ভারতে ঘর ওয়াপাস্ : শেষ কোথায়? by ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
ভারতে মুসলমান ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের
হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করার এক জোরদার তৎপরতা শুরু হয়েছে। কয়েকদিন আগে
তাজমহলের নগরী আগ্রায় ৫০টি মুসলমান পরিবারকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তর করা
হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদে বলা হচ্ছে, অতিশয় দরিদ্র এই
ব্যক্তিদের রেশন কার্ড, বাসস্থান এবং তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ দেয়ার
প্রলোভন দেখিয়ে একটি পূজা অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে পূজা আয়োজকরা
বলছেন, এই ব্যক্তিরা আগে হিন্দু ছিল। ৩০ বছর আগে তাদের মুসলমান করা হয়।
তারা স্বেচ্ছায় পূজায় অংশ নিয়েছে এবং পূজা শেষে স্বেচ্ছায় হিন্দুত্ব বরণ
করে নিয়েছে। তারা তাদের পুরনো ধর্মে ফিরে এসেছে। এটা ধর্মান্তর নয়, স্বগৃহে
প্রত্যাবর্তন, ঘর ওয়াপাস্। যদিও এই কথিত ঘর ওয়াপাসিতে অংশ নেয়া কয়েকজনকে
টেলিভিশনে পরস্পরবিরোধী কথা বলতে শোনা গেছে। একজনকে বলতে শুনেছি, তিনি
বুঝেশুনেই এ কাজ করেছেন। আবার আরেকজন বলেছেন, তাদের বলা হয়েছিল পূজায় অংশ
নিলে খেতে দেয়া হবে এবং তারা অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবেন, তাদের হিন্দু বানানো
হবে তা বলা হয়নি। একজন তো চিৎকার করে বলেছেন, আমরা তো মুসলমান, হিন্দু হব
কেন? মরে গেলেও হব না।
এ ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে অনুরূপ একটি অনুষ্ঠানে ২০০ জন উপজাতীয় খ্রিস্টানকে হিন্দু বানানো হয়েছে।
ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক সহযোগী আরএসএস এবং বজরং দল এই গণ-ধর্মান্তর কর্মসূচির উদ্যোক্তা।
আগ্রার পর এখন আলীগড়ে আরও বড় আকারে অনুরূপ ধর্মান্তর অনুষ্ঠান আয়োজনের তোড়জোড় চলছে। ২৫ ডিসেম্বর সেখানে ৪০০০ খ্রিস্টান পরিবার ও ১০০০ মুসলমান পরিবারকে একযোগে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ সেই অনুষ্ঠানে থাকবেন।
বিজেপির আরেক শীর্ষ নেতা সুব্রহ্মনিয়াম স্বামী বলেছেন, বিগত নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের জনগণ হিন্দুত্ববাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। এই বিজয় হিন্দুত্বের বিজয়। কারণ বিজেপির নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর কেন্দ্রীয় ইস্যু ছিল হিন্দুত্ব। খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ভগবত গীতাকে রাষ্ট্রীয় ধর্মগ্রন্থ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। আরেকজন বিজেপি নেতা মোহনলাল বলেছেন, ভগবত গীতা সংবিধানের ওপরে। আরও এক কাঠি এগিয়ে বিজেপির এক রাষ্ট্রমন্ত্রী স্বাধ্বী নিরঞ্জনা জ্যোতি বলেছেন, যারা রামকে মানে না তারা জারজ (বাস্টার্ড)!
নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী বিজেপি এবং তার সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিকভাবেই ভারতজুড়ে অহিন্দু সংখ্যালঘু জনগণকে চরম শংকা ও অস্থিরতায় নিক্ষেপ করেছে।
আশার কথা, ভারতের প্রায় সব কটি বিরোধী দল এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ভারতের লোকসভায় বিরোধী দলের ১৪০ জন সদস্য এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এ ধরনের গণধর্মান্তরকে বেআইনি ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন, এর ফলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে এবং দেশজুড়ে নৈরাজ্য ও হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের উদ্ভব হবে। তাদের প্রতিবাদের মুখে সংসদের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পার্লামেন্টের কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ পরিস্থিতিতে চরম বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আলীগড়ে ধর্মান্তর অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া হবে না। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানের আয়োজকরা পিছু হঠতে নারাজ। তারা বলছেন, অনুষ্ঠান হবেই। আয়োজকরা ঘোষণা দিয়েছে, ধর্মান্তরে অংশ নিয়ে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করলে বছরে প্রত্যেক মুসলমানকে ৫ লাখ রুপি এবং প্রত্যেক খ্রিস্টানকে ২ লাখ রুপি দেয়া হবে। এই ঘোষণা সংবলিত প্রচারপত্র ব্যাপকভাবে বিলি করা হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ স্পষ্ট। তবে আরএসএস, বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো বিজেপির পেছনের শক্তিগুলোর এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিজেপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রকাশ্য সমর্থনের দায় মোদি সরকারকেই বহন করতে হবে।
ভারতে সাম্প্রদায়িকতার এই নব-উত্থান সমগ্র উপমহাদেশের সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে শংকিত করছে। বিশেষ করে উগ্রবাদকবলিত পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুরা এতে নিরাপত্তাহীনতার আশংকায় আছেন বলে খবর হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। ভারত সরকারকে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে দেয়া দরকার। এ ধরনের ঘটনার প্রতিক্রিয়া কোথায় কখন কীভাবে ঘটে বলা মুশকিল।
২.
ধর্মান্তর নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর সব ধর্মেই অতি উৎসাহী ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা নিজ ধর্মকে একমাত্র সত্যধর্ম মনে করে। তারা অন্যসব ধর্মের লোকদের নরকবাস সুনিশ্চিত মনে করে এবং অন্য ধর্মের একজনকেও ধর্মান্তরিত করে সঠিক পথে আনতে পারলে নিজের স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত মনে করে। এই পুণ্য অর্জনে তাদের আগ্রহের সীমা থাকে না। সে কারণেই যুগে যুগে ধর্মযুদ্ধে কতই না রক্ত ঝরেছে! কত প্রাণ নিঃশেষ হয়েছে! প্রায়শ এতে রাজনীতি জড়িয়ে যায়। রাজ্য জয় এবং প্রজাদের ওপর কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার জন্য ধর্মের বন্ধনকে কাজে লাগানো হয়েছে যুগে যুগে। পৃথিবীর বুকে প্রায় সব ধর্মমতই প্রচারিত হয়েছে সমকালীন সামাজিক অবক্ষয় ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে। তাতে মানব সমাজ উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এক পর্যায়ে সেই ধর্ম রাজশক্তির প্রজা-শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম, হিন্দুধর্ম কোনোটাই ব্যতিক্রম নয় (সাম্প্রতিককালে মহামতি বুদ্ধের অহিংসার ধর্মের অনুসারীরাও সেই কাতারে শামিল হয়েছে)। কিন্তু আধুনিক কালের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সম-নাগরিকত্বের ধারণার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি মোটেই খাপ খায় নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব নাগরিকের নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অবাধ অধিকার
নিশ্চিত থাকবে সেটাই প্রত্যাশিত। দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই সেই নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের ঘোষণাও দ্ব্যর্থহীন।
এ অবস্থায় ভারতে এ ধরনের ঘটনা সাড়ম্বরে ঘটছে এবং তা আরও ব্যাপকভাবে ঘটার আশংকা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি যে কোনো বিবেকবান মানুষকেই চিন্তিত করবে।
