মোবারক হোসেনের মৃত্যুদণ্ড
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা ও স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার মোবারক হোসেনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে গঠিত এই ট্রাইব্যুনাল গতকাল জনাকীর্ণ আদালতে মোবারকের বিরুদ্ধে এই রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ৫টি অভিযোগের মধ্যে ২টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় প্রথম অভিযোগে ফাঁসি ও তৃতীয় অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। দাখিলকৃত অপর তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে এসব অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন সাজাপ্রাপ্ত মোবারক হোসেন। এই রায়ের মাধ্যমে এই প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের কোন সাবেক নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় ঘোষিত হলো। গতকাল মোবারকের বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে রায়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি মর্মে এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছে আসাপিক্ষের আইনজীবী ও তার স্বজনেরা। এনিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ত্রয়োদশতম রায় ঘোষিত হলো। মোবারকের রায়সহ ট্রাইব্যুনাল ১-এ ঘোষিত রায়ের সংখ্যা ৬টি। মোবারকের রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনাল ১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে ব্রেকিং নিউজ প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। রায় ঘোষণার আগে গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে মোবারককে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যানে করে কড়া নিরাপত্তায় ট্রাইব্যুনালে হাজতখানায় আনা হয়। এরপর বেলা ১১টায় সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি পরা মোবারককে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়।
১১টার কিছু পরে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক এজলাসে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, উপস্থিত প্রসিকিউশন, আসামি পক্ষ, সুধী ও সাংবাদিকবৃন্দ, আজ এ ট্রাইব্যুনাল থেকে আমরা ষষ্ঠ রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছি। রায়ের মধ্য থেকে বিশেষ কিছু অংশ এবং আদেশ আমরা পাঠ করবো। তবে তার আগে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের ট্রাইব্যুনালে গতকাল (রোববার ২৩শে নভেম্বর) এ মামলাটির রায় ঘোষণার আদেশের জন্য কার্যতালিকায় রেখেছিলাম। তা দেখে কিছু কিছু টিভি চ্যানেল ‘আগামীকাল রায়’ মর্মে ব্রেকিং নিউজ বা সংবাদ প্রচার করে। আদালতের সংবাদ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আদালত যখন যেমন যে অবস্থায় থাকেন, তেমনই সংবাদ প্রকাশ করা উচিত। মামলাটি আদেশের জন্য কার্যতালিকায় আসার পর আগামীকাল রায় ঘোষণা না লিখে ‘সম্ভবত আগামীকাল রায় ঘোষণা হবে’ লিখলেই হতো। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, আজ এক পত্রিকায় দেখলাম, সেখানে লেখা আজ ঠিক ১১টায় রায় ঘোষণা করা হবে। কিন্তু রিপোর্টার সেটা কিভাবে বুঝলেন? আদালতের সংবাদ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সকলকে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত। এমন কিছু করা উচিত নয়, যা আদালতের কর্তৃত্ব বা এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে। ট্রাইব্যুনাল ১-এর চেয়ারম্যান আরও বলেন, সকালে একটি চ্যানেলে দেখছিলাম এক সিনিয়র সাংবাদিক মন্তব্য করছেন, দেশে এক বিতর্কিত ব্যক্তি ফিরে এসেছেন। এছাড়া পিএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এ সবের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণা যুক্ত করে তিনি মন্তব্য করেছেন। আদালতের বিষয়ে মন্তব্য করার আগে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। এরপর ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত সংবাদ সংস্থা ইউএনবি’র প্রতিনিধি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ফারুক কাজী ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করে বলেন, গতকালের (রোববার) বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল থেকে অবহিত হওয়ার পর আমরা ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের পক্ষ থেকে আদালত সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের আরও সতর্ক হয়ে সংবাদ করার জন্য ই-মেইলের মাধ্যমে জানিয়েছি। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি আদালতে রায় ঘোষণার আলাদা রুলস রয়েছে। হাইকোর্টে এক ধরনের রুলস, আপিল বিভাগের এক ধরনের রুলস। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে এ রকম আলাদা কোন রুলস নেই। এ ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রথম রায় ঘোষণার দিন বলা হয়েছিল, রায় ঘোষণার আগের দিন আমরা (ট্রাইব্যুনাল) জানিয়ে দেবো। তাই কার্যতালিকায় দেখে পরদিন রায় ঘোষণা করা হবে তা ধরে নেয়া হয়েছে। তবে রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের সুনির্দিষ্ট রুলস থাকা উচিত। এ সময় ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা যদি গতকাল বলতাম, এটা (রায়) ৩০ তারিখে চলে যাবে। তখন আপনাদের রিপোর্ট জনগণের কাছে কি মেসেজ দিতো?
