১৮র আগে বিয়ে নয়, ২০ হলে ভালো হয় by রঞ্জন কর্মকার
প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পৃথিবীর দেশে দেশে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর ল্যাটিন আমেরিকার ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত বিদ্রোহ করার জন্য প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনারভা মিরাবেল- এ তিন বোনকে হত্যা করা হয়। ১৯৮১ সাল থেকে এ দিনটি আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৯৩ সালে মানবাধিকার সম্মেলনে দিবসটি স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস এবং ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর থেকে বাংলাদেশেও ১৬ দিনের প্রচারাভিযান নামে এ প্রতিবাদ পক্ষ পালিত হয়ে আসছে। এবারও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস এবং আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ পালন করা হবে। কতগুলো কারণে এবার আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ পালন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা, কষ্ট, যন্ত্রণা ও ক্ষতি যথাযথভাবে পরিমাপ করা কখনোই সম্ভব নয়। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির দিক অনেক। নির্যাতনের প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে নির্যাতনের ফলে শারীরিক বা মানসিক আঘাতজনিত চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্যহানিজনিত চিকিৎসা ব্যয়, কর্মক্ষেত্রে যেতে না পারার ক্ষতি, আইন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত খরচ, বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যয়, সন্তানের জন্য ব্যয়ভার ইত্যাদি। পরোক্ষ ক্ষতির দিক তার চেয়েও বেশি। এর কুফল ওই পরিবারের শিশু থেকে শুরু করে অন্য সদস্যরাও ভোগ করে। দেখা গেছে, যেসব পরিবারে নারীরা অধিক হারে নির্যাতিত, সেখানে সন্তানদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে না। নির্যাতনের ফলে নারীর শরীর ও মনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তার ফলে নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। জাতি বঞ্চিত হয় প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর মূল্যবান অবদান থেকে। এভাবে এটি একাধারে নারী, শিশু, পরিবার ও সমাজের স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। সামগ্রিক বিচারে তাই নারীর প্রতি সহিংসতা জাতীয় উন্নয়নের একটি অন্যতম অন্তরায়। অথচ নারী নির্যাতনের ব্যাপারে আমাদের দেশে এক ধরনের নীরবতার সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায়। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস ও প্রতিবাদ পক্ষে সেজন্যই আমাদের স্লোগান- ‘নীরবতা ভেঙে জাগো-জাগাও, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও।’
বাল্যবিয়ে নারী নির্যাতনের একটি অন্যতম কারণ হলেও আমাদের দেশে বাল্যবিয়ে কমানোর উদ্যোগ সফল হচ্ছে না। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৯ শতাংশ মেয়ের এবং ১৮ বছরের মধ্যে ৭৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। এখানে বাল্যবিয়ের গড় হার ৬৫ শতাংশ। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের এ হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। এ বিবেচনায় বাল্যবিয়ের হারে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ২০১২ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতে বাল্যবিয়ের গড় হার ৪৩ শতাংশ, নেপালে ৪১ শতাংশ, আফগানিস্তানে ৪০ শতাংশ, ভুটানে ২৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৪ শতাংশ, শ্রীলংকায় ১২ শতাংশ এবং মালদ্বীপে ৪ শতাংশ। ভারতে ব্রিটিশ-ভারতের আইন অনুযায়ী ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ এবং মেয়েদের ১৮। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততধিক সন্তানের মা হচ্ছেন। এর ফলে প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যাও তাদের ক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে। গর্ভধারণকালীন এবং প্রসবের সময় এসব কিশোরী মায়ের উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করা হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে বর্তমানে ৭০ কোটি নারী বাল্যবিয়ের শিকার, যার মধ্যে প্রতি তিনজনের একজনেরই বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর বয়সের নিচে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এক দশক ধরে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা গর্ভবতী হচ্ছে। এ বয়সসীমার মা হওয়া ৩০ শতাংশ নারী এবং ৪১ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
