাশে আর একটিও নেই। সারা পৃথিবী খুঁজলেও তার দ্বিতীয়টি পাওয়া অসম্ভব। এ পৃথিবীতে কোনো দুটি মানুষই হুবহু একরকম নয়, ভিন্ন তারা পরস্পর থেকে- কোনো না কোনো দিক দিয়ে। কিন্তু হ্যামলেট তো আবার সব কালেরই মানুষ, সব দেশেরই মানুষ; সেই মানুষ যিনি দেখেছেন ভালোর সঙ্গে মন্দের দ্বন্দ্ব চলছে প্রতিনিয়ত, যে দ্বন্দ্বে ভালো রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অহরহ। আকাশের ছায়া পড়ে পুকুরে, সব মানুষের ছায়া এসে পড়ে কোনো কোনো মানুষের জীবনে।
ট্রাজেডির নায়ক যতটা সর্বজনীন, মহাকাব্যের নায়ক অবশ্য ততটা সর্বজনীন নন। তুলনায় তিনি অধিকতর স্থানীয়। এ প্রসঙ্গে কথাটা বলা যায়, ট্রাজেডির সঙ্গে মহাকাব্যের মৌলিক তফাৎ এই খানে, ট্রাজেডি জীবনের একটি খণ্ড অংশের ছবি ফুটিয়ে তোলে, আর মহাকাব্য চায় ছবি দেবে সমগ্র জীবনের। ট্রাজেডি হচ্ছে দুর্ভোগের প্রতিচ্ছবি। মানুষের জীবনের দুর্ভোগ একটি অত্যন্ত বড় সত্য, কিন্তু তাই বলে সে তো একমাত্র সত্য নয়। হাসির পাশাপাশি কান্নাও আছে। গভীরের পাশে তো চটুল থাকতে পারে, গভীরের পাশে যেমন থাকে সরল। ট্রাজেডি দুঃখের গভীর ও গভীর ছবি নিয়ে আসে, হাসির হাল্কা সরল অংশটিকে বাদ দিয়ে। ট্রাজেডি তাই গভীর সত্য বলে ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য বলে না। ট্রাজেডির গভীরতার ব্যাপারটা স্মরণে না রাখলে কিন্তু তার প্রতি গভীর অন্যায় করা হবে। বাল্মীকি যে রামায়ণ নামে মহাকাব্য লিখলেন, তার অনুপ্রেরণা তিনি পেলেন কোথায়? পেলেন দুঃখের গভীর এক বোধে। বাল্মীকি যে মহাকাব্য লিখবেন এমন কোনো কথাই ছিল না। প্রথম জীবনে তিনি দস্যু ছিলেন, নাম ছিল রত্নাকর; পরে সাধু হয়ে বনে চলে গেছেন। সেই বনবাসের কালে একদিন বেরিয়েছিলেন কাঠ সংগ্রহে, হঠাৎ দেখেন গাছের ওপর বসে আছে দুটি পাখি। এই সময়েই, কওয়া নেই বলা নেই, কোথা থেকে ছুটে এলো শিকারির তীর। দুটি পাখির একটি গেল পড়ে, আর অন্যটি শুরু করল বিলাপ। তাই দেখে ভেতর থেকে ধিক্কার বেরিয়ে এলো কাল্মীকির। তিনি দেখেন যাই বলছেন, আসছে সুরে ভেসে, ছন্দে ভর করে। সেইভাবেই রচিত হল তার মহাকাব্য। এ গল্পে রূপক আছে। সাহিত্য ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে মানুষের। আর এই যে সাহিত্য সৃষ্টি এর সবচেয়ে গভীর কারণ হল দুঃখ। আমাদের সবচেয়ে সুন্দর গান হচ্ছে সবচেয়ে বড় দুঃখের কাহিনী। দুঃখই সবচেয়ে ভারী, তার কাহিনীই সবচেয়ে বেশি আন্তরিক ও মর্মস্পর্শী। কিন্তু তবুও ট্রাজেডি খণ্ডিত যে তা সত্য। মহাকাব্য ট্রাজেডির তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত। তার গল্প সত্যি সত্যি বহতা নদীর মতো- কেবল দৈর্ঘ্যে নয়, প্রস্থেও।
ওই যে ‘মহাভারতের কথা বললাম, ও তো কেবল গল্প নয়। মনে করা হয় যে ওর কাহিনীতে ইতিহাস আছে, কারও কারও কাছে এ মহাকাব্য ধর্মগ্রন্থও বটে। ফেরদৌসির শাহনামা ভিন্ন দেশে লেখা, ফার্সি ভাষায় রচিত। সেখানেও ইতিহাস আছে, রাজবংশের ইতিহাস। কিন্তু মহাকাব্যে ইতিহাস থাকে- এটা কোন অর্থে? আমরা কি জানি না যে কাব্য মাত্রেই কল্পনার ফসল, সে জন্য মিথ্যা ভাষণ? কবিদের বিরুদ্ধে চিরকালের অভিযোগ কি এ নয় যে, তারা মিথ্যা বলেন, বানিয়ে বানিয়ে বলেন? তবুও মহাকাব্যে ইতহিাস অবশ্যই থাকে- থাকে সময়ের ইতিহাস, সমাজের ইতিহাস। একটি মহাকাব্য পড়া মানে একটি গল্প পড়া নয় কেবল, সেই বিশেষ সময়ের সমাজ ও সংস্কৃতির একটি ইতিহাস পড়াও বটে। এই ইতিহাস, ইতিহাস বইয়ের ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত। কেননা এ হচ্ছে কবির লেখা ইতিহাস। কবির থাকে কল্পনা, সেই কল্পনা অনেক রুদ্ধ দরজা অনায়াসে খুলে ফেলে, এমনিতে যাদের বন্ধ থাকার কথা। কবির কল্পনা ভেদ করে অন্ধকার, চূর্ণ করে জটাজাল।
