রাজনীতিতে সহনশীলতার ঘাটতি by মিজানুর রহমান খান
জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দেশের প্রথম
রাষ্ট্রপতি দাবি করাকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে সহনশীলতার ঘাটতি আবারও স্পষ্ট
হয়ে উঠেছে। এটা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে যে অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয় এবং অসত্য
বক্তব্যকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কীভাবে গ্রহণ করে থাকে। সন্দেহ নেই
ইংল্যান্ডের যে শহরটিতে বসে জিয়াপুত্র ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান
তারেক রহমান প্রথম এই বিতর্কের সূচনা ঘটালেন, ওই শহরের ইতিহাসের সঙ্গেই
জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণের দৃষ্টান্ত।
জাতীয় সংসদে যে ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা হয়েছে, সেটা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার হুমকি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পথে অন্তরায়। একই সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, যিনি ৭২ ঘণ্টা আগে একজন বিদ্যুৎ প্রকৌশলীকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়েছেন, তিনি বলেছেন, ‘পাগল-ছাগলদের মাথা মুড়িয়ে দেওয়া দরকার। ওদের সাহস বেড়ে গেছে। মাথাটা নামিয়ে দিতে হবে।’
জাতীয় সংসদে যে ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা হয়েছে, সেটা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার হুমকি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পথে অন্তরায়। একই সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, যিনি ৭২ ঘণ্টা আগে একজন বিদ্যুৎ প্রকৌশলীকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়েছেন, তিনি বলেছেন, ‘পাগল-ছাগলদের মাথা মুড়িয়ে দেওয়া দরকার। ওদের সাহস বেড়ে গেছে। মাথাটা নামিয়ে দিতে হবে।’
অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন
বেগম খালেদা জিয়া, যিনি একটা দীর্ঘ সময় অপেক্ষাকৃত বাক্সংযমী হিসেবে
পরিচিত ছিলেন, তিনি ক্রমেই সংযমহারা হিসেবে নিজেকে জাতির সামনে তুলে ধরছেন।
রাষ্ট্রপতিতত্ত্বের পরে চামড়াতত্ত্ব দিয়েছেন। নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী
একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অথচ তিনি বিএনপির নেত্রীর
সমালোচনা করতে গিয়ে যে ইঙ্গিত করেছেন, তাকে শালীন বলা যাবে না। জাসদের একজন
নেতা বলেছেন, ‘ভদ্রমহিলা (খালেদা জিয়া) যে বক্তব্য রেখেছেন, তা জাতীয় সংসদ
ও সংবিধানের নিয়মাবলির বরখেলাপ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা।’ সংবাদপত্রের বিবরণ পড়ে
আমরা বুঝতে পারিনি ঠিক কোন শব্দ ও বাক্যটি সংবিধানের নিয়মাবলির বাইরে গেছে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতা কীভাবে ঘটল?
এই যুক্তি অসমীচীন নয় যে যেকোনো নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। জিয়াউর রহমানকে যে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করেছেন তারেক রহমান এবং তাঁর মা, সেটা বাক্-স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। যদিও প্রচলিত আইন, যা খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন, রক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করে এসেছেন, সে রকমের একটি বিধানের আওতায় তাঁর ওই দাবি সংগতিপূর্ণ নয়। রাষ্ট্রপতিতত্ত্ব নিয়ে সহকর্মী সোহরাব হাসান এর আগে নিবন্ধ লিখেছেন। সুতরাং রাজনীতির দিকে যাচ্ছি না। আইনগত দিকটি খতিয়ে দেখব। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়কেই বলব, এ রকমের একটি আইন আমাদের থাকা উচিত কি না?
