কী ঘটবে ৫ জানুয়ারি? by আহমেদ সুমন
আগামী ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ
নির্বাচনের এক বছর পূর্ণ হতে চলছে। দিনটি সামনে রেখে সংসদের বাইরের প্রধান
বিরোধী দল বিএনপি আবারও নতুন করে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ
করছে। এ কথা পুনর্বার বলার প্রয়োজন নেই যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধান
বিরোধী দল বিএনপির বর্জন এবং প্রতিরোধের মুখে জাতীয় সংসদের প্রায়
ভোটারবিহীন দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দশম সংসদ নির্বাচনের এক বছর
পূর্তির প্রাক্কালে ওই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তকে
বিভিন্ন মহল থেকে ‘সঠিক’ বা ‘ভুল’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। বক্ষমাণ নিবন্ধে এ
সঠিক কিংবা ভুলের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে সেই সময়কার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তকে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীসহ অপরাপর দলের অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অনেক শীর্ষ নেতাই এখনও মনে করেন, ‘শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ভুল নয়; বরং সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কারচুপির একটি নীলনকশার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে শেখ হাসিনা সরকারকে বৈধতার সুযোগ দেয়ার কোনো মানে হয় না। সংসদে পুনর্বার বিরোধী দল হওয়ার কোনো অর্থ হয় না।’ আসলে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ‘ভুল’ না ‘সঠিক’, সে সম্পর্কে অল্প সময়ে যথার্থ মন্তব্য করা যায় না। ঘটনা পরম্পরায় সিদ্ধান্ত ভুল বা সঠিক প্রমাণিত হয়। ঘটনা যত বেশি পুরনো হয়, ইতিহাসের মূল্যায়ন ততই সঠিক হয়।
বিএনপির বর্জনের মুখে যেনতেনভাবে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরপরই বিএনপি দেশব্যাপী তাদের লাগাতার আন্দোলন এবং সড়ক অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করে। আন্দোলন স্থগিত করে বিএনপি নির্বাচন বাতিলের দাবি জানায় এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে আলোচনা শুরু করার দাবি অব্যাহত রাখে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনোত্তর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সহসাই নতুন করে নির্বাচন দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগ্রহ দেখান। রাজনীতিকে অনেকেই ‘গেম’ বলে অভিহিত করে থাকেন। এ গেমে নির্বাচনের পরপরই বিএনপি দম নিতে থাকে। আওয়ামী লীগ বিএনপির দম নেয়ার সুযোগ নিয়ে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে ৫ বছর আগে নির্বাচন না দেয়ার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে। বিএনপি একটু দম নিয়ে সংলাপ এবং নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে বিগত দুটি ঈদেই ‘ঈদের পর’ সরকারবিরোধী আন্দোলনের হুমকি-ধামকি দিয়েছে। সেসব হুমকি-ধামকি কার্যত ‘অসার’ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এখন আসছে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখটি ঘিরে নতুন করে আন্দোলনের হুমকি-ধামকি দেয়া শুরু করেছে। যেহেতু বিএনপি বিগত এক বছরে সব হুমকি-ধমকিতে ফ্লপ মেরেছে, তাই সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা বিএনপিকে কাগুজে বাঘ বলে মনে করে। বিগত সময়ে বিএনপি আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া কার্যত কিছু করতে পারেনি। বিএনপির নেতাকর্মীরা রাজপথে নামেনি। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিএনপির ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পুরোপুরি ফ্লপ হয়েছে। দলীয় এ নাজুক অবস্থা অনুধাবন করে বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ক্ষেত্রে অনেকটা নমনীয় হয়ে সর্বশেষ শেখ হাসিনা বাদে অন্য কাউকে সর্বদলীয় সরকারের প্রধান করা হলে তা মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মানসিকতা দেখিয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও একটি বড় রাজনৈতিক দল। বিগত সময়ের সংসদ নির্বাচনে এ দুই দলেরই প্রাপ্ত ভোটের হার চল্লিশ শতাংশের ওপরে। বিএনপি ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। বিএনপির অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে এক প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। ভারত ব্যতিরেকে অনেক বিদেশী রাষ্ট্র নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেসব রাষ্ট্র মনোভাব পাল্টাতে শুরু করেছে। নির্বাচন প্রশ্নে চীন, কোরিয়া, জাপানের মনোভাব পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেসব দেশ সফরে গিয়ে বর্তমানে তার নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার বিষয়টি ঘষামাজা করে ঠিক করে ফেলেছেন। বলা যায়, নির্বাচন প্রশ্নে এখনও নেতিবাচক মনোভাব অটুট রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা, মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপন করেই যাচ্ছেন। এমনকি ড্যান মজিনার যিনি স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন, মার্শিয়া বার্নিকাটও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি আশা করেছিল, তারা দেশী-বিদেশী চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার অধীনে নতুন করে নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হবে। তাদের এ আশা যে অচিরেই পূরণ হবে, তারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো বৃহৎ রাষ্ট্র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নে কঠোর মনোভাব বজায় রাখেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে। তারা আগামী সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানাচ্ছেন। হিসাব অনুযায়ী আগামী সংসদ নির্বাচন হতে আরও চার বছর বাকি, তাই সরকার এ বিষয়ে এখনই তাগিদ বোধ করছে না। সময় হলে এ নিয়ে তারা সংলাপ শুরু করতে পারে। আবার সেই সংলাপে যে বিএনপির দাবির প্রতিফলন ঘটবে, তেমন আশা ক্ষীণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘নির্বাচনকালীন সরকারে’ যোগ দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তকে যারা সঠিক বলে মনে করেন তাদের ধারণা, ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও বিজয় নিশ্চিত ছিল না। অন্তত বিএনপি জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ের ক্ষেত্রে সরকারপ্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াত। ফলে বিএনপি জোটের সরকার গঠনের ভাবনা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। এ মতের সমর্থকদের আরও ধারণা, আওয়ামী লীগ কমপক্ষে ১৫১ আসনে বিজয় নিশ্চিত করতে সব ধরনের ক্যারিকেচার করত। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিপরিষদে বিরোধী দলের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে যতই চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করা হোক, প্রশাসনিক শক্তি ও গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য আর কেউ হতে পারেন না। এ অবস্থায় নির্বাচনে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে, তা নিয়ে নির্ভাবনায় থাকা যায় না। বিএনপি নিশ্চয় এ উপলব্ধি থেকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে না পারলেও বর্জন করার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে করছে। বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গণতন্ত্রের নামে যেভাবেই হোক রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া এবং ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় স্থায়ী হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করা। রাজনীতির এ খেলায় আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। তারা সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার নামে দায়সারা গোছের নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে সরকারের সাংবিধানিক মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ করতে চাচ্ছে। এ লক্ষ্যে সরকার নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপির দেশী-বিদেশী সব ধরনের পরিকল্পনা ব্যর্থ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিগত এক বছরে বিএনপি কয়েক দফায় আন্দোলন কর্মসূচি দিলেও তা হালে পানি পায়নি। সরকার বরং বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা অব্যাহত রেখে তাদের দৌড়ের ওপর রেখেছে। বিদেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ভালো আছে।
পরিশেষে বলা যায়, নির্বাচনোত্তর পরিবেশ-পরিস্থিতি এখন সরকারের অনুকূলে। এ পরিবেশ দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। বিএনপি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়েছে। ভালো কী মন্দ কিংবা স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যা-ই হোক না কেন, বর্তমান সরকারের যদি হঠাৎ বিদায় ঘটে বা বিএনপির দাবি মেনে নিয়ে সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়, সেক্ষেত্রে নির্বাচন বর্জনের বিএনপির সিদ্ধান্ত সঠিক বলে গণ্য হতে পারে। লক্ষণীয়, ধারণাগত দিক দিয়ে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও সরকার বিএনপিকে কোণঠাসা অবস্থায় রেখে প্রমাণ করতে চলেছে, নির্বাচন বর্জন বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তবে ইতিহাস এখানে কী সাক্ষ্য দেবে, তা দূর ভবিষ্যতে বলা যাবে।
আহমেদ সুমন : গবেষক, বিশ্লেষক
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে সেই সময়কার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তকে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীসহ অপরাপর দলের অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অনেক শীর্ষ নেতাই এখনও মনে করেন, ‘শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ভুল নয়; বরং সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কারচুপির একটি নীলনকশার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে শেখ হাসিনা সরকারকে বৈধতার সুযোগ দেয়ার কোনো মানে হয় না। সংসদে পুনর্বার বিরোধী দল হওয়ার কোনো অর্থ হয় না।’ আসলে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ‘ভুল’ না ‘সঠিক’, সে সম্পর্কে অল্প সময়ে যথার্থ মন্তব্য করা যায় না। ঘটনা পরম্পরায় সিদ্ধান্ত ভুল বা সঠিক প্রমাণিত হয়। ঘটনা যত বেশি পুরনো হয়, ইতিহাসের মূল্যায়ন ততই সঠিক হয়।
বিএনপির বর্জনের মুখে যেনতেনভাবে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরপরই বিএনপি দেশব্যাপী তাদের লাগাতার আন্দোলন এবং সড়ক অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করে। আন্দোলন স্থগিত করে বিএনপি নির্বাচন বাতিলের দাবি জানায় এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে আলোচনা শুরু করার দাবি অব্যাহত রাখে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনোত্তর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সহসাই নতুন করে নির্বাচন দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগ্রহ দেখান। রাজনীতিকে অনেকেই ‘গেম’ বলে অভিহিত করে থাকেন। এ গেমে নির্বাচনের পরপরই বিএনপি দম নিতে থাকে। আওয়ামী লীগ বিএনপির দম নেয়ার সুযোগ নিয়ে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে ৫ বছর আগে নির্বাচন না দেয়ার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে। বিএনপি একটু দম নিয়ে সংলাপ এবং নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে বিগত দুটি ঈদেই ‘ঈদের পর’ সরকারবিরোধী আন্দোলনের হুমকি-ধামকি দিয়েছে। সেসব হুমকি-ধামকি কার্যত ‘অসার’ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এখন আসছে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখটি ঘিরে নতুন করে আন্দোলনের হুমকি-ধামকি দেয়া শুরু করেছে। যেহেতু বিএনপি বিগত এক বছরে সব হুমকি-ধমকিতে ফ্লপ মেরেছে, তাই সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা বিএনপিকে কাগুজে বাঘ বলে মনে করে। বিগত সময়ে বিএনপি আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া কার্যত কিছু করতে পারেনি। বিএনপির নেতাকর্মীরা রাজপথে নামেনি। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিএনপির ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পুরোপুরি ফ্লপ হয়েছে। দলীয় এ নাজুক অবস্থা অনুধাবন করে বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ক্ষেত্রে অনেকটা নমনীয় হয়ে সর্বশেষ শেখ হাসিনা বাদে অন্য কাউকে সর্বদলীয় সরকারের প্রধান করা হলে তা মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মানসিকতা দেখিয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও একটি বড় রাজনৈতিক দল। বিগত সময়ের সংসদ নির্বাচনে এ দুই দলেরই প্রাপ্ত ভোটের হার চল্লিশ শতাংশের ওপরে। বিএনপি ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। বিএনপির অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে এক প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। ভারত ব্যতিরেকে অনেক বিদেশী রাষ্ট্র নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেসব রাষ্ট্র মনোভাব পাল্টাতে শুরু করেছে। নির্বাচন প্রশ্নে চীন, কোরিয়া, জাপানের মনোভাব পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেসব দেশ সফরে গিয়ে বর্তমানে তার নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার বিষয়টি ঘষামাজা করে ঠিক করে ফেলেছেন। বলা যায়, নির্বাচন প্রশ্নে এখনও নেতিবাচক মনোভাব অটুট রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা, মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপন করেই যাচ্ছেন। এমনকি ড্যান মজিনার যিনি স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন, মার্শিয়া বার্নিকাটও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি আশা করেছিল, তারা দেশী-বিদেশী চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার অধীনে নতুন করে নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হবে। তাদের এ আশা যে অচিরেই পূরণ হবে, তারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো বৃহৎ রাষ্ট্র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নে কঠোর মনোভাব বজায় রাখেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে। তারা আগামী সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানাচ্ছেন। হিসাব অনুযায়ী আগামী সংসদ নির্বাচন হতে আরও চার বছর বাকি, তাই সরকার এ বিষয়ে এখনই তাগিদ বোধ করছে না। সময় হলে এ নিয়ে তারা সংলাপ শুরু করতে পারে। আবার সেই সংলাপে যে বিএনপির দাবির প্রতিফলন ঘটবে, তেমন আশা ক্ষীণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘নির্বাচনকালীন সরকারে’ যোগ দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তকে যারা সঠিক বলে মনে করেন তাদের ধারণা, ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও বিজয় নিশ্চিত ছিল না। অন্তত বিএনপি জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ের ক্ষেত্রে সরকারপ্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াত। ফলে বিএনপি জোটের সরকার গঠনের ভাবনা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। এ মতের সমর্থকদের আরও ধারণা, আওয়ামী লীগ কমপক্ষে ১৫১ আসনে বিজয় নিশ্চিত করতে সব ধরনের ক্যারিকেচার করত। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিপরিষদে বিরোধী দলের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে যতই চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করা হোক, প্রশাসনিক শক্তি ও গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য আর কেউ হতে পারেন না। এ অবস্থায় নির্বাচনে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে, তা নিয়ে নির্ভাবনায় থাকা যায় না। বিএনপি নিশ্চয় এ উপলব্ধি থেকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে না পারলেও বর্জন করার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে করছে। বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গণতন্ত্রের নামে যেভাবেই হোক রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া এবং ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতায় স্থায়ী হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করা। রাজনীতির এ খেলায় আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। তারা সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার নামে দায়সারা গোছের নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে সরকারের সাংবিধানিক মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ করতে চাচ্ছে। এ লক্ষ্যে সরকার নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপির দেশী-বিদেশী সব ধরনের পরিকল্পনা ব্যর্থ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিগত এক বছরে বিএনপি কয়েক দফায় আন্দোলন কর্মসূচি দিলেও তা হালে পানি পায়নি। সরকার বরং বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা অব্যাহত রেখে তাদের দৌড়ের ওপর রেখেছে। বিদেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ভালো আছে।
পরিশেষে বলা যায়, নির্বাচনোত্তর পরিবেশ-পরিস্থিতি এখন সরকারের অনুকূলে। এ পরিবেশ দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। বিএনপি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়েছে। ভালো কী মন্দ কিংবা স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যা-ই হোক না কেন, বর্তমান সরকারের যদি হঠাৎ বিদায় ঘটে বা বিএনপির দাবি মেনে নিয়ে সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়, সেক্ষেত্রে নির্বাচন বর্জনের বিএনপির সিদ্ধান্ত সঠিক বলে গণ্য হতে পারে। লক্ষণীয়, ধারণাগত দিক দিয়ে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও সরকার বিএনপিকে কোণঠাসা অবস্থায় রেখে প্রমাণ করতে চলেছে, নির্বাচন বর্জন বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তবে ইতিহাস এখানে কী সাক্ষ্য দেবে, তা দূর ভবিষ্যতে বলা যাবে।
আহমেদ সুমন : গবেষক, বিশ্লেষক
No comments