মিলন ও সম্প্রীতির উৎসব by ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী... কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ,
সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের
শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।
৩২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে প্রতিবছর গোটা বিশ্বের খ্রিস্টবিশ্বাসীরা ২৫ ডিসেম্বর যিশুখ্রিস্টের জন্মতিথি পালন করে আসছে। আত্মিক তাৎপর্যের বিবেচনায় খ্রিস্টের পুনরুত্থান উৎসবই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মণ্ডলীর শুরু থেকে যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থান পর্ব বা ইস্টারই সবচেয়ে বড় পর্ব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে বর্তমানে ক্রিসমাস বা বড়দিনটিই বেশি জাঁকজমক ও আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়। যিশুখ্রিস্টকে খ্রিস্টবিশ্বাসীরা মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তা বা মুক্তিদাতা বলে বিশ্বাস করে। তাই তন্ন দিন পালন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
বড়দিনের পূর্ববর্তী চার সপ্তাহব্যাপী প্রস্তুতিকালকে বলা হয় পবিত্র আগমনকাল। এ সময় খ্রিস্টের তিনটি আগমন-এর কথা স্মরণ করা হয় : ১. ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ২০০০ বছর আগে বেথলেহেমে যিশুখ্রিস্টের জন্ম, ২. সমকালীন ইতিহাসে প্রতিদিন আমাদের জীবনে তার আগমন এবং ৩. জগতের শেষদিনে তার গৌরবময় পুনরাবির্ভাব। আগমনকাল হচ্ছে খ্রিস্টীয় উপাসনাবর্ষের অন্যতম প্রধান প্রস্তুতিকাল। এ প্রস্তুতি মূলত আধ্যাত্মিক, আর এর মূল কথা হচ্ছে মন পরিবর্তন। অন্তরে গভীর প্রত্যাশা নিয়ে ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, সমাজ ও বিশ্ব সৃষ্টির মাঝে মুক্তিদাতাকে বরণ করার আহ্বান জানানো হয় এ আগমনকালে। তার জন্মের প্রত্যাশায় যুগ যুগ ধরে মানবজাতি যে প্রস্তুতি নিয়েছিল, তা-ই স্মরণ করে এ আগমনকাল পালন করা হয়।
ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে পাপ করার ফলে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে; ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে মানুষ পরস্পরের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে তার নিজের অন্তরের পরিবেশও কলুষিত হয়ে পড়েছে। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সর্বত্র : মানুষের মাঝে যে ঘৃণা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ¡-সংঘাত, অমিল, দলাদলি, কলহ-বিবাদ, মারামারি, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি চলছে, তা-ই এর প্রমাণ। গোটা পৃথিবীটাই হয়ে পড়েছে অশান্ত। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তিলাভের জন্য মানুষ আজ ব্যাকুল। মানুষ চায় শান্তি; তার অন্তরের গভীরতম আকাক্সক্ষা হচ্ছে শান্তি। কিন্তু এ শান্তির পূর্বশর্ত হচ্ছে ন্যায্যতা, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমা দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে ভগ্ন সম্পর্কের নিরাময়, পুনর্মিলন ও সম্প্রীতি স্থাপন। এজন্যই যুগে যুগে প্রবক্তা ও মহর্ষিরা ভাবী ত্রাণকর্তাকে শান্তিরাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং মানুষের মনে তাকে বরণ করার প্রত্যাশা জাগিয়েছেন। প্রবক্তা যিশাইয়া যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৭৪০ বছর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : “একটি শিশু আমাদের জন্য আজ জন্ম নিয়েছেন, একটি পুত্রকে আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তার স্কন্ধের ওপর ন্যস্ত রয়েছে সবকিছুর আধিপত্যভার। তার নাম : অনন্য মন্ত্রণাদাতা, শক্তিমান