গণবিরোধী কর্মসূচি ও গণআন্দোলন by একেএম শাহনাওয়াজ
এপ্রিলে সপরিবারে দার্জিলিং গিয়েছিলাম।
কলকাতায় গুমোট গরম। সেখান থেকেই ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে সব বন্দোবস্ত করে
রওনা হলাম। জানতাম আট হাজার ফুট উপরের শৈল শহর দার্জিলিংয়ে এত গরম থাকবে
না। সঙ্গে শীতবস্ত্র নেই। ঠিক করেছি দার্জিলিংয়ে গিয়ে কিনে নেব। পাহাড়ে
উঠতে উঠতে গাড়ির ভেতরেই ক্রমে শীতের প্রচণ্ডতা বাড়ছিল। পড়ন্ত বিকেলে
দার্জিলিং শহরে পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নামতেই সবার ঠাণ্ডায় দাঁতকপাটি লাগার
দশা। সোজা হোটেলে কম্বলের নিচে। ম্যানেজারকে বললাম, এই মুহূর্তে আমাদের
শীতবস্ত্র কেনা জরুরি। আমাদের প্রস্তুতিহীন অবস্থা দেখে তিনি ভীত হয়ে
পড়লেন। বললেন, এক্ষুণি পাশের মার্কেটে চলে যান। কাল সুভাষ ঘিষিং বন্ধ
ডেকেছেন। এতক্ষণে মার্কেট বুঝি বন্ধ হয়ে গেল। ম্যানেজারের কথার সব মর্মার্থ
বুঝতে পারলাম না। তবে এ মুহূর্তের সংকট থেকে বাঁচতে পড়িমরি ছুটলাম।
মার্কেটের অধিকাংশ দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। গরম পোশাকের একটি দোকান আধখোলা।
বন্ধের প্রস্তুতি চলছে। সুতরাং পছন্দ-অপছন্দ নয়- দরকারি যা পেলাম, তাড়াতাড়ি
কিনে নিলাম। হোটেলে এসে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে মনের ধন্ধ কাটল।
সুভাষ ঘিষিং গোরখা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা। ভীষণ জনপ্রিয়। তিনি দার্জিলিং গোরখা হিল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। ঘিষিং বন্ধ অর্থাৎ হরতালের ডাক দিলে তা কঠিনভাবে পালিত হয়। শুধু নির্দিষ্ট দিনেই পালিত হয় না, হরতালের আগের সন্ধ্যা থেকে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতালের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সীমিত হয়ে যায় গাড়িঘোড়া চলা। ফুটপাথের ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকানও সন্ধ্যা থেকে পাওয়া যাবে না। কিন্তু রাস্তাঘাটে তেমন পুলিশি টহল নেই। মানুষের মনে ভীতি ছড়িয়ে হরতাল কার্যকর করার জন্য নাশকতা শুরু করেনি সুভাষ ঘিষিংয়ের কর্মীবাহিনী। হরতালের দিনেও একই চিত্র দেখলাম। কঠিনভাবে পালিত হচ্ছে হরতাল। নেতার ডাকে সব শ্রেণীপেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া। পিকেটিং নেই। গাড়ি ভাংচুর নেই। কোনো ককটেল-বোমার শব্দও শুনতে পেলাম না। নেতার ডাকে মানুষের হাতে প্রশাসন যেন জিম্মি হয়ে গেছে। আমাদের নেতানেত্রীরা যেমন জিম্মি করে ফেলেন সাধারণ মানুষকে।
স্মৃতিটি মনে ভেসে উঠল ২১ ডিসেম্বর যুগান্তর পড়তে পড়তে। জানলাম, কথিত আন্দোলন সফল করতে এবার রাজপথ দখলে নামবে বিএনপি। নিকট অতীতেও এ ধরনের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। তবে সরকারি প্রতিরোধ, বিএনপি নেতানেত্রী আর কর্মীবাহিনীর আড়মোড়া না ভাঙা এবং গণসমর্থনের অভাবে সেসব কর্মসূচি ফ্লপ করেছে। আজকাল দেখা যাচ্ছে প্রতিবাদের একটি মাত্র হাতিয়ারকে ধারণ করছে বিরোধী দলগুলো। আর তা হচ্ছে হরতাল। এ অস্ত্রটি অপ্রয়োজনে বহু ব্যবহারে ভোঁতা হয়ে যাওয়ার পরও নানা ছুতানাতায় মুড়িমুড়কির মতো আবারও ব্যবহার করা হচ্ছে।
মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে হরতাল চালু করেছিলেন। পরে এর সহিংস রূপ দেখে পিছিয়েও এসেছিলেন। কিন্তু ভালো কিছু অনুকরণ করতে না পারলেও আমরা মন্দের পেছনে ঠিকই ছুটি। তাই হরতাল আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে গেল। পাকিস্তান আমলে দেখেছি, সরকারকে চাপে ফেলতে হরতাল ছিল শেষ অস্ত্র। আর জনমত প্রস্তুত করেই সে হরতাল ডাকা হতো। স্বাধীনতার পরেও অনেক হরতাল ডেকেছে সব সরকারবিরোধী পক্ষ। তবে বরাবর হরতাল ডাকা হতো ঘটনা ঘটার প্রতিক্রিয়ায়। একদিন, দুদিন বা লাগাতার। এখন তো দেখছি অগ্রিম বুকিং দেয়া হচ্ছে হরতালের। বিএনপি ৫ জানুয়ারি ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করতে চায়। সরকার পক্ষ যদি এ কর্মসূচিতে বাধা দেয় তবে তিন দিনের লাগাতার হরতাল দেয়ার অগ্রিম হুমকি দেয়া হয়েছে। এই তিন দিনে দেশের বা সাধারণ মানুষের কতটা ক্ষতি হবে, তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