বাল্যবিয়ের এ উদ্বেগজনক চিত্র যখন সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে, তখন সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৪-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ এবং পুরুষের জন্য ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি বাল্যবিয়ের অপরাধের জন্য সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ২ বছর ও জরিমানা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। বর্তমানে বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ সাজা তিন মাস এবং জরিমানা ১ হাজার টাকা। প্রস্তাবিত আইনের সাজাসংক্রান্ত অংশটি যথার্থ হলেও বিয়ের বয়স কমানোর প্রস্তাবটি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গত মেয়াদে শিশু আইন- ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। এ আইনের চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হইবে।’ জাতীয় শিশুনীতি ২০১১-তে শিশুর সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী বাংলাদেশের সব ব্যক্তিকে বুঝাবে। দেশের প্রচলিত কোনো আইনে এর ভিন্নতা থাকলে এ নীতির আলোকে প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে সামঞ্জস্য বিধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে’। এছাড়া জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী যে কোনো মানুষকে বুঝাবে’। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ সনদ গৃহীত হয়। বিশ্বের প্রথম যে ২২টি দেশ সনদটি অনুমোদন করে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। তাই মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমালে সেটা একদিকে যেমন সরকারের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে হবে অসঙ্গতিপূর্ণ, তেমনি হবে প্রচলিত আইন ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিয়ের বয়স কমানো হলে বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে সামাজিক আন্দোলন ও প্রচারণা চলছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত হবে এবং বাল্যবিয়ের পরিমাণ আরও আশংকাজনকভাবে বাড়বে। নারীর স্বাস্থ্য ও ক্ষমতায়নের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামাজিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকবে না। ১৮ বছরের কম বয়সে একটি ছেলে বা মেয়ে কখনোই পরিবারের গুরুদায়িত্ব নেয়ার মতো পরিপক্বতা লাভ করে না। কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য বাল্যবিয়ে একটি হুমকি। বাল্যবিয়ে নারী নির্যাতনকেও বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করে। এছাড়া মেয়েদের বিয়ের বয়স কমালে কিশোরী মায়ের সংখ্যা বাড়বে। এর সুদূরপ্রসারী খারাপ প্রভাব পড়বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর। ফলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য, নারীশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করেছে তা খর্ব হবে।
১৮ বছরের আগে মেয়েরা সন্তান জন্মদানের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত হয় না। চিকিৎসকদের মতে, যেসব মেয়ে ১৮ বছরের আগে সন্তান ধারণ করে, তাদের নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। শুধু প্রসবকালীন নয়, প্রসবের পরও নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। কিশোরী মায়েরা বাচ্চার ঠিকমতো দেখভাল করতে পারে না। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা যায়। অনেক বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ পায় না। প্রতিটি অঙ্গের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। ১৬ বছরের মেয়েদের অনেক অঙ্গই পরিপূর্ণতা পায় না। হরমোনের বিবেচনায় ১৬ বছরে নারী মা হতে পারে সত্যি, কিন্তু তার পরিপূর্ণ শারীরিক সক্ষমতা থাকে না। অনেক কিশোরী মানসিকভাবে যৌন সম্পর্কের জন্য তৈরি থাকে না। এ ক্ষেত্রে তাদের ওপর বলপ্রয়োগ হলে বাকি জীবন যৌনতা নিয়ে তারা একটি নেতিবাচক ধারণা বয়ে বেড়ায়।
বাল্যবিয়ে কমানোর জন্য বয়স না কমিয়ে দারিদ্র্য ও নিরাপত্তার অভাবসহ যেসব কারণে বাল্যবিয়ে কমছে না, সেসব কারণ দূর করতে সচেষ্ট হতে হবে। একই সঙ্গে এ সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ ও দুর্ভেদ্য সামাজিক আন্দোলন। ছেলেমেয়ে উভয়কে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদের জীবন বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করার দিকে সরকারকে অধিক মনোযোগী হতে হবে, যাতে তারা জাতীয় উন্নয়নে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। বিয়ের বয়স কমলে সেটা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় উন্নয়নের ধারাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বয়স কমিয়ে বাল্যবিয়ের সংখ্যা হ্রাসের শর্টকাট পথ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা আশা করব, সরকার বিয়ের বয়স কমানোর প্রস্তাবটির সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে জাতীয় স্বার্থেই তা প্রত্যাহার করবে। এবার আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস ও প্রতিবাদ পক্ষে আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তুলি- ‘১৮-র আগে মেয়েদের বিয়ে নয়, ২০ হলে ভালো হয়’।
