কাশবনে স্মৃতি লেখে নগরের বাউল কবি by বিমল গুহ
মানুষ
জন্মগতভাবে সৌন্দর্যপিপাসু। যখন মানুষের বুদ্ধি হয়েছে, বিবেক জাগ্রত
হয়েছে, তখন থেকেই সে তার কথা জানাতে চেয়েছে। গুহাবাসী মানুষের জীবনাচরণ
আমাদের সেই ধারণা দেয়। দেয়ালের গায়ে তাদের নানা আঁকিবুঁকির মধ্য থেকে তা
অনুমেয়। এতদিন মনের ফ্রেমে যে দৃশ্যাবলি ধারণ করত, ক্যামেরা আবিষ্কারের পর
মানুষ ছবি তোলার জন্য আরও ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ক্যামেরায় তোলা ছবি পূর্ণাঙ্গ
ছবি হয় না। সে ছবিতে ফুটে ওঠে একটা রূপ, একটা দিক। কিন্তু মানুষের চোখ তার
চেয়ে অনেক বেশি দেখে। এই ছবি আঁকার জন্য কেউ হাতে নেয় তুলি, কেউ হাতে তুলে
নেয় কলম। কবি কলম দিয়ে জীবনের যে-ছবি লেখেন তা চিন্তাজাত বলেই এর ব্যাপ্তি
বেশি। প্রকৃত কবি সমাজ সভ্যতারই রূপকার। তেমন একজন কবি অরুণাভ সরকার,
সম্প্রতি লোকান্তরিত হয়েছেন। যে-কবি বাউলের বেশে ঢাকা শহরের বাসিন্দা
হয়েছিলেন, চলেও গেলেন সেই বাউলের বেশেই।
বাউলেরা সৃষ্টির মাহাত্ম্যে মুগ্ধ থেকে জীবনের রূপ-রসের সন্ধান করেন, বাউল-কবি তার থেকে বড় ব্যতিক্রমী ছিলেন কি! জীবনযাপনে এক ধরনের উদাসীনতা সব সময় ছিল এই কবির। কবিতা বা লেখালেখির ক্ষেত্রে শুদ্ধাচারী ছিলেন বটে, উদাসীনতার আঁচ থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি কখনও। তার কাছে পাঠকের প্রত্যাশা ছিল অনেক, কিন্তু পাঠককে দিখেছেন কম। কবিতার বই মাত্র তিনটি- ১) নগরে বাউল, ২) কেউ কিছু জানে না ও ৩) নারীরা ফেরে না। মানুষের জীবন-আচরণের সব বিষয় তার কবিতার বিষয়। দৈনন্দিন জীবনযাপনের যাবতীয় দিক কবিতার ছত্রে ছত্রে নিপুণভাবে অঙ্কন করেছেন কবি। ভালোবাসা তার অনুভবে ও বর্ণনায় সর্বগ্রাসী ছায়া বিস্তার করে আছে সর্বত্র। তার শিশুতোষ গ্রন্থ ‘খোকনের অভিযান’ও উল্লেখযোগ্য রচনা। রয়েছে পেশাগত সম্পাদনার বইও। তবে মূলত কবিই ছিলেন তিনি।
কবিতার প্রতি তীব্র আসক্তি কবিকে বাউল করেছে- এ কথা তো বলাই যায়! যে কারণে অন্য কোনো বিষয়ে স্থিরতা হয়নি কোনো দিন। চাকরির ক্ষেত্রে বাউল প্রকৃতি তাকে স্থানচ্যুত করেছে বার বার। সাংবাদিতাই ছিল পেশা। কবিতার নেশার কারণে একটি সাহিত্যপত্রিকা দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন। পত্রিকার নাম- ঈষিকা। দেখা হলেই ‘ঈষিকা’র জন্য কবিতা চাই। আমাকে বেশি স্নেহই করে ফেলেছিলেন কবি। দেখার সঙ্গে সঙ্গে নানা অভিযোগ। ফোন করিনি কেন! কবিতা পাঠাইনি কেন- এসব। ‘ঈষিকা’ ক্ষীণাঙ্গি হলেও মানসম্পন্ন কবিতা পত্রিকা। নামটা আমারও বেশ পছন্দের ছিল। এত পছন্দ যে, আমরা ১৯৮৩ সালে জন্মগ্রহণকারী আমাদের বড় মেয়ের নামই রেখেছি- ‘ঈষিকা’। কবিতা পত্রিকা ‘ঈষিকা’র আয়ুস্কাল ছিল ১৯৮৫ পর্যন্ত। আমার ঈষিকা এখন বড় হয়েছে। শুরুতে নিয়মিত শিশুতোষ সাহিত্যচর্চ্চা করত, এখন কম। আমার ঈষিকার ছড়ার বইও আছে একটা- ‘ছড়ার নাচন হাওয়ার নাচন’। অরুণদা তাতেই খুশি ছিলেন। বলতেন- অন্তত আপনার ঈষিকা বড় হচ্ছে। অরুণদা বরাবর আমাকে ‘আপনি’ই সম্বোধন করতেন! তবুও অগ্রজের স্নেহ থেকে কখনও বঞ্চিত হয়নি। দাদা যখন বেশ অসুস্থ, বৌদিকে নাকি বলতেন- বিমলকে ফোন ধরে দাও। এই অসুস্থতার মধ্যেও কথা হয়েছে। এভাবে হঠাৎ চলে যাবেন- তা কি করে ভাবি! ফোনে বলেছিলেন বার বার- ‘বিমল একবার আসবেন আপনার সঙ্গে কথা আছে’! যাব যাব করেই কেটে গেল দুই সপ্তাহ। যাওয়া হল না, কী কথা তাও জানতে পারলাম না আর। মাফ করে দেবেন- অরুণদা!
