ধর্ম, সেক্যুলারিজম ও রাজনীতি by ড. মাহবুব উল্লাহ্
সমাজের মধ্যে ধর্মের প্রভাবকে বিবেচনায় নিয়েই উন্নয়নের চিন্তা ও পরিকল্পনা করতে হবে। বিশ্বজুড়ে ধর্ম নিয়ে যে উত্তেজনা এবং মৌলবাদী তৎপরতা চলছে, তা বন্ধ করতেও ধর্মের নানা দিক বুঝতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মকে বাদ দেয়া ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি- এ দুই পথকেই সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। গত ২২ নভেম্বর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জর্জটাওন বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলে ধর্ম, শান্তি এবং আন্তর্জাতিক বিষয় কেন্দ্র এবং ওয়ার্ল্ড ফেইথ্স ডেভেলপমেন্ট ডায়ালগের উদ্যোগে এক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সেক্যুলারিজম অ্যান্ড ফেইথ ইন্সপায়ার ডেভেলপমেন্ট : আন্ডারস্ট্যান্ডিং কনটেস্টেশন অ্যান্ড কোলাবেরেশন শিরোনামে দিনব্যাপী এই কর্মশালাটি ব্র্যাক ইন-এ অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে ধর্মের প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশের উন্নয়নে ধর্মের প্রভাব নিয়ে এ রকম একটি কর্মশালা প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হল। বিষয়টি নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। ইতিমধ্যে ধর্ম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এমন চরম পন্থার দিকে গড়িয়ে গেছে, যদি কেউ ধর্মের গুরুত্ব তুলে ধরেন অথবা ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলেন তাহলে তাকে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী রাজাকার আখ্যা দিতে কসুর করেন না। অন্যদিকে ধর্মের বিষয়ে আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেউ কিছু বলার চেষ্টা করার সময় তার বক্তব্যে ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা না থাকলেও তাকে কোনো কোনো মহল থেকে মুরতাদ ঘোষণা করার দাবি ওঠে। কার্যত এ উভয় প্রবণতাই সমাজের জন্য ক্ষতিকর। ধর্মকে অবজ্ঞা করলে কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানলে দেশের আমজনতা সেটাকে গ্রহণ করে না বরং ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। সেটা এতদিন অনেকে বুঝতে না চাইলেও লতিফ সিদ্দিকীর ঘটনার পর নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পারছেন। এর পরও যদি তারা বুঝে না থাকেন তাহলে বলতে হবে তারা জনবিচ্ছিন্ন মানসিকতারই চর্চা করছেন। সরকার যদি লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিত তাহলে সরকারের অস্তিত্বই বিপন্ন হতো। বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতা সম্পর্কে প্রায়ই বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। একসময়কার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সংবিধানে ধর্ম বিশ্বাস করার এবং না করার অধিকার সংযোজিত হয়েছিল। নাস্তিক্যবাদের পক্ষে এসব দেশে প্রচারণাও কম হয়নি। আলবেনিয়ার আনভার হোক্সার কমিউনিস্ট শাসনামলে আলবেনিয়াকে Godless stateঘোষণা করা হয়েছিল। আলবেনিয়া একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। কমিউনিজমের পতনের পর এসব দেশে ধর্মচর্চা প্রবলভাবে ফিরে এসেছে। আলবেনিয়াতে এখন ইসলামের চর্চা হচ্ছে। সুতরাং আমাদের দেশে ধর্মের কথা শুনলে যাদের এলার্জি হয়, তাদের অবশ্যই গভীরভাবে ভাবতে হবে ধর্মের অন্তর্গত শক্তির উৎস কোথায়। মানবসৃষ্ট জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিসমাপ্তির বিন্দুতে ধর্মীয় চিন্তার উদ্ভব হয়। দুর্জ্ঞায়কে জানার জন্য সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষ অবিরাম চেষ্টা করেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার ফলে মানুষ অনেক রহস্যের গ্রন্থিও ছিন্ন করেছে। কিন্তু মানুষ এখনও জানে না সে কোথা থেকে এসেছে এবং জীবনাবসানের পর তার পরিণতি কী হবে।