এরপর বেলা সোয়া এগারটা থেকে ৯২ পৃষ্ঠার মূল রায়ের সারাংশের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। তিনি এই মামলায় অভিযুক্ত মোবারকের রাজনৈতিক পরিচয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন তার ভূমিকা, মোবারকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ৫টি অভিযোগ পড়ে শোনান। দুপুর ১২টায় রায়ের মূল অংশ ও দ-দান সম্পর্কিত অংশ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, প্রসিকিউশনের সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, আসামি মোবারক হোসেন ওরফে মোবারক আলী প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত প্রথম ও তৃতীয় অভিযোগে অভিযুক্ত। এ কারণে প্রথম অভিযোগে তাকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকরের আদেশ দেয়া হলো। এছাড়া তৃতীয় অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এই অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হলো। তবে রায় ঘোষণার পর অভিযুক্ত মোবারক ছিলেন অনেকটাই নির্লিপ্ত। রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে মোবারক হোসেনও পুলিশি নিরাপত্তায় এজলাস ত্যাগ করে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় চলে যান।
রায়ে সন্তুষ্ট রাষ্ট্রপক্ষ: মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত মোবারক হোসেনের ফাঁসির রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক। গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। আইনমন্ত্রী বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই বিচারকাজ হচ্ছে। এই বিচারে জনগণের আস্থাও ফিরে আসছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, আমরা এই রায়ে সনু্তষ্ট। সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে মোবারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে খালাস পাওয়া অভিযোগগুলোর বিষয়ে আপিলের সিদ্ধান্ত হবে বলে জানান তিনি। এই মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শাহীদুর রহমান বলেন, প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। আমরা সন্তুষ্ট। পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে আপিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ন্যায়বিচার পাইনি, আপিল করা হবে- তাজুল:
মোবারকের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আদালতের কাজ হচ্ছে আবেগের বাইরে গিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। কিন্তু মোবারকের রায়ে ট্রাইব্যুনাল সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছুতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা এ রায়ে সনু্তষ্ট নই। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। আশা করি আপিলে গিয়ে এই রায় বাতিল হবে। মোবারকের বড় ছেলে আসাদুল্লাহ বলেন, আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
যে অভিযোগে ফাঁসি
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে: ১৯৭১ সালের ২২শে আগস্ট আখাউড়ার টানমা-াইল গ্রামের হাজী নূর বক্সের বাড়িতে ১৩০/১৩২ জন গ্রামবাসীকে জড়ো করে মোবারক ও তার রাজাকার সহযোগীরা। পরে তাদের আটক করে নৌকায় করে গঙ্গাসাগর দীঘির পাড়ে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে সেখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হয়। এরপর ৩৩ জনকে বাছাই করে আটকে রাখা হয় তেরজুড়ি হাজতখানায়। পরদিন ২৩শে আগস্ট পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ওই ৩৩ জনকে দীঘির পাড়ে পানিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
যে অভিযোগে যাবজ্জীবন: তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ই নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানার ছাতিয়ান গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতাকারী আবদুুল খালেককে অপহরণ করে মোবারক ও তার সহযোগী রাজাকাররা। তাকে সুহিলপুর রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়, যার প্রত্যক্ষদর্শী তার ছেলে রফিকুল ইসলাম। একই রাতে তাকে তিতাস নদীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলি করার পরে মোবারক বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খালেকের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচ ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ২৩শে এপ্রিল মোবারকের বিচার শুরু হয়। সাক্ষ্য ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ২রা জুন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। একাত্তরে একটি হত্যাকা-ের