ভারতে এই গণ-ধর্মান্তরের কারিগরদের বক্তব্য- তারা কাউকে প্রলুব্ধ করে বা জোরজবরদস্তি করে ধর্মান্তরিত করছেন না। কিন্তু বাস্তবে তারা যে প্রলোভন দেখাচ্ছেন এবং চাপ সৃষ্টি করছেন, তা মোটেই লুকায়িত থাকছে না।
কেউ যদি কোনো ধর্মীয় মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বুঝেশুনে নতুন ধর্মে দীক্ষা নিতে চান তাকে বাধা দেয়া নিরর্থক। কিন্তু সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র ও অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষকে খাদ্য বা কোনো প্রকার বৈষয়িক সহায়তার বিনিময়ে ধর্মান্তরে রাজি করা জবরদস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা সব ধর্মের জন্যই প্রযোজ্য। এ নিয়ে বিশ্বে বিবেকবান মানুষ বরাবর আপত্তি জানিয়ে আসছেন। পশ্চিমের অনেকে খ্রিস্টধর্মের প্রচারকদের ধর্মপ্রচারের জোরালো প্রয়াসকে aggressive proselytisation আখ্যা দিয়ে এর তীব্র বিরোধিতা করে থাকেন। সাম্প্রতিককালে সিরিয়া ও ইরাকের কথিত ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রের মুখে ধর্মান্তরের অভিযোগ উঠেছে। এই কথিত রাষ্ট্র কারা কোন উদ্দেশ্যে করেছে তা স্পষ্ট নয়। এই রাষ্ট্র বিশ্বসভার সমর্থন বঞ্চিত এবং তার শোচনীয় পরিসমাপ্তি খুব দূরে আছে বলে মনে হয় না। মানব সভ্যতার বুকে এই দুষ্টক্ষতটি যত শিগগির দূর হয় ততই মঙ্গল।
বলা হচ্ছে, অতীতে এই উপমহাদেশে সবাই হিন্দু ছিল। মুসলমান শাসকদের আমলে শক্তিবলে এখানকার মানুষকে মুসলমান বানানো হয়েছে। এ বক্তব্য কতটা সঠিক সে বিতর্কে যাব না। ক্ষেত্রবিশেষে রাজশক্তি বা শক্তিমান পক্ষ তেমন কিছু ঘটনা ঘটিয়ে থাকতেও পারে। তবে দুদিন আগে ভারতের এনডিটিভিতে একজন আলোচক যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। ৮০০ বছর এদেশ পরাধীন ছিল, তখন জোরজবরদস্তি করে মানুষকে মুসলমান করা হয়েছে- এমন
এক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, শক্তি বা প্রলোভন বশে নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই দলে দলে মানুষ সুযোগ পেয়ে অন্য ধর্মে চলে গেছে।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশের জনসমর্থিত ক্ষমতাসীন দল অতীত বা বর্র্তমানের কু-দৃষ্টান্ত তুলে ধরে একই পথে চলতে চাইলে তার চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের ছাড়পত্র হতে পারে না। এটা ভারতের জন্যই আত্মঘাতী হবে। কারণ আজকের ভারতে মুসলমান, খ্রিস্টানসহ প্রায় ৩০ কোটি অ-হিন্দু মানুষের বাস। ৩০ কোটি জনসংখ্যাকে সংখ্যালঘু বিবেচনা করা যুক্তিসিদ্ধ নয়। এ ধরনের কর্মসূচিতে ৩০ কোটি মানুষকে ধর্মান্তরিত করতে গেলে তার প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি কী হতে পারে সেটা অনুধাবন করা কঠিন কিছু নয়। তদুপরি, সারা বিশ্বে, বিশেষ করে ভারতের চারপাশে হিন্দুর চেয়ে অ-হিন্দুর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। সেখানেও ধর্মান্ধতার কোনো কমতি নেই, যেখানে অবধারিতরূপেই প্রত্যাঘাত মাথাচাড়া দিতে পারে।
বিশ্ববাসী আশা করবে, ভারতের জনগণ এই ভয়ংকর পরিস্থিতি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবেন।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
এ ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে অনুরূপ একটি অনুষ্ঠানে ২০০ জন উপজাতীয় খ্রিস্টানকে হিন্দু বানানো হয়েছে।
ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক সহযোগী আরএসএস এবং বজরং দল এই গণ-ধর্মান্তর কর্মসূচির উদ্যোক্তা।
আগ্রার পর এখন আলীগড়ে আরও বড় আকারে অনুরূপ ধর্মান্তর অনুষ্ঠান আয়োজনের তোড়জোড় চলছে। ২৫ ডিসেম্বর সেখানে ৪০০০ খ্রিস্টান পরিবার ও ১০০০ মুসলমান পরিবারকে একযোগে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ সেই অনুষ্ঠানে থাকবেন।
বিজেপির আরেক শীর্ষ নেতা সুব্রহ্মনিয়াম স্বামী বলেছেন, বিগত নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের জনগণ হিন্দুত্ববাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। এই বিজয় হিন্দুত্বের বিজয়। কারণ বিজেপির নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর কেন্দ্রীয় ইস্যু ছিল হিন্দুত্ব। খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ভগবত গীতাকে রাষ্ট্রীয় ধর্মগ্রন্থ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। আরেকজন বিজেপি নেতা মোহনলাল বলেছেন, ভগবত গীতা সংবিধানের ওপরে। আরও এক কাঠি এগিয়ে বিজেপির এক রাষ্ট্রমন্ত্রী স্বাধ্বী নিরঞ্জনা জ্যোতি বলেছেন, যারা রামকে মানে না তারা জারজ (বাস্টার্ড)!
নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী বিজেপি এবং তার সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিকভাবেই ভারতজুড়ে অহিন্দু সংখ্যালঘু জনগণকে চরম শংকা ও অস্থিরতায় নিক্ষেপ করেছে।
আশার কথা, ভারতের প্রায় সব কটি বিরোধী দল এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ভারতের লোকসভায় বিরোধী দলের ১৪০ জন সদস্য এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এ ধরনের গণধর্মান্তরকে বেআইনি ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন, এর ফলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে এবং দেশজুড়ে নৈরাজ্য ও হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের উদ্ভব হবে। তাদের প্রতিবাদের মুখে সংসদের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পার্লামেন্টের কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ পরিস্থিতিতে চরম বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আলীগড়ে ধর্মান্তর অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া হবে না। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানের আয়োজকরা পিছু হঠতে নারাজ। তারা বলছেন, অনুষ্ঠান হবেই। আয়োজকরা ঘোষণা দিয়েছে, ধর্মান্তরে অংশ নিয়ে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করলে বছরে প্রত্যেক মুসলমানকে ৫ লাখ রুপি এবং প্রত্যেক খ্রিস্টানকে ২ লাখ রুপি দেয়া হবে। এই ঘোষণা সংবলিত প্রচারপত্র ব্যাপকভাবে বিলি করা হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ স্পষ্ট। তবে আরএসএস, বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো বিজেপির পেছনের শক্তিগুলোর এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিজেপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রকাশ্য সমর্থনের দায় মোদি সরকারকেই বহন করতে হবে।
ভারতে সাম্প্রদায়িকতার এই নব-উত্থান সমগ্র উপমহাদেশের সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে শংকিত করছে। বিশেষ করে উগ্রবাদকবলিত পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুরা এতে নিরাপত্তাহীনতার আশংকায় আছেন বলে খবর হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। ভারত সরকারকে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে দেয়া দরকার। এ ধরনের ঘটনার প্রতিক্রিয়া কোথায় কখন কীভাবে ঘটে বলা মুশকিল।
২.
ধর্মান্তর নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর সব ধর্মেই অতি উৎসাহী ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা নিজ ধর্মকে একমাত্র সত্যধর্ম মনে করে। তারা অন্যসব ধর্মের লোকদের নরকবাস সুনিশ্চিত মনে করে এবং অন্য ধর্মের একজনকেও ধর্মান্তরিত করে সঠিক পথে আনতে পারলে নিজের স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত মনে করে। এই পুণ্য অর্জনে তাদের আগ্রহের সীমা থাকে না। সে কারণেই যুগে যুগে ধর্মযুদ্ধে কতই না রক্ত ঝরেছে! কত প্রাণ নিঃশেষ হয়েছে! প্রায়শ এতে রাজনীতি জড়িয়ে যায়। রাজ্য জয় এবং প্রজাদের ওপর কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার জন্য ধর্মের বন্ধনকে কাজে লাগানো হয়েছে যুগে যুগে। পৃথিবীর বুকে প্রায় সব ধর্মমতই প্রচারিত হয়েছে সমকালীন সামাজিক অবক্ষয় ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে। তাতে মানব সমাজ উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এক পর্যায়ে সেই ধর্ম রাজশক্তির প্রজা-শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম, হিন্দুধর্ম কোনোটাই ব্যতিক্রম নয় (সাম্প্রতিককালে মহামতি বুদ্ধের অহিংসার ধর্মের অনুসারীরাও সেই কাতারে শামিল হয়েছে)। কিন্তু আধুনিক কালের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সম-নাগরিকত্বের ধারণার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি মোটেই খাপ খায় নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব নাগরিকের নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অবাধ অধিকার
নিশ্চিত থাকবে সেটাই প্রত্যাশিত। দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই সেই নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের ঘোষণাও দ্ব্যর্থহীন।
এ অবস্থায় ভারতে এ ধরনের ঘটনা সাড়ম্বরে ঘটছে এবং তা আরও ব্যাপকভাবে ঘটার আশংকা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি যে কোনো বিবেকবান মানুষকেই চিন্তিত করবে।
ভারতে এই গণ-ধর্মান্তরের কারিগরদের বক্তব্য- তারা কাউকে প্রলুব্ধ করে বা জোরজবরদস্তি করে ধর্মান্তরিত করছেন না। কিন্তু বাস্তবে তারা যে প্রলোভন দেখাচ্ছেন এবং চাপ সৃষ্টি করছেন, তা মোটেই লুকায়িত থাকছে না।
কেউ যদি কোনো ধর্মীয় মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বুঝেশুনে নতুন ধর্মে দীক্ষা নিতে চান তাকে বাধা দেয়া নিরর্থক। কিন্তু সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র ও অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষকে খাদ্য বা কোনো প্রকার বৈষয়িক সহায়তার বিনিময়ে ধর্মান্তরে রাজি করা জবরদস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা সব ধর্মের জন্যই প্রযোজ্য। এ নিয়ে বিশ্বে বিবেকবান মানুষ বরাবর আপত্তি জানিয়ে আসছেন। পশ্চিমের অনেকে খ্রিস্টধর্মের প্রচারকদের ধর্মপ্রচারের জোরালো প্রয়াসকে aggressive proselytisation আখ্যা দিয়ে এর তীব্র বিরোধিতা করে থাকেন। সাম্প্রতিককালে সিরিয়া ও ইরাকের কথিত ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রের মুখে ধর্মান্তরের অভিযোগ উঠেছে। এই কথিত রাষ্ট্র কারা কোন উদ্দেশ্যে করেছে তা স্পষ্ট নয়। এই রাষ্ট্র বিশ্বসভার সমর্থন বঞ্চিত এবং তার শোচনীয় পরিসমাপ্তি খুব দূরে আছে বলে মনে হয় না। মানব সভ্যতার বুকে এই দুষ্টক্ষতটি যত শিগগির দূর হয় ততই মঙ্গল।
বলা হচ্ছে, অতীতে এই উপমহাদেশে সবাই হিন্দু ছিল। মুসলমান শাসকদের আমলে শক্তিবলে এখানকার মানুষকে মুসলমান বানানো হয়েছে। এ বক্তব্য কতটা সঠিক সে বিতর্কে যাব না। ক্ষেত্রবিশেষে রাজশক্তি বা শক্তিমান পক্ষ তেমন কিছু ঘটনা ঘটিয়ে থাকতেও পারে। তবে দুদিন আগে ভারতের এনডিটিভিতে একজন আলোচক যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। ৮০০ বছর এদেশ পরাধীন ছিল, তখন জোরজবরদস্তি করে মানুষকে মুসলমান করা হয়েছে- এমন
এক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, শক্তি বা প্রলোভন বশে নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই দলে দলে মানুষ সুযোগ পেয়ে অন্য ধর্মে চলে গেছে।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশের জনসমর্থিত ক্ষমতাসীন দল অতীত বা বর্র্তমানের কু-দৃষ্টান্ত তুলে ধরে একই পথে চলতে চাইলে তার চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের ছাড়পত্র হতে পারে না। এটা ভারতের জন্যই আত্মঘাতী হবে। কারণ আজকের ভারতে মুসলমান, খ্রিস্টানসহ প্রায় ৩০ কোটি অ-হিন্দু মানুষের বাস। ৩০ কোটি জনসংখ্যাকে সংখ্যালঘু বিবেচনা করা যুক্তিসিদ্ধ নয়। এ ধরনের কর্মসূচিতে ৩০ কোটি মানুষকে ধর্মান্তরিত করতে গেলে তার প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি কী হতে পারে সেটা অনুধাবন করা কঠিন কিছু নয়। তদুপরি, সারা বিশ্বে, বিশেষ করে ভারতের চারপাশে হিন্দুর চেয়ে অ-হিন্দুর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। সেখানেও ধর্মান্ধতার কোনো কমতি নেই, যেখানে অবধারিতরূপেই প্রত্যাঘাত মাথাচাড়া দিতে পারে।
বিশ্ববাসী আশা করবে, ভারতের জনগণ এই ভয়ংকর পরিস্থিতি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবেন।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
No comments