এই প্রশ্ন মানুষকে চিন্তানিমগ্ন করে তুলেছে। এ পর্যায়ে এসেই মানুষ ধর্ম চিন্তার আশ্রয় নেয়। এর মাধ্যমে মানুষ এক রকম মানসিক প্রশান্তিও খুঁজে পায়। তাহলে ধর্ম বিশ্বাসের জন্য কাউকে অপাঙ্ক্তেয় মনে করার কোনো যুক্তি আছে কি? বরং যারা ধর্মচিন্তাকে অবজ্ঞা করেন, তারা মানুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অনুভূতিকেই আঘাত করেন। ফলে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় সেটা অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ব্যক্তি হিসেবে কেউ নাস্তিক হতে পারেন, কিন্তু অপরের বিশ্বাসকে নিয়ে বিদ্রুপ কিংবা মসকরা করা গ্রহণযোগ্য নয়।
মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ধর্ম সাধারণ মানুষের কালচার, কালচার সাধারণ মানুষের ধর্ম।
ধর্মীয় চৈতন্য সামাজিক শক্তি হিসেবে আবির্র্ভূত হতে পারে। মধ্যযুগে ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় অর্থনৈতিক নৈতিকতার দৃষ্টিতে পুঁজিবাদী ভাবাদর্শ এবং উন্নয়ন ছিল অবাঞ্ছিত। তখনকার খ্রিস্টীয় ধর্মগুরুরা বস্তুগত সম্পদ আহরণের বিরোধিতা করতে গিয়ে যেমন লোভের বিরোধিতা করেছিল। সেন্ট জেরোমে বলেছিলেন, একজন ধনী মানুষ হয় একজন তস্কর অথবা তস্করের সন্তান। সেন্ট অগাস্টিন মনে করতেন ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ, কেননা এর ফলে মানুষ ইশ্বরের অনুসন্ধান থেকে দূরে সরে যায়। পুরো মধ্যযুগজুড়ে বাণিজ্য এবং ব্যাংকিংকে বড় জোর Necessary evil হিসেবে দেখা হতো। খ্রিস্টানরা মনে করত, টাকা ধার দেয়ার ব্যবসা একজন খ্রিস্টানের জন্য অসম্মানজনক। চার্চ ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের আইন অনুযায়ী টাকা ধার দিয়ে সুদ নেয়া ছিল বেআইনি। মধ্যযুগে ফটকা কারবার এবং মুনাফাখোরি ন্যায্য দামের অর্থনৈতিক চিন্তার পরিপন্থী বলে বিবেচিত হতো। মধ্যযুগের শেষদিকে বাণিজ্যের বিস্তারের ফলে এক বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এ বিতর্কের মধ্য দিয়েই অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে ধর্মীয় মতবাদের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশনের প্রাক্কালে যখন লোভকে পাপ বলে বিবেচনা করা হতো, ততদিনে পুঁজিবাদ শাসক এবং সাধারণ মানুষের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। কারণ সাধারণ মানুষ তাদের কর্মসংস্থানের জন্য পুঁজিবাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল এবং এভাবেই ক্যাথলিক ধর্মমতের কঠোরতার বন্ধন শিথিল হতে থাকে।
প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশন দানা বাঁধতে শুরু করে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতি ছিল না। উত্তর ইউরোপে বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস ও ইংল্যান্ডে পুঁজিবাদী উত্থানের সহায়ক হিসেবে প্রটেস্টান্ট ধর্মমত এক শক্তিশালী সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা করেছিল কিনা অথবা ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন আর্থসামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছিল- এটি একটি বিতর্কিত বিষয় হিসেবে থেকে যাবে। তবে ম্যাক্সওয়েবারসহ অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, প্রটেস্টান্ট মতবাদ পুঁজিবাদী মনস্তত্বের জন্ম দিয়েছিল। যার ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এক নতুন ধরনের ইহজাগতিকতাবোধের জন্ম হয়। এ চেতনা হল কঠোর শ্রম, মিতব্যয়িতা, পরিমিতিবোধ এবং দক্ষতা। বাজারব্যবস্থার সঙ্গে এর যেমন সঙ্গতি রয়েছে একই ধরনের সঙ্গতি রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষালয়ের সঙ্গে। সম্প্রসারণশীল শিল্প ও বাণিজ্যের পরিবশে প্রটেস্টান্ট ধর্মমত এই শিক্ষাই দিল যে, সঞ্চিত সম্পদকে ব্যবহার করতে হবে উত্তরোত্তর সম্পদ সৃষ্টির জন্য। প্রটেস্টান্ট নৈতিকতা থেকে শ্রমের মুক্ত বাজারেরও উদ্ভব হল। মুক্ত শ্রমিককে এখন আর কেউ বল প্রয়োগ করে নিজের সেবার জন্য খাটাতে পারবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন পাশ্চাত্য জগতে পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথকে সুগম করে দিয়েছিল।