অভিযোগে ২০০৯ সালের ৩রা মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্র্রেট আদালতে মোবারকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। তখন হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন তিনি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর তার মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। গত বছরের ১৫ই জুলাই মোবারক হোসেনকে দুই মাসের জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর কয়েক দফায় তার জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ১২ই মার্চ অভিযোগ আমলে নিয়ে তার জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ২৫শে ফেব্রুয়ারি মোবারকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। ১২ই মার্চ অভিযোগ আমলে নিয়ে জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ১৬ই জুলাই থেকে গত ২২শে জানুয়ারি পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১৩ সালের ২০শে মে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের মোট ১২ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। গত ২৫শে নভেম্বর প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ এবং তাদের আসামি পক্ষের জেরা শেষ হয়।
১১টার কিছু পরে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক এজলাসে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, উপস্থিত প্রসিকিউশন, আসামি পক্ষ, সুধী ও সাংবাদিকবৃন্দ, আজ এ ট্রাইব্যুনাল থেকে আমরা ষষ্ঠ রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছি। রায়ের মধ্য থেকে বিশেষ কিছু অংশ এবং আদেশ আমরা পাঠ করবো। তবে তার আগে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের ট্রাইব্যুনালে গতকাল (রোববার ২৩শে নভেম্বর) এ মামলাটির রায় ঘোষণার আদেশের জন্য কার্যতালিকায় রেখেছিলাম। তা দেখে কিছু কিছু টিভি চ্যানেল ‘আগামীকাল রায়’ মর্মে ব্রেকিং নিউজ বা সংবাদ প্রচার করে। আদালতের সংবাদ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আদালত যখন যেমন যে অবস্থায় থাকেন, তেমনই সংবাদ প্রকাশ করা উচিত। মামলাটি আদেশের জন্য কার্যতালিকায় আসার পর আগামীকাল রায় ঘোষণা না লিখে ‘সম্ভবত আগামীকাল রায় ঘোষণা হবে’ লিখলেই হতো। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, আজ এক পত্রিকায় দেখলাম, সেখানে লেখা আজ ঠিক ১১টায় রায় ঘোষণা করা হবে। কিন্তু রিপোর্টার সেটা কিভাবে বুঝলেন? আদালতের সংবাদ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সকলকে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত। এমন কিছু করা উচিত নয়, যা আদালতের কর্তৃত্ব বা এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে। ট্রাইব্যুনাল ১-এর চেয়ারম্যান আরও বলেন, সকালে একটি চ্যানেলে দেখছিলাম এক সিনিয়র সাংবাদিক মন্তব্য করছেন, দেশে এক বিতর্কিত ব্যক্তি ফিরে এসেছেন। এছাড়া পিএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এ সবের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণা যুক্ত করে তিনি মন্তব্য করেছেন। আদালতের বিষয়ে মন্তব্য করার আগে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। এরপর ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত সংবাদ সংস্থা ইউএনবি’র প্রতিনিধি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ফারুক কাজী ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করে বলেন, গতকালের (রোববার) বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল থেকে অবহিত হওয়ার পর আমরা ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের পক্ষ থেকে আদালত সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের আরও সতর্ক হয়ে সংবাদ করার জন্য ই-মেইলের মাধ্যমে জানিয়েছি। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি আদালতে রায় ঘোষণার আলাদা রুলস রয়েছে। হাইকোর্টে এক ধরনের রুলস, আপিল বিভাগের এক ধরনের রুলস। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে এ রকম আলাদা কোন রুলস নেই। এ ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রথম রায় ঘোষণার দিন বলা হয়েছিল, রায় ঘোষণার আগের দিন আমরা (ট্রাইব্যুনাল) জানিয়ে দেবো। তাই কার্যতালিকায় দেখে পরদিন রায় ঘোষণা করা হবে তা ধরে নেয়া হয়েছে। তবে রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের সুনির্দিষ্ট রুলস থাকা উচিত। এ সময় ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা যদি গতকাল বলতাম, এটা (রায়) ৩০ তারিখে চলে যাবে। তখন আপনাদের রিপোর্ট জনগণের কাছে কি মেসেজ দিতো?
