স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়া একজন গোলাপ বানু by সুজয় মহাজন
(অভাবী
নারীদের নিয়ে মুঠো মুঠো চাল জমিয়ে স্বপ্নের শুরু করেছিলেন তিনি। সেই
সমিতির পুঁজি এখন ছাড়িয়ে গেছে শতকোটি টাকা। রাজধানীর ভাটারায় সমিতির
নিজস্ব জমিতে গড়ে তোলা কার্যালয়ের সামনে শুরুর স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়া
গোলাপ বানু l প্রথম আলো) মানুষ
তাঁর স্বপ্নের সমান বড়। কথাটা সব সময় বলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের
প্রতিষ্ঠাতা আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
চেষ্টা, কর্মস্পৃহা ও ইচ্ছাশক্তিই স্বপ্ন দেখা মানুষকে তাঁর স্বপ্নের
কাছাকাছি নিয়ে যায়। তবে এ বছর বেগম রোকেয়া পদক বিজয়ী গোলাপ বানুর
জীবনের গল্পটি যেন স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যাওয়া বাস্তব এক চরিত্র। জীবনযুদ্ধ
করতে করতেই যেন তিনি হয়ে উঠেছেন স্বপ্নের চেয়েও বড়।
নারী উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় অসামান্য অবদানের জন্য স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ ডিসেম্বর গোলাপ বানুর গলায় পরিয়ে দিয়েছেন বেগম রোকেয়া পদক।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ছোঁয়া না পাওয়া গোলাপ বানু (৬০) এখন হাজারো নারীর স্বপ্ন দেখার চোখ। অনেকের কাছে প্রেরণাও। অভাবী নারীদের নিয়ে প্রতিদিনের রান্নার চাল থেকে জমানো মুঠো চাল দিয়ে সঞ্চয়ের শুরু। এরপর সমবায় সমিতি গড়ে তা শতকোটিতে নিয়ে যাওয়া। সত্যিই স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যাওয়া। গোলাপ বানুর সেই সমিতির নাম ‘বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি’।
সংগ্রামী জীবন: গরিব কৃষক বাবার ঘরে জন্ম গোলাপ বানুর। বাবা রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বাজারে গিয়ে কৃষিপণ্য বেচতেন। মাথায় করে সেসব পণ্য বাজারে নিয়ে যেতেন গোলাপ বানুও। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে এক মাসের স্কুলযাত্রা আর ছয় মাসের বয়স্ক শিক্ষা। গোলাপ বানু বলেন, ‘বড় ভাই একদিন পড়াতে বসালেন। বহু চেষ্টার পরও “অ” উচ্চারণটা ঠিকভাবে করতে পারিনি। তাই খেপে গিয়ে থাপড় দিলেন। তখন বাবা বললেন, আমার মেয়ে তো বড় হয়ে জজ-ব্যারিস্টার হবে না। স্বামীর সংসারে গিয়ে কাজ করবে। তাই তার স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। এরপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি।’
মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় গোলাপ বানুর। অভাবকে সঙ্গী করে রাজমিস্ত্রি স্বামীর সঙ্গে শুরু করেন সংসার। বিয়ের চার বছরের মাথায় প্রথম মেয়ের জন্ম। তারপর স্বামী উধাও। মেয়েকে নিয়ে ফিরলেন বাবার সংসারে। বাবার সংসারে বোঝা হয়ে না থেকে একটি চটের কারখানায় চাকরি নিলেন। এক বছর পর স্বামীর খোঁজ পেলেন। বাবার অমতে স্বামীর কাছে চলে গেলেন। আবার শুরু করলেন কষ্টের সংসার। একপর্যায়ে মন গলে বাবারও। রাজধানীর ভাটারার নুরের চালায় নিজের জমিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন মেয়েকে। সংগ্রামের কথা স্মরণ করে গোলাপ বানু বলেন, ‘ছনের কুঁড়েঘরে বৃষ্টি হইলেই পানি পড়ত। মুরগি যেমন তার পালকের নিচে ছানা আগলে রাখে, আমিও ওপরে পলিথিন দিয়া ছোট ছোট চার ছেলেমেয়েরে আগলে রাখতাম, যাতে ভিইজ্যা না যায়।’