কবি অরুণাভ সরকারের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৯ সালের প্রথম দিকে। আমি তখন মতিঝিলে একটি বেসরকারি দফতরে চাকরি করতাম। ছিলাম মাত্র ছয় মাস। দেখি- এক দুপুরে আমার খোঁজে এসেছেন একজন কেউ। লম্বা গোছের মানুষ- অতি বিনয়ী। দেখেই পরিচয় দিলেন- ‘আমি অরুণ। মুখের দিকে তাকাতেই আবার বললেন- অরুণাভ সরকার’। আমি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। কবির লেখার সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল। বললাম- আপনি আমার প্রিয় কবি। আমার ঠিকানা...? বললেন- কবি আহসান হাবীবের কাছে জেনেছি। এর আগের সপ্তাহে দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য পৃষ্ঠায় আমার কবিতা পড়ে সেদিন আমাকে স্নেহের পরশে জড়িয়ে নিয়েছেন অরুণদা। তিনি নাকি কবি আহসান হাবীবের কাছে জানতে চেয়েছেন- কে এই তরুণ? হাবীব ভাই বলেছিলেন না কি- চট্টগ্রাম থেকে আসা এই ছেলে নিয়মিত লিখছে, সম্প্রতি চাকরিতে যোগদান করেছে ‘পদ্মা প্রিন্টার্সে’, মতিঝিলে অফিস। সেই মহৎ হৃদয়ের অরুণ’দা- এক অর্বাচীনকে খুঁজতে এসেছেন মতিঝিলে! আমি তো আপ্লুুত! সেই থেকে আমি পেয়েছি একজন আপন আত্মীয়কে।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসেছি আগের বছর। এক আত্মীয়ের সুবাদে এই অস্থায়ী কাজে যোগদান। ঢাকা এসে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছিলাম কবি আহসান হাবীবকে। হাবীব ভাইয়ের কাছে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমার। প্রকৃত অভিভাবকই বটে। গেলে প্রথমেই খোঁজ নিতেন আমার কিছু হল কি না! তাই চাকরিতে যোগদানের খবর হাবীব ভাইকেই দিয়েছি সবার আগে। সেখানে আমার পরিচয় কবি নাসির আহমেদের সঙ্গে, পরে বন্ধুত্ব। হাবীব ভাইয়ের কাছে কবিতার পরীক্ষাও দিতে হয়েছে বহুবার। এমনও হয়েছে- কবিতা হাতে দিলেই নাসির আহমেদকে দিয়ে বলতেন- পড়। নিজের উপস্থিতিতে এই পরীক্ষা বড় কঠিনই ছিল! পরে অরুণদার সঙ্গে দু’একবার হাবীব ভাইয়ের দফতরেও দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সাহিত্যের কথাই হতো। পরিমাণে কম লিখলেও সাহিত্যপ্রাণ মানুষ বলতে যা বোঝায়- অরুণদা তা-ই ছিলেন। কবিতা শুদ্ধতাই বিশ্বাস করতেন বলে কখনও আমার লেখা তার পছন্দ হলে বা পছন্দ না হলে ফোন করে খুশির প্রকাশ করতেন অথবা অভিযোগ করতেন। বলা যায়- প্রিয় অগ্রজের এক ধরনের শাসন! আমাকে ফোনে না পেলে আমার বন্ধু- যাকে অরুণদা সমান ভালোবাসতেন বা বেশি ভালোবাসতেন- কবি ফারুক মাহমুদ, তাকে বলতেন ও যেন আমাকে জানায়- অরুণদাকে শিগগিরই ফোন করতে। স্নেহের এই ভালোবাসার মানুষটিকে আর কখনও পাব না- তা ভাবলে মনটা হুহু করে ওঠে! অরুণদা, আপনি নেই, আপনার কবিতা আমাদের সাথী হয়ে থাকল!