রঞ্জন কর্মকার : একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক
নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা, কষ্ট, যন্ত্রণা ও ক্ষতি যথাযথভাবে পরিমাপ করা কখনোই সম্ভব নয়। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির দিক অনেক। নির্যাতনের প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে নির্যাতনের ফলে শারীরিক বা মানসিক আঘাতজনিত চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্যহানিজনিত চিকিৎসা ব্যয়, কর্মক্ষেত্রে যেতে না পারার ক্ষতি, আইন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত খরচ, বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যয়, সন্তানের জন্য ব্যয়ভার ইত্যাদি। পরোক্ষ ক্ষতির দিক তার চেয়েও বেশি। এর কুফল ওই পরিবারের শিশু থেকে শুরু করে অন্য সদস্যরাও ভোগ করে। দেখা গেছে, যেসব পরিবারে নারীরা অধিক হারে নির্যাতিত, সেখানে সন্তানদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে না। নির্যাতনের ফলে নারীর শরীর ও মনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তার ফলে নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। জাতি বঞ্চিত হয় প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর মূল্যবান অবদান থেকে। এভাবে এটি একাধারে নারী, শিশু, পরিবার ও সমাজের স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। সামগ্রিক বিচারে তাই নারীর প্রতি সহিংসতা জাতীয় উন্নয়নের একটি অন্যতম অন্তরায়। অথচ নারী নির্যাতনের ব্যাপারে আমাদের দেশে এক ধরনের নীরবতার সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায়। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস ও প্রতিবাদ পক্ষে সেজন্যই আমাদের স্লোগান- ‘নীরবতা ভেঙে জাগো-জাগাও, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও।’
বাল্যবিয়ে নারী নির্যাতনের একটি অন্যতম কারণ হলেও আমাদের দেশে বাল্যবিয়ে কমানোর উদ্যোগ সফল হচ্ছে না। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৯ শতাংশ মেয়ের এবং ১৮ বছরের মধ্যে ৭৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। এখানে বাল্যবিয়ের গড় হার ৬৫ শতাংশ। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের এ হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। এ বিবেচনায় বাল্যবিয়ের হারে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ২০১২ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতে বাল্যবিয়ের গড় হার ৪৩ শতাংশ, নেপালে ৪১ শতাংশ, আফগানিস্তানে ৪০ শতাংশ, ভুটানে ২৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৪ শতাংশ, শ্রীলংকায় ১২ শতাংশ এবং মালদ্বীপে ৪ শতাংশ। ভারতে ব্রিটিশ-ভারতের আইন অনুযায়ী ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ এবং মেয়েদের ১৮। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততধিক সন্তানের মা হচ্ছেন। এর ফলে প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যাও তাদের ক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে। গর্ভধারণকালীন এবং প্রসবের সময় এসব কিশোরী মায়ের উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করা হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে বর্তমানে ৭০ কোটি নারী বাল্যবিয়ের শিকার, যার মধ্যে প্রতি তিনজনের একজনেরই বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর বয়সের নিচে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এক দশক ধরে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা গর্ভবতী হচ্ছে। এ বয়সসীমার মা হওয়া ৩০ শতাংশ নারী এবং ৪১ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