বিএনপির তো ঝগড়া সরকার তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে। সমাবেশ না করতে দেয়ার অপরাধে সরকার বা আওয়ামী লীগ শাস্তি পেতে পারে। প্রাচীন ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবির আইনে প্রভাবিত হয়ে তারা বড়জোর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। যেমন সরকারকে শাস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অবরুদ্ধ করে দেয়ার কর্মসূচি নিতে পারে। ঘেরাও করতে পারে সচিবালয়। আর আওয়ামী লীগকে শাস্তি দিতে হলে বঙ্গবন্ধু রোডে আওয়ামী লীগ অফিস ঘেরাও করতে পারে। তা না করে দেশের কোটি কোটি নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেয়া কেন? বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়ার কোনো দায় কি সাধারণ মানুষের রয়েছে? বিএনপিই তো বলেছে, ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে। তাহলে মানতে হবে, মানুষ সেই নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানে মানুষের দায় না থাকলে বিএনপি সাধারণ মানুষকে হরতালের শাস্তি দিতে চাচ্ছে কেন? নাকি বিএনপি বিশ্বাস করে, এ দেশের সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে। তাই মানুষকে শাস্তি দিলে আওয়ামী লীগ বা সরকারকে শাস্তি দেয়া হবে। দলটির নেতারা তো বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দল বলে প্রচার করছেন। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য না দিয়ে জনস্বার্থবিরোধী হরতাল চাপিয়ে দেয়ার মধ্যে কি কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ খুঁজে পাওয়া যাবে?
হরতাল এতই সস্তা বিষয় হয়ে গেছে যে, যে কোনো ঘটনায় প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে হরতালের ডাক আসবে- এটি মানুষকে যেন নিয়তি হিসেবেই মেনে নিতে হচ্ছে। এখন তো জামায়াত আর বিএনপির স্বতন্ত্র রাজনীতি নেই। একে অন্যের পরিপূরক। কোন পক্ষের প্রভাব কার ওপর বেশি তা গবেষণার বিষয়। তবে বিএনপির ডাকা আন্দোলনে নাশকতা ছড়াতে আর বিএনপি নেত্রীর জনসভায় জনতা সরবরাহে জামায়াতের সদম্ভ অবস্থান দেখিয়ে জামায়াত যেন বলতে চায়, দাপটে আমরাই এগিয়ে আছি। দুকদম পেছনে হাঁটছে বিএনপি। এভাবে বন্ধুত্বের শক্তি সঞ্চয় করে জামায়াত নিজের অবস্থান জানান দিতে মানবতাবিরোধী অপরাধী নিজ দলীয় নেতাদের শাস্তির রায় ঘোষিত হলেই সাধারণ মানুষের ওপর অবধারিতভাবে হরতাল চাপিয়ে দেয়াকে এখন রেওয়াজে পরিণত করেছে। পৃথিবীতে আর কোনো দেশ আছে কি-না জানা নেই, যেখানে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল হয়। কিন্তু এসব চাপিয়ে দেয়া হরতালে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি, সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের নানা ক্ষতির দায়ও কেউ নেয় না- মানুষের পাশে এসেও কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায় না। আবার হরতাল ডাকিয়ে এসব দল গলা উঁচিয়ে বলে তারা গণতান্ত্রিক।
হরতাল ডেকে বিএনপি সরকারকে চাপে ফেলে কী অর্জন করতে চায়? যত ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলি লক্ষ্য একটিই- সিংহাসনের দখল নেয়া। অতীতে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের লক্ষ্যও অভিন্ন ছিল। ক্ষমতায় গিয়ে তারা দেশ-জাতির কতটা কী উদ্ধার করেছে তার জন্য তো অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। আজ বিএনপি আন্দোলনের ডাক দিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, এর দায় কি শুধু দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা? কোনো এক মায়ার বলয়ে বন্দি না থাকলে বিএনপি নেতৃত্ব ঠিকই বুঝতে পারতেন কোন যুক্তিতে দলান্ধ বিএনপির কর্মী-সমর্থক ছাড়া সাধারণ মানুষ বিএনপির আন্দোলন সফল করতে এগিয়ে আসবে? তাদের আমলের অপশাসন কি মানুষ ভুলে গেছে? যৌক্তিক কারণেই আজ বেগম জিয়া ছাত্রলীগকে গুণ্ডালীগ বলছেন; কিন্তু ছাত্রদল-যুবদলের সন্ত্রাস কি মুছে গেছে মানুষের মন থেকে? বর্তমান আমলের চেয়ে কত শতাংশ কম দুর্নীতি হয়েছে বিএনপির আমলে, আমাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার রাজনীতিতে বিএনপি হয়তো সে হিসাব করতে পারে। তবে বিএনপি নেতাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি নিশ্চয়ই মুছে যায়নি মানুষের মন থেকে। এর সঙ্গে প্রবলভাবে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ-বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। জামায়াতের সব অপকর্মের সহযোগী হওয়া। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের মহাত্মনরা সাধারণ মানুষকে যতটা বোধহীন মূর্খ ভাবেন, মানুষ ততটা মূর্খ নয়। তাই নষ্ট রাজনীতির পক্ষে আন্দোলনে তাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই।
এ বাস্তবতায় মানুষ চাপিয়ে দেয়া হরতালের খক্ষ হজম করবে কেন? নেতারা একবারও কি ভাবেন একটি দিনের হরতালে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে কতটা অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে? মানুষের ও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কতটা ক্ষতি হয়? শিক্ষা কার্যক্রমে কতটা ধস নামে? গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অসুস্থ রোগীর জীবন বিপন্ন হয়। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় যানবাহন। জানমালের ভয়ংকর ক্ষতি সাধিত হয়। আর এসবের ফলে মানুষ এক দুর্বৃত্তায়িত শাসনের বদলে আরেক দুর্বৃত্তায়িত শাসন প্রতিষ্ঠার ক্রীড়নক হয়।
তারপরও আমাদের প্রতাপশালী রাজনীতিকরা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে গণবিরোধী কর্মসূচি চাপিয়ে দিচ্ছেন। আজ আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকার দশা। এটা নিশ্চিত, এই অসুস্থ রাজনীতির মহাত্মনরা সাধারণ মানুষকে রক্ষায় এগিয়ে আসবেন না। তারা কেবল জনগণকে নিয়ে বিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করবেন অথবা জনগণকে নিয়ে সরকার-বিরোধী আন্দোলন সফল করবেন। প্রকৃত জনগণের ভাগ্যে জুটবে লবডঙ্কা। তাই এ সময়ের বাস্তবতায় জনগণকেই আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। দরকার গণজাগরণের প্রস্তুতি। অশুভ বা অন্যায়কারী শক্তি সব সময়ই মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল। আজ সময় এসেছে এসব অন্যায় গণবিরোধী কর্মসূচি প্রতিহত করার। এজন্য সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে সক্রিয় হতে হবে। গণশক্তির প্রকাশ কিন্তু ইতিমধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। বিগত বেশ কটি হরতাল জনজীবনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। যেহেতু সব পক্ষই হরতাল অস্ত্র ব্যবহার করতে চায়, তাই কেউ আইন করে হরতাল বন্ধ করবে না। এ কারণে জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি ছাড়া নিবর্তনমূলক কর্মসূচির হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই।
সুভাষ ঘিষিংয়ের মতো নেতাদের মধ্যে ক্ষমতা বিলাস আর স্বার্থপরতা ছিল না বলেই মানুষ জীবন দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। একই বাস্তবতা এলে এ দেশের মানুষও আন্দোলন সফল করতে পথে নেমে আসবে। আমাদের রাজনীতিকরা একটি চ্যালেঞ্জ কি গ্রহণ করতে পারবেন : কোনো একটি ইস্যুতে হরতাল ডাকবে বিরোধী দল। এই হরতাল সফল করতে আগের রাত থেকে কোনো ভীতি ছড়ানো হবে না। পিকেটিংয়ের নামে ভাঙচুর হবে না। ককটেল ছোড়া হবে না। পুলিশি টহলের দরকার পড়বে না। তারপর দেখুন জনগণ সে হরতাল সফল করে কিনা!
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সুভাষ ঘিষিং গোরখা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা। ভীষণ জনপ্রিয়। তিনি দার্জিলিং গোরখা হিল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। ঘিষিং বন্ধ অর্থাৎ হরতালের ডাক দিলে তা কঠিনভাবে পালিত হয়। শুধু নির্দিষ্ট দিনেই পালিত হয় না, হরতালের আগের সন্ধ্যা থেকে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতালের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সীমিত হয়ে যায় গাড়িঘোড়া চলা। ফুটপাথের ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকানও সন্ধ্যা থেকে পাওয়া যাবে না। কিন্তু রাস্তাঘাটে তেমন পুলিশি টহল নেই। মানুষের মনে ভীতি ছড়িয়ে হরতাল কার্যকর করার জন্য নাশকতা শুরু করেনি সুভাষ ঘিষিংয়ের কর্মীবাহিনী। হরতালের দিনেও একই চিত্র দেখলাম। কঠিনভাবে পালিত হচ্ছে হরতাল। নেতার ডাকে সব শ্রেণীপেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া। পিকেটিং নেই। গাড়ি ভাংচুর নেই। কোনো ককটেল-বোমার শব্দও শুনতে পেলাম না। নেতার ডাকে মানুষের হাতে প্রশাসন যেন জিম্মি হয়ে গেছে। আমাদের নেতানেত্রীরা যেমন জিম্মি করে ফেলেন সাধারণ মানুষকে।
স্মৃতিটি মনে ভেসে উঠল ২১ ডিসেম্বর যুগান্তর পড়তে পড়তে। জানলাম, কথিত আন্দোলন সফল করতে এবার রাজপথ দখলে নামবে বিএনপি। নিকট অতীতেও এ ধরনের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। তবে সরকারি প্রতিরোধ, বিএনপি নেতানেত্রী আর কর্মীবাহিনীর আড়মোড়া না ভাঙা এবং গণসমর্থনের অভাবে সেসব কর্মসূচি ফ্লপ করেছে। আজকাল দেখা যাচ্ছে প্রতিবাদের একটি মাত্র হাতিয়ারকে ধারণ করছে বিরোধী দলগুলো। আর তা হচ্ছে হরতাল। এ অস্ত্রটি অপ্রয়োজনে বহু ব্যবহারে ভোঁতা হয়ে যাওয়ার পরও নানা ছুতানাতায় মুড়িমুড়কির মতো আবারও ব্যবহার করা হচ্ছে।
মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে হরতাল চালু করেছিলেন। পরে এর সহিংস রূপ দেখে পিছিয়েও এসেছিলেন। কিন্তু ভালো কিছু অনুকরণ করতে না পারলেও আমরা মন্দের পেছনে ঠিকই ছুটি। তাই হরতাল আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে গেল। পাকিস্তান আমলে দেখেছি, সরকারকে চাপে ফেলতে হরতাল ছিল শেষ অস্ত্র। আর জনমত প্রস্তুত করেই সে হরতাল ডাকা হতো। স্বাধীনতার পরেও অনেক হরতাল ডেকেছে সব সরকারবিরোধী পক্ষ। তবে বরাবর হরতাল ডাকা হতো ঘটনা ঘটার প্রতিক্রিয়ায়। একদিন, দুদিন বা লাগাতার। এখন তো দেখছি অগ্রিম বুকিং দেয়া হচ্ছে হরতালের। বিএনপি ৫ জানুয়ারি ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করতে চায়। সরকার পক্ষ যদি এ কর্মসূচিতে বাধা দেয় তবে তিন দিনের লাগাতার হরতাল দেয়ার অগ্রিম হুমকি দেয়া হয়েছে। এই তিন দিনে দেশের বা সাধারণ মানুষের কতটা ক্ষতি হবে, তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
বিএনপির তো ঝগড়া সরকার তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে। সমাবেশ না করতে দেয়ার অপরাধে সরকার বা আওয়ামী লীগ শাস্তি পেতে পারে। প্রাচীন ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবির আইনে প্রভাবিত হয়ে তারা বড়জোর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। যেমন সরকারকে শাস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অবরুদ্ধ করে দেয়ার কর্মসূচি নিতে পারে। ঘেরাও করতে পারে সচিবালয়। আর আওয়ামী লীগকে শাস্তি দিতে হলে বঙ্গবন্ধু রোডে আওয়ামী লীগ অফিস ঘেরাও করতে পারে। তা না করে দেশের কোটি কোটি নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেয়া কেন? বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়ার কোনো দায় কি সাধারণ মানুষের রয়েছে? বিএনপিই তো বলেছে, ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে। তাহলে মানতে হবে, মানুষ সেই নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানে মানুষের দায় না থাকলে বিএনপি সাধারণ মানুষকে হরতালের শাস্তি দিতে চাচ্ছে কেন? নাকি বিএনপি বিশ্বাস করে, এ দেশের সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে। তাই মানুষকে শাস্তি দিলে আওয়ামী লীগ বা সরকারকে শাস্তি দেয়া হবে। দলটির নেতারা তো বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দল বলে প্রচার করছেন। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য না দিয়ে জনস্বার্থবিরোধী হরতাল চাপিয়ে দেয়ার মধ্যে কি কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ খুঁজে পাওয়া যাবে?
হরতাল এতই সস্তা বিষয় হয়ে গেছে যে, যে কোনো ঘটনায় প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে হরতালের ডাক আসবে- এটি মানুষকে যেন নিয়তি হিসেবেই মেনে নিতে হচ্ছে। এখন তো জামায়াত আর বিএনপির স্বতন্ত্র রাজনীতি নেই। একে অন্যের পরিপূরক। কোন পক্ষের প্রভাব কার ওপর বেশি তা গবেষণার বিষয়। তবে বিএনপির ডাকা আন্দোলনে নাশকতা ছড়াতে আর বিএনপি নেত্রীর জনসভায় জনতা সরবরাহে জামায়াতের সদম্ভ অবস্থান দেখিয়ে জামায়াত যেন বলতে চায়, দাপটে আমরাই এগিয়ে আছি। দুকদম পেছনে হাঁটছে বিএনপি। এভাবে বন্ধুত্বের শক্তি সঞ্চয় করে জামায়াত নিজের অবস্থান জানান দিতে মানবতাবিরোধী অপরাধী নিজ দলীয় নেতাদের শাস্তির রায় ঘোষিত হলেই সাধারণ মানুষের ওপর অবধারিতভাবে হরতাল চাপিয়ে দেয়াকে এখন রেওয়াজে পরিণত করেছে। পৃথিবীতে আর কোনো দেশ আছে কি-না জানা নেই, যেখানে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল হয়। কিন্তু এসব চাপিয়ে দেয়া হরতালে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি, সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের নানা ক্ষতির দায়ও কেউ নেয় না- মানুষের পাশে এসেও কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায় না। আবার হরতাল ডাকিয়ে এসব দল গলা উঁচিয়ে বলে তারা গণতান্ত্রিক।
হরতাল ডেকে বিএনপি সরকারকে চাপে ফেলে কী অর্জন করতে চায়? যত ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলি লক্ষ্য একটিই- সিংহাসনের দখল নেয়া। অতীতে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের লক্ষ্যও অভিন্ন ছিল। ক্ষমতায় গিয়ে তারা দেশ-জাতির কতটা কী উদ্ধার করেছে তার জন্য তো অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। আজ বিএনপি আন্দোলনের ডাক দিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, এর দায় কি শুধু দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা? কোনো এক মায়ার বলয়ে বন্দি না থাকলে বিএনপি নেতৃত্ব ঠিকই বুঝতে পারতেন কোন যুক্তিতে দলান্ধ বিএনপির কর্মী-সমর্থক ছাড়া সাধারণ মানুষ বিএনপির আন্দোলন সফল করতে এগিয়ে আসবে? তাদের আমলের অপশাসন কি মানুষ ভুলে গেছে? যৌক্তিক কারণেই আজ বেগম জিয়া ছাত্রলীগকে গুণ্ডালীগ বলছেন; কিন্তু ছাত্রদল-যুবদলের সন্ত্রাস কি মুছে গেছে মানুষের মন থেকে? বর্তমান আমলের চেয়ে কত শতাংশ কম দুর্নীতি হয়েছে বিএনপির আমলে, আমাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার রাজনীতিতে বিএনপি হয়তো সে হিসাব করতে পারে। তবে বিএনপি নেতাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি নিশ্চয়ই মুছে যায়নি মানুষের মন থেকে। এর সঙ্গে প্রবলভাবে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ-বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। জামায়াতের সব অপকর্মের সহযোগী হওয়া। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের মহাত্মনরা সাধারণ মানুষকে যতটা বোধহীন মূর্খ ভাবেন, মানুষ ততটা মূর্খ নয়। তাই নষ্ট রাজনীতির পক্ষে আন্দোলনে তাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই।
এ বাস্তবতায় মানুষ চাপিয়ে দেয়া হরতালের খক্ষ হজম করবে কেন? নেতারা একবারও কি ভাবেন একটি দিনের হরতালে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে কতটা অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে? মানুষের ও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কতটা ক্ষতি হয়? শিক্ষা কার্যক্রমে কতটা ধস নামে? গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অসুস্থ রোগীর জীবন বিপন্ন হয়। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় যানবাহন। জানমালের ভয়ংকর ক্ষতি সাধিত হয়। আর এসবের ফলে মানুষ এক দুর্বৃত্তায়িত শাসনের বদলে আরেক দুর্বৃত্তায়িত শাসন প্রতিষ্ঠার ক্রীড়নক হয়।
তারপরও আমাদের প্রতাপশালী রাজনীতিকরা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে গণবিরোধী কর্মসূচি চাপিয়ে দিচ্ছেন। আজ আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকার দশা। এটা নিশ্চিত, এই অসুস্থ রাজনীতির মহাত্মনরা সাধারণ মানুষকে রক্ষায় এগিয়ে আসবেন না। তারা কেবল জনগণকে নিয়ে বিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করবেন অথবা জনগণকে নিয়ে সরকার-বিরোধী আন্দোলন সফল করবেন। প্রকৃত জনগণের ভাগ্যে জুটবে লবডঙ্কা। তাই এ সময়ের বাস্তবতায় জনগণকেই আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। দরকার গণজাগরণের প্রস্তুতি। অশুভ বা অন্যায়কারী শক্তি সব সময়ই মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল। আজ সময় এসেছে এসব অন্যায় গণবিরোধী কর্মসূচি প্রতিহত করার। এজন্য সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে সক্রিয় হতে হবে। গণশক্তির প্রকাশ কিন্তু ইতিমধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। বিগত বেশ কটি হরতাল জনজীবনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। যেহেতু সব পক্ষই হরতাল অস্ত্র ব্যবহার করতে চায়, তাই কেউ আইন করে হরতাল বন্ধ করবে না। এ কারণে জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি ছাড়া নিবর্তনমূলক কর্মসূচির হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই।
সুভাষ ঘিষিংয়ের মতো নেতাদের মধ্যে ক্ষমতা বিলাস আর স্বার্থপরতা ছিল না বলেই মানুষ জীবন দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। একই বাস্তবতা এলে এ দেশের মানুষও আন্দোলন সফল করতে পথে নেমে আসবে। আমাদের রাজনীতিকরা একটি চ্যালেঞ্জ কি গ্রহণ করতে পারবেন : কোনো একটি ইস্যুতে হরতাল ডাকবে বিরোধী দল। এই হরতাল সফল করতে আগের রাত থেকে কোনো ভীতি ছড়ানো হবে না। পিকেটিংয়ের নামে ভাঙচুর হবে না। ককটেল ছোড়া হবে না। পুলিশি টহলের দরকার পড়বে না। তারপর দেখুন জনগণ সে হরতাল সফল করে কিনা!
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments