প্রতীক্ষার প্রহর যেন দীর্ঘ না হয় by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক
আগামী বছরটি শুরু হবে যথাসম্ভব উত্তপ্ত
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। এ বছরটি শেষ হচ্ছে নাতিশীতোষ্ণ বা অর্ধেক
উত্তপ্ত অর্ধেক শীতল মাত্রার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে। আজ ২৭ ডিসেম্বর, এ
বছরের জন্য ২০ দলীয় জোটের সর্বশেষ রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সভাটি
হচ্ছে গাজীপুরে। গাজীপুরের সঙ্গে আমার কিছু স্মৃতি রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৯
মার্চ গাজীপুরের ভাওয়াল রাজার রাজবাড়িতে অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্টের অন্যতম সদস্য ছিলাম। বলতে গেলে বাঙালি অফিসারদের মধ্যে আমি
ছিলাম কনিষ্ঠতম। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৯৫
ভাগই ছিলাম বাঙালি। আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই যে সেনাদল
বা সেনা সদস্যরা পাকিস্তানিদের আদেশ মান্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং
জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন, সেই সেনাদলের সদস্যরা ছিলেন দ্বিতীয়
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্তর্গত। আজকের গাজীপুর জেলার সদর যেখানে
অবস্থিত, তার কাছেই ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ইতিহাস-খ্যাত
ভাওয়াল রাজাদের প্রাসাদে অর্থাৎ রাজবাড়িতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
থাকত। সেখানে আমার অনেক স্মৃতি-বিস্মৃতি রয়েছে। তাই ২০ দলীয় জোটের আজকের
সভাটির সঙ্গে আমার অনেক আবেগ জড়িত।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলাম ওই গাজীপুরে অবস্থিত ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ি থেকে। অর্থাৎ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান আল্লাহর নামে অনিশ্চয়তার মুখে আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। দীর্ঘ নয় মাস এ অনিশ্চয়তা আমাদের তাড়া করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় আসে। কিন্তু এ বিজয়টি যে ১৬ ডিসেম্বরেই আসবে, সেটা আমরা দু’দিন আগেও জানতাম না। তাই একটি অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমরা যুদ্ধ চালিয়ে গেছি এবং বিজয় লাভ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি এখানে এজন্য আনলাম যে, যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় পরিবেশে আজ আমরা দিন কাটাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বা মুক্তিযুদ্ধ শেষে তেমন পরিস্থিতির কথা কখনও কল্পনা করেছিলাম? করিনি। ৪৩ বছর আগে মানুষ যা কল্পনা করেনি এখন তা হচ্ছে। ৪৩ বছর আগের কল্পনা, আশা-আকাক্সক্ষা সবকিছুই যে ঠিক থাকবে এটাও স্বাভাবিক নয়। পরিবর্তন হতেই পারে। তবে সে পরিবর্তনটি যদি ইতিবাচক বা গঠনমূলক হয়, তাহলে মানুষের মনে কোনো প্রশ্ন থাকে না।
২০১৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দুটি পরস্পরবিরোধী শিবিরের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সে দ্বন্দ্বটির বিস্তৃতি আরও ব্যাপক। একটি উদাহরণ দিই, তাহলে এই দ্বন্দ্বের ব্যাপকতা, গভীরতা সম্পর্কে পাঠক পরিষ্কার একটি ধারণা পাবেন।
স্বাধীনতার পর নয় মাসের মধ্যে যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল তা একটি পরিচ্ছন্ন সংবিধান ছিল এবং এত দ্রুততম সময়ে সংবিধান প্রণয়নের জন্য সংবিধান প্রণেতারা সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দনও পেয়েছেন। কিন্তু মুদ্রার আরও একটি পিঠ রয়েছে। সেটি হল অতি দ্রুত সময়ে কাজটি করতে গিয়ে সংবিধান প্রণেতারা কি সব বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছিলেন? নাকি তারা পাকিস্তানের সংবিধান, ভারতের সংবিধান ও ব্রিটিশদের (অলিখিত) সংবিধান থেকে কিছু কিছু অংশ বেছে নিয়ে সংবিধানটি রচনা করেছিলেন? এটা