বাউলেরা সৃষ্টির মাহাত্ম্যে মুগ্ধ থেকে জীবনের রূপ-রসের সন্ধান করেন, বাউল-কবি তার থেকে বড় ব্যতিক্রমী ছিলেন কি! জীবনযাপনে এক ধরনের উদাসীনতা সব সময় ছিল এই কবির। কবিতা বা লেখালেখির ক্ষেত্রে শুদ্ধাচারী ছিলেন বটে, উদাসীনতার আঁচ থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি কখনও। তার কাছে পাঠকের প্রত্যাশা ছিল অনেক, কিন্তু পাঠককে দিখেছেন কম। কবিতার বই মাত্র তিনটি- ১) নগরে বাউল, ২) কেউ কিছু জানে না ও ৩) নারীরা ফেরে না। মানুষের জীবন-আচরণের সব বিষয় তার কবিতার বিষয়। দৈনন্দিন জীবনযাপনের যাবতীয় দিক কবিতার ছত্রে ছত্রে নিপুণভাবে অঙ্কন করেছেন কবি। ভালোবাসা তার অনুভবে ও বর্ণনায় সর্বগ্রাসী ছায়া বিস্তার করে আছে সর্বত্র। তার শিশুতোষ গ্রন্থ ‘খোকনের অভিযান’ও উল্লেখযোগ্য রচনা। রয়েছে পেশাগত সম্পাদনার বইও। তবে মূলত কবিই ছিলেন তিনি।
কবিতার প্রতি তীব্র আসক্তি কবিকে বাউল করেছে- এ কথা তো বলাই যায়! যে কারণে অন্য কোনো বিষয়ে স্থিরতা হয়নি কোনো দিন। চাকরির ক্ষেত্রে বাউল প্রকৃতি তাকে স্থানচ্যুত করেছে বার বার। সাংবাদিতাই ছিল পেশা। কবিতার নেশার কারণে একটি সাহিত্যপত্রিকা দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন। পত্রিকার নাম- ঈষিকা। দেখা হলেই ‘ঈষিকা’র জন্য কবিতা চাই। আমাকে বেশি স্নেহই করে ফেলেছিলেন কবি। দেখার সঙ্গে সঙ্গে নানা অভিযোগ। ফোন করিনি কেন! কবিতা পাঠাইনি কেন- এসব। ‘ঈষিকা’ ক্ষীণাঙ্গি হলেও মানসম্পন্ন কবিতা পত্রিকা। নামটা আমারও বেশ পছন্দের ছিল। এত পছন্দ যে, আমরা ১৯৮৩ সালে জন্মগ্রহণকারী আমাদের বড় মেয়ের নামই রেখেছি- ‘ঈষিকা’। কবিতা পত্রিকা ‘ঈষিকা’র আয়ুস্কাল ছিল ১৯৮৫ পর্যন্ত। আমার ঈষিকা এখন বড় হয়েছে। শুরুতে নিয়মিত শিশুতোষ সাহিত্যচর্চ্চা করত, এখন কম। আমার ঈষিকার ছড়ার বইও আছে একটা- ‘ছড়ার নাচন হাওয়ার নাচন’। অরুণদা তাতেই খুশি ছিলেন। বলতেন- অন্তত আপনার ঈষিকা বড় হচ্ছে। অরুণদা বরাবর আমাকে ‘আপনি’ই সম্বোধন করতেন! তবুও অগ্রজের স্নেহ থেকে কখনও বঞ্চিত হয়নি। দাদা যখন বেশ অসুস্থ, বৌদিকে নাকি বলতেন- বিমলকে ফোন ধরে দাও। এই অসুস্থতার মধ্যেও কথা হয়েছে। এভাবে হঠাৎ চলে যাবেন- তা কি করে ভাবি! ফোনে বলেছিলেন বার বার- ‘বিমল একবার আসবেন আপনার সঙ্গে কথা আছে’! যাব যাব করেই কেটে গেল দুই সপ্তাহ। যাওয়া হল না, কী কথা তাও জানতে পারলাম না আর। মাফ করে দেবেন- অরুণদা!