ঈশ্বর, শাশ্বত পিতা, শান্তিরাজ! এবার শুরু হবে ... অন্তবিহীন শান্তির যুগ!... ন্যায় ও ধর্মিষ্ঠতার ভিত্তিতে, আজ থেকে চিরকালের মতো।” (যিশাইয়া ৯:৬-৭)। প্রবক্তা যিশাইয়া আরও বলেছিলেন, “শোন, কুমারী কন্যাটি হবে গর্ভবতী; সে এক পুত্র-সন্তান জন্ম দেবে। একদিন সবাই তাকে ইম্মানুয়েল নামে ডাকবে (নামটির অর্থ হল : ঈশ্বর আমাদের সঙ্গেই আছেন।” (যিশাইয়া ৭:১৪)। যিশুখ্রিস্টের মধ্যে এ ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন বলে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস। যিশুর জন্মের আগে মহাদূত গাব্রিয়েল মারিয়ার কাছে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, ভয় পেয়ো না, মারিয়া! তুমি পরমেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোন, গর্ভধারণ করে তুমি একটি পুত্রের জন্ম দেবে। তার নাম রাখবে যিশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন, পরাৎপরের পুত্র বলে পরিচিত হবেন। প্রভু পরমেশ্বর তাকে দান করবেন তার পিতৃপুরুষ দাউদের সিংহাসন (লুক ১:৩০-৩২)। যিশুর ঐশী পর স্বর্গদূত রাখালদের কাছে দেখা দিয়ে বললেন, ভয় পেয়ো না! আমি এক মহা আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি; এই আনন্দ জাতির সব মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে। আজ দাউদ-নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন... তিনি সেই খ্রিস্ট, স্বয়ং প্রভু। এ চিহ্নে তোমরা তাকে চিনতে পারবে : দেখতে পাবে কাপড়ে জড়ানো, জাবপাত্রে শোয়ানো এক শিশুকে (লুক ২:১০-১২)। যিশুতে ঐশী-প্রতিশ্রুতির এ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই বড়দিনের উৎসব পালিত হয়। প্রতীকী ভাষায় ঘটনার নাটকীয় বর্ণনার অন্তর্নিহিত ভাব ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করাই বড়দিন উৎসব পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
বড়দিনের উৎসবমুখর দিনগুলোতে খ্রিস্টবিশ্বাসীরা যেসব বিষয় নিয়ে ধ্যানমগ্ন বা সমাহিত হয়ে থাকেন তা নিুরূপ-
১. যিশু ত্রিব্যক্তি ঈশ্বরের দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি পাপে পতিত মানবজাতিকে পাপের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছেন। এজন্য তাকে বলা হয় মসিহ বা ত্রাণকর্তা। ঈশ্বরের পুত্র (লুক ১:৩২) বলে তিনি ঈশ্বরকে পিতা বলে ডাকেন এবং তার ওপর বিশ্বাসী মানুষকেও তিনি তা করতে শিক্ষা দেন। খ্রিস্টানদের শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা বলে পরিচিত প্রভুর প্রার্থনায় সন্তানসুলভ মনোভাব নিয়ে যিশু তার আত্মিক বা রূহানি প্রেরণায় সঞ্জীবিত হয়ে ঈশ্বরকে পিতা বলে ডাকতে শিখিয়েছেন, যাতে মানব পরিবারের সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জন্ম নিতে পারে।
২. যিশু ঈশ্বরের জীবনময় বাণী বা কালাম। যোহন তার মঙ্গল সমাচারের শুরুতেই বলেন, আদিতে ছিলেন বাণী; বাণী ছিলেন ঈশ্বরের সঙ্গে, বাণী ছিলেন ঈশ্বর। আদিতে তিনি ঈশ্বরের সঙ্গেই ছিলেন। তার দ্বারাই সবকিছু অস্তিত্ব পেয়েছিল এবং যা কিছু অস্তিত্ব পেয়েছিল, তার কোনোকিছুই তাকে ছাড়া অস্তিত্ব পায়নি (যোহন ১:১-৩)। শয়তান কর্তৃক পরীক্ষিত হওয়ার সময় যিশু বলেছেন, শুধু রুটি খেয়ে নয়, বরং ঈশ্বরের শ্রীমুখে উচ্চারিত প্রতিটি বাণীকে সম্বল করেই মানুষকে বেঁচে থাকতে হয় (মথি ৪:৪)। প্রয়াত পোপ ২য় জন পল তার এক সর্বজনীন পত্রে বলেছেন, মানব পরিবারের সদস্যরা এ বাণী অনুসরণ না করার কারণেই বর্তমানে মানুষের মাঝে গড়ে উঠছে জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুর কালচার বা মৃত্যুর সভ্যতা। বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান সহিংসতা, সন্ত্রাস, আÍঘাতী বোমা হামলা, মারণাস্ত্র তৈরি ও ব্যবসা ইত্যাদি সেই ধ্বংসাÍক কালচারের নিদর্শন।