এই বিধান সম্পর্কে প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছিলেন ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ। তখন মাঝেমধ্যে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা নিয়ে বিতর্ক হতো। আওয়ামী লীগ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হতো। গতকাল জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটি মানহানির মামলা করা হয়েছে। এটা অবশ্য মানহানি মামলার বিষয় হতে পারে না। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আদালতে যুক্তি নিবেদন করতে পারেন যে জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলা দণ্ডবিধির পরিপন্থী। কারণ, দণ্ডবিধি বলেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধাচরণ এমনকি আকার-ইঙ্গিতেও তা করা হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়া যাবে। এটা বিস্ময়কর যে বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি নিয়েও বিএনপির নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের জন্মসনদ। আবদুল মতিন খসরু আইনমন্ত্রী থাকাকালে এটি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।
রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত তাহলে দেশের রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন? আর তথ্য হিসেবে এটা সঠিক যে জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে যেসব ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে তিনি একটিবারের জন্য হলেও নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে খালেদা জিয়া তাঁকে প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আইনানুগভাবে দাবি করতে পারেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পরিষ্কার লেখা আছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে। এই ঘোষণাপত্র পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের দুই উপ-অনুচ্ছেদের আওতায় সপ্তম তফসিলে সন্নিবেশিত রয়েছে।
এটা সবারই জানা যে শপথ গ্রহণ ছাড়া সংবিধানের কোনো পদধারী দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। এবং আমরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে দেখি, ‘সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপরাষ্ট্রপতি থাকবেন।’ এতে আরও লেখা আছে, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি না থাকা বা রাষ্ট্রপতি তাঁহার কার্যভার গ্রহণ করিতে অসমর্থ হওয়া বা তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে অসমর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রপতির উপর এতদ্বারা অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপরাষ্ট্রপতির থাকিবে এবং তিনি উহা প্রয়োগ ও পালন করিবেন।’
সুতরাং ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, এটা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রেও তিনি হয়তো প্রথম রাষ্ট্রপতি ঘোষক বলে তাঁর অনুসারীরা চায়ের টেবিলে আলোচনা করতে পারেন। বিএনপির যুক্তি আরও একটি কারণে অচল। কারণ, জেনারেল জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দাবি করার অল্প সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ করেছিলেন। সুতরাং জিয়া তাঁর জীবদ্দশায় কেন নিজেকে প্রথম রাষ্ট্রপতি দূরে থাক, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবেও জাহির করেননি, সেটা বোধগম্য।
গত ২৯ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংবিধান পর্যালোচনা শীর্ষক একটি আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে বাহাত্তরের সংবিধানে কীভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার ওপর বেশি আলো ফেলা হয়েছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেছিলাম, বাহাত্তরের সংবিধানপ্রণেতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, বাহাত্তরের সংবিধান ৪২ বছর ধরে বাংলাদেশের সব ধরনের নেতা গ্রহণ, অনুসরণ ও সমর্থন করে চলেছেন। ১৭ গবেষক উল্লেখ করেছেন, বঙ্গবন্ধু কীভাবে চতুর্থ সংশোধনীতে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী থেকে বিনা ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করিয়ে নিয়েছিলেন। এই যুক্তি কি অসংগত যে জিয়াও বিনা নির্বাচনে নিজেকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন?
প্রথম রাষ্ট্রপতি হওয়া প্রসঙ্গে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়াকে যে কথাটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার, তা হলো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যেক সামরিক ও বেসামরিক শাসক অতিক্রম করে গিয়েছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার বিতর্কিত রায় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে বিতর্কে ফেলেছে। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে তিনি যে অসাধারণ যুক্তির অবতারণা করেছেন, তা খণ্ডন করে কার সাধ্য?