বাল্যবিয়ের এ উদ্বেগজনক চিত্র যখন সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে, তখন সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৪-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ এবং পুরুষের জন্য ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি বাল্যবিয়ের অপরাধের জন্য সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ২ বছর ও জরিমানা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। বর্তমানে বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ সাজা তিন মাস এবং জরিমানা ১ হাজার টাকা। প্রস্তাবিত আইনের সাজাসংক্রান্ত অংশটি যথার্থ হলেও বিয়ের বয়স কমানোর প্রস্তাবটি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গত মেয়াদে শিশু আইন- ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। এ আইনের চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হইবে।’ জাতীয় শিশুনীতি ২০১১-তে শিশুর সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী বাংলাদেশের সব ব্যক্তিকে বুঝাবে। দেশের প্রচলিত কোনো আইনে এর ভিন্নতা থাকলে এ নীতির আলোকে প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে সামঞ্জস্য বিধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে’। এছাড়া জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী যে কোনো মানুষকে বুঝাবে’। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ সনদ গৃহীত হয়। বিশ্বের প্রথম যে ২২টি দেশ সনদটি অনুমোদন করে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। তাই মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমালে সেটা একদিকে যেমন সরকারের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে হবে অসঙ্গতিপূর্ণ, তেমনি হবে প্রচলিত আইন ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিয়ের বয়স কমানো হলে বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে সামাজিক আন্দোলন ও প্রচারণা চলছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহত হবে এবং বাল্যবিয়ের পরিমাণ আরও আশংকাজনকভাবে বাড়বে। নারীর স্বাস্থ্য ও ক্ষমতায়নের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামাজিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকবে না। ১৮ বছরের কম বয়সে একটি ছেলে বা মেয়ে কখনোই পরিবারের গুরুদায়িত্ব নেয়ার মতো পরিপক্বতা লাভ করে না। কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য বাল্যবিয়ে একটি হুমকি। বাল্যবিয়ে নারী নির্যাতনকেও বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করে। এছাড়া মেয়েদের বিয়ের বয়স কমালে কিশোরী মায়ের সংখ্যা বাড়বে। এর সুদূরপ্রসারী খারাপ প্রভাব পড়বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর। ফলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য, নারীশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করেছে তা খর্ব হবে।
১৮ বছরের আগে মেয়েরা সন্তান জন্মদানের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত হয় না। চিকিৎসকদের মতে, যেসব মেয়ে ১৮ বছরের আগে সন্তান ধারণ করে, তাদের নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। শুধু প্রসবকালীন নয়, প্রসবের পরও নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। কিশোরী মায়েরা বাচ্চার ঠিকমতো দেখভাল করতে পারে না। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা যায়। অনেক বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ পায় না। প্রতিটি অঙ্গের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। ১৬ বছরের মেয়েদের অনেক অঙ্গই পরিপূর্ণতা পায় না। হরমোনের বিবেচনায় ১৬ বছরে নারী মা হতে পারে সত্যি, কিন্তু তার পরিপূর্ণ শারীরিক সক্ষমতা থাকে না। অনেক কিশোরী মানসিকভাবে যৌন সম্পর্কের জন্য তৈরি থাকে না। এ ক্ষেত্রে তাদের ওপর বলপ্রয়োগ হলে বাকি জীবন যৌনতা নিয়ে তারা একটি নেতিবাচক ধারণা বয়ে বেড়ায়।
বাল্যবিয়ে কমানোর জন্য বয়স না কমিয়ে দারিদ্র্য ও নিরাপত্তার অভাবসহ যেসব কারণে বাল্যবিয়ে কমছে না, সেসব কারণ দূর করতে সচেষ্ট হতে হবে। একই সঙ্গে এ সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ ও দুর্ভেদ্য সামাজিক আন্দোলন। ছেলেমেয়ে উভয়কে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদের জীবন বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করার দিকে সরকারকে অধিক মনোযোগী হতে হবে, যাতে তারা জাতীয় উন্নয়নে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। বিয়ের বয়স কমলে সেটা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় উন্নয়নের ধারাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বয়স কমিয়ে বাল্যবিয়ের সংখ্যা হ্রাসের শর্টকাট পথ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা আশা করব, সরকার বিয়ের বয়স কমানোর প্রস্তাবটির সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে জাতীয় স্বার্থেই তা প্রত্যাহার করবে। এবার আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস ও প্রতিবাদ পক্ষে আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তুলি- ‘১৮-র আগে মেয়েদের বিয়ে নয়, ২০ হলে ভালো হয়’।
রঞ্জন কর্মকার : একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক
No comments