৩. যিশু সত্য। তিনি বলেন, আমিই সত্য (যোহন ১৫:৬)। সৎ বা ভালো যা কিছু তার উৎস একমাত্র ঈশ্বর। আর একমাত্র সত্যই মানুষকে মুক্ত করতে পারে। তোমরা যদি আমার বাণী পালনে নিষ্ঠাবান থাক, তাহলেই তো তোমরা আমার যথার্থ শিষ্য; তাহলেই তো সত্যকে তোমরা জানতে পারবে আর সত্য তখন তোমাদের স্বাধীন করে দেবে (ওই, ৮:৩১-৩২)। বর্তমান সমাজে যে অন্যায়-অসত্য বিরাজ করছে, তা কেবল সত্যের দ্বারাই নির্মূল করা সম্ভব। কূটচাল, ধূর্ততা, বাকচাতুরী দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত কল্যাণ বা মঙ্গল প্রতিষ্ঠা করতে হলে সত্যকে অনুসরণ করার কোনো বিকল্প নেই।
৪. যিশুই জীবন। তিনি বলেন, আমিই জীবন (যোহন ১৫:৬), আমি এসেছি যাতে মানুষ জীবন পায়, পুরোপুরিভাবেই পায়! (ওই, ১০:১০)। এখানে জীবন বলতে কোনো জৈবিক সত্তাকে বোঝায় না, বরং মানুষের মনুষ্যত্ব ও আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জীবনকে বোঝায়, যার গুণে মানুষ অন্যান্য পশুপক্ষী বা জীবজন্তু থেকে স্বতন্ত্র হয়। এই জীবনের উৎস ও ভিত্তি স্বয়ং ঈশ্বর। যিশু বলেন, আমি আপনাদের সত্যি সত্যিই বলছি, যে আমার কথা শোনে আর যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, তাকে যে বিশ্বাসও করে, সে শাশ্বত জীবন পেয়েই গেছে। তাকে আর অপরাধীর মতো বিচারে দাঁড়াতে হবে না, বরং এর মধ্যেই সে মৃত্যু থেকে জীবনে উত্তীর্ণ হয়েছে (যোহন ৫:২৪)।
৫. যিশু আলো। তিনি বলেন, আমি জগতের আলো। যে আমার অনুসরণ করে, সে কখনও অন্ধকারে চলবে না; সে তো জীবনেরই আলো লাভ করবে (যোহন ৮:১২)। পাপ-পুণ্য, আলো-অন্ধকার ও ভালো-মন্দের দ্বন্দ¡ অনস্বীকার্য। অন্ধকারকে জয় করতে হলে আলো জ্বালাতেই হবে। বর্তমান সময়ে তাই অনেককেই বলতে শোনা যায়, সমাজের তমসা দূরীভূত করতে হলে আলোকিত মানুষ দরকার।
৬. যিশুখ্রিস্ট মহাযাজক। তিনি ঈশ্বর ও মানুষের মাঝে একমাত্র মধ্যস্থতাকারী। আমরা তো পেয়েছি এক পরম মহাযাজককে, যিনি আকাশমণ্ডল অতিক্রম করে গেছেন : তিনি ঈশ্বরপুত্র যিশু। ... আমরা এই যে মহাযাজককে পেয়েছি, তিনি আমাদের দুর্বলতার সমব্যথী থেকে অক্ষম নন; বরং আমাদের মতোই তিনিও সবদিক দিয়ে পরীক্ষিত হয়েছেন, কিন্তু থেকেছেন নিষ্পাপ (হিব্রু ৪:১৪-১৫)। খ্রিস্টও তেমনি নিজেই নিজেকে মহাযাজক হওয়ার গৌরবে ভূষিত করেননি; করেছেন তিনিই, যিনি তাকে বলেছিলেন : তুমি আমার পুত্র; আমিই আজ তোমাকে জন্ম দিয়েছি! আবার আরেক জায়গায় তিনি বলেছেন : যাজক তুমি চিরকালের মতো, মেলখিসেদেকের রীতি অনুসারে (হিব্র“ ৫:৫-৬)। তিনি যাজক হয়েছেন দেহগত জন্মের কোনো নিয়মের জোরে নয়, বরং অবিনশ্বর এক জীবনেরই শক্তিতে (প্রাগুক্ত ৭:১৬)। যিশু যেহেতু চিরজীবী, তার যাজকত্বও চিরস্থায়ী। আর তাই যারা তার মধ্য দিয়ে পরমেশ্বরের কাছে যায়, চিরকালের মতোই তিনি তাদের পরিত্রাণ করার ক্ষমতা রাখেন; কারণ পরমেশ্বরের কাছে তাদেরই হয়ে আবেদন জানানোর জন্য তিনি যে নিত্যই রয়েছেন।
৭. যিশু ভালোবাসা। পরমেশ্বর জগৎকে এতই ভালোবেসেছেন যে, তার একমাত্র পুত্রকে তিনি দান করে দিয়েছেন, যাতে, যে কেউ তাকে বিশ্বাস করে, তার যেন বিনাশ না হয়, বরং সে যেন লাভ করে শাশ্বত জীবন। পরমেশ্বর জগৎকে দণ্ডিত করতে তার পুত্রকে এই জগতে পাঠাননি; পাঠিয়েছিলেন, যাতে তার দ্বারা জগৎ পরিত্রাণ লাভ করে (যোহন ৩:১৬-১৭)। আমাদের প্রতি পরমেশ্বরের ভালোবাসা এতেই প্রকাশিত হয়েছে যে, তিনি তার একমাত্র পুত্রকে এই জগতে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তার দ্বারাই আমরা জীবন লাভ করি (১ যোহন ৪:৯)। যে ভালোবাসে না সে ঈশ্বরকে জানে না। ঈশ্বর ও মানুষকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়, তা আমরা যিশুর জীবন ও কাজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। তিনি মানুষকে ভালোবেসে নিজের জীবন দান করেছেন এবং আমাদেরও আদেশ দিয়েছেন পরস্পরকে ভালোবাসতে। আমাদের কাছে যিশুর আদেশ হচ্ছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ভালোবাসা, এমনকি শত্র“কেও ভালোবাসা।