অস্বাভাবিক নয়। গবেষণার কাজই হচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে তত্ত্ব ও তথ্য নিয়ে সমন্বয় করা। ১৯৭২ সালে যে সংবিধানটি করা হয়েছিল তা চারবার সংশোধন করা হয় সংবিধান প্রণয়নকারী সরকারের আমলেই। চতুর্থ সংশোধনীটি ছিল মারাÍক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। সেই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে ‘বাকশাল’ এসেছিল। বাকশাল মানে ছিল একদলীয় শাসন এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত। যে বঙ্গবন্ধু সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের বাকস্বাধীনতার জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তিনি কী পরিস্থিতিতে এবং কেন একদলীয় শাসনের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন আজকের রচনায় সেটা আলোচ্য বিষয় নয়। যা হোক, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি সপরিবারে নিহত হন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। ’৭৫-এর পর থেকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ২০০৮ সালে সংবিধান একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। যতটুকু শুনেছি, ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকার সংবিধান সংশোধনের কাজে হাত দিতে চেয়েছিলেন। তারা নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে না থাকায় তারা আর এগোতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে সংবিধানে আওয়ামী লীগ কর্তৃক পরিচালিত আন্দোলনের ফলস্বরূপ, একটি বড় সংশোধনী আনা হয়। সংশোধনী এনেছিল বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির দাবি তুলেছিল। আবার সেই একই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধও করেছে আওয়ামী লীগ এবং তাদের নেতৃত্বাধীন সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার কারণ দেখিয়েছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল থাকলে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা দেশ শাসন করবে। তাই এটা বাতিল করতে হবে। আমার মতে কারণটি এতই ঠুনকো যে এটি কোনো প্রকারের যুক্তি-তর্কেই টেকে না। কারণ এই মুহূর্তে আমরা বলতে বাধ্য যে, গত প্রায় ১২ মাস ধরে বাংলাদেশ শাসিত হচ্ছে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা। বাংলাদেশের সংবিধান যদি অনির্বাচিত সরকারকে বৈধতা দিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারে, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কেন একজন বা এক ডজন নিরপেক্ষ অনির্বাচিত ব্যক্তি সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারবে না? এই প্রশ্নটির উত্তর আওয়ামী লীগ কর্তৃক কোথাও দেয়া হয়নি।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার চাচ্ছে, তারা যেন ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্ত এই সংসদ চালিয়ে নিতে পারে। এই সংসদ গঠনের সময়ই অনেক ভুলত্র“টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও ভুল করেছে। নির্বাচনী গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে মারাÍক রকমের। আমি ওই আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলব, বর্তমান সংসদ অনির্বাচিত। ১৫৩ জন ব্যক্তি বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৫৩টি আসন অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়। সাংবিধানিকভাবে একথা বলা যাবে যে, ৩০০টি আসনেও যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩০০ জন নির্বাচিত হন, সেই সংসদও বৈধ। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি যে আমাদের বর্তমান সরকার অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা চলছে। শুধু তাই নয়, তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য হল, তাদের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য, বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন এবং (তাদের মতে) এই কাজকে এগিয়ে নিতেই তারা ক্ষমতায় থাকতে চান। এটা আংশিকভাবে সত্য হলেও হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে যে বড় বিষয়টি রয়েছে সেটি হচ্ছে দুর্নীতি-লুটপাট। সেই সঙ্গে তারা যে গণতন্ত্রকে হত্যার প্রক্রিয়া চালু করেছে সেটাকে অব্যাহত রাখা। কারণ গত সাত বছরে আওয়ামী লীগের প্রতি ছুড়ে দেয়া কোনো প্রশ্নের জবাব জনগণ পায়নি। এই প্রশ্নগুলোর জবাব এড়িয়ে যাওয়ারও কোনো অবকাশ নেই। কোনো না কোনো দিন, জনগণকে এই প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতেই হবে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে বড় বড় দুর্নীতি, বড় বড় গুম, হত্যার।
এখন আমাদের দেশে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে একটি সংলাপের জন্য। সংলাপটি হবে সরকারি অংশ এবং সরকারের বাইরের অংশের মধ্যে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারি দলের উন্নাসিকতা, অহংবোধ এবং জেদ সংলাপের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বোপরি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সংলাপে গেলে যুক্তিতে হেরে যাওয়ার এবং সেই সঙ্গে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়ার ভয় রয়েছে। অতএব সংলাপ পরিহার করাই তাদের জন্য বাঞ্ছনীয় বলে তারা মনে করছে। বিষয়টি অনেকটা দুষ্ট শিশুদের মতো। যেমন- বাচ্চা যখন খেতে চায় না, মা তখন বলেন, তোমাকে খেতে হবে না, টেবিলে এসে বসো। তখন ওই বাচ্চাটি টেবিলের কাছে এসে আবার দৌড়ে চলে যায়। কারণ সে জানে, টেবিলে বসলেই খেতে হবে। তাই সে টেবিলে না বসাটাকেই শ্রেয় মনে করে।
অতি সাম্প্রতিক সময়ের কথায় আসি। আগামী ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিরোধী শিবির ঘোষণা দিয়েছে ওই দিন গণতন্ত্রের কালো দিবস হিসেবে পালন করবে। মহাশূন্য যানে পৃথিবী থেকে ৪৫০ মাইল ওপরে যখন একজন ব্যক্তি বসে থাকেন, তখন সেখান থেকে পৃথিবীটাকে কেমন দেখেন? ওই ব্যক্তি পৃথিবীটার একটি অংশ আলোকিত এবং অপর অংশকে অন্ধকার দেখেন। ৫ জানুয়ারিকেও যে দর্শক বা পর্যবেক্ষক যে রকম দেখতে চান, তিনি সে রকম দেখতে পারেন। একটি ঘটনা স্মৃতিতে আনুন। বর্তমান সরকারের একজন সম্মানিত সদস্য এখন থেকে চার বছর আগে পিলখানার বিডিআর গেটের ভেতরে এক বস্তা টাকাসহ মধ্যরাতে ধরা পড়েন। কেউ ওই ব্যক্তির নাম নেন না, শুধু কালো বিড়াল বলে থাকেন। কেন কালো বিড়াল বলেন? কালো বিড়াল এজন্য বলেন যে, অন্ধকার রাতে কালো বিড়ালকে কেউ দেখতে পায় না। তদ্রুপ ৫ জানুয়ারির নাম নেয়ার প্রয়োজন নেই। ৫ জানুয়ারি কী হয়েছে সেসব দৃশ্য সেদিনকার টিভি চ্যানেলগুলো যারা দেখেছেন এবং ৬ জানুয়ারির পত্রপত্রিকাগুলো যারা পড়েছেন তাদের কাছে বেশ স্পষ্ট। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, সব টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বা কর্মকর্তারা আওয়ামী-বিরোধী ছিলেন না যে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ সংবাদ রিপোর্ট ও প্রচার করেছে। তারা নিরপেক্ষভাবেই তাদের কাজ করে গেছেন। পত্র-পত্রিকার বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং ৫ জানুয়ারি কী হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০১৪ যেমনই গেছে যাক। কিন্তু ২০১৫-তে আমাদের একটি শুভ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তের প্রথম অংশটি হতে হবে এই যে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ভদ্রতা, শালীনতা বজায় রাখতে হবে। সিদ্ধান্তের দ্বিতীয় অংশটি হতে হবে এই যে, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে যেন জনগণের দুর্ভোগ না হয় অথবা ইচ্ছাকৃত কোনো দুর্ভোগ ঘটানো না হয়। সিদ্ধান্তের তৃতীয় অংশটি হতে হবে এই যে, সব রাজনৈতিক কর্মে সাহস, স্বচ্ছতা ও সততা বজায় রাখতে হবে। সরকারকেও সহানুভূতিশীল হতে হবে। আমরা যারা বিরোধী শিবিরে, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানকে জনবান্ধব করা এবং বর্তমান সরকার কর্তৃক আনা সাংবিধানিক সংশোধনীকে পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে জনবান্ধব করা।