বর্তমান যুগের বাস্তবতাকে তুলে ধরতে গিয়ে মার্ক যুয়েরজেন্সনিয়ার তার রিলিজিয়াস ন্যাশনালিজম কনফ্রন্টস্ দ্য সেক্যুলার স্টেইট গ্রন্থে বলেছেন, আমি কয়েক ডজন গোলযোগপূর্ণ দেশে ১৯৮০ এবং ৯০-এর দশকে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গিয়ে দেখেছি, তার (ড. মোহাম্মদ ইব্রাহিম আল গিয়সী, ডিন আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়) মতবাদ সাজুয্যহীন নয়। এ শতাব্দীতে যেসব দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, কেবল মিসর নয়, মধ্য এশিয়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশ যেগুলো আলজেরিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ইউক্রেনীয়, শ্রীলংকান, ভরতীয়, ইসরাইলি, মঙ্গোলিয়ান এবং গভীরভাবে ধর্মানুরাগী ব্যক্তিরা এমন এক ধরনের দেশীয়, ধর্মীয়, রাজনীতি চান, যা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বারা কলুষিত হয়নি। বস্তুত ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছিল। কারণ এ বিপ্লব পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আধিপত্য এবং এর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে ১৯৭৯ সালে চ্যালেঞ্জ করেছিল। বিষয়টি ১৯৯০-এর দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি মুখ্য আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। দ্বিমেরুবিশিষ্ট শীতল যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে যে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হয় এর বৈশিষ্ট্য শুধু নতুন অর্থনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় নয়, পুরনো সাম্রাজ্যের ভেঙে পড়া নয়, কমিউনিজমের গৌরব ক্ষুণ্ন হওয়া নয় বরং এর মধ্য দিয়ে বর্ণগোষ্ঠী ও ধর্মীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে সংকীর্ণ পরিচিতির উত্থান ঘটেছে। যদিও অন্যদের মধ্যে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা দাবি করেছেন, শীতল যুদ্ধের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং বিশ্বজুড়ে সেক্যুলার, লিবারেল গণতন্ত্রের পক্ষে আদর্শিক সহমত সৃষ্টি হয়েছে। তদসত্ত্বেও ধর্মীয় এবং এথনিক জাতীয়তাবাদ সেই দাবিকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে। এ ছাড়াও নব্য জাতীয়তাবাদগুলোর প্রবক্তারা মনে করেন, সেক্যুলার পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে অভিন্ন অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে- এ থেকেই নতুন ধরনের শীতল যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। এ গবেষক আরও মনে করেন, Like the old cold war, the confrontation between these new forms of culture- based politics and the secular state is global in its scope, binary in its opposition, occasionally violent, and essentially a difference of ideologies; and, like the old cold war, each side tends to stereotype the other. সুতরাং আমাদের দেশে যেসব পণ্ডিত মনে করেন সেক্যুলারিজম নিয়ে শেষ কথা বলা হয়ে গেছে এবং এর পর আর পর নেই, তারা আসলে সময়ের বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। এরা আসলে ফুকুইয়ামারই অনুসারী। ফুকুইয়ামার মতোই তারা ইতিহাসের আর কোনো পরিবর্তন বা বিবর্তন দেখতে পান না। এরা বস্তুত চক্ষুহীন। এরা শ্রুতিশক্তিহীনও বটে। কারণ সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তিও তারা শুনতে পান না। এরা কার্যত অপরিণামদর্শী। নতুন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জাতিগঠন এবং গণতন্ত্র চর্চার জন্য যে ধরনের নীতি-কৌশল অবলম্বন করা দরকার সে সম্পর্কে তাদের কোনো সৃজনশীল ধ্যান-ধারণা নেই। এরা মানব জাতির ইতিহাসও ভালোভাবে পাঠ করে দেখেননি। এরা ইউরোপের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে আটকা পড়ে আছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে কী করণীয় সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।