৮. যিশু আনন্দ। যিশুর জন্মলগ্নে স্বর্গদূত বললেন, আমি এক আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি। এই আনন্দ জাতির সব মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে (লুক ২:১০)। বড়দিনের আনন্দ তখনই সার্থক হয় যখন আমরা শুধু মৌখিক প্রচারের মাধ্যমে নয়, বরং অপরের সঙ্গে সহভাগিতার মাধ্যমে তা প্রচার করি। যিশু বলেন, পিতা যেমন আমাকে ভালোবেসেছেন, আমিও তেমনি তোমাদের ভালোবেসেছি। তোমরা আমার ভালোবাসার আশ্রয়ে থেকো। যদি আমার সব আদেশ পালন কর, তবেই তোমরা আমার ভালোবাসার আশ্রয়ে থাকবে, আমিও যেমন পিতার সব আদেশ পালন করেছি আর আছি তার ভালোবাসার আশ্রয়ে। এসব কথা তোমাদের বললাম, যাতে আমার আনন্দ তোমাদের অন্তরে থাকতে পারে এবং তোমাদের আনন্দ যেন পরিপূর্ণ হতে পারে (যোহন ১৫:৯-১১)।
৯. যিশু শান্তি। যিশু ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি শান্তিরাজ (যিশাইয়া ৯:৬)। যিশুর জন্মের রাতে স্বর্গের দূতবাহিনী গেয়ে উঠেছিল : জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়! ইহলোকে নামুক শান্তি তার অনুগৃহীত মানবের অন্তরে (লুক ২:১৪)। ঈশ্বর প্রদত্ত এ শান্তি অন্তরে গ্রহণ করলেই মানুষের মন থেকে সব রকম ঘৃণা-বিদ্বেষ দূর হতে পারে। যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ মানুষের একান্ত কাম্য তাই বড়দিন উৎসবের অন্যতম প্রধান আশীর্বাদ। মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের পরে শিষ্যদের দেখা দিয়ে যিশু দুবার বলেছিলেন, তোমাদের শান্তি হোক (যোহন ২০:১৯-২১)। তবে যিশুর দেয়া শান্তি আর মানুষের দেয়া শান্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য। যিশু বলেন, তোমাদের জন্য শান্তি রেখে যাচ্ছি, তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি আমারই শান্তি; অবশ্য এ সংসার যেভাবে শান্তি দেয়, সেভাবে আমি তোমাদের তা দিয়ে যাচ্ছি না (যোহন ১৪:২৭)। যিশুর দেয়া শান্তি হচ্ছে পবিত্র আত্মা বা পাক রূহের বশে চলার ফল (গালাতীয় ৫:২২)। এর বিপরীত হচ্ছে রিপু বা পাপ-স্বভাবের বশে চলা। এর ফলে মানুষের ব্যক্তিজীবনে ও সমাজে নেমে আসে অশান্তি ও অরাজকতা। বড়দিন উৎসবে শান্তি-শুভেচ্ছা বিনিময় যদি কেবল মৌখিক শিষ্টাচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তবে আমরা শান্তি-আশীর্বাদ পেতে পারি না।
মঙ্গল সমাচারে যিশুর জন্ম কাহিনীর বর্ণনায় অনেক প্রতীক ও রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। বড়দিন উৎসবের সময় এ প্রতীকগুলোর অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আকাশে উদিত উজ্জ্বল তারকা প্রকাশ করে যে যিশু হচ্ছেন জগতের আলো। জগতের অন্ধকার দূর করতেই তিনি ইম্মানুয়েল বা আমাদের নিত্যসঙ্গী ঈশ্বর। পূর্বদেশের তিন পণ্ডিত বলতে বোঝায় অযিহুদী। অর্থাৎ যিশু কেবল কোনো এক জাতি বা গোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা নন, তিনি সব মানুষেরই মুক্তিদাতা।
আজকাল মুসলমানদের ঈদ ও হিন্দু-বৌদ্ধদের পূজা-পার্বণের মতো বড়দিন উৎসবও কেবল খ্রিস্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। অখ্রিস্টান প্রতিবেশী ভাইবোন এবং বন্ধু-বান্ধবও বড়দিনের উৎসবে আমন্ত্রিত হন। সবার সঙ্গে বড়দিনের আনন্দ সহভাগিতা করার ফলে আনন্দের মাত্রা বেড়ে যায়। বাংলাদেশে সব ধর্মের লোকের মাঝে শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড়দিন উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমার দেশবাসী সবার কাছে বড়দিনের শান্তি-শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা, সিএসসি : উপাচার্য, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