অনেকে অভিযোগ করছেন, বর্তমান শাসক দল একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতি এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, না, সরকার বাংলাদেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে একটি কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, অনিশ্চয়তা কাউকেই শান্তি দেয় না, উন্নয়নও ঘটায় না। সুতরাং নিশ্চয়তা চাই। আমরা সে নিশ্চয়তার প্রতীক্ষায় রইলাম। তবে প্রতীক্ষার প্রহর যেন দীর্ঘ না হয়।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক : সভাপতি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলাম ওই গাজীপুরে অবস্থিত ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ি থেকে। অর্থাৎ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান আল্লাহর নামে অনিশ্চয়তার মুখে আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। দীর্ঘ নয় মাস এ অনিশ্চয়তা আমাদের তাড়া করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় আসে। কিন্তু এ বিজয়টি যে ১৬ ডিসেম্বরেই আসবে, সেটা আমরা দু’দিন আগেও জানতাম না। তাই একটি অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমরা যুদ্ধ চালিয়ে গেছি এবং বিজয় লাভ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি এখানে এজন্য আনলাম যে, যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় পরিবেশে আজ আমরা দিন কাটাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বা মুক্তিযুদ্ধ শেষে তেমন পরিস্থিতির কথা কখনও কল্পনা করেছিলাম? করিনি। ৪৩ বছর আগে মানুষ যা কল্পনা করেনি এখন তা হচ্ছে। ৪৩ বছর আগের কল্পনা, আশা-আকাক্সক্ষা সবকিছুই যে ঠিক থাকবে এটাও স্বাভাবিক নয়। পরিবর্তন হতেই পারে। তবে সে পরিবর্তনটি যদি ইতিবাচক বা গঠনমূলক হয়, তাহলে মানুষের মনে কোনো প্রশ্ন থাকে না।
২০১৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দুটি পরস্পরবিরোধী শিবিরের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সে দ্বন্দ্বটির বিস্তৃতি আরও ব্যাপক। একটি উদাহরণ দিই, তাহলে এই দ্বন্দ্বের ব্যাপকতা, গভীরতা সম্পর্কে পাঠক পরিষ্কার একটি ধারণা পাবেন।
স্বাধীনতার পর নয় মাসের মধ্যে যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল তা একটি পরিচ্ছন্ন সংবিধান ছিল এবং এত দ্রুততম সময়ে সংবিধান প্রণয়নের জন্য সংবিধান প্রণেতারা সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দনও পেয়েছেন। কিন্তু মুদ্রার আরও একটি পিঠ রয়েছে। সেটি হল অতি দ্রুত সময়ে কাজটি করতে গিয়ে সংবিধান প্রণেতারা কি সব বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছিলেন? নাকি তারা পাকিস্তানের সংবিধান, ভারতের সংবিধান ও ব্রিটিশদের (অলিখিত) সংবিধান থেকে কিছু কিছু অংশ বেছে নিয়ে সংবিধানটি রচনা করেছিলেন? এটা অস্বাভাবিক নয়। গবেষণার কাজই হচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে তত্ত্ব ও তথ্য নিয়ে সমন্বয় করা। ১৯৭২ সালে যে সংবিধানটি করা হয়েছিল তা চারবার সংশোধন করা হয় সংবিধান প্রণয়নকারী সরকারের আমলেই। চতুর্থ সংশোধনীটি ছিল মারাÍক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। সেই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে ‘বাকশাল’ এসেছিল। বাকশাল মানে ছিল একদলীয় শাসন এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত। যে বঙ্গবন্ধু সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের বাকস্বাধীনতার জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তিনি কী পরিস্থিতিতে এবং কেন একদলীয় শাসনের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন আজকের রচনায় সেটা আলোচ্য বিষয় নয়। যা