ক্রিস্টোফার পাইপার এবং মাইকেল পি ইয়াং তাদের রিলিজিয়ান অ্যান্ড পোস্ট সেক্যুলার পলিটিক্স প্রবন্ধে মোয়াড্ডেলের যুক্তি উল্লেখ করে বলেছেন, ভাবাদর্শের পরিগঠন প্রাধান্য বিস্তারকারী সমাজ কাঠামোর মধ্যে পাওয়া যাবে না কিন্তু এর সূত্র পাওয়া যেতে পারে অসংলগ্ন প্রেক্ষাপটে এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের মধ্যে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, একটি আগ্রাসী সেক্যুলার রাষ্ট্র স্বৈরতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে ধর্মের রাজনীতিকরণ করেছে, ফলত মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াবাদের জন্ম হয়েছে। এ ফলাফল অপ্রয়োজনীয় ছিল। মোয়াড্ডেল বলতে চান, ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করা সম্ভব, সমগ্র সমাজ জীবনকে সেক্যুলার বিশ্ববীক্ষায় উপনিবেশিকরণ না করেও। দৃষ্টান্তস্বরূপ শিক্ষা, লিঙ্গ সম্পর্ক, আইন এবং ধর্মকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য না করে। এরকম অনেক দেশে রাষ্ট্র ধর্মকে তাদের নিজস্ব সেক্যুলার প্রকল্পের অধীনস্ত করতে চেয়েছে। ফলে ধর্মগুরুরা ক্ষিপ্ত হয়েছেন এবং সাধারণ মানুষও ক্ষিপ্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতি মৌলবাদকে উসকে দিয়েছে। এ ধরনের সরকারগুলোর অধীনে আংশিক বিরোধিতা কিংবা সীমিত বিরোধিতার কোনো সুযোগ থাকে না। কারণ এর অর্থ হয়ে দাঁড়ায় সম্পূর্ণ বিরোধিতা। অর্থাৎ হয় কোনো বিরোধিতা থাকবে না, নয়তো সর্বাত্মক বিরোধিতা গড়ে উঠবে। এভাবে বিরোধী মতাদর্শ অনিচ্ছুকভাবে পরিণত হয় বিপ্লবী মতাদর্শে। ফলে রাষ্ট্রের মূল তাৎপর্যটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আজকের বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে, তার ফলে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে কিনা সেটা রাষ্ট্র পরিচালকদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্কের বিষয়। এ ব্যাপারে গোয়ার্তুমির ফলাফল হিতে বিপরীত হতে পারে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের উন্নয়নে ধর্মের প্রভাব নিয়ে এ রকম একটি কর্মশালা প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হল। বিষয়টি নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। ইতিমধ্যে ধর্ম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এমন চরম পন্থার দিকে গড়িয়ে গেছে, যদি কেউ ধর্মের গুরুত্ব তুলে ধরেন অথবা ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলেন তাহলে তাকে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী রাজাকার আখ্যা দিতে কসুর করেন না। অন্যদিকে ধর্মের বিষয়ে আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেউ কিছু বলার চেষ্টা করার সময় তার বক্তব্যে ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা না থাকলেও তাকে কোনো কোনো মহল থেকে মুরতাদ ঘোষণা করার দাবি ওঠে। কার্যত এ উভয় প্রবণতাই সমাজের জন্য ক্ষতিকর। ধর্মকে অবজ্ঞা করলে কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানলে দেশের আমজনতা সেটাকে গ্রহণ করে না বরং ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। সেটা এতদিন অনেকে বুঝতে না চাইলেও লতিফ সিদ্দিকীর ঘটনার পর নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পারছেন। এর পরও যদি তারা বুঝে না থাকেন তাহলে বলতে হবে তারা জনবিচ্ছিন্ন মানসিকতারই চর্চা করছেন। সরকার যদি লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিত তাহলে সরকারের অস্তিত্বই বিপন্ন হতো। বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতা সম্পর্কে প্রায়ই বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। একসময়কার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সংবিধানে ধর্ম বিশ্বাস করার এবং না করার অধিকার সংযোজিত হয়েছিল। নাস্তিক্যবাদের পক্ষে এসব দেশে প্রচারণাও কম হয়নি। আলবেনিয়ার আনভার হোক্সার কমিউনিস্ট শাসনামলে আলবেনিয়াকে Godless stateঘোষণা করা হয়েছিল। আলবেনিয়া একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। কমিউনিজমের পতনের পর এসব দেশে ধর্মচর্চা প্রবলভাবে ফিরে এসেছে। আলবেনিয়াতে এখন ইসলামের চর্চা হচ্ছে। সুতরাং আমাদের দেশে ধর্মের কথা শুনলে যাদের এলার্জি হয়, তাদের অবশ্যই গভীরভাবে ভাবতে হবে ধর্মের অন্তর্গত শক্তির উৎস কোথায়। মানবসৃষ্ট জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিসমাপ্তির বিন্দুতে ধর্মীয় চিন্তার উদ্ভব হয়। দুর্জ্ঞায়কে জানার জন্য সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষ অবিরাম চেষ্টা করেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার ফলে মানুষ অনেক রহস্যের গ্রন্থিও ছিন্ন করেছে। কিন্তু মানুষ এখনও জানে না সে কোথা থেকে এসেছে এবং জীবনাবসানের পর তার পরিণতি কী হবে।
এই প্রশ্ন মানুষকে চিন্তানিমগ্ন করে তুলেছে। এ পর্যায়ে এসেই মানুষ ধর্ম চিন্তার আশ্রয় নেয়। এর মাধ্যমে মানুষ এক রকম মানসিক প্রশান্তিও খুঁজে পায়। তাহলে ধর্ম বিশ্বাসের জন্য কাউকে অপাঙ্ক্তেয় মনে করার কোনো যুক্তি আছে কি? বরং যারা ধর্মচিন্তাকে অবজ্ঞা করেন, তারা মানুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অনুভূতিকেই আঘাত করেন। ফলে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় সেটা অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ব্যক্তি হিসেবে কেউ নাস্তিক হতে পারেন, কিন্তু অপরের বিশ্বাসকে নিয়ে বিদ্রুপ কিংবা মসকরা করা গ্রহণযোগ্য নয়।
মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ধর্ম সাধারণ মানুষের কালচার, কালচার সাধারণ মানুষের ধর্ম।
ধর্মীয় চৈতন্য সামাজিক শক্তি হিসেবে আবির্র্ভূত হতে পারে। মধ্যযুগে ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় অর্থনৈতিক নৈতিকতার দৃষ্টিতে পুঁজিবাদী ভাবাদর্শ এবং উন্নয়ন ছিল অবাঞ্ছিত। তখনকার খ্রিস্টীয় ধর্মগুরুরা বস্তুগত সম্পদ আহরণের বিরোধিতা করতে গিয়ে যেমন লোভের বিরোধিতা করেছিল। সেন্ট জেরোমে বলেছিলেন, একজন ধনী মানুষ হয় একজন তস্কর অথবা তস্করের সন্তান। সেন্ট অগাস্টিন মনে করতেন ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ, কেননা এর ফলে মানুষ ইশ্বরের অনুসন্ধান থেকে দূরে সরে যায়। পুরো মধ্যযুগজুড়ে বাণিজ্য এবং ব্যাংকিংকে বড় জোর Necessary evil হিসেবে দেখা হতো। খ্রিস্টানরা মনে করত, টাকা ধার দেয়ার ব্যবসা একজন খ্রিস্টানের জন্য অসম্মানজনক। চার্চ ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের আইন অনুযায়ী টাকা ধার দিয়ে সুদ নেয়া ছিল বেআইনি। মধ্যযুগে ফটকা কারবার এবং মুনাফাখোরি ন্যায্য দামের অর্থনৈতিক চিন্তার পরিপন্থী বলে বিবেচিত হতো। মধ্যযুগের শেষদিকে বাণিজ্যের বিস্তারের ফলে এক বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এ বিতর্কের মধ্য দিয়েই অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে ধর্মীয় মতবাদের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশনের প্রাক্কালে যখন লোভকে পাপ বলে বিবেচনা করা হতো, ততদিনে পুঁজিবাদ শাসক এবং সাধারণ মানুষের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। কারণ সাধারণ মানুষ তাদের কর্মসংস্থানের জন্য পুঁজিবাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল এবং এভাবেই ক্যাথলিক ধর্মমতের কঠোরতার বন্ধন শিথিল হতে থাকে।