৩২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে প্রতিবছর গোটা বিশ্বের খ্রিস্টবিশ্বাসীরা ২৫ ডিসেম্বর যিশুখ্রিস্টের জন্মতিথি পালন করে আসছে। আত্মিক তাৎপর্যের বিবেচনায় খ্রিস্টের পুনরুত্থান উৎসবই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মণ্ডলীর শুরু থেকে যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থান পর্ব বা ইস্টারই সবচেয়ে বড় পর্ব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে বর্তমানে ক্রিসমাস বা বড়দিনটিই বেশি জাঁকজমক ও আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়। যিশুখ্রিস্টকে খ্রিস্টবিশ্বাসীরা মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তা বা মুক্তিদাতা বলে বিশ্বাস করে। তাই তন্ন দিন পালন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
বড়দিনের পূর্ববর্তী চার সপ্তাহব্যাপী প্রস্তুতিকালকে বলা হয় পবিত্র আগমনকাল। এ সময় খ্রিস্টের তিনটি আগমন-এর কথা স্মরণ করা হয় : ১. ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ২০০০ বছর আগে বেথলেহেমে যিশুখ্রিস্টের জন্ম, ২. সমকালীন ইতিহাসে প্রতিদিন আমাদের জীবনে তার আগমন এবং ৩. জগতের শেষদিনে তার গৌরবময় পুনরাবির্ভাব। আগমনকাল হচ্ছে খ্রিস্টীয় উপাসনাবর্ষের অন্যতম প্রধান প্রস্তুতিকাল। এ প্রস্তুতি মূলত আধ্যাত্মিক, আর এর মূল কথা হচ্ছে মন পরিবর্তন। অন্তরে গভীর প্রত্যাশা নিয়ে ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, সমাজ ও বিশ্ব সৃষ্টির মাঝে মুক্তিদাতাকে বরণ করার আহ্বান জানানো হয় এ আগমনকালে। তার জন্মের প্রত্যাশায় যুগ যুগ ধরে মানবজাতি যে প্রস্তুতি নিয়েছিল, তা-ই স্মরণ করে এ আগমনকাল পালন করা হয়।
ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে পাপ করার ফলে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে; ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে মানুষ পরস্পরের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে তার নিজের অন্তরের পরিবেশও কলুষিত হয়ে পড়েছে। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সর্বত্র : মানুষের মাঝে যে ঘৃণা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ¡-সংঘাত, অমিল, দলাদলি, কলহ-বিবাদ, মারামারি, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি চলছে, তা-ই এর প্রমাণ। গোটা পৃথিবীটাই হয়ে পড়েছে অশান্ত। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তিলাভের জন্য মানুষ আজ ব্যাকুল। মানুষ চায় শান্তি; তার অন্তরের গভীরতম আকাক্সক্ষা হচ্ছে শান্তি। কিন্তু এ শান্তির পূর্বশর্ত হচ্ছে ন্যায্যতা, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমা দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে ভগ্ন সম্পর্কের নিরাময়, পুনর্মিলন ও সম্প্রীতি স্থাপন। এজন্যই যুগে যুগে প্রবক্তা ও মহর্ষিরা ভাবী ত্রাণকর্তাকে শান্তিরাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং মানুষের মনে তাকে বরণ করার প্রত্যাশা জাগিয়েছেন। প্রবক্তা যিশাইয়া যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৭৪০ বছর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : “একটি শিশু আমাদের জন্য আজ জন্ম নিয়েছেন, একটি পুত্রকে আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তার স্কন্ধের ওপর ন্যস্ত রয়েছে সবকিছুর আধিপত্যভার। তার নাম : অনন্য মন্ত্রণাদাতা, শক্তিমান ঈশ্বর, শাশ্বত পিতা, শান্তিরাজ! এবার শুরু হবে ... অন্তবিহীন শান্তির যুগ!... ন্যায় ও ধর্মিষ্ঠতার ভিত্তিতে, আজ থেকে চিরকালের মতো।” (যিশাইয়া ৯:৬-৭)। প্রবক্তা যিশাইয়া আরও বলেছিলেন, “শোন, কুমারী কন্যাটি হবে গর্ভবতী; সে এক পুত্র-সন্তান জন্ম দেবে। একদিন সবাই তাকে ইম্মানুয়েল নামে ডাকবে (নামটির অর্থ হল : ঈশ্বর আমাদের সঙ্গেই আছেন।” (যিশাইয়া ৭:১৪)। যিশুখ্রিস্টের মধ্যে এ ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন বলে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস। যিশুর জন্মের আগে মহাদূত গাব্রিয়েল মারিয়ার কাছে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, ভয় পেয়ো না, মারিয়া! তুমি পরমেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোন, গর্ভধারণ করে তুমি একটি পুত্রের জন্ম দেবে। তার নাম রাখবে যিশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন, পরাৎপরের পুত্র বলে পরিচিত হবেন। প্রভু পরমেশ্বর তাকে দান করবেন তার পিতৃপুরুষ দাউদের সিংহাসন (লুক ১:৩০-৩২)। যিশুর ঐশী পর স্বর্গদূত রাখালদের কাছে দেখা দিয়ে বললেন, ভয় পেয়ো না! আমি এক মহা আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি; এই আনন্দ জাতির সব মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে। আজ দাউদ-নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন... তিনি সেই খ্রিস্ট, স্বয়ং প্রভু। এ চিহ্নে তোমরা তাকে চিনতে পারবে : দেখতে পাবে কাপড়ে জড়ানো, জাবপাত্রে শোয়ানো এক শিশুকে (লুক ২:১০-১২)। যিশুতে ঐশী-প্রতিশ্রুতির এ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই বড়দিনের উৎসব পালিত হয়। প্রতীকী ভাষায় ঘটনার নাটকীয় বর্ণনার অন্তর্নিহিত ভাব ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করাই বড়দিন উৎসব পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
বড়দিনের উৎসবমুখর দিনগুলোতে খ্রিস্টবিশ্বাসীরা যেসব বিষয় নিয়ে ধ্যানমগ্ন বা সমাহিত হয়ে থাকেন তা নিুরূপ-
১. যিশু ত্রিব্যক্তি ঈশ্বরের দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি পাপে পতিত মানবজাতিকে পাপের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছেন। এজন্য তাকে বলা হয় মসিহ বা ত্রাণকর্তা। ঈশ্বরের পুত্র (লুক ১:৩২) বলে তিনি ঈশ্বরকে পিতা বলে ডাকেন এবং তার ওপর বিশ্বাসী মানুষকেও তিনি তা করতে শিক্ষা দেন। খ্রিস্টানদের শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা বলে পরিচিত প্রভুর প্রার্থনায় সন্তানসুলভ মনোভাব নিয়ে যিশু তার আত্মিক বা রূহানি প্রেরণায় সঞ্জীবিত হয়ে ঈশ্বরকে পিতা বলে ডাকতে শিখিয়েছেন, যাতে মানব পরিবারের সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জন্ম নিতে পারে।
২. যিশু ঈশ্বরের জীবনময় বাণী বা কালাম। যোহন তার মঙ্গল সমাচারের শুরুতেই বলেন, আদিতে ছিলেন বাণী; বাণী ছিলেন ঈশ্বরের সঙ্গে, বাণী ছিলেন ঈশ্বর। আদিতে তিনি ঈশ্বরের সঙ্গেই ছিলেন। তার দ্বারাই সবকিছু অস্তিত্ব পেয়েছিল এবং যা কিছু অস্তিত্ব পেয়েছিল, তার কোনোকিছুই তাকে ছাড়া অস্তিত্ব পায়নি (যোহন ১:১-৩)। শয়তান কর্তৃক পরীক্ষিত হওয়ার সময় যিশু বলেছেন, শুধু রুটি খেয়ে নয়, বরং ঈশ্বরের শ্রীমুখে উচ্চারিত প্রতিটি বাণীকে সম্বল করেই মানুষকে বেঁচে থাকতে হয় (মথি ৪:৪)। প্রয়াত পোপ ২য় জন পল তার এক সর্বজনীন পত্রে বলেছেন, মানব পরিবারের সদস্যরা এ বাণী অনুসরণ না করার কারণেই বর্তমানে মানুষের মাঝে গড়ে উঠছে জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুর কালচার বা মৃত্যুর সভ্যতা। বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান সহিংসতা, সন্ত্রাস, আÍঘাতী বোমা হামলা, মারণাস্ত্র তৈরি ও ব্যবসা ইত্যাদি সেই ধ্বংসাÍক কালচারের নিদর্শন।
৩. যিশু সত্য। তিনি বলেন, আমিই সত্য (যোহন ১৫:৬)। সৎ বা ভালো যা কিছু তার উৎস একমাত্র ঈশ্বর। আর একমাত্র সত্যই মানুষকে মুক্ত করতে পারে। তোমরা যদি আমার বাণী পালনে নিষ্ঠাবান থাক, তাহলেই তো তোমরা আমার যথার্থ শিষ্য; তাহলেই তো সত্যকে তোমরা জানতে পারবে আর সত্য তখন তোমাদের স্বাধীন করে দেবে (ওই, ৮:৩১-৩২)। বর্তমান সমাজে যে অন্যায়-অসত্য বিরাজ করছে, তা কেবল সত্যের দ্বারাই নির্মূল করা সম্ভব। কূটচাল, ধূর্ততা, বাকচাতুরী দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত কল্যাণ বা মঙ্গল প্রতিষ্ঠা করতে হলে সত্যকে অনুসরণ করার কোনো বিকল্প নেই।
৪. যিশুই জীবন। তিনি বলেন, আমিই জীবন (যোহন ১৫:৬), আমি এসেছি যাতে মানুষ জীবন পায়, পুরোপুরিভাবেই পায়! (ওই, ১০:১০)। এখানে জীবন বলতে কোনো জৈবিক সত্তাকে বোঝায় না, বরং মানুষের মনুষ্যত্ব ও আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জীবনকে বোঝায়, যার গুণে মানুষ অন্যান্য পশুপক্ষী বা জীবজন্তু থেকে স্বতন্ত্র হয়। এই জীবনের উৎস ও ভিত্তি স্বয়ং ঈশ্বর। যিশু বলেন, আমি আপনাদের সত্যি সত্যিই বলছি, যে আমার কথা শোনে আর যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, তাকে যে বিশ্বাসও করে, সে শাশ্বত জীবন পেয়েই গেছে। তাকে আর অপরাধীর মতো বিচারে দাঁড়াতে হবে না, বরং এর মধ্যেই সে মৃত্যু থেকে জীবনে উত্তীর্ণ হয়েছে (যোহন ৫:২৪)।
৫. যিশু আলো। তিনি বলেন, আমি জগতের আলো। যে আমার অনুসরণ করে, সে কখনও অন্ধকারে চলবে না; সে তো জীবনেরই আলো লাভ করবে (যোহন ৮:১২)। পাপ-পুণ্য, আলো-অন্ধকার ও ভালো-মন্দের দ্বন্দ¡ অনস্বীকার্য। অন্ধকারকে জয় করতে হলে আলো জ্বালাতেই হবে। বর্তমান সময়ে তাই অনেককেই বলতে শোনা যায়, সমাজের তমসা দূরীভূত করতে হলে আলোকিত মানুষ দরকার।
৬. যিশুখ্রিস্ট মহাযাজক। তিনি ঈশ্বর ও মানুষের মাঝে একমাত্র মধ্যস্থতাকারী। আমরা তো পেয়েছি এক পরম মহাযাজককে, যিনি আকাশমণ্ডল অতিক্রম করে গেছেন : তিনি ঈশ্বরপুত্র যিশু। ... আমরা এই যে মহাযাজককে পেয়েছি, তিনি আমাদের দুর্বলতার সমব্যথী থেকে অক্ষম নন; বরং আমাদের মতোই তিনিও সবদিক দিয়ে পরীক্ষিত হয়েছেন, কিন্তু থেকেছেন নিষ্পাপ (হিব্রু ৪:১৪-১৫)। খ্রিস্টও তেমনি নিজেই নিজেকে মহাযাজক হওয়ার গৌরবে ভূষিত করেননি; করেছেন তিনিই, যিনি তাকে বলেছিলেন : তুমি আমার পুত্র; আমিই আজ তোমাকে জন্ম দিয়েছি! আবার আরেক জায়গায় তিনি বলেছেন : যাজক তুমি চিরকালের মতো, মেলখিসেদেকের রীতি অনুসারে (হিব্র“ ৫:৫-৬)। তিনি যাজক হয়েছেন দেহগত জন্মের কোনো নিয়মের জোরে নয়, বরং অবিনশ্বর এক জীবনেরই শক্তিতে (প্রাগুক্ত ৭:১৬)। যিশু যেহেতু চিরজীবী, তার যাজকত্বও চিরস্থায়ী। আর তাই যারা তার মধ্য দিয়ে পরমেশ্বরের কাছে যায়, চিরকালের মতোই তিনি তাদের পরিত্রাণ করার ক্ষমতা রাখেন; কারণ পরমেশ্বরের কাছে তাদেরই হয়ে আবেদন জানানোর জন্য তিনি যে নিত্যই রয়েছেন।
৭. যিশু ভালোবাসা। পরমেশ্বর জগৎকে এতই ভালোবেসেছেন যে, তার একমাত্র পুত্রকে তিনি দান করে দিয়েছেন, যাতে, যে কেউ তাকে বিশ্বাস করে, তার যেন বিনাশ না হয়, বরং সে যেন লাভ করে শাশ্বত জীবন। পরমেশ্বর জগৎকে দণ্ডিত করতে তার পুত্রকে এই জগতে পাঠাননি; পাঠিয়েছিলেন, যাতে তার দ্বারা জগৎ পরিত্রাণ লাভ করে (যোহন ৩:১৬-১৭)। আমাদের প্রতি পরমেশ্বরের ভালোবাসা এতেই প্রকাশিত হয়েছে যে, তিনি তার একমাত্র পুত্রকে এই জগতে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তার দ্বারাই আমরা জীবন লাভ করি (১ যোহন ৪:৯)। যে ভালোবাসে না সে ঈশ্বরকে জানে না। ঈশ্বর ও মানুষকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়, তা আমরা যিশুর জীবন ও কাজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। তিনি মানুষকে ভালোবেসে নিজের জীবন দান করেছেন এবং আমাদেরও আদেশ দিয়েছেন পরস্পরকে ভালোবাসতে। আমাদের কাছে যিশুর আদেশ হচ্ছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ভালোবাসা, এমনকি শত্র“কেও ভালোবাসা।
৮. যিশু আনন্দ। যিশুর জন্মলগ্নে স্বর্গদূত বললেন, আমি এক আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি। এই আনন্দ জাতির সব মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে (লুক ২:১০)। বড়দিনের আনন্দ তখনই সার্থক হয় যখন আমরা শুধু মৌখিক প্রচারের মাধ্যমে নয়, বরং অপরের সঙ্গে সহভাগিতার মাধ্যমে তা প্রচার করি। যিশু বলেন, পিতা যেমন আমাকে ভালোবেসেছেন, আমিও তেমনি তোমাদের ভালোবেসেছি। তোমরা আমার ভালোবাসার আশ্রয়ে থেকো। যদি আমার সব আদেশ পালন কর, তবেই তোমরা আমার ভালোবাসার আশ্রয়ে থাকবে, আমিও যেমন পিতার সব আদেশ পালন করেছি আর আছি তার ভালোবাসার আশ্রয়ে। এসব কথা তোমাদের বললাম, যাতে আমার আনন্দ তোমাদের অন্তরে থাকতে পারে এবং তোমাদের আনন্দ যেন পরিপূর্ণ হতে পারে (যোহন ১৫:৯-১১)।
৯. যিশু শান্তি। যিশু ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি শান্তিরাজ (যিশাইয়া ৯:৬)। যিশুর জন্মের রাতে স্বর্গের দূতবাহিনী গেয়ে উঠেছিল : জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়! ইহলোকে নামুক শান্তি তার অনুগৃহীত মানবের অন্তরে (লুক ২:১৪)। ঈশ্বর প্রদত্ত এ শান্তি অন্তরে গ্রহণ করলেই মানুষের মন থেকে সব রকম ঘৃণা-বিদ্বেষ দূর হতে পারে। যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ মানুষের একান্ত কাম্য তাই বড়দিন উৎসবের অন্যতম প্রধান আশীর্বাদ। মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের পরে শিষ্যদের দেখা দিয়ে যিশু দুবার বলেছিলেন, তোমাদের শান্তি হোক (যোহন ২০:১৯-২১)। তবে যিশুর দেয়া শান্তি আর মানুষের দেয়া শান্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য। যিশু বলেন, তোমাদের জন্য শান্তি রেখে যাচ্ছি, তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি আমারই শান্তি; অবশ্য এ সংসার যেভাবে শান্তি দেয়, সেভাবে আমি তোমাদের তা দিয়ে যাচ্ছি না (যোহন ১৪:২৭)। যিশুর দেয়া শান্তি হচ্ছে পবিত্র আত্মা বা পাক রূহের বশে চলার ফল (গালাতীয় ৫:২২)। এর বিপরীত হচ্ছে রিপু বা পাপ-স্বভাবের বশে চলা। এর ফলে মানুষের ব্যক্তিজীবনে ও সমাজে নেমে আসে অশান্তি ও অরাজকতা। বড়দিন উৎসবে শান্তি-শুভেচ্ছা বিনিময় যদি কেবল মৌখিক শিষ্টাচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তবে আমরা শান্তি-আশীর্বাদ পেতে পারি না।
মঙ্গল সমাচারে যিশুর জন্ম কাহিনীর বর্ণনায় অনেক প্রতীক ও রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। বড়দিন উৎসবের সময় এ প্রতীকগুলোর অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আকাশে উদিত উজ্জ্বল তারকা প্রকাশ করে যে যিশু হচ্ছেন জগতের আলো। জগতের অন্ধকার দূর করতেই তিনি ইম্মানুয়েল বা আমাদের নিত্যসঙ্গী ঈশ্বর। পূর্বদেশের তিন পণ্ডিত বলতে বোঝায় অযিহুদী। অর্থাৎ যিশু কেবল কোনো এক জাতি বা গোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা নন, তিনি সব মানুষেরই মুক্তিদাতা।
আজকাল মুসলমানদের ঈদ ও হিন্দু-বৌদ্ধদের পূজা-পার্বণের মতো বড়দিন উৎসবও কেবল খ্রিস্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। অখ্রিস্টান প্রতিবেশী ভাইবোন এবং বন্ধু-বান্ধবও বড়দিনের উৎসবে আমন্ত্রিত হন। সবার সঙ্গে বড়দিনের আনন্দ সহভাগিতা করার ফলে আনন্দের মাত্রা বেড়ে যায়। বাংলাদেশে সব ধর্মের লোকের মাঝে শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড়দিন উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমার দেশবাসী সবার কাছে বড়দিনের শান্তি-শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা, সিএসসি : উপাচার্য, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
No comments