এরপর বেলা সোয়া এগারটা থেকে ৯২ পৃষ্ঠার মূল রায়ের সারাংশের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। তিনি এই মামলায় অভিযুক্ত মোবারকের রাজনৈতিক পরিচয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন তার ভূমিকা, মোবারকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ৫টি অভিযোগ পড়ে শোনান। দুপুর ১২টায় রায়ের মূল অংশ ও দ-দান সম্পর্কিত অংশ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, প্রসিকিউশনের সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, আসামি মোবারক হোসেন ওরফে মোবারক আলী প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত প্রথম ও তৃতীয় অভিযোগে অভিযুক্ত। এ কারণে প্রথম অভিযোগে তাকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকরের আদেশ দেয়া হলো। এছাড়া তৃতীয় অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এই অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হলো। তবে রায় ঘোষণার পর অভিযুক্ত মোবারক ছিলেন অনেকটাই নির্লিপ্ত। রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে মোবারক হোসেনও পুলিশি নিরাপত্তায় এজলাস ত্যাগ করে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় চলে যান।
রায়ে সন্তুষ্ট রাষ্ট্রপক্ষ: মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত মোবারক হোসেনের ফাঁসির রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক। গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। আইনমন্ত্রী বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই বিচারকাজ হচ্ছে। এই বিচারে জনগণের আস্থাও ফিরে আসছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, আমরা এই রায়ে সনু্তষ্ট। সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে মোবারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে খালাস পাওয়া অভিযোগগুলোর বিষয়ে আপিলের সিদ্ধান্ত হবে বলে জানান তিনি। এই মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শাহীদুর রহমান বলেন, প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। আমরা সন্তুষ্ট। পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে আপিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ন্যায়বিচার পাইনি, আপিল করা হবে- তাজুল:
মোবারকের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আদালতের কাজ হচ্ছে আবেগের বাইরে গিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। কিন্তু মোবারকের রায়ে ট্রাইব্যুনাল সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছুতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা এ রায়ে সনু্তষ্ট নই। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। আশা করি আপিলে গিয়ে এই রায় বাতিল হবে। মোবারকের বড় ছেলে আসাদুল্লাহ বলেন, আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
যে অভিযোগে ফাঁসি
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে: ১৯৭১ সালের ২২শে আগস্ট আখাউড়ার টানমা-াইল গ্রামের হাজী নূর বক্সের বাড়িতে ১৩০/১৩২ জন গ্রামবাসীকে জড়ো করে মোবারক ও তার রাজাকার সহযোগীরা। পরে তাদের আটক করে নৌকায় করে গঙ্গাসাগর দীঘির পাড়ে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে সেখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হয়। এরপর ৩৩ জনকে বাছাই করে আটকে রাখা হয় তেরজুড়ি হাজতখানায়। পরদিন ২৩শে আগস্ট পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ওই ৩৩ জনকে দীঘির পাড়ে পানিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
যে অভিযোগে যাবজ্জীবন: তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ই নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানার ছাতিয়ান গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতাকারী আবদুুল খালেককে অপহরণ করে মোবারক ও তার সহযোগী রাজাকাররা। তাকে সুহিলপুর রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়, যার প্রত্যক্ষদর্শী তার ছেলে রফিকুল ইসলাম। একই রাতে তাকে তিতাস নদীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলি করার পরে মোবারক বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খালেকের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচ ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ২৩শে এপ্রিল মোবারকের বিচার শুরু হয়। সাক্ষ্য ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ২রা জুন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। একাত্তরে একটি হত্যাকা-ের অভিযোগে ২০০৯ সালের ৩রা মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্র্রেট আদালতে মোবারকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। তখন হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন তিনি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর তার মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। গত বছরের ১৫ই জুলাই মোবারক হোসেনকে দুই মাসের জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর কয়েক দফায় তার জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ১২ই মার্চ অভিযোগ আমলে নিয়ে তার জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ২৫শে ফেব্রুয়ারি মোবারকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। ১২ই মার্চ অভিযোগ আমলে নিয়ে জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ১৬ই জুলাই থেকে গত ২২শে জানুয়ারি পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১৩ সালের ২০শে মে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের মোট ১২ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। গত ২৫শে নভেম্বর প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ এবং তাদের আসামি পক্ষের জেরা শেষ হয়।
No comments