যেমন ধরা যাক হোমারের কথা। বলা হয় তিনি অন্ধ ছিলেন। অন্ধ হোন, আর নাই হোন সত্য এটা যে একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ছিল তার মনের দৃষ্টি, যেটা বোঝা যায় তার মহাকাব্য দুটি- ‘ইলিয়াড’ ও ‘অডিসি’- পড়লে। একই ব্যক্তি এ দুটি মহাকাব্য লিখলেন কী করে? কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন। কেননা এ দুটি মহাকাব্য গ্রিকদের কাহিনী হিসেবে এক বটে, কিন্তু নানাদিক দিয়ে একে অপর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটা অবশ্য অন্য কথা। বড় কথা এখানে এই যে, কবি কেবল কল্পনাই করেননি; তিনি তার কল্পনাকে কাজে লাগিয়েছেন সেকালের গ্রিক জীবনের ছবি তুলে ধরতে। তখনকার গ্রিকরা কেমন করে যুদ্ধ করতেন সেকথা আছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আছে তাদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, আছে তাদের আচার-আচরণ, খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়া। কী নেই? গ্রিকরা কী ভাবতেন, কেমন ছিল তাদের জগৎদৃষ্টি। বিপদগুলো কোন দিক থেকে আসত, কেমন করে, কোথায় ছিল সুখ, কিসে দুঃখ- সবই আছে এ দুটি মহাকাব্যে। ঘরের ছবি মিশে গেছে সমাজের ছবির সঙ্গে। কেবল তাই নয়, দেব-দেবীরাও আছেন, যাদের অস্তিত্বে গ্রিকরা তখন বিশ্বাস করতেন। সেসব দেব-দেবীদের দেখে মানুষকেই চেনা যায় আসলে, কেননা তারা মানুষের মতোই আচরণ করেন। মানুষই যেন, ভিন্নরূপে। এসব দেবতারা মানুষের সৃষ্টি; সৃষ্টি দেখে ধরা যায় স্রস্টাকে।
আর বীরের ধারণা মাত্রই আসলে সামাজিক ধারণা। হোমারের বীরেরা ব্যক্তিগতভাবে হোমারেরই সৃষ্টি, কিন্তু কেবল হোমারের একার সৃষ্টি নয় তো; হোমার তার ধারণাগুলো পেলেন কোথা থেকে? পেলেন তার সমাজ থেকেই। যেমন ধরা যাক, অডিসির কথা। অডিসির নায়ক অডিসিয়ুস সম্মানকে অত্যন্ত উঁচু মূল্য দেন। তিনি লড়াই করেন নির্ভয়ে, বুদ্ধি আঁটেন ঠাণ্ডা মাথায়। ওদিকে তার স্ত্রী পেনিলোপি প্রতীক্ষায় থাকেন তার স্বামীর। স্বামী যুদ্ধে গেছেন, দশ বছর ধরে চলেছে সেই যুদ্ধ, তারপর যুদ্ধ থামার পরও আরও দশ বছর গেছে চলে, কিন্তু স্বামী অডিসিয়ুসের কোনো খোঁজখবর নেই। তাকে উত্ত্যক্ত করছে ভিনেদশী রাজপুত্ররা, যারা তাকে বিয়ে করতে চায় সম্পত্তির লোভে। ছেলে বেরিয়েছে পিতার খোঁজে। অডিসিয়ুসের বৃদ্ধ পিতা শোকার্ত। এই যে ছবি, এ ছবি একটি সামাজিক ছবি। ট্রাজেডির নায়কের তুলনায় মহাকাব্যের নায়ক অনেক বেশি সামাজিক- সমাজের নানা জটিল সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ তিনি, নানাভাবে। মহাকাব্য কবিতায় লেখা। কবিতাই হচ্ছে আদিরূপ সাহিত্যের। আদিতে কবিরা মহাকাব্য লিখেছেন জনজীবনের কাহিনী নিয়ে, আবার গীতিকবিতাও লিখেছেন নিজের ব্যক্তিগত কথা নিয়ে। আদিকালে ট্রাজেডি, কমেডি লেখা হতো কবিতাতেই, গদ্য এসেছে বেশ পরে। গদ্য এলো তখন যখন মানুষের সভ্যতার বয়স কিছু বাড়ল, অনেক রকম বিষয়ে চিন্তা এলো মনে, প্রয়োজন দেখা দিল প্রকাশেরও যোগাযোগের। এমনকি যখন লিখতে জানত না মানুষ, তখনও কবিতা ছিল।
মুখে মুখে তৈরি হতো, মুখে মুখে ঘুরত। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘ইলিয়াড’, ‘অডিসি’, ‘বেউলফ’ (ইংরেজদের আদি মহাকাব্য)। সবই মুখে মুখে তৈরি মহাকাব্য। এদের মধ্যে বেউলফের রচয়িতাকে তা জানাই সম্ভব হয়নি; অন্যক’টি মহাকাব্যের নির্দিষ্ট রচয়িতা আছেন বলে আমরা জানি, বাল্মীকি, ব্যাস ও হোমারের পরিচয় জানা আছে আমাদের, কিন্তু মহাকাব্যগুলোর সব অংশই যে তাদেরই রচনা তা বলা যাবে না, মূল রচনার স্রোতের সঙ্গে অন্য ধারাও এসে যোগ দিয়েছে হয়তো- ‘মহাভারতে’র ক্ষেত্রে তো এটা অবশ্যই সত্য। ভার্জিলের ‘ঈনিদ’, পরবর্তীকালে লেখা, সেটি লিখিত মহাকাব্য, মুখে মুখে রচিত নয়। যেমন মিল্টনের ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ ও মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখিত মহাকাব্য।
মিল্টন তার মহাকাব্য লিখেছেন সপ্তদশ শতাব্দীতে, তাকে বলা হয় ইংরেজি সাহিত্যের একমাত্র লিখিত ও পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্য। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের মেঘনাদবধের স্থানও অনেকটাই ওই রকম; বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য আরও আছে ঠিকই, কিন্তু কোনোটিই মেঘনাদবধের কাছাকাছি নয়। মধুসূদন তার কাব্য লিখেছেন মিল্টনের প্রায় দুশ’ বছর পরে, তার লেখায় মিল্টনের প্রভাব আছে, যেটা থাকা ছিল স্বাভাবিক। মিল্টন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, চোখে দেখতেন না। যখন তিনি ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ রচনা করেন সেই সময়টা তার ভয়ংকর দুর্দশার সময়, আশংকা ছিল রাজনৈতিক নির্যাতনের, একাকী হয়ে পড়েছিলেন, ভয়ংকর আর্থিক কষ্টও ছিল। এরি মধ্যে তিনি এই অতুলনীয় মহাকাব্য লিখেছেন। সেই সময়টা ছিল ইংল্যান্ডে বিপ্লবের সময়। মনে হচ্ছিল পুরনো ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে অভ্যুদয় ঘটবে নতুন এক সভ্যতার। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটল প্রজার। রাজা সিংহাসন ও মাথা দুইই হারালেন। এ যুদ্ধে মিল্টন নিজেও অংশ নিয়েছেন। এত লেখা লিখেছেন বিপ্লবের পক্ষে যে তার এমনিতে দুর্বল চোখ আরও দুর্বল হয়ে পড়ল পরিশ্রমে, তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেলেন। তার মনের ভেতরে ছিল বীরত্বের ছবি, বাইরে দেখছিলেন বীরত্বের প্রকাশ। সে জন্য বীরগাথা লিখলেন তিনি। কিন্তু এখানে বীরত্ব ভিন্ন ধরনের। মিল্টনের বিষয়টা স্থানীয় নয়, ধর্মীয় এবং সে অর্থে সর্বকালের। তিনি লিখলেন মানুষের আদি পতনের কথা, স্বর্গ এলো তার কাব্যে, এলেন ঐশ্বর, অ্যাডাম হলেন নায়ক, শত্র“ হিসেবে এলো স্যাটান। কোনো বিশেষকালের কাহিনী নয় এটি, সর্বকালের। কিন্তু তবু ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ যে সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে একজন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীর লেখা সেটা ভুল করার কোনো উপায় নেই। জগৎ সম্পর্কে মিল্টনের ধারণা, তার স্বর্গ ও নরক, অ্যাডাম-ঈভের সম্পর্ক, স্যাটানের বিদ্রোহ- সর্বত্র ছায়া ফেলেছে। মিল্টনের কাল ও সমাজ। মাইকেলের মধ্যেও মিল্টনের মতোই এক ধরনের বিদ্রোহ ছিল। তারও ছিল বীরত্বের প্রতি অসম্ভব আকর্ষণ, যে জন্য তিনি ধর্ম ছেড়ে দিয়েছিলেন, দেশ ছেড়েছিলেন, তারপর আবার ফিরেও এসেছিলেন ঘরে। তার মহাকাব্যে তার কাল আছে; আছে তার কালে স্বাধীনতার আগ্রহ, পরাধীনতার বেদনা, আছে পতিত মানুষের প্রতি গভীর বেদনাবোধ।
আধুনিককালে মহাকাব্য লেখা হয় না। কারণ কী না লেখার? কারণ কি এই যে, লেখকের সময় নেই অতবড় লেখা লিখার, পাঠকেরও সময় নেই তা পড়ার? সেটা একটা কারণ যে তা অস্বীকার করা যাবে না। আরও একটা কারণ এই যে, আধুনিককাল ব্যক্তির জন্য বীরত্বের কাল নয়। লোকে এখন ব্যক্তির অসামান্য বীরত্বে আর আস্থা রাখে না। তাছাড়া মানুষ এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পরস্পর থেকে। মহাকাব্যে দেখি নায়কেরা অনায়াসে মিশে যান অনেকের সঙ্গে, গ্রিক মহাকাব্যে একসঙ্গে অনেক মানুষ যুদ্ধ করে, জাহাজে চড়ে, দেশে ফেরে; নায়ক সেখানে অনায়াসে বন্ধুত্ব করেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে; কিন্তু একালে তো সেটা সম্ভব নয়।
মিল্টনের কালেরই মানুষ ছিলেন ড্রাইডেন। কবি হিসেবে খাটো ছিলেন না মোটেই। তারও আশা ছিল মহাকাব্য লিখবেন, ধর্মীয় মহাকাব্য নয়, জাতীয় মহাকাব্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিখতে পারলেন না। কারণ কী? তিনি বলেছেন কারণ হল রাজা তাকে টাকা দিলেন না। কিন্তু অর্থাভাব কি কারণ হতে পারে মহাকাব্য না-লেখার। মিল্টনও তো ছিলেন অর্থকষ্টে। কিন্তু কই অসম্ভব হয়নি তো তার পক্ষে মহাকাব্য লেখা। না, আসল কারণ সেটা নয়। আসল কারণ ড্রাইডেনের ছিল না বীরত্বের বোধ। তিনি যুদ্ধে যাননি। তিনি দল বদলেছেন। তার প্রতিভার বিশেষ স্ফূরণ দেখা গেছে হাসি-ঠাট্টার কাব্য রচনায়। সে প্রতিভা ভিন্ন ধরনের। মহাকাব্যিক একনিষ্ঠা ও অনমনীয়তা ছিল না সেখানে। খাটি মহাকাব্য লেখেন কি বটে, কিন্তু ড্রাইডেন ব্যঙ্গ মহাকাব্য লিখে গেছেন।
ব্যঙ্গ মহাকাব্যে মহাকাব্যের ভঙ্গিটি থাকে, ভাবটি থাকেন না। সামান্য বিষয়কে অসামান্য করে তোলা হয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে। পোশাকটা জাদরেল, চাল-চলন ভারিক্কি, কিন্তু মানুষটা খুব সামান্য; ফলে সবটা মিলে একটা কিম্ভূতের সৃষ্টি হয়, যা লোক হাসায়। ইচ্ছা করেই সৃষ্টি করা হয় এ কিম্ভূতের, উদ্দেশ্য হচ্ছে হাস্যকর করে তোলা সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের খারাপ জিনিসগুলোকে। আধুনিককালে এ ধরনের রচনা যতটা স্বাভাবিক, মহাকাব্য ততটা মোটেই নয়। আর ওই যে বিচ্ছিন্নতার কথা বললাম, সেটাও একালের প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রিক নায়ক অডিসিয়ুস রাজার সঙ্গে মেলেন যেমন তেমনি মেলেন শূকর পালকের সঙ্গে; লোকালয়ে যেমন থাকেন তেমনি সাঁতরে গিয়ে ওঠেন অচেনা দেশে; ভিখিরি সাজতে কষ্ট হয় না তার, যেমন অসম্ভব হয় না খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে। অনায়াসে বন্ধুত্ব করেন তিনি অচেনা মানুষের সঙ্গে। এখানকার মানুষ একজন আরেকজনের সঙ্গে মিশতে পারেন না তখনকার মতো, দেয়াল থাকে মাঝখানে। এ বিচ্ছিন্নতায় মহাকাব্য রচনা করা কঠিন, গীতিকবিতা রচনাটা স্বাভাবিক। প্রত্যেকে নিজের কথা বলেন সবার কথা না বলে। অডিসিয়ুসকে কেউ বন্দি করে রাখতে পারেননি, কিন্তু এককালের অনেক মানুষই মেনে নেন বন্দিত্বকে। তবে কবিতায় না হোক গদ্যে মহাকাব্যে লেখা হয়েছে আধুনিককালেও। যেমন টলস্টয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ এবং ‘আন্না কারেনিনা’। এ দুটি উপন্যাসে মহাকাব্যের ব্যাপ্তি আছে, বৈচিত্র্য আছে, আছে গভীরতাও। তবে এরা ব্যতিক্রম। তাছাড়া এ দুটি উপন্যাসের কোনোটিতেই নায়ক একজন নন, নায়ক একাধিক। টলস্টয় যা পেরেছেন অন্য উপন্যাসিকরা কিন্তু তা করতে পারেননি। প্রথম কথা, রুশ দেশটা অনেক বড়, সেই বিরাটত্ব এসে গেছে টলস্টয়ের লেখায়। দ্বিতীয়ত, টলস্টয়ের নিজের মধ্যে ছিল বীরত্ব। তিনি বীরের মতো অনেক সাহসী কাজ করেছেন সারা জীবন। তৃতীয় কথা, তার কালে রুশ দেশে মানুষ ততটা বিচ্ছিন্ন হয়নি তখনও পরস্পর থেকে- যতটা ইউরোপে হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধ ও শান্তিতে তিনি চলে গিয়েছিলেন ইতিহাসের কাছে, ইতিহাসের ঘটনা নিয়েই লিখেছেন উপন্যাস। ‘আন্না কারেনিনা’তে দেখছি বিচ্ছিন্নতা এসে গেছে, সে জন্য এ উপন্যাসের ব্যাপকতা অনেকটা কম এবং সেই ব্যাপকতাও টলস্টয়ের পর আর আনতে পারেনি তার কোনো লেখায়। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসেও একটা ব্যাপকতা আছে। কিন্তু গোরা রবীন্দ্রনাথ একবারই লিখেছেন। তারপর তাকে দৃষ্টি দিতে হয়েছে তুলনায় ছোট এলাকায়। তিনি লিখেছেন ‘ঘরে বাইরে’, ‘যোগাযোগ’, ‘চার অধ্যায়’, ‘শেষের কবিতা’, যাদের প্রত্যেকটিই অত্যন্ত মূল্যবান সৃষ্টি, কিন্তু কোনোটিই মহাকাব্যিক নয়। কবিতাতেও মহাকাব্য লেখেননি রবীন্দ্রনাথ, অজস্র গীতিকবিতা লিখেছেন।
হোমারের অডিসিয়ুস যদি একালে ফিরে আসতেন তাহলে তার কী দশা হতো সে ছবি ইংরেজ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েস দিয়েছেন তার বড় উপন্যাস ইউলিসিসে। বীর থাকতেন না তিনি, সামান্য হয়ে পড়তেন। এ যুগেও পিতা সন্তানকে খোঁজে, যেমন অডিসিয়ুস খুঁজেছেন। আবার সন্তানও পিতাকে খোঁজে, যেমন অডিসিয়ুসের পুত্র টেলিমেকাস খুঁজেছেন। কিন্তু এ খোঁজায় কোনো বীরত্ব নেই।
একালে যে বীরত্ব নেই তা নয়। তবে তা ভিন্ন ধরনের, একালের সাহিত্যও তাই ভিন্ন রকমের।
এরপরও কিন্তু বাকি থাকে কিছু। কেবল বড় নয়, কেবল বীরত্বপূর্ণ নয়, মহাকাব্যের কাহিনী জনপদের কাহিনী। একজন বিশেষ মানুষের গল্প শুধু নয়, গল্প একটি জনজীবনের, বিশেষ একটি সভ্যতার। এ ক্ষেত্রেও ওই নদীর মতোই। নদী যে লোকালয়ের ভেতর দিয়ে যায় সেই লোকালয়েরই নদী হয়ে ওঠে। মহাকাব্যের গল্পও তেমনি। লোকালয়ের গল্প। একজন মানুষের কাহিনী হয়েও অনেক মানুষের কাহিনী। ওই একজন- যাকে আমরা বীর বলি, তিনি অনেক মানুষের প্রতিনিধি।