কবি অরুণাভ সরকারের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৯ সালের প্রথম দিকে। আমি তখন মতিঝিলে একটি বেসরকারি দফতরে চাকরি করতাম। ছিলাম মাত্র ছয় মাস। দেখি- এক দুপুরে আমার খোঁজে এসেছেন একজন কেউ। লম্বা গোছের মানুষ- অতি বিনয়ী। দেখেই পরিচয় দিলেন- ‘আমি অরুণ। মুখের দিকে তাকাতেই আবার বললেন- অরুণাভ সরকার’। আমি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। কবির লেখার সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল। বললাম- আপনি আমার প্রিয় কবি। আমার ঠিকানা...? বললেন- কবি আহসান হাবীবের কাছে জেনেছি। এর আগের সপ্তাহে দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য পৃষ্ঠায় আমার কবিতা পড়ে সেদিন আমাকে স্নেহের পরশে জড়িয়ে নিয়েছেন অরুণদা। তিনি নাকি কবি আহসান হাবীবের কাছে জানতে চেয়েছেন- কে এই তরুণ? হাবীব ভাই বলেছিলেন না কি- চট্টগ্রাম থেকে আসা এই ছেলে নিয়মিত লিখছে, সম্প্রতি চাকরিতে যোগদান করেছে ‘পদ্মা প্রিন্টার্সে’, মতিঝিলে অফিস। সেই মহৎ হৃদয়ের অরুণ’দা- এক অর্বাচীনকে খুঁজতে এসেছেন মতিঝিলে! আমি তো আপ্লুুত! সেই থেকে আমি পেয়েছি একজন আপন আত্মীয়কে।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসেছি আগের বছর। এক আত্মীয়ের সুবাদে এই অস্থায়ী কাজে যোগদান। ঢাকা এসে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছিলাম কবি আহসান হাবীবকে। হাবীব ভাইয়ের কাছে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমার। প্রকৃত অভিভাবকই বটে। গেলে প্রথমেই খোঁজ নিতেন আমার কিছু হল কি না! তাই চাকরিতে যোগদানের খবর হাবীব ভাইকেই দিয়েছি সবার আগে। সেখানে আমার পরিচয় কবি নাসির আহমেদের সঙ্গে, পরে বন্ধুত্ব। হাবীব ভাইয়ের কাছে কবিতার পরীক্ষাও দিতে হয়েছে বহুবার। এমনও হয়েছে- কবিতা হাতে দিলেই নাসির আহমেদকে দিয়ে বলতেন- পড়। নিজের উপস্থিতিতে এই পরীক্ষা বড় কঠিনই ছিল! পরে অরুণদার সঙ্গে দু’একবার হাবীব ভাইয়ের দফতরেও দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সাহিত্যের কথাই হতো। পরিমাণে কম লিখলেও সাহিত্যপ্রাণ মানুষ বলতে যা বোঝায়- অরুণদা তা-ই ছিলেন। কবিতা শুদ্ধতাই বিশ্বাস করতেন বলে কখনও আমার লেখা তার পছন্দ হলে বা পছন্দ না হলে ফোন করে খুশির প্রকাশ করতেন অথবা অভিযোগ করতেন। বলা যায়- প্রিয় অগ্রজের এক ধরনের শাসন! আমাকে ফোনে না পেলে আমার বন্ধু- যাকে অরুণদা সমান ভালোবাসতেন বা বেশি ভালোবাসতেন- কবি ফারুক মাহমুদ, তাকে বলতেন ও যেন আমাকে জানায়- অরুণদাকে শিগগিরই ফোন করতে। স্নেহের এই ভালোবাসার মানুষটিকে আর কখনও পাব না- তা ভাবলে মনটা হুহু করে ওঠে! অরুণদা, আপনি নেই, আপনার কবিতা আমাদের সাথী হয়ে থাকল!
No comments