সমিতির জন্মকথা: ১৯৮৯ সালে নুরেরচালা এলাকার অভাবী পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার উদ্যোগ নেয় একটি বেসরকারি সংস্থা। গোলাপ বানুর ছেলেও সেখানে যায়। সে সময় ওই সংস্থার তৎকালীন মাঠ কর্মকর্তা নিত্য অধিকারী (বর্তমানে বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপক) গোলাপ বানুর মতো অভাবী নারীদের জন্য বয়স্কশিক্ষার পাশাপাশি সমবায় সমিতি গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রতি দলে ২০ জন করে পাঁচটি দলের ১০০ সদস্য নিয়ে ১৯৯২ সাল থেকে দলভিত্তিক সমবায় কার্যক্রম শুরু করেন গোলাপ বানুরা। ১৯৯৪ সালে তাঁদের নিয়ে গঠিত হয় ‘বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি’। শুরুতে প্রত্যেক সদস্য মাসে ৫০ টাকা করে জমা দেবেন বলে ঠিক হয়। কিন্তু এই ৫০ টাকা জোগাড় করাও তাঁদের জন্য কঠিন ছিল। পথ বাতলে দিলেন নিত্য অধিকারী। রান্নার চাল থেকে দু-এক মুঠো চাল আলাদা করে জমিয়ে তা বিক্রি করে টাকা জোগাড়ের পরামর্শ দেন। পরামর্শটি মনে ধরল অনেকেরই। টাকা জমাতে থাকলেন গোলাপ বানুরা। ১৯৯৭ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাটি এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তখন নতুনভাবে সমিতির কার্যক্রম শুরু হয়। গোলাপ বানু হন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। নিত্য অধিকারী বলেন, ‘আমি যে সংস্থাটিতে কাজ করতাম সেটি এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও গোলাপ বানু এবং অন্যরা মিলে আমাকে রেখে দেন। সেই থেকে আমি এ সমিতির ব্যবস্থাপক।’
সমিতি গড়ার শুরুতে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়েছে গোলাপ বানুকে। ‘সমিতি করতে গিয়া পাড়ার মানুষেরও কথা শুনছি। তবে যারা বাধা দিত, তারাই একসময় সমিতি থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করে’, বললেন গোলাপ বানু। সমিতি ও তাঁর আজকের অবস্থানে উঠে আসার পেছনে নিত্য অধিকারীর অবদানের কথাটিও কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করলেন তিনি।
সমিতির কার্যক্রম: নুরের চালা এলাকায় ১০০ সদস্য আর পাঁচ হাজার টাকার মূলধন নিয়ে শুরু করা বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির এখন নিজস্ব জমিতে সাড়ে ছয়তলা ভবন। মূলধন ১৭০ কোটি টাকা। সদস্যসংখ্যা ৪৩ হাজারের বেশি। ব্যবস্থাপক নিত্য অধিকারী জানান, ১৭০ কোটি টাকার মূলধনের মধ্যে প্রায় ১৫০ কোটি টাকায় এখন ঋণ হিসেবে সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বাকি টাকা নগদ ও বিভিন্ন সম্পদে বিনিয়োগ রয়েছে।