সাহিত্যে এ ব্যাপারটা সব সময়েই ঘটে থাকে। একজন মানুষ অনেক মানুষের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। আর সেই জন্যই ওই একজন মানুষ বিশেষভাবে মূল্যবান। ট্রাজেডিতে এটা খুব স্পষ্টভাবে ঘটে। যেমন ধরুন শেকসপীয়রের ট্রাজেডির নায়কেরা। তারা একক মানুষ কি? হ্যাঁ, হ্যামলেট তো একজন বিশেষ মানুষই বটে। ডেনমার্কের রাজপুত্র তিনি। তার কালের মানুষ, তার মতো মানুষ তার আশপাশে আর একটিও নেই। সারা পৃথিবী খুঁজলেও তার দ্বিতীয়টি পাওয়া অসম্ভব। এ পৃথিবীতে কোনো দুটি মানুষই হুবহু একরকম নয়, ভিন্ন তারা পরস্পর থেকে- কোনো না কোনো দিক দিয়ে। কিন্তু হ্যামলেট তো আবার সব কালেরই মানুষ, সব দেশেরই মানুষ; সেই মানুষ যিনি দেখেছেন ভালোর সঙ্গে মন্দের দ্বন্দ্ব চলছে প্রতিনিয়ত, যে দ্বন্দ্বে ভালো রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অহরহ। আকাশের ছায়া পড়ে পুকুরে, সব মানুষের ছায়া এসে পড়ে কোনো কোনো মানুষের জীবনে।
ট্রাজেডির নায়ক যতটা সর্বজনীন, মহাকাব্যের নায়ক অবশ্য ততটা সর্বজনীন নন। তুলনায় তিনি অধিকতর স্থানীয়। এ প্রসঙ্গে কথাটা বলা যায়, ট্রাজেডির সঙ্গে মহাকাব্যের মৌলিক তফাৎ এই খানে, ট্রাজেডি জীবনের একটি খণ্ড অংশের ছবি ফুটিয়ে তোলে, আর মহাকাব্য চায় ছবি দেবে সমগ্র জীবনের। ট্রাজেডি হচ্ছে দুর্ভোগের প্রতিচ্ছবি। মানুষের জীবনের দুর্ভোগ একটি অত্যন্ত বড় সত্য, কিন্তু তাই বলে সে তো একমাত্র সত্য নয়। হাসির পাশাপাশি কান্নাও আছে। গভীরের পাশে তো চটুল থাকতে পারে, গভীরের পাশে যেমন থাকে সরল। ট্রাজেডি দুঃখের গভীর ও গভীর ছবি নিয়ে আসে, হাসির হাল্কা সরল অংশটিকে বাদ দিয়ে। ট্রাজেডি তাই গভীর সত্য বলে ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য বলে না। ট্রাজেডির গভীরতার ব্যাপারটা স্মরণে না রাখলে কিন্তু তার প্রতি গভীর অন্যায় করা হবে। বাল্মীকি যে রামায়ণ নামে মহাকাব্য লিখলেন, তার অনুপ্রেরণা তিনি পেলেন কোথায়? পেলেন দুঃখের গভীর এক বোধে। বাল্মীকি যে মহাকাব্য লিখবেন এমন কোনো কথাই ছিল না। প্রথম জীবনে তিনি দস্যু ছিলেন, নাম ছিল রত্নাকর; পরে সাধু হয়ে বনে চলে গেছেন। সেই বনবাসের কালে একদিন বেরিয়েছিলেন কাঠ সংগ্রহে, হঠাৎ দেখেন গাছের ওপর বসে আছে দুটি পাখি। এই সময়েই, কওয়া নেই বলা নেই, কোথা থেকে ছুটে এলো শিকারির তীর। দুটি পাখির একটি গেল পড়ে, আর অন্যটি শুরু করল বিলাপ। তাই দেখে ভেতর থেকে ধিক্কার বেরিয়ে এলো কাল্মীকির। তিনি দেখেন যাই বলছেন, আসছে সুরে ভেসে, ছন্দে ভর করে। সেইভাবেই রচিত হল তার মহাকাব্য। এ গল্পে রূপক আছে। সাহিত্য ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে মানুষের। আর এই যে সাহিত্য সৃষ্টি এর সবচেয়ে গভীর কারণ হল দুঃখ। আমাদের সবচেয়ে সুন্দর গান হচ্ছে সবচেয়ে বড় দুঃখের কাহিনী। দুঃখই সবচেয়ে ভারী, তার কাহিনীই সবচেয়ে বেশি আন্তরিক ও মর্মস্পর্শী। কিন্তু তবুও ট্রাজেডি খণ্ডিত যে তা সত্য। মহাকাব্য ট্রাজেডির তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত। তার গল্প সত্যি সত্যি বহতা নদীর মতো- কেবল দৈর্ঘ্যে নয়, প্রস্থেও।
ওই যে ‘মহাভারতের কথা বললাম, ও তো কেবল গল্প নয়। মনে করা হয় যে ওর কাহিনীতে ইতিহাস আছে, কারও কারও কাছে এ মহাকাব্য ধর্মগ্রন্থও বটে। ফেরদৌসির শাহনামা ভিন্ন দেশে লেখা, ফার্সি ভাষায় রচিত। সেখানেও ইতিহাস আছে, রাজবংশের ইতিহাস। কিন্তু মহাকাব্যে ইতিহাস থাকে- এটা কোন অর্থে? আমরা কি জানি না যে কাব্য মাত্রেই কল্পনার ফসল, সে জন্য মিথ্যা ভাষণ? কবিদের বিরুদ্ধে চিরকালের অভিযোগ কি এ নয় যে, তারা মিথ্যা বলেন, বানিয়ে বানিয়ে বলেন? তবুও মহাকাব্যে ইতহিাস অবশ্যই থাকে- থাকে সময়ের ইতিহাস, সমাজের ইতিহাস। একটি মহাকাব্য পড়া মানে একটি গল্প পড়া নয় কেবল, সেই বিশেষ সময়ের সমাজ ও সংস্কৃতির একটি ইতিহাস পড়াও বটে। এই ইতিহাস, ইতিহাস বইয়ের ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত। কেননা এ হচ্ছে কবির লেখা ইতিহাস। কবির থাকে কল্পনা, সেই কল্পনা অনেক রুদ্ধ দরজা অনায়াসে খুলে ফেলে, এমনিতে যাদের বন্ধ থাকার কথা। কবির কল্পনা ভেদ করে অন্ধকার, চূর্ণ করে জটাজাল।
যেমন ধরা যাক হোমারের কথা। বলা হয় তিনি অন্ধ ছিলেন। অন্ধ হোন, আর নাই হোন সত্য এটা যে একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ছিল তার মনের দৃষ্টি, যেটা বোঝা যায় তার মহাকাব্য দুটি- ‘ইলিয়াড’ ও ‘অডিসি’- পড়লে। একই ব্যক্তি এ দুটি মহাকাব্য লিখলেন কী করে? কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন। কেননা এ দুটি মহাকাব্য গ্রিকদের কাহিনী হিসেবে এক বটে, কিন্তু নানাদিক দিয়ে একে অপর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটা অবশ্য অন্য কথা। বড় কথা এখানে এই যে, কবি কেবল কল্পনাই করেননি; তিনি তার কল্পনাকে কাজে লাগিয়েছেন সেকালের গ্রিক জীবনের ছবি তুলে ধরতে। তখনকার গ্রিকরা কেমন করে যুদ্ধ করতেন সেকথা আছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আছে তাদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, আছে তাদের আচার-আচরণ, খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়া। কী নেই? গ্রিকরা কী ভাবতেন, কেমন ছিল তাদের জগৎদৃষ্টি। বিপদগুলো কোন দিক থেকে আসত, কেমন করে, কোথায় ছিল সুখ, কিসে দুঃখ- সবই আছে এ দুটি মহাকাব্যে। ঘরের ছবি মিশে গেছে সমাজের ছবির সঙ্গে। কেবল তাই নয়, দেব-দেবীরাও আছেন, যাদের অস্তিত্বে গ্রিকরা তখন বিশ্বাস করতেন। সেসব দেব-দেবীদের দেখে মানুষকেই চেনা যায় আসলে, কেননা তারা মানুষের মতোই আচরণ করেন। মানুষই যেন, ভিন্নরূপে। এসব দেবতারা মানুষের সৃষ্টি; সৃষ্টি দেখে ধরা যায় স্রস্টাকে।
আর বীরের ধারণা মাত্রই আসলে সামাজিক ধারণা। হোমারের বীরেরা ব্যক্তিগতভাবে হোমারেরই সৃষ্টি, কিন্তু কেবল হোমারের একার সৃষ্টি নয় তো; হোমার তার ধারণাগুলো পেলেন কোথা থেকে? পেলেন তার সমাজ থেকেই। যেমন ধরা যাক, অডিসির কথা। অডিসির নায়ক অডিসিয়ুস সম্মানকে অত্যন্ত উঁচু মূল্য দেন। তিনি লড়াই করেন নির্ভয়ে, বুদ্ধি আঁটেন ঠাণ্ডা মাথায়। ওদিকে তার স্ত্রী পেনিলোপি প্রতীক্ষায় থাকেন তার স্বামীর। স্বামী যুদ্ধে গেছেন, দশ বছর ধরে চলেছে সেই যুদ্ধ, তারপর যুদ্ধ থামার পরও আরও দশ বছর গেছে চলে, কিন্তু স্বামী অডিসিয়ুসের কোনো খোঁজখবর নেই। তাকে উত্ত্যক্ত করছে ভিনেদশী রাজপুত্ররা, যারা তাকে বিয়ে করতে চায় সম্পত্তির লোভে। ছেলে বেরিয়েছে পিতার খোঁজে। অডিসিয়ুসের বৃদ্ধ পিতা শোকার্ত। এই যে ছবি, এ ছবি একটি সামাজিক ছবি। ট্রাজেডির নায়কের তুলনায় মহাকাব্যের নায়ক অনেক বেশি সামাজিক- সমাজের নানা জটিল সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ তিনি, নানাভাবে। মহাকাব্য কবিতায় লেখা। কবিতাই হচ্ছে আদিরূপ সাহিত্যের। আদিতে কবিরা মহাকাব্য লিখেছেন জনজীবনের কাহিনী নিয়ে, আবার গীতিকবিতাও লিখেছেন নিজের ব্যক্তিগত কথা নিয়ে। আদিকালে ট্রাজেডি, কমেডি লেখা হতো কবিতাতেই, গদ্য এসেছে বেশ পরে। গদ্য এলো তখন যখন মানুষের সভ্যতার বয়স কিছু বাড়ল, অনেক রকম বিষয়ে চিন্তা এলো মনে, প্রয়োজন দেখা দিল প্রকাশেরও যোগাযোগের। এমনকি যখন লিখতে জানত না মানুষ, তখনও কবিতা ছিল।
মুখে মুখে তৈরি হতো, মুখে মুখে ঘুরত। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘ইলিয়াড’, ‘অডিসি’, ‘বেউলফ’ (ইংরেজদের আদি মহাকাব্য)। সবই মুখে মুখে তৈরি মহাকাব্য। এদের মধ্যে বেউলফের রচয়িতাকে তা জানাই সম্ভব হয়নি; অন্যক’টি মহাকাব্যের নির্দিষ্ট রচয়িতা আছেন বলে আমরা জানি, বাল্মীকি, ব্যাস ও হোমারের পরিচয় জানা আছে আমাদের, কিন্তু মহাকাব্যগুলোর সব অংশই যে তাদেরই রচনা তা বলা যাবে না, মূল রচনার স্রোতের সঙ্গে অন্য ধারাও এসে যোগ দিয়েছে হয়তো- ‘মহাভারতে’র ক্ষেত্রে তো এটা অবশ্যই সত্য। ভার্জিলের ‘ঈনিদ’, পরবর্তীকালে লেখা, সেটি লিখিত মহাকাব্য, মুখে মুখে রচিত নয়। যেমন মিল্টনের ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ ও মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখিত মহাকাব্য।
মিল্টন তার মহাকাব্য লিখেছেন সপ্তদশ শতাব্দীতে, তাকে বলা হয় ইংরেজি সাহিত্যের একমাত্র লিখিত ও পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্য। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের মেঘনাদবধের স্থানও অনেকটাই ওই রকম; বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য আরও আছে ঠিকই, কিন্তু কোনোটিই মেঘনাদবধের কাছাকাছি নয়। মধুসূদন তার কাব্য লিখেছেন মিল্টনের প্রায় দুশ’ বছর পরে, তার লেখায় মিল্টনের প্রভাব আছে, যেটা থাকা ছিল স্বাভাবিক। মিল্টন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, চোখে দেখতেন না। যখন তিনি ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ রচনা করেন সেই সময়টা তার ভয়ংকর দুর্দশার সময়, আশংকা ছিল রাজনৈতিক নির্যাতনের, একাকী হয়ে পড়েছিলেন, ভয়ংকর আর্থিক কষ্টও ছিল। এরি মধ্যে তিনি এই অতুলনীয় মহাকাব্য লিখেছেন। সেই সময়টা ছিল ইংল্যান্ডে বিপ্লবের সময়। মনে হচ্ছিল পুরনো ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে অভ্যুদয় ঘটবে নতুন এক সভ্যতার। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটল প্রজার। রাজা সিংহাসন ও মাথা দুইই হারালেন। এ যুদ্ধে মিল্টন নিজেও অংশ নিয়েছেন। এত লেখা লিখেছেন বিপ্লবের পক্ষে যে তার এমনিতে দুর্বল চোখ আরও দুর্বল হয়ে পড়ল পরিশ্রমে, তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেলেন। তার মনের ভেতরে ছিল বীরত্বের ছবি, বাইরে দেখছিলেন বীরত্বের প্রকাশ। সে জন্য বীরগাথা লিখলেন তিনি। কিন্তু এখানে বীরত্ব ভিন্ন ধরনের। মিল্টনের বিষয়টা স্থানীয় নয়, ধর্মীয় এবং সে অর্থে সর্বকালের। তিনি লিখলেন মানুষের আদি পতনের কথা, স্বর্গ এলো তার কাব্যে, এলেন ঐশ্বর, অ্যাডাম হলেন নায়ক, শত্র“ হিসেবে এলো স্যাটান। কোনো বিশেষকালের কাহিনী নয় এটি, সর্বকালের। কিন্তু তবু ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ যে সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে একজন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীর লেখা সেটা ভুল করার কোনো উপায় নেই। জগৎ সম্পর্কে মিল্টনের ধারণা, তার স্বর্গ ও নরক, অ্যাডাম-ঈভের সম্পর্ক, স্যাটানের বিদ্রোহ- সর্বত্র ছায়া ফেলেছে। মিল্টনের কাল ও সমাজ। মাইকেলের মধ্যেও মিল্টনের মতোই এক ধরনের বিদ্রোহ ছিল। তারও ছিল বীরত্বের প্রতি অসম্ভব আকর্ষণ, যে জন্য তিনি ধর্ম ছেড়ে দিয়েছিলেন, দেশ ছেড়েছিলেন, তারপর আবার ফিরেও এসেছিলেন ঘরে। তার মহাকাব্যে তার কাল আছে; আছে তার কালে স্বাধীনতার আগ্রহ, পরাধীনতার বেদনা, আছে পতিত মানুষের প্রতি গভীর বেদনাবোধ।
আধুনিককালে মহাকাব্য লেখা হয় না। কারণ কী না লেখার? কারণ কি এই যে, লেখকের সময় নেই অতবড় লেখা লিখার, পাঠকেরও সময় নেই তা পড়ার? সেটা একটা কারণ যে তা অস্বীকার করা যাবে না। আরও একটা কারণ এই যে, আধুনিককাল ব্যক্তির জন্য বীরত্বের কাল নয়। লোকে এখন ব্যক্তির অসামান্য বীরত্বে আর আস্থা রাখে না। তাছাড়া মানুষ এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পরস্পর থেকে। মহাকাব্যে দেখি নায়কেরা অনায়াসে মিশে যান অনেকের সঙ্গে, গ্রিক মহাকাব্যে একসঙ্গে অনেক মানুষ যুদ্ধ করে, জাহাজে চড়ে, দেশে ফেরে; নায়ক সেখানে অনায়াসে বন্ধুত্ব করেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে; কিন্তু একালে তো সেটা সম্ভব নয়।
মিল্টনের কালেরই মানুষ ছিলেন ড্রাইডেন। কবি হিসেবে খাটো ছিলেন না মোটেই। তারও আশা ছিল মহাকাব্য লিখবেন, ধর্মীয় মহাকাব্য নয়, জাতীয় মহাকাব্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিখতে পারলেন না। কারণ কী? তিনি বলেছেন কারণ হল রাজা তাকে টাকা দিলেন না। কিন্তু অর্থাভাব কি কারণ হতে পারে মহাকাব্য না-লেখার। মিল্টনও তো ছিলেন অর্থকষ্টে। কিন্তু কই অসম্ভব হয়নি তো তার পক্ষে মহাকাব্য লেখা। না, আসল কারণ সেটা নয়। আসল কারণ ড্রাইডেনের ছিল না বীরত্বের বোধ। তিনি যুদ্ধে যাননি। তিনি দল বদলেছেন। তার প্রতিভার বিশেষ স্ফূরণ দেখা গেছে হাসি-ঠাট্টার কাব্য রচনায়। সে প্রতিভা ভিন্ন ধরনের। মহাকাব্যিক একনিষ্ঠা ও অনমনীয়তা ছিল না সেখানে। খাটি মহাকাব্য লেখেন কি বটে, কিন্তু ড্রাইডেন ব্যঙ্গ মহাকাব্য লিখে গেছেন।
ব্যঙ্গ মহাকাব্যে মহাকাব্যের ভঙ্গিটি থাকে, ভাবটি থাকেন না। সামান্য বিষয়কে অসামান্য করে তোলা হয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে। পোশাকটা জাদরেল, চাল-চলন ভারিক্কি, কিন্তু মানুষটা খুব সামান্য; ফলে সবটা মিলে একটা কিম্ভূতের সৃষ্টি হয়, যা লোক হাসায়। ইচ্ছা করেই সৃষ্টি করা হয় এ কিম্ভূতের, উদ্দেশ্য হচ্ছে হাস্যকর করে তোলা সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের খারাপ জিনিসগুলোকে। আধুনিককালে এ ধরনের রচনা যতটা স্বাভাবিক, মহাকাব্য ততটা মোটেই নয়। আর ওই যে বিচ্ছিন্নতার কথা বললাম, সেটাও একালের প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রিক নায়ক অডিসিয়ুস রাজার সঙ্গে মেলেন যেমন তেমনি মেলেন শূকর পালকের সঙ্গে; লোকালয়ে যেমন থাকেন তেমনি সাঁতরে গিয়ে ওঠেন অচেনা দেশে; ভিখিরি সাজতে কষ্ট হয় না তার, যেমন অসম্ভব হয় না খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে। অনায়াসে বন্ধুত্ব করেন তিনি অচেনা মানুষের সঙ্গে। এখানকার মানুষ একজন আরেকজনের সঙ্গে মিশতে পারেন না তখনকার মতো, দেয়াল থাকে মাঝখানে। এ বিচ্ছিন্নতায় মহাকাব্য রচনা করা কঠিন, গীতিকবিতা রচনাটা স্বাভাবিক। প্রত্যেকে নিজের কথা বলেন সবার কথা না বলে। অডিসিয়ুসকে কেউ বন্দি করে রাখতে পারেননি, কিন্তু এককালের অনেক মানুষই মেনে নেন বন্দিত্বকে। তবে কবিতায় না হোক গদ্যে মহাকাব্যে লেখা হয়েছে আধুনিককালেও। যেমন টলস্টয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ এবং ‘আন্না কারেনিনা’। এ দুটি উপন্যাসে মহাকাব্যের ব্যাপ্তি আছে, বৈচিত্র্য আছে, আছে গভীরতাও। তবে এরা ব্যতিক্রম। তাছাড়া এ দুটি উপন্যাসের কোনোটিতেই নায়ক একজন নন, নায়ক একাধিক। টলস্টয় যা পেরেছেন অন্য উপন্যাসিকরা কিন্তু তা করতে পারেননি। প্রথম কথা, রুশ দেশটা অনেক বড়, সেই বিরাটত্ব এসে গেছে টলস্টয়ের লেখায়। দ্বিতীয়ত, টলস্টয়ের নিজের মধ্যে ছিল বীরত্ব। তিনি বীরের মতো অনেক সাহসী কাজ করেছেন সারা জীবন। তৃতীয় কথা, তার কালে রুশ দেশে মানুষ ততটা বিচ্ছিন্ন হয়নি তখনও পরস্পর থেকে- যতটা ইউরোপে হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধ ও শান্তিতে তিনি চলে গিয়েছিলেন ইতিহাসের কাছে, ইতিহাসের ঘটনা নিয়েই লিখেছেন উপন্যাস। ‘আন্না কারেনিনা’তে দেখছি বিচ্ছিন্নতা এসে গেছে, সে জন্য এ উপন্যাসের ব্যাপকতা অনেকটা কম এবং সেই ব্যাপকতাও টলস্টয়ের পর আর আনতে পারেনি তার কোনো লেখায়। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসেও একটা ব্যাপকতা আছে। কিন্তু গোরা রবীন্দ্রনাথ একবারই লিখেছেন। তারপর তাকে দৃষ্টি দিতে হয়েছে তুলনায় ছোট এলাকায়। তিনি লিখেছেন ‘ঘরে বাইরে’, ‘যোগাযোগ’, ‘চার অধ্যায়’, ‘শেষের কবিতা’, যাদের প্রত্যেকটিই অত্যন্ত মূল্যবান সৃষ্টি, কিন্তু কোনোটিই মহাকাব্যিক নয়। কবিতাতেও মহাকাব্য লেখেননি রবীন্দ্রনাথ, অজস্র গীতিকবিতা লিখেছেন।
হোমারের অডিসিয়ুস যদি একালে ফিরে আসতেন তাহলে তার কী দশা হতো সে ছবি ইংরেজ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েস দিয়েছেন তার বড় উপন্যাস ইউলিসিসে। বীর থাকতেন না তিনি, সামান্য হয়ে পড়তেন। এ যুগেও পিতা সন্তানকে খোঁজে, যেমন অডিসিয়ুস খুঁজেছেন। আবার সন্তানও পিতাকে খোঁজে, যেমন অডিসিয়ুসের পুত্র টেলিমেকাস খুঁজেছেন। কিন্তু এ খোঁজায় কোনো বীরত্ব নেই।
একালে যে বীরত্ব নেই তা নয়। তবে তা ভিন্ন ধরনের, একালের সাহিত্যও তাই ভিন্ন রকমের।
No comments