হোক, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি সপরিবারে নিহত হন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। ’৭৫-এর পর থেকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ২০০৮ সালে সংবিধান একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। যতটুকু শুনেছি, ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকার সংবিধান সংশোধনের কাজে হাত দিতে চেয়েছিলেন। তারা নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে না থাকায় তারা আর এগোতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে সংবিধানে আওয়ামী লীগ কর্তৃক পরিচালিত আন্দোলনের ফলস্বরূপ, একটি বড় সংশোধনী আনা হয়। সংশোধনী এনেছিল বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির দাবি তুলেছিল। আবার সেই একই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধও করেছে আওয়ামী লীগ এবং তাদের নেতৃত্বাধীন সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার কারণ দেখিয়েছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল থাকলে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা দেশ শাসন করবে। তাই এটা বাতিল করতে হবে। আমার মতে কারণটি এতই ঠুনকো যে এটি কোনো প্রকারের যুক্তি-তর্কেই টেকে না। কারণ এই মুহূর্তে আমরা বলতে বাধ্য যে, গত প্রায় ১২ মাস ধরে বাংলাদেশ শাসিত হচ্ছে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা। বাংলাদেশের সংবিধান যদি অনির্বাচিত সরকারকে বৈধতা দিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারে, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কেন একজন বা এক ডজন নিরপেক্ষ অনির্বাচিত ব্যক্তি সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারবে না? এই প্রশ্নটির উত্তর আওয়ামী লীগ কর্তৃক কোথাও দেয়া হয়নি।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার চাচ্ছে, তারা যেন ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্ত এই সংসদ চালিয়ে নিতে পারে। এই সংসদ গঠনের সময়ই অনেক ভুলত্র“টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও ভুল করেছে। নির্বাচনী গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে মারাÍক রকমের। আমি ওই আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলব, বর্তমান সংসদ অনির্বাচিত। ১৫৩ জন ব্যক্তি বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৫৩টি আসন অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়। সাংবিধানিকভাবে একথা বলা যাবে যে, ৩০০টি আসনেও যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩০০ জন নির্বাচিত হন, সেই সংসদও বৈধ। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি যে আমাদের বর্তমান সরকার অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা চলছে। শুধু তাই নয়, তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য হল, তাদের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য, বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন এবং (তাদের মতে) এই কাজকে এগিয়ে নিতেই তারা ক্ষমতায় থাকতে চান। এটা আংশিকভাবে সত্য হলেও হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে যে বড় বিষয়টি রয়েছে সেটি হচ্ছে দুর্নীতি-লুটপাট। সেই সঙ্গে তারা যে গণতন্ত্রকে হত্যার প্রক্রিয়া চালু করেছে সেটাকে অব্যাহত রাখা। কারণ গত সাত বছরে আওয়ামী লীগের প্রতি ছুড়ে দেয়া কোনো প্রশ্নের জবাব জনগণ পায়নি। এই প্রশ্নগুলোর জবাব এড়িয়ে যাওয়ারও কোনো অবকাশ নেই। কোনো না কোনো দিন, জনগণকে এই প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতেই হবে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে বড় বড় দুর্নীতি, বড় বড় গুম, হত্যার।
এখন আমাদের দেশে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে একটি সংলাপের জন্য। সংলাপটি হবে সরকারি অংশ এবং সরকারের বাইরের অংশের মধ্যে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারি দলের উন্নাসিকতা, অহংবোধ এবং জেদ সংলাপের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বোপরি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সংলাপে গেলে যুক্তিতে হেরে যাওয়ার এবং সেই সঙ্গে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়ার ভয় রয়েছে। অতএব সংলাপ পরিহার করাই তাদের জন্য বাঞ্ছনীয় বলে তারা মনে করছে। বিষয়টি অনেকটা দুষ্ট শিশুদের মতো। যেমন- বাচ্চা যখন খেতে চায় না, মা তখন বলেন, তোমাকে খেতে হবে না, টেবিলে এসে বসো। তখন ওই বাচ্চাটি টেবিলের কাছে এসে আবার দৌড়ে চলে যায়। কারণ সে জানে, টেবিলে বসলেই খেতে হবে। তাই সে টেবিলে না বসাটাকেই শ্রেয় মনে করে।
অতি সাম্প্রতিক সময়ের কথায় আসি। আগামী ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিরোধী শিবির ঘোষণা দিয়েছে ওই দিন গণতন্ত্রের কালো দিবস হিসেবে পালন করবে। মহাশূন্য যানে পৃথিবী থেকে ৪৫০ মাইল ওপরে যখন একজন ব্যক্তি বসে থাকেন, তখন সেখান থেকে পৃথিবীটাকে কেমন দেখেন? ওই ব্যক্তি পৃথিবীটার একটি অংশ আলোকিত এবং অপর অংশকে অন্ধকার দেখেন। ৫ জানুয়ারিকেও যে দর্শক বা পর্যবেক্ষক যে রকম দেখতে চান, তিনি সে রকম দেখতে পারেন। একটি ঘটনা স্মৃতিতে আনুন। বর্তমান সরকারের একজন সম্মানিত সদস্য এখন থেকে চার বছর আগে পিলখানার বিডিআর গেটের ভেতরে এক বস্তা টাকাসহ মধ্যরাতে ধরা পড়েন। কেউ ওই ব্যক্তির নাম নেন না, শুধু কালো বিড়াল বলে থাকেন। কেন কালো বিড়াল বলেন? কালো বিড়াল এজন্য বলেন যে, অন্ধকার রাতে কালো বিড়ালকে কেউ দেখতে পায় না। তদ্রুপ ৫ জানুয়ারির নাম নেয়ার প্রয়োজন নেই। ৫ জানুয়ারি কী হয়েছে সেসব দৃশ্য সেদিনকার টিভি চ্যানেলগুলো যারা দেখেছেন এবং ৬ জানুয়ারির পত্রপত্রিকাগুলো যারা পড়েছেন তাদের কাছে বেশ স্পষ্ট। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, সব টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বা কর্মকর্তারা আওয়ামী-বিরোধী ছিলেন না যে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ সংবাদ রিপোর্ট ও প্রচার করেছে। তারা নিরপেক্ষভাবেই তাদের কাজ করে গেছেন। পত্র-পত্রিকার বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং ৫ জানুয়ারি কী হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০১৪ যেমনই গেছে যাক। কিন্তু ২০১৫-তে আমাদের একটি শুভ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তের প্রথম অংশটি হতে হবে এই যে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ভদ্রতা, শালীনতা বজায় রাখতে হবে। সিদ্ধান্তের দ্বিতীয় অংশটি হতে হবে এই যে, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে যেন জনগণের দুর্ভোগ না হয় অথবা ইচ্ছাকৃত কোনো দুর্ভোগ ঘটানো না হয়। সিদ্ধান্তের তৃতীয় অংশটি হতে হবে এই যে, সব রাজনৈতিক কর্মে সাহস, স্বচ্ছতা ও সততা বজায় রাখতে হবে। সরকারকেও সহানুভূতিশীল হতে হবে। আমরা যারা বিরোধী শিবিরে, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানকে জনবান্ধব করা এবং বর্তমান সরকার কর্তৃক আনা সাংবিধানিক সংশোধনীকে পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে জনবান্ধব করা।
অনেকে অভিযোগ করছেন, বর্তমান শাসক দল একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতি এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, না, সরকার বাংলাদেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে একটি কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, অনিশ্চয়তা কাউকেই শান্তি দেয় না, উন্নয়নও ঘটায় না। সুতরাং নিশ্চয়তা চাই। আমরা সে নিশ্চয়তার প্রতীক্ষায় রইলাম। তবে প্রতীক্ষার প্রহর যেন দীর্ঘ না হয়।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক : সভাপতি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
No comments