আজ সংসদে বিএনপির নেতাদের আক্রমণ করতে শালীনতার সীমা অতিক্রম করার দরকার নেই। শুধু বিএনপিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার যে জেনারেল ক্রমওয়েল, যিনি ১৬৫৩ সালে নিজেকে লর্ড প্রটেক্টর অব ইংল্যান্ড ঘোষণা করেছিলেন। তিনি আইনের শাসন থেকে পালাতে পারেননি। ১৬৬১ সালে ব্রিটিশরা তাঁর বিচার করেছিল। বিএনপির নেতাদের উচিত হবে ইংল্যান্ডের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। তারেক রহমানের উচিত হবে জেনারেল অলিভার ক্রমওয়েলের সমাধি পরিদর্শন করা।
তবে জেনারেল অলিভার ক্রমওয়েল কিন্তু নিজেকে আইন সৃষ্টি করার স্বর্গীয় ক্ষমতাধর ঘোষণা করেননি। বঙ্গবন্ধু করেননি। জিয়াউর রহমান করেছেন। মধ্যযুগের ইংল্যান্ডও জিয়ার ফরমান দেখে লজ্জিত হতো। কারণ, ১৫৩৯ সালে ব্রিটেন শেষবারের মতো আইন করেছিল। রাজা সংসদ ছাড়াই আইন সৃষ্টি করতে পারবেন। কিন্তু সেটা ১৫৫৩ সালের মধ্যে বিলোপ করা হয়। আর এই বিলুপ্তির প্রায় ৪০০ বছর পরে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল ফরমান জারি করলেন। আজ থেকে সামরিক শাসন তুলে নেওয়া হলো; ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যা জারি করা হয়েছিল। তবে এখন থেকে রাষ্ট্রপতি চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো প্রয়োজনে তিনি তাঁর খুশিমতো ফরমান জারি করতে পারবেন। সংবিধান বা আইন তাঁকে বাধা দেবে না। সবার ওপরে ফরমান সত্য তাহার ওপরে আর কিছু নাই—এ রকমের একটি বিধান ৩২ বছর ধরে বাংলাদেশ বয়ে চলেছে। সুতরাং প্রথম রাষ্ট্রপতি বিতর্ককে কেন্দ্র করে আত্মজিজ্ঞাসার জাগরণ ঘটুক, সেটাই প্রার্থনা করি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
এই যুক্তি অসমীচীন নয় যে যেকোনো নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। জিয়াউর রহমানকে যে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করেছেন তারেক রহমান এবং তাঁর মা, সেটা বাক্-স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। যদিও প্রচলিত আইন, যা খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন, রক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করে এসেছেন, সে রকমের একটি বিধানের আওতায় তাঁর ওই দাবি সংগতিপূর্ণ নয়। রাষ্ট্রপতিতত্ত্ব নিয়ে সহকর্মী সোহরাব হাসান এর আগে নিবন্ধ লিখেছেন। সুতরাং রাজনীতির দিকে যাচ্ছি না। আইনগত দিকটি খতিয়ে দেখব। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়কেই বলব, এ রকমের একটি আইন আমাদের থাকা উচিত কি না?
এই বিধান সম্পর্কে প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছিলেন ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ। তখন মাঝেমধ্যে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা নিয়ে বিতর্ক হতো। আওয়ামী লীগ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হতো। গতকাল জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটি মানহানির মামলা করা হয়েছে। এটা অবশ্য মানহানি মামলার বিষয় হতে পারে না। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আদালতে যুক্তি নিবেদন করতে পারেন যে জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলা দণ্ডবিধির পরিপন্থী। কারণ, দণ্ডবিধি বলেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধাচরণ এমনকি আকার-ইঙ্গিতেও তা করা হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়া যাবে। এটা বিস্ময়কর যে বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি নিয়েও বিএনপির নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের জন্মসনদ। আবদুল মতিন খসরু আইনমন্ত্রী থাকাকালে এটি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।
রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত তাহলে দেশের রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন? আর তথ্য হিসেবে এটা সঠিক যে জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে যেসব ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে তিনি একটিবারের জন্য হলেও নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে খালেদা জিয়া তাঁকে প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আইনানুগভাবে দাবি করতে পারেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পরিষ্কার লেখা আছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে। এই ঘোষণাপত্র পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের দুই উপ-অনুচ্ছেদের আওতায় সপ্তম তফসিলে সন্নিবেশিত রয়েছে।
