বিরোধী রাজনীতির নতুন চ্যালেঞ্জ by ফরহাদ মজহার
জানুয়ারির ৫ তারিখকে কেন্দ্র করে
রাজনীতিতে সহিংসতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে বকশিবাজারের ঘটনা আমরা
দেখেছি। গাজীপুরে বদরে আলম কলেজ মাঠে বিএনপির সভা ২৭ তারিখে, এদিন এই
লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার কথা। গতকাল সেখানে লাঠিমিছিল করেছে যুবলীগ ও
ছাত্রলীগ। তারা ঘোষণা দিয়েছে, যে কোনো মূল্যে তারা এই সভা প্রতিহত করবে।
একই দিনে একই জায়গায় তারা তাদের সমাবেশ করবে। বিএনপি আগেই অনুমতি চেয়েছে
বলে মেয়র জানিয়েছেন, কারণ তাদের সভা হওয়ার কথা ছিল ২৩ তারিখ, সেদিন শেখ
হাসিনা কাশিমপুর জেলের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বলে তারিখ বদল করা হয়েছিল ২৭
ডিসেম্বর। তার জন্য অনুমতিও পেয়েছে। বিএনপি বলেছে, তারা যে কোনো মূল্যে ২৭
তারিখে গাজীপুরে সভা করবে। খালেদা জিয়া অবশ্য এর আগে স্পষ্ট বলেছেন, তার
রাজনীতি হবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক। পত্রিকা থেকে জেনেছি, সাতাশ
তারিখ সকালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানের বাসা থেকে গাজীপুরে
জনসভার উদ্দেশে রওনা হবেন। তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারাসহ ঢাকা মহানগর
বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মীও সঙ্গী হবেন। যেখানে বাধা আসবে, সেখানেই তারা
সমাবেশ করবেন।
দলীয় নেতাকর্মীদের এই দিকনির্দেশনা মেনে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের সশস্ত্র হামলার মোকাবেলা বিএনপি কীভাবে করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ক্ষমতাসীনদের জন্য রাজনীতির এই পর্যায়ে বিএনপির কর্মসূচি সশস্ত্রভাবে মোকাবেলা ঝুঁকিপূর্ণ। বকশিবাজারের ঘটনা যারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা জানেন যে বিএনপির দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ হলে সাধারণ মানুষ বিএনপির পক্ষে জড়িয়ে পড়ত। একে সামাল দেয়া ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়ন, সহিংসতা ও রক্তপাত মানুষ পছন্দ করছে না। বিএনপি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে এটা মানুষ যেমন বিশ্বাস করে না, তেমনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে শেখ হাসিনার পতন ঘটানো যাবে, সেটাও মনে করে না। অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। ফলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বিএনপি বর্তমান শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্তি দিক।
অথচ ক্ষমতাসীনরাও জানে বিএনপি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে এখন বাধ্য। এর সুযোগও পুরা মাত্রায় তারা নেবে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তি বারবারই যে পরামর্শ তাদের স্বার্থের অনুকূল দলগুলোকে দিয়ে থাকে সেটা হল, আন্দোলন ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাবহির্ভূত যাদেরই হোক, রাজনীতি ও ক্ষমতা সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট দলগুলোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট রাজনৈতিক দলের বাইরে আন্দোলন উপচে পড়ুক এটা কোনো পরাশক্তি চাইবে না, তাদের নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও। উপচে পড়লে বাংলাদেশে বিরাট কিছু ঘটে যাবে, তা না। সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট দলগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও ক্ষমতার ভারসাম্যে যে অনিশ্চয়তা সেটা কোনো পরাশক্তিই নতুন করে মোকাবেলা করতে চায় না। তাছাড়া হাজার হোক ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত উভয় পক্ষেই তাদের দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ রয়েছে। অতএব আন্দোলন যেন কখনোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় সেটা তারা কূটনৈতিকভাবে নিশ্চিত করতে সব সময়ই আগ্রহী। বিএনপির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের উত্থান-পতন এই কূটনৈতিক চাপের দ্বারাই নির্ধারিত। এই দিকটি বোঝার দরকার আছে।