প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশন দানা বাঁধতে শুরু করে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতি ছিল না। উত্তর ইউরোপে বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস ও ইংল্যান্ডে পুঁজিবাদী উত্থানের সহায়ক হিসেবে প্রটেস্টান্ট ধর্মমত এক শক্তিশালী সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা করেছিল কিনা অথবা ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন আর্থসামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছিল- এটি একটি বিতর্কিত বিষয় হিসেবে থেকে যাবে। তবে ম্যাক্সওয়েবারসহ অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, প্রটেস্টান্ট মতবাদ পুঁজিবাদী মনস্তত্বের জন্ম দিয়েছিল। যার ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এক নতুন ধরনের ইহজাগতিকতাবোধের জন্ম হয়। এ চেতনা হল কঠোর শ্রম, মিতব্যয়িতা, পরিমিতিবোধ এবং দক্ষতা। বাজারব্যবস্থার সঙ্গে এর যেমন সঙ্গতি রয়েছে একই ধরনের সঙ্গতি রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষালয়ের সঙ্গে। সম্প্রসারণশীল শিল্প ও বাণিজ্যের পরিবশে প্রটেস্টান্ট ধর্মমত এই শিক্ষাই দিল যে, সঞ্চিত সম্পদকে ব্যবহার করতে হবে উত্তরোত্তর সম্পদ সৃষ্টির জন্য। প্রটেস্টান্ট নৈতিকতা থেকে শ্রমের মুক্ত বাজারেরও উদ্ভব হল। মুক্ত শ্রমিককে এখন আর কেউ বল প্রয়োগ করে নিজের সেবার জন্য খাটাতে পারবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন পাশ্চাত্য জগতে পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথকে সুগম করে দিয়েছিল।
বর্তমান যুগের বাস্তবতাকে তুলে ধরতে গিয়ে মার্ক যুয়েরজেন্সনিয়ার তার রিলিজিয়াস ন্যাশনালিজম কনফ্রন্টস্ দ্য সেক্যুলার স্টেইট গ্রন্থে বলেছেন, আমি কয়েক ডজন গোলযোগপূর্ণ দেশে ১৯৮০ এবং ৯০-এর দশকে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গিয়ে দেখেছি, তার (ড. মোহাম্মদ ইব্রাহিম আল গিয়সী, ডিন আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়) মতবাদ সাজুয্যহীন নয়। এ শতাব্দীতে যেসব দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, কেবল মিসর নয়, মধ্য এশিয়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশ যেগুলো আলজেরিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ইউক্রেনীয়, শ্রীলংকান, ভরতীয়, ইসরাইলি, মঙ্গোলিয়ান এবং গভীরভাবে ধর্মানুরাগী ব্যক্তিরা এমন এক ধরনের দেশীয়, ধর্মীয়, রাজনীতি চান, যা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বারা কলুষিত হয়নি। বস্তুত ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছিল। কারণ এ বিপ্লব পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আধিপত্য এবং এর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে ১৯৭৯ সালে চ্যালেঞ্জ করেছিল। বিষয়টি ১৯৯০-এর দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি মুখ্য আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। দ্বিমেরুবিশিষ্ট শীতল যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে যে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হয় এর বৈশিষ্ট্য শুধু নতুন অর্থনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় নয়, পুরনো সাম্রাজ্যের ভেঙে পড়া নয়, কমিউনিজমের গৌরব ক্ষুণ্ন হওয়া নয় বরং এর মধ্য দিয়ে বর্ণগোষ্ঠী ও ধর্মীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে সংকীর্ণ পরিচিতির উত্থান ঘটেছে। যদিও অন্যদের মধ্যে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা দাবি করেছেন, শীতল যুদ্ধের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং বিশ্বজুড়ে সেক্যুলার, লিবারেল গণতন্ত্রের পক্ষে আদর্শিক সহমত সৃষ্টি হয়েছে। তদসত্ত্বেও ধর্মীয় এবং এথনিক জাতীয়তাবাদ সেই দাবিকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে। এ ছাড়াও নব্য জাতীয়তাবাদগুলোর প্রবক্তারা মনে করেন, সেক্যুলার পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে অভিন্ন অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে- এ থেকেই নতুন ধরনের শীতল যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। এ গবেষক আরও মনে করেন, Like the old cold war, the confrontation between these new forms of culture- based politics and the secular state is global in its scope, binary in its opposition, occasionally violent, and essentially a difference of ideologies; and, like the old cold war, each side tends to stereotype the other. সুতরাং আমাদের দেশে যেসব পণ্ডিত মনে করেন সেক্যুলারিজম নিয়ে শেষ কথা বলা হয়ে গেছে এবং এর পর আর পর নেই, তারা আসলে সময়ের বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। এরা আসলে ফুকুইয়ামারই অনুসারী। ফুকুইয়ামার মতোই তারা ইতিহাসের আর কোনো পরিবর্তন বা বিবর্তন দেখতে পান না। এরা বস্তুত চক্ষুহীন। এরা শ্রুতিশক্তিহীনও বটে। কারণ সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তিও তারা শুনতে পান না। এরা কার্যত অপরিণামদর্শী। নতুন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জাতিগঠন এবং গণতন্ত্র চর্চার জন্য যে ধরনের নীতি-কৌশল অবলম্বন করা দরকার সে সম্পর্কে তাদের কোনো সৃজনশীল ধ্যান-ধারণা নেই। এরা মানব জাতির ইতিহাসও ভালোভাবে পাঠ করে দেখেননি। এরা ইউরোপের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে আটকা পড়ে আছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে কী করণীয় সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।
ক্রিস্টোফার পাইপার এবং মাইকেল পি ইয়াং তাদের রিলিজিয়ান অ্যান্ড পোস্ট সেক্যুলার পলিটিক্স প্রবন্ধে মোয়াড্ডেলের যুক্তি উল্লেখ করে বলেছেন, ভাবাদর্শের পরিগঠন প্রাধান্য বিস্তারকারী সমাজ কাঠামোর মধ্যে পাওয়া যাবে না কিন্তু এর সূত্র পাওয়া যেতে পারে অসংলগ্ন প্রেক্ষাপটে এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের মধ্যে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, একটি আগ্রাসী সেক্যুলার রাষ্ট্র স্বৈরতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে ধর্মের রাজনীতিকরণ করেছে, ফলত মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াবাদের জন্ম হয়েছে। এ ফলাফল অপ্রয়োজনীয় ছিল। মোয়াড্ডেল বলতে চান, ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করা সম্ভব, সমগ্র সমাজ জীবনকে সেক্যুলার বিশ্ববীক্ষায় উপনিবেশিকরণ না করেও। দৃষ্টান্তস্বরূপ শিক্ষা, লিঙ্গ সম্পর্ক, আইন এবং ধর্মকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য না করে। এরকম অনেক দেশে রাষ্ট্র ধর্মকে তাদের নিজস্ব সেক্যুলার প্রকল্পের অধীনস্ত করতে চেয়েছে। ফলে ধর্মগুরুরা ক্ষিপ্ত হয়েছেন এবং সাধারণ মানুষও ক্ষিপ্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতি মৌলবাদকে উসকে দিয়েছে। এ ধরনের সরকারগুলোর অধীনে আংশিক বিরোধিতা কিংবা সীমিত বিরোধিতার কোনো সুযোগ থাকে না। কারণ এর অর্থ হয়ে দাঁড়ায় সম্পূর্ণ বিরোধিতা। অর্থাৎ হয় কোনো বিরোধিতা থাকবে না, নয়তো সর্বাত্মক বিরোধিতা গড়ে উঠবে। এভাবে বিরোধী মতাদর্শ অনিচ্ছুকভাবে পরিণত হয় বিপ্লবী মতাদর্শে। ফলে রাষ্ট্রের মূল তাৎপর্যটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আজকের বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে, তার ফলে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে কিনা সেটা রাষ্ট্র পরিচালকদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্কের বিষয়। এ ব্যাপারে গোয়ার্তুমির ফলাফল হিতে বিপরীত হতে পারে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments