আরব বসন্তের ফুল ফুটল তিউনিসিয়ায়
আরব বসন্তের যে দমকা হাওয়া উল্টে-পাল্টে দিয়েছিল গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে, সেই মাতাল বসন্ত হাওয়া এবার পরাগায়ন ঘটল আরব বসন্তের সূতিকাগার তিউনিসিয়ায়। প্রায় চার বছর আগে সবজি বিক্রেতা বু আজিজির আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে তিউনিসিয়া থেকেই প্রথম শুরু হয়েছিল আরব জাগরণ। আর জাগরণের ধাক্কায় টালমাটাল হয় আরব বিশ্বের দেশগুলোতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা স্বেচ্ছাচারী শাসনের ভিত্তিমূল। তবে আরব জাগরণের ধাক্কায় আরব দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন কতটুকু তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, বিপ্লবের জননী হিসেবে পরিচিত তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের ফুল কিন্তু ঠিকই ফুটছে পূর্ণ বিকশিত রূপে। রোববার ছিল তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের চক্র পূর্ণ হওয়ার দিন। দেশটির ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল এদিন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকারের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করবে দেশটি। ১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের অধীনতা থেকে মুক্তির পর আধুনিক তিউনিসিয়ায় ইতিহাসের এটিই প্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত মাত্র দু’জনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেয়েছে তিউনিসিয়া। একজন আধুনিক তিউনিসিয়ার জনক হাবিব বুরগুইবা এবং আরেকজন তার উত্তরসূরি জাইন আল আবেদিন বেন আলী। ১৯৮৭ সালে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাবিব বুরগুইবাকে উৎখাত করেন জাইন আল আবেদিন। দু’জনই পরবর্তীতে পরিণত হন অজনপ্রিয় স্বৈরশাসকে। বেন আলী পরবর্তী তিউনিসিয়ার জনগণ আজ বিভক্ত ইসলামপন্থী এবং সেক্যুলার দুই ভাগে।
তিউনিসিয়ার এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে তাই ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। ভোটকে যুগান্তকারী আখ্যা দিয়ে আলজাজিরার তিউনিসিয়ার প্রতিনিধি মোহামেদ বাক্কালি বলেন, পুরো তিউনিসিয়াজুড়ে আজ গর্বের আবহ প্রবাহিত হচ্ছে, কারণ ছোট্ট একটি দেশ পুরো আরব বিশ্বকে গণতন্ত্রের শিক্ষা দিচ্ছে। রোববার স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় শুরু হয় এ ভোট গ্রহণ। ভোট গ্রহণ চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। সারা দেশে ৫২ লাখ ভোটারের জন্য খোলা হয়েছিল সাড়ে চার হাজারের বেশি পোলিং বুথ। রোববারের নির্বাচনে মূলত লড়াই হয় ৮৭ বছর বয়সী সেক্যুলার প্রার্থী বেজি কাইদ ইসেবসি এবং ইসলামপন্থীদের সমর্থনপুষ্ট মোনসেফ মারজুকির মধ্যে। ইসেবসির দল নিদা তিউনিস গত মাসের পার্লামেন্টারি নির্বাচনে জয়লাভ করায় তিনি আছেন শক্ত অবস্থানে। অপরদিকে বেন আলী ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত তিন বছর ধরে দেশটির অন্তর্বর্তী শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা মোনসেফ মারজুকিকে সমর্থন দিচ্ছে বিপুল ভোটব্যাংক সমৃদ্ধ ইসলামপন্থী এন্নাহদা পার্টি। এই দু’জনসহ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৭ প্রার্থী।এদিন সকাল থেকেই তিউনিসিয়ার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের লম্বা লাইনের কথা জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই ভোটে ধারণা করা হচ্ছে কেউই কাক্সিক্ষত ৫০ শতাংশ ভোট পাবেন না। সেক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দুই প্রার্থীর মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় দফার ভোট। সেখানেই নির্ধারিত হবে কে হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনে তিউনিসিয়াজুড়ে মোতায়েন করা হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী। এছাড়া নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আছেন ছয় শতাধিক বিদেশী পর্যবেক্ষক। প্রথম দফায় কেউ বিজয়ী না হলে দ্বিতীয় দফার ভোট হবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর।
তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসের ইউনিভার্সিটি অব লিগ্যাল, পলিটিক্যাল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের আইনের অধ্যাপক মোহাম্মদ সালাহ বেন আইসা বলেন, বেজি সেইদ এসেবসি এবং মোনসেফ মারজুকিই প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করবেন। তবে একই সঙ্গে পপুলার ফ্রন্টের প্রার্থী হাম্মা হাম্মেমিও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে দ্বিতীয় দফার ভোটে অংশ নিতে পারেন। তবে তা হবে প্রথম দফা ভোটের বিস্ময়। ইসেবসি তিউনিসিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট হাবিব বুরগুইবার আমলে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষাসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি ছিলেন পতিত স্বৈরশাসক বেন আলীর পার্লামেন্টের স্পিকার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি দেশটির পুরোনো শাসক চক্র এবং এলিট এস্টাবলিশমেন্টকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তবে একই সঙ্গে তাকে সমর্থন করছেন ট্রেড ইউনিয়ন এবং বামপন্থীরা। পাশাপাশি দেশটির অভিজাত শ্রেণীর সমর্থনও পাচ্ছেন তিনি। অপরদিকে মারজুকি নির্ভর করছেন ইসলামপন্থী এন্নাহদা পার্টির ওপর। এন্নাহদা এ নির্বাচনে কোনো প্রার্থী না দিলেও সমর্থন দিচ্ছেন এসেবসিকে। অন্য আলোচিত প্রার্থীরা হলেন- দেশটির ধনী ব্যবসায়ী এবং তিউনিসিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল দল ক্লাব আফ্রিকেইনের মালিক স্লিম রিয়াহি এবং সাংবিধানিক পরিষদের প্রধান মুস্তাফা বেন জাফর। এএফপি
No comments