সারমর্মে কূটনৈতিক ফর্মুলা হচ্ছে, ক্ষমতাবহির্ভূত রাজনৈতিক আন্দোলন যেন নিছকই ক্ষমতা হস্তান্তরের আন্দোলনে সীমিত থাকে। ক্ষমতার চরিত্রে কোনো সংস্কার বা রূপান্তর দূরে থাকুক- কোনোভাবেই বর্তমান চরিত্রে কোনো হেরফের যেন না হয় সেটা নিশ্চিত করতেই সব পরাশক্তি আগ্রহী। যে কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কে তাদের কোনো অবস্থান নেই। আন্দোলন করতে গিয়ে মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম কোনো রাজনীতির জন্ম যেন না ঘটে। ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার সংস্কার করে তাকে উদার গণতান্ত্রিক ক্ষমতায় রূপান্তরও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এক বিশাল বৈপ্লবিক কাজ। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি বিএনপির পক্ষে সম্ভব? উদার গণতন্ত্রকে গণশক্তিতে রূপান্তর তো আরও কঠিন ও দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ব্যাপার। কিন্তু সেটা তো পরের কথা। সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের পক্ষে ইতিবাচক কিছু অর্জন অসম্ভব।
কূটনৈতিক পাড়ার অসম ফর্মুলা মেনে বিএনপি আন্দোলন করলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অবক্ষয় নিশ্চিত। ক্ষমতাসীনদের ক্যাডাররা বিএনপিকে শুধু সশস্ত্রভাবেই মোকাবেলা করছে না, তাদের হাতে প্রশাসন, পুলিশ, এমনকি বিচার বিভাগ রয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে বিএনপি কি শুধু পাল্টা মার খেয়ে যাবে, নাকি নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হবে সেটা আগাম বলা যাচ্ছে না।
বলাবাহুল্য, বল প্রয়োগ অবশ্যই রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য বিষয়। বিশুদ্ধ আহাম্মক ছাড়া এটা কেউই অবিশ্বাস করে না। এগুলো রাষ্ট্র গঠন ও রাজনীতির গোড়ার কথা। গণতান্ত্রিক কন্সটিটিউশন ও তার ওপর দাঁড়ানো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা গেলে আইনের শাসন (অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন ও বিচারব্যবস্থার শাসন), নিয়মতান্ত্রিকতা (অর্থাৎ নাগরিকদের গণতান্ত্রিক বিধিবিধান মেনে চলা), শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ইত্যাদি অর্থপূর্ণ হতে পারে। কারণ গণতন্ত্র কায়েম থাকা অবস্থায় নিয়ম না মানা বা সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের অর্থ হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার বিধিবিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার রক্ষার নীতি ও বিধানের ওপর দাঁড়ায় না, নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে লাঠি-গুলি দিয়ে দমন করে, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রুদ্ধ করে হত্যা-গুম-খুন যেখানে নিত্যদিনের কারবার, সেখানে রাজনীতি নির্ধারণ করতে সক্ষম যে কোনো পাল্টা বল প্রয়োগ গাঠনিক (constitutive) অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য অবশ্যই দরকার। এটা বিএনপি করুক বা না করুক, যারা সমাজ, রাজনীতি, আইন, ইতিহাস ইত্যাদি বিজ্ঞান হিসেবে পাঠ করেন, তাদের কাছে পরিষ্কার। এখন বিএনপি কী করবে বা কী করতে সক্ষম সেটা তাদের ব্যাপার। খালেদা জিয়ার নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে আমরা কৌশলগত নাকি নীতিগত অবস্থান হিসেবে পাঠ করব সেটা আগামী দিনে বিএনপির রাজনীতি দেখেই আমরা বুঝব।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা থেকে যারা উত্তরণ চান তাদের কাছে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটা পরিষ্কার। বৈপ্লবিক চিন্তা-ভাবনার আলোকে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংস্কার কোথায়, কীভাবে করতে হবে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তির পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান বোঝাতে কীভাবে আমরা সক্ষম হব সেই পথের সন্ধানই সঠিক পথ। বাংলাদেশের বৈপ্লবিক রূপান্তরের স্বপ্ন আমাদের দেখতে হবে। তরুণদের তো অবশ্যই। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপ্লবের নামে কোনো অবাস্তব ও গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির দিবাস্বপ্ন আমাদের কোথাও নেবে না। কুয়ার মধ্যে পড়া ছাড়া। নজর মাটির দিকেই রাখতে হবে, আকাশে না। যে রাজনীতি বা যে চিন্তা বাস্তবায়নের বাস্তব পদক্ষেপ আমাদের জানা নেই বা আমরা ভাবতে সক্ষম না, সেই চিন্তা শিশুর হাতে বেলুন দিয়ে সুতা ধরে রাখার কোনো অর্থ নেই। এটা ফাটবেই। একে ছেড়ে দিন, উড়ে যাক। যে চিন্তার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সম্পর্ক রচনা কঠিন বা অসম্ভব তেমন বিমূর্ত বাসনাকে চেনা ও পরিহার করাই এখনকার কাজ।
বৈপ্লবিক চিন্তা-ভাবনা এবং বাস্তব অবস্থায় বাস্তবিক পদক্ষেপ হিসেবে তাকে প্রয়োগের শিক্ষা আমাদের দরকার। সেই পদক্ষেপ সংস্কারমূলক বা বিপ্লবী কিনা সেটা হাওয়াই স্লোগান দিয়ে বোঝা যাবে না। কংক্রিট বাস্তব চিন্তা ও পদক্ষেপ দেখেই সাধারণ মানুষ চিনবে। কিন্তু বাস্তব চিন্তা ও কর্মসূচি বইপুস্তকে পাওয়া যাবে না। বাস্তবতার বিচার করেই তা নির্ণয় করতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্য ছয় দফা দিয়েছিলেন। এটা তো কোনো বিপ্লবী দাবি ছিল না। অথচ সেটাই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়েছে। কী করে উদার ও সংস্কারবাদী দাবিও বৈপ্লবিক হয়ে ওঠে তার শিক্ষা নিজেদের ইতিহাস থেকেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
দুই
শেখ মুজিবুর পাকিস্তান ভাঙতে চাননি; এ কথা বহু বছর আগে বলে আমি নিন্দিত হয়েছি। তিনি মুসলিম লীগ করেছেন, পাকিস্তানের জন্য লড়েছেন। অথচ সেই মুজিবুরই স্বাধীন পাকিস্তানে বাঙালি হওয়ার জন্য লড়েছেন, ইসলাম বা মুসলমান হিসেবে তার ইতিহাস ও পরিচয় ভুলে গিয়ে নয়। এটাও জানতেন কলকাতার উচ্চ বর্ণের বাঙালির কাছে মুসলমানরা বাঙালি বলে স্বীকৃত ছিল না। ইতিহাসের বিচিত্র প্রহসন যে মুসলমানকে রক্ত দিয়ে বাঙালি হতে হয়েছে। জন্মসূত্রে তারা এই রাজনৈতিক পরিচয় লাভ করতে পারেনি। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে আরও অনেক কিছুই অনেকে এখন বুঝতে শিখছেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীনের রাজনীতি করেননি। তাজউদ্দীন তাকে জোর করলেও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। সবচেয়ে দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বিধিবিধান মেনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে। আমি সব সময়ই তার এই দূরদর্শিতার প্রশংসা করেছি। নিজেকে তিনি লেনিন, মাও সে তুং বা হো চি মিন মনে করেননি। মুসলিম লীগ করা ও সোহরাওয়ার্দীর কাছে পার্লামেন্টারি রাজনীতির শিক্ষা পাওয়া শেখ মুজিবই মনে করেছিলেন। ধরা দেয়ার সময়ও তার চিন্তা ও রাজনীতি নিজের চিন্তা-ভাবনার বাইরে যায়নি। শাসক হিসেবেই তার চিন্তার সীমাবদ্ধতা ধরা পড়তে শুরু করে। বাকশালী মুজিবের ইতিহাস ভিন্ন ইতিহাস।
তো আমাদের শিখতে হবে নিজেদের ইতিহাস থেকেই। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের জনগণের সমর্থন ও সহায়তা চেয়েছেন, কিন্তু দিল্লির দাসত্ব মেনে নেননি। শেখ হাসিনা তার পিতার রক্ত বহন করতে পারেন, কিন্তু তার রাজনীতির উত্তরাধিকারী নন। তিনি দিল্লির দাসত্ব মেনে ক্ষমতায় আছেন এবং মতাদর্শিকভাবে তাজউদ্দীনের পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করছেন। যে কারণে তার মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবুরের অনুসারীদের চেয়েও তথাকথিত পেটি বুর্জোয়া বামপন্থীদেরই দৌরাত্ম্য বেশি। তিনি নিজেকে নিজে লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন।
বৈপ্লবিক চিন্তা-ভাবনার আলোকে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংস্কার ও কর্মসূচি কী হতে পারে সে ব্যাপারে ব্যাপক আলাপ-আলোচনাই এখনকার কাজ। সেই রাজনীতি অন্বেষণই ফ্যাসিবাদবিরোধী সবার কর্তব্য। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের ইতিহাস যারা জানেন তারা সবাই শেখ হাসিনার হাতে গড়া বর্তমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছেন, এটা আমি মনে করি না। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। অন্যদিকে বিএনপি এমন কোনো নীতি বা কর্মসূচি হাজির করেনি যাতে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সব নাগরিক ঐক্যবদ্ধ হতে পারে বা বিরোধী রাজনীতির পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে ওঠে। সোজা কথায় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিএনপির ছয় দফা-জাতীয় কোনো সংস্কারমূলক কর্মসূচি নেই। এখানেই বিএনপির বিশাল বিপদের জায়গা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বোঝা দরকার, সশস্ত্র রাজনীতি বা সহিংসভাবে প্রতিপক্ষের সহিংসতা মোকাবেলায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক কোনো দল নিয়ে আমরা কথা বলছি না। আমরা কথা বলছি সেই দলটিকে নিয়ে যারা গণতন্ত্রের কথা বলে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। কেন পারেনি? সেটা কি কোনো তথাকথিত অগণতান্ত্রিক রাজনীতি বা শক্তির কারণে? মোটেও না। তাদের কারণেই গণতন্ত্র আজও সোনার হরিণ, যারা গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা বাকশাল কায়েম করে, একদলীয় শাসন কায়েম করতে গিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশের সংবিধানকে নিজ দলের দলিলে পরিণত করে। পঞ্চদশ সংশোধনী এ অবিশ্বাস্য উদাহরণ। গণবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগ তাদের কব্জায় থাকা রাষ্ট্রের সমূহ সশস্ত্র শক্তি ব্যবহার করে ক্ষান্ত থাকে না; রামদা, লগিবৈঠা, পিস্তল, কাটাবন্দুক মায় স্টেনগানসহ রাস্তায় সবার চোখের সামনে সশস্ত্রভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করে। রক্ত ঝরায় এবং প্রকাশ্যে রাস্তায় লাশ ফেলতে দ্বিধা করে না। ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যদি বলে যে তারা বিরোধী দলকে যেভাবেই হোক প্রতিহত করবে, তারা লগিবৈঠা, লাঠি-বন্দুক যেভাবেই হোক করবেই, তখন তারা ভয় দেখানোর জন্য বলে না। শেখ হাসিনার সামনে সশস্ত্রভাবে বিরোধী দলকে মোকাবেলা করা ছাড়া সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। তিনি রাজনীতিকে বারুদ, রক্তপাত ও লাশের স্তরে নিয়ে এসেছেন। এই পথ থেকে তার ফিরে যাওয়ার কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। অন্তত আমি দেখছি না। শেখ হাসিনা জানেন একটি দুর্বল বিরোধিতাও তাকে যে কোনো মুহূর্তে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। তিনি বিরোধীদলীয় কোনো কর্মকাণ্ডই তাই করতে দেবেন না। বাধ্য না হলে।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করে, বা কী করতে সক্ষম সেটাই এখন দেখার বিষয়।
দলীয় নেতাকর্মীদের এই দিকনির্দেশনা মেনে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের সশস্ত্র হামলার মোকাবেলা বিএনপি কীভাবে করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ক্ষমতাসীনদের জন্য রাজনীতির এই পর্যায়ে বিএনপির কর্মসূচি সশস্ত্রভাবে মোকাবেলা ঝুঁকিপূর্ণ। বকশিবাজারের ঘটনা যারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা জানেন যে বিএনপির দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ হলে সাধারণ মানুষ বিএনপির পক্ষে জড়িয়ে পড়ত। একে সামাল দেয়া ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়ন, সহিংসতা ও রক্তপাত মানুষ পছন্দ করছে না। বিএনপি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে এটা মানুষ যেমন বিশ্বাস করে না, তেমনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে শেখ হাসিনার পতন ঘটানো যাবে, সেটাও মনে করে না। অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। ফলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বিএনপি বর্তমান শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্তি দিক।