সমিতির নামে গাজীপুরেও সাড়ে ১৬ বিঘা জমি রয়েছে। তার মধ্যে কিছু জায়গায় প্লট বানিয়ে সদস্যদের দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর ভাটারা, বাড্ডা, গুলশান, উত্তরা, খিলক্ষেত ও ক্যান্টনমেন্টসহ ছয়টি থানায় সমিতি কাজ করছে। গাজীপুরেও সীমিত আকারে কাজ শুরু করেছে। সঞ্চয় ও ঋণ দেওয়া ছাড়াও রাজধানীতে ছয়টি বয়স্কশিক্ষার স্কুল পরিচালনাসহ ১১ ধরনের কাজ করছে সমিতি।
সমিতির সদস্যদের নির্বাচিত ১২ জন প্রতিনিধির মাধ্যমে চলে এর কার্যক্রম। সমিতিতে কর্মরত আছেন ৭১ জন। মাসে গড়ে লেনদেন হয় প্রায় ১০ কোটি টাকা।
গোলাপ বানুর চার ছেলেমেয়ে। বিয়ে হয়ে গেছে সবার। অভাবের কারণে ছেলেমেয়েদেরও খুব বেশি পড়াতে পারেননি। স্বামী হাবিবুর রহমান রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। এখন ধর্মপ্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। একমাত্র ছেলেটি বেকার।
প্রতিদিন সমিতির নানা কাজে যুক্ত থাকলেও মাসিক সম্মানী নেন না গোলাপ বানু। সমিতির কর্মকর্তারা জানালেন, সপ্তাহে মাত্র দুদিন ৫০০ টাকা করে মোট এক হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হয় তাঁকে। এর বাইরে সমিতির পরিচালনা পর্ষদের সভা হলে তাতে উপস্থিতির জন্য পান ৫০০ টাকা। আর ব্যক্তিগতভাবে মুঠোফোন ব্যবহার করেন না বলে যোগাযোগের জন্য তাঁর বাড়ির মুঠোফোনে ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। গোলাপ বানু বলেন, ‘সমিতির টাকাগুলো অভাবী নারীদের সঞ্চয়। আমি তার হেফাজতকারী। বিশ্বাস ও সম্মান করে সদস্যরা আমাকে এ দায়িত্বে বসিয়েছেন। এ সম্মানের জন্য তো আমি কোনো অর্থ নিতে পারি না।’ তিনি জানালেন, সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে বাবার দেওয়া জায়গার ওপর তিনতলা বাড়ি করেছেন। ভাড়া দিয়ে তা থেকে মাসে ৩০ হাজার টাকার মতো পান। তা দিয়েই চলে সংসার।
সমিতিতেই নিজের ছেলেকে চাকরি দেওয়ার সুযোগ আছে গোলাপ বানুর। সেটি করছেন না কেন? জানতে চাইলে তাঁর সরল জবাব, ‘সেটি কখনোই করব না। আমি তো মা। ছেলেকে নিজের সমিতিতে চাকরি দেওয়ার পর ছেলে যদি কোনো অপরাধ করে, তাহলে তার বিচার করব কীভাবে? যদি ছেলের সঠিক বিচার করতে না পারি তাহলে আমার সম্পর্কে সদস্যদের ধারণা নষ্ট হবে, সমিতির ক্ষতি হবে। আমাকে যে সম্মান সদস্যরা দিয়েছেন, সেটির অমর্যাদা করতে চাই না।’
স্বীকৃতি: বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি ২০০২ ও ২০০৯ সালে সরকারিভাবে শ্রেষ্ঠ মহিলা সমবায় সমিতি নির্বাচিত হয়। আর গোলাপ বানু ২০১০ সালে জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ সমবায়ী নির্বাচিত হন। এ ছাড়া দেশ-বিদেশে একাধিক পুরস্কার পেয়েছে এই সমিতি।
নতুন স্বপ্ন: সমিতির সদস্যদের জন্য একটি বৃদ্ধাশ্রম আর সন্তানদের জন্য একটি স্কুল গড়ার স্বপ্ন দেখেন গোলাপ বানু। কিন্তু সমিতির আওতাভুক্ত এলাকায় এমন জায়গা পাওয়া কঠিন। তাই এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তাও রয়েছে তাঁর। সরকারের সহায়তা চান কি না, জবাবে গোলাপ বানু বললেন, ‘সরকারের কাছে চাইলে হয়তো কিছু জমির ব্যবস্থা হবে। সে জন্য হয়তো কাউকে উচ্ছেদ করা হবে। আমি তো কারও কপালে লাথি মেরে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই না।’
গোলাপ বানুর জীবনের জয়গান প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বললেন, শুধু স্বপ্ন দিয়ে তিনি আজকের অবস্থানে আসতে পারতেন না, যদি কাজ ও উদ্যমকে স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারতেন। কিন্তু গোলাপ বানু সেটি পেরেছেন, তাই তিনি বিজয়ী।
নারী উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় অসামান্য অবদানের জন্য স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ ডিসেম্বর গোলাপ বানুর গলায় পরিয়ে দিয়েছেন বেগম রোকেয়া পদক।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ছোঁয়া না পাওয়া গোলাপ বানু (৬০) এখন হাজারো নারীর স্বপ্ন দেখার চোখ। অনেকের কাছে প্রেরণাও। অভাবী নারীদের নিয়ে প্রতিদিনের রান্নার চাল থেকে জমানো মুঠো চাল দিয়ে সঞ্চয়ের শুরু। এরপর সমবায় সমিতি গড়ে তা শতকোটিতে নিয়ে যাওয়া। সত্যিই স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যাওয়া। গোলাপ বানুর সেই সমিতির নাম ‘বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি’।
সংগ্রামী জীবন: গরিব কৃষক বাবার ঘরে জন্ম গোলাপ বানুর। বাবা রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বাজারে গিয়ে কৃষিপণ্য বেচতেন। মাথায় করে সেসব পণ্য বাজারে নিয়ে যেতেন গোলাপ বানুও। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে এক মাসের স্কুলযাত্রা আর ছয় মাসের বয়স্ক শিক্ষা। গোলাপ বানু বলেন, ‘বড় ভাই একদিন পড়াতে বসালেন। বহু চেষ্টার পরও “অ” উচ্চারণটা ঠিকভাবে করতে পারিনি। তাই খেপে গিয়ে থাপড় দিলেন। তখন বাবা বললেন, আমার মেয়ে তো বড় হয়ে জজ-ব্যারিস্টার হবে না। স্বামীর সংসারে গিয়ে কাজ করবে। তাই তার স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। এরপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি।’
মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় গোলাপ বানুর। অভাবকে সঙ্গী করে রাজমিস্ত্রি স্বামীর সঙ্গে শুরু করেন সংসার। বিয়ের চার বছরের মাথায় প্রথম মেয়ের জন্ম। তারপর স্বামী উধাও। মেয়েকে নিয়ে ফিরলেন বাবার সংসারে। বাবার সংসারে বোঝা হয়ে না থেকে একটি চটের কারখানায় চাকরি নিলেন। এক বছর পর স্বামীর খোঁজ পেলেন। বাবার অমতে স্বামীর কাছে চলে গেলেন। আবার শুরু করলেন কষ্টের সংসার। একপর্যায়ে মন গলে বাবারও। রাজধানীর ভাটারার নুরের চালায় নিজের জমিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন মেয়েকে। সংগ্রামের কথা স্মরণ করে গোলাপ বানু বলেন, ‘ছনের কুঁড়েঘরে বৃষ্টি হইলেই পানি পড়ত। মুরগি যেমন তার পালকের নিচে ছানা আগলে রাখে, আমিও ওপরে পলিথিন দিয়া ছোট ছোট চার ছেলেমেয়েরে আগলে রাখতাম, যাতে ভিইজ্যা না যায়।’
সমিতির জন্মকথা: ১৯৮৯ সালে নুরেরচালা এলাকার অভাবী পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার উদ্যোগ নেয় একটি বেসরকারি সংস্থা। গোলাপ বানুর ছেলেও সেখানে যায়। সে সময় ওই সংস্থার তৎকালীন মাঠ কর্মকর্তা নিত্য অধিকারী (বর্তমানে বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপক) গোলাপ বানুর মতো অভাবী নারীদের জন্য বয়স্কশিক্ষার পাশাপাশি সমবায় সমিতি গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রতি দলে ২০ জন করে পাঁচটি দলের ১০০ সদস্য নিয়ে ১৯৯২ সাল থেকে দলভিত্তিক সমবায় কার্যক্রম শুরু করেন গোলাপ বানুরা। ১৯৯৪ সালে তাঁদের নিয়ে গঠিত হয় ‘বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি’। শুরুতে প্রত্যেক সদস্য মাসে ৫০ টাকা করে জমা দেবেন বলে ঠিক হয়। কিন্তু এই ৫০ টাকা জোগাড় করাও তাঁদের জন্য কঠিন ছিল। পথ বাতলে দিলেন নিত্য অধিকারী। রান্নার চাল থেকে দু-এক মুঠো চাল আলাদা করে জমিয়ে তা বিক্রি করে টাকা জোগাড়ের পরামর্শ দেন। পরামর্শটি মনে ধরল অনেকেরই। টাকা জমাতে থাকলেন গোলাপ বানুরা। ১৯৯৭ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাটি এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তখন নতুনভাবে সমিতির কার্যক্রম শুরু হয়। গোলাপ বানু হন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। নিত্য অধিকারী বলেন, ‘আমি যে সংস্থাটিতে কাজ করতাম সেটি এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও গোলাপ বানু এবং অন্যরা মিলে আমাকে রেখে দেন। সেই থেকে আমি এ সমিতির ব্যবস্থাপক।’
সমিতি গড়ার শুরুতে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়েছে গোলাপ বানুকে। ‘সমিতি করতে গিয়া পাড়ার মানুষেরও কথা শুনছি। তবে যারা বাধা দিত, তারাই একসময় সমিতি থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করে’, বললেন গোলাপ বানু। সমিতি ও তাঁর আজকের অবস্থানে উঠে আসার পেছনে নিত্য অধিকারীর অবদানের কথাটিও কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করলেন তিনি।
সমিতির কার্যক্রম: নুরের চালা এলাকায় ১০০ সদস্য আর পাঁচ হাজার টাকার মূলধন নিয়ে শুরু করা বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির এখন নিজস্ব জমিতে সাড়ে ছয়তলা ভবন। মূলধন ১৭০ কোটি টাকা। সদস্যসংখ্যা ৪৩ হাজারের বেশি। ব্যবস্থাপক নিত্য অধিকারী জানান, ১৭০ কোটি টাকার মূলধনের মধ্যে প্রায় ১৫০ কোটি টাকায় এখন ঋণ হিসেবে সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বাকি টাকা নগদ ও বিভিন্ন সম্পদে বিনিয়োগ রয়েছে।
সমিতির নামে গাজীপুরেও সাড়ে ১৬ বিঘা জমি রয়েছে। তার মধ্যে কিছু জায়গায় প্লট বানিয়ে সদস্যদের দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর ভাটারা, বাড্ডা, গুলশান, উত্তরা, খিলক্ষেত ও ক্যান্টনমেন্টসহ ছয়টি থানায় সমিতি কাজ করছে। গাজীপুরেও সীমিত আকারে কাজ শুরু করেছে। সঞ্চয় ও ঋণ দেওয়া ছাড়াও রাজধানীতে ছয়টি বয়স্কশিক্ষার স্কুল পরিচালনাসহ ১১ ধরনের কাজ করছে সমিতি।
সমিতির সদস্যদের নির্বাচিত ১২ জন প্রতিনিধির মাধ্যমে চলে এর কার্যক্রম। সমিতিতে কর্মরত আছেন ৭১ জন। মাসে গড়ে লেনদেন হয় প্রায় ১০ কোটি টাকা।
গোলাপ বানুর চার ছেলেমেয়ে। বিয়ে হয়ে গেছে সবার। অভাবের কারণে ছেলেমেয়েদেরও খুব বেশি পড়াতে পারেননি। স্বামী হাবিবুর রহমান রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। এখন ধর্মপ্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। একমাত্র ছেলেটি বেকার।
প্রতিদিন সমিতির নানা কাজে যুক্ত থাকলেও মাসিক সম্মানী নেন না গোলাপ বানু। সমিতির কর্মকর্তারা জানালেন, সপ্তাহে মাত্র দুদিন ৫০০ টাকা করে মোট এক হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হয় তাঁকে। এর বাইরে সমিতির পরিচালনা পর্ষদের সভা হলে তাতে উপস্থিতির জন্য পান ৫০০ টাকা। আর ব্যক্তিগতভাবে মুঠোফোন ব্যবহার করেন না বলে যোগাযোগের জন্য তাঁর বাড়ির মুঠোফোনে ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। গোলাপ বানু বলেন, ‘সমিতির টাকাগুলো অভাবী নারীদের সঞ্চয়। আমি তার হেফাজতকারী। বিশ্বাস ও সম্মান করে সদস্যরা আমাকে এ দায়িত্বে বসিয়েছেন। এ সম্মানের জন্য তো আমি কোনো অর্থ নিতে পারি না।’ তিনি জানালেন, সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে বাবার দেওয়া জায়গার ওপর তিনতলা বাড়ি করেছেন। ভাড়া দিয়ে তা থেকে মাসে ৩০ হাজার টাকার মতো পান। তা দিয়েই চলে সংসার।
সমিতিতেই নিজের ছেলেকে চাকরি দেওয়ার সুযোগ আছে গোলাপ বানুর। সেটি করছেন না কেন? জানতে চাইলে তাঁর সরল জবাব, ‘সেটি কখনোই করব না। আমি তো মা। ছেলেকে নিজের সমিতিতে চাকরি দেওয়ার পর ছেলে যদি কোনো অপরাধ করে, তাহলে তার বিচার করব কীভাবে? যদি ছেলের সঠিক বিচার করতে না পারি তাহলে আমার সম্পর্কে সদস্যদের ধারণা নষ্ট হবে, সমিতির ক্ষতি হবে। আমাকে যে সম্মান সদস্যরা দিয়েছেন, সেটির অমর্যাদা করতে চাই না।’
স্বীকৃতি: বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি ২০০২ ও ২০০৯ সালে সরকারিভাবে শ্রেষ্ঠ মহিলা সমবায় সমিতি নির্বাচিত হয়। আর গোলাপ বানু ২০১০ সালে জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ সমবায়ী নির্বাচিত হন। এ ছাড়া দেশ-বিদেশে একাধিক পুরস্কার পেয়েছে এই সমিতি।
নতুন স্বপ্ন: সমিতির সদস্যদের জন্য একটি বৃদ্ধাশ্রম আর সন্তানদের জন্য একটি স্কুল গড়ার স্বপ্ন দেখেন গোলাপ বানু। কিন্তু সমিতির আওতাভুক্ত এলাকায় এমন জায়গা পাওয়া কঠিন। তাই এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তাও রয়েছে তাঁর। সরকারের সহায়তা চান কি না, জবাবে গোলাপ বানু বললেন, ‘সরকারের কাছে চাইলে হয়তো কিছু জমির ব্যবস্থা হবে। সে জন্য হয়তো কাউকে উচ্ছেদ করা হবে। আমি তো কারও কপালে লাথি মেরে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই না।’
গোলাপ বানুর জীবনের জয়গান প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বললেন, শুধু স্বপ্ন দিয়ে তিনি আজকের অবস্থানে আসতে পারতেন না, যদি কাজ ও উদ্যমকে স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারতেন। কিন্তু গোলাপ বানু সেটি পেরেছেন, তাই তিনি বিজয়ী।
No comments