অথচ ক্ষমতাসীনরাও জানে বিএনপি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে এখন বাধ্য। এর সুযোগও পুরা মাত্রায় তারা নেবে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তি বারবারই যে পরামর্শ তাদের স্বার্থের অনুকূল দলগুলোকে দিয়ে থাকে সেটা হল, আন্দোলন ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাবহির্ভূত যাদেরই হোক, রাজনীতি ও ক্ষমতা সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট দলগুলোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট রাজনৈতিক দলের বাইরে আন্দোলন উপচে পড়ুক এটা কোনো পরাশক্তি চাইবে না, তাদের নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও। উপচে পড়লে বাংলাদেশে বিরাট কিছু ঘটে যাবে, তা না। সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট দলগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও ক্ষমতার ভারসাম্যে যে অনিশ্চয়তা সেটা কোনো পরাশক্তিই নতুন করে মোকাবেলা করতে চায় না। তাছাড়া হাজার হোক ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত উভয় পক্ষেই তাদের দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ রয়েছে। অতএব আন্দোলন যেন কখনোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় সেটা তারা কূটনৈতিকভাবে নিশ্চিত করতে সব সময়ই আগ্রহী। বিএনপির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের উত্থান-পতন এই কূটনৈতিক চাপের দ্বারাই নির্ধারিত। এই দিকটি বোঝার দরকার আছে।
সারমর্মে কূটনৈতিক ফর্মুলা হচ্ছে, ক্ষমতাবহির্ভূত রাজনৈতিক আন্দোলন যেন নিছকই ক্ষমতা হস্তান্তরের আন্দোলনে সীমিত থাকে। ক্ষমতার চরিত্রে কোনো সংস্কার বা রূপান্তর দূরে থাকুক- কোনোভাবেই বর্তমান চরিত্রে কোনো হেরফের যেন না হয় সেটা নিশ্চিত করতেই সব পরাশক্তি আগ্রহী। যে কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কে তাদের কোনো অবস্থান নেই। আন্দোলন করতে গিয়ে মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম কোনো রাজনীতির জন্ম যেন না ঘটে। ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার সংস্কার করে তাকে উদার গণতান্ত্রিক ক্ষমতায় রূপান্তরও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এক বিশাল বৈপ্লবিক কাজ। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি বিএনপির পক্ষে সম্ভব? উদার গণতন্ত্রকে গণশক্তিতে রূপান্তর তো আরও কঠিন ও দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ব্যাপার। কিন্তু সেটা তো পরের কথা। সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের পক্ষে ইতিবাচক কিছু অর্জন অসম্ভব।
কূটনৈতিক পাড়ার অসম ফর্মুলা মেনে বিএনপি আন্দোলন করলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অবক্ষয় নিশ্চিত। ক্ষমতাসীনদের ক্যাডাররা বিএনপিকে শুধু সশস্ত্রভাবেই মোকাবেলা করছে না, তাদের হাতে প্রশাসন, পুলিশ, এমনকি বিচার বিভাগ রয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে বিএনপি কি শুধু পাল্টা মার খেয়ে যাবে, নাকি নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হবে সেটা আগাম বলা যাচ্ছে না।
বলাবাহুল্য, বল প্রয়োগ অবশ্যই রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য বিষয়। বিশুদ্ধ আহাম্মক ছাড়া এটা কেউই অবিশ্বাস করে না। এগুলো রাষ্ট্র গঠন ও রাজনীতির গোড়ার কথা। গণতান্ত্রিক কন্সটিটিউশন ও তার ওপর দাঁড়ানো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা গেলে আইনের শাসন (অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন ও বিচারব্যবস্থার শাসন), নিয়মতান্ত্রিকতা (অর্থাৎ নাগরিকদের গণতান্ত্রিক বিধিবিধান মেনে চলা), শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ইত্যাদি অর্থপূর্ণ হতে পারে। কারণ গণতন্ত্র কায়েম থাকা অবস্থায় নিয়ম না মানা বা সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের অর্থ হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার বিধিবিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার রক্ষার নীতি ও বিধানের ওপর দাঁড়ায় না, নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে লাঠি-গুলি দিয়ে দমন করে, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রুদ্ধ করে হত্যা-গুম-খুন যেখানে নিত্যদিনের কারবার, সেখানে রাজনীতি নির্ধারণ করতে সক্ষম যে কোনো পাল্টা বল প্রয়োগ গাঠনিক (constitutive) অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য অবশ্যই দরকার। এটা বিএনপি করুক বা না করুক, যারা সমাজ, রাজনীতি, আইন, ইতিহাস ইত্যাদি বিজ্ঞান হিসেবে পাঠ করেন, তাদের কাছে পরিষ্কার। এখন বিএনপি কী করবে বা কী করতে সক্ষম সেটা তাদের ব্যাপার। খালেদা জিয়ার নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে আমরা কৌশলগত নাকি নীতিগত অবস্থান হিসেবে পাঠ করব সেটা আগামী দিনে বিএনপির রাজনীতি দেখেই আমরা বুঝব।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা থেকে যারা উত্তরণ চান তাদের কাছে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটা পরিষ্কার। বৈপ্লবিক চিন্তা-ভাবনার আলোকে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংস্কার কোথায়, কীভাবে করতে হবে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তির পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান বোঝাতে কীভাবে আমরা সক্ষম হব সেই পথের সন্ধানই সঠিক পথ। বাংলাদেশের বৈপ্লবিক রূপান্তরের স্বপ্ন আমাদের দেখতে হবে। তরুণদের তো অবশ্যই। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপ্লবের নামে কোনো অবাস্তব ও গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির দিবাস্বপ্ন আমাদের কোথাও নেবে না। কুয়ার মধ্যে পড়া ছাড়া। নজর মাটির দিকেই রাখতে হবে, আকাশে না। যে রাজনীতি বা যে চিন্তা বাস্তবায়নের বাস্তব পদক্ষেপ আমাদের জানা নেই বা আমরা ভাবতে সক্ষম না, সেই চিন্তা শিশুর হাতে বেলুন দিয়ে সুতা ধরে রাখার কোনো অর্থ নেই। এটা ফাটবেই। একে ছেড়ে দিন, উড়ে যাক। যে চিন্তার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সম্পর্ক রচনা কঠিন বা অসম্ভব তেমন বিমূর্ত বাসনাকে চেনা ও পরিহার করাই এখনকার কাজ।
বৈপ্লবিক চিন্তা-ভাবনা এবং বাস্তব অবস্থায় বাস্তবিক পদক্ষেপ হিসেবে তাকে প্রয়োগের শিক্ষা আমাদের দরকার। সেই পদক্ষেপ সংস্কারমূলক বা বিপ্লবী কিনা সেটা হাওয়াই স্লোগান দিয়ে বোঝা যাবে না। কংক্রিট বাস্তব চিন্তা ও পদক্ষেপ দেখেই সাধারণ মানুষ চিনবে। কিন্তু বাস্তব চিন্তা ও কর্মসূচি বইপুস্তকে পাওয়া যাবে না। বাস্তবতার বিচার করেই তা নির্ণয় করতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্য ছয় দফা দিয়েছিলেন। এটা তো কোনো বিপ্লবী দাবি ছিল না। অথচ সেটাই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়েছে। কী করে উদার ও সংস্কারবাদী দাবিও বৈপ্লবিক হয়ে ওঠে তার শিক্ষা নিজেদের ইতিহাস থেকেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
দুই
শেখ মুজিবুর পাকিস্তান ভাঙতে চাননি; এ কথা বহু বছর আগে বলে আমি নিন্দিত হয়েছি। তিনি মুসলিম লীগ করেছেন, পাকিস্তানের জন্য লড়েছেন। অথচ সেই মুজিবুরই স্বাধীন পাকিস্তানে বাঙালি হওয়ার জন্য লড়েছেন, ইসলাম বা মুসলমান হিসেবে তার ইতিহাস ও পরিচয় ভুলে গিয়ে নয়। এটাও জানতেন কলকাতার উচ্চ বর্ণের বাঙালির কাছে মুসলমানরা বাঙালি বলে স্বীকৃত ছিল না। ইতিহাসের বিচিত্র প্রহসন যে মুসলমানকে রক্ত দিয়ে বাঙালি হতে হয়েছে। জন্মসূত্রে তারা এই রাজনৈতিক পরিচয় লাভ করতে পারেনি। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে আরও অনেক কিছুই অনেকে এখন বুঝতে শিখছেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীনের রাজনীতি করেননি। তাজউদ্দীন তাকে জোর করলেও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। সবচেয়ে দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বিধিবিধান মেনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে। আমি সব সময়ই তার এই দূরদর্শিতার প্রশংসা করেছি। নিজেকে তিনি লেনিন, মাও সে তুং বা হো চি মিন মনে করেননি। মুসলিম লীগ করা ও সোহরাওয়ার্দীর কাছে পার্লামেন্টারি রাজনীতির শিক্ষা পাওয়া শেখ মুজিবই মনে করেছিলেন। ধরা দেয়ার সময়ও তার চিন্তা ও রাজনীতি নিজের চিন্তা-ভাবনার বাইরে যায়নি। শাসক হিসেবেই তার চিন্তার সীমাবদ্ধতা ধরা পড়তে শুরু করে। বাকশালী মুজিবের ইতিহাস ভিন্ন ইতিহাস।
তো আমাদের শিখতে হবে নিজেদের ইতিহাস থেকেই। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের জনগণের সমর্থন ও সহায়তা চেয়েছেন, কিন্তু দিল্লির দাসত্ব মেনে নেননি। শেখ হাসিনা তার পিতার রক্ত বহন করতে পারেন, কিন্তু তার রাজনীতির উত্তরাধিকারী নন। তিনি দিল্লির দাসত্ব মেনে ক্ষমতায় আছেন এবং মতাদর্শিকভাবে তাজউদ্দীনের পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করছেন। যে কারণে তার মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবুরের অনুসারীদের চেয়েও তথাকথিত পেটি বুর্জোয়া বামপন্থীদেরই দৌরাত্ম্য বেশি। তিনি নিজেকে নিজে লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন।
বৈপ্লবিক চিন্তা-ভাবনার আলোকে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংস্কার ও কর্মসূচি কী হতে পারে সে ব্যাপারে ব্যাপক আলাপ-আলোচনাই এখনকার কাজ। সেই রাজনীতি অন্বেষণই ফ্যাসিবাদবিরোধী সবার কর্তব্য। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের ইতিহাস যারা জানেন তারা সবাই শেখ হাসিনার হাতে গড়া বর্তমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছেন, এটা আমি মনে করি না। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। অন্যদিকে বিএনপি এমন কোনো নীতি বা কর্মসূচি হাজির করেনি যাতে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সব নাগরিক ঐক্যবদ্ধ হতে পারে বা বিরোধী রাজনীতির পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে ওঠে। সোজা কথায় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিএনপির ছয় দফা-জাতীয় কোনো সংস্কারমূলক কর্মসূচি নেই। এখানেই বিএনপির বিশাল বিপদের জায়গা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বোঝা দরকার, সশস্ত্র রাজনীতি বা সহিংসভাবে প্রতিপক্ষের সহিংসতা মোকাবেলায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক কোনো দল নিয়ে আমরা কথা বলছি না। আমরা কথা বলছি সেই দলটিকে নিয়ে যারা গণতন্ত্রের কথা বলে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। কেন পারেনি? সেটা কি কোনো তথাকথিত অগণতান্ত্রিক রাজনীতি বা শক্তির কারণে? মোটেও না। তাদের কারণেই গণতন্ত্র আজও সোনার হরিণ, যারা গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা বাকশাল কায়েম করে, একদলীয় শাসন কায়েম করতে গিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশের সংবিধানকে নিজ দলের দলিলে পরিণত করে। পঞ্চদশ সংশোধনী এ অবিশ্বাস্য উদাহরণ। গণবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগ তাদের কব্জায় থাকা রাষ্ট্রের সমূহ সশস্ত্র শক্তি ব্যবহার করে ক্ষান্ত থাকে না; রামদা, লগিবৈঠা, পিস্তল, কাটাবন্দুক মায় স্টেনগানসহ রাস্তায় সবার চোখের সামনে সশস্ত্রভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করে। রক্ত ঝরায় এবং প্রকাশ্যে রাস্তায় লাশ ফেলতে দ্বিধা করে না। ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যদি বলে যে তারা বিরোধী দলকে যেভাবেই হোক প্রতিহত করবে, তারা লগিবৈঠা, লাঠি-বন্দুক যেভাবেই হোক করবেই, তখন তারা ভয় দেখানোর জন্য বলে না। শেখ হাসিনার সামনে সশস্ত্রভাবে বিরোধী দলকে মোকাবেলা করা ছাড়া সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। তিনি রাজনীতিকে বারুদ, রক্তপাত ও লাশের স্তরে নিয়ে এসেছেন। এই পথ থেকে তার ফিরে যাওয়ার কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। অন্তত আমি দেখছি না। শেখ হাসিনা জানেন একটি দুর্বল বিরোধিতাও তাকে যে কোনো মুহূর্তে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। তিনি বিরোধীদলীয় কোনো কর্মকাণ্ডই তাই করতে দেবেন না। বাধ্য না হলে।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করে, বা কী করতে সক্ষম সেটাই এখন দেখার বিষয়।
No comments