এটা সবারই জানা যে শপথ গ্রহণ ছাড়া সংবিধানের কোনো পদধারী দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। এবং আমরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে দেখি, ‘সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপরাষ্ট্রপতি থাকবেন।’ এতে আরও লেখা আছে, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি না থাকা বা রাষ্ট্রপতি তাঁহার কার্যভার গ্রহণ করিতে অসমর্থ হওয়া বা তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে অসমর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রপতির উপর এতদ্বারা অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপরাষ্ট্রপতির থাকিবে এবং তিনি উহা প্রয়োগ ও পালন করিবেন।’
সুতরাং ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, এটা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রেও তিনি হয়তো প্রথম রাষ্ট্রপতি ঘোষক বলে তাঁর অনুসারীরা চায়ের টেবিলে আলোচনা করতে পারেন। বিএনপির যুক্তি আরও একটি কারণে অচল। কারণ, জেনারেল জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দাবি করার অল্প সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ করেছিলেন। সুতরাং জিয়া তাঁর জীবদ্দশায় কেন নিজেকে প্রথম রাষ্ট্রপতি দূরে থাক, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবেও জাহির করেননি, সেটা বোধগম্য।
গত ২৯ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংবিধান পর্যালোচনা শীর্ষক একটি আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে বাহাত্তরের সংবিধানে কীভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার ওপর বেশি আলো ফেলা হয়েছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেছিলাম, বাহাত্তরের সংবিধানপ্রণেতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, বাহাত্তরের সংবিধান ৪২ বছর ধরে বাংলাদেশের সব ধরনের নেতা গ্রহণ, অনুসরণ ও সমর্থন করে চলেছেন। ১৭ গবেষক উল্লেখ করেছেন, বঙ্গবন্ধু কীভাবে চতুর্থ সংশোধনীতে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী থেকে বিনা ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করিয়ে নিয়েছিলেন। এই যুক্তি কি অসংগত যে জিয়াও বিনা নির্বাচনে নিজেকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন?
প্রথম রাষ্ট্রপতি হওয়া প্রসঙ্গে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়াকে যে কথাটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার, তা হলো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যেক সামরিক ও বেসামরিক শাসক অতিক্রম করে গিয়েছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার বিতর্কিত রায় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে বিতর্কে ফেলেছে। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে তিনি যে অসাধারণ যুক্তির অবতারণা করেছেন, তা খণ্ডন করে কার সাধ্য?
আজ সংসদে বিএনপির নেতাদের আক্রমণ করতে শালীনতার সীমা অতিক্রম করার দরকার নেই। শুধু বিএনপিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার যে জেনারেল ক্রমওয়েল, যিনি ১৬৫৩ সালে নিজেকে লর্ড প্রটেক্টর অব ইংল্যান্ড ঘোষণা করেছিলেন। তিনি আইনের শাসন থেকে পালাতে পারেননি। ১৬৬১ সালে ব্রিটিশরা তাঁর বিচার করেছিল। বিএনপির নেতাদের উচিত হবে ইংল্যান্ডের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। তারেক রহমানের উচিত হবে জেনারেল অলিভার ক্রমওয়েলের সমাধি পরিদর্শন করা।
তবে জেনারেল অলিভার ক্রমওয়েল কিন্তু নিজেকে আইন সৃষ্টি করার স্বর্গীয় ক্ষমতাধর ঘোষণা করেননি। বঙ্গবন্ধু করেননি। জিয়াউর রহমান করেছেন। মধ্যযুগের ইংল্যান্ডও জিয়ার ফরমান দেখে লজ্জিত হতো। কারণ, ১৫৩৯ সালে ব্রিটেন শেষবারের মতো আইন করেছিল। রাজা সংসদ ছাড়াই আইন সৃষ্টি করতে পারবেন। কিন্তু সেটা ১৫৫৩ সালের মধ্যে বিলোপ করা হয়। আর এই বিলুপ্তির প্রায় ৪০০ বছর পরে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল ফরমান জারি করলেন। আজ থেকে সামরিক শাসন তুলে নেওয়া হলো; ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যা জারি করা হয়েছিল। তবে এখন থেকে রাষ্ট্রপতি চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো প্রয়োজনে তিনি তাঁর খুশিমতো ফরমান জারি করতে পারবেন। সংবিধান বা আইন তাঁকে বাধা দেবে না। সবার ওপরে ফরমান সত্য তাহার ওপরে আর কিছু নাই—এ রকমের একটি বিধান ৩২ বছর ধরে বাংলাদেশ বয়ে চলেছে। সুতরাং প্রথম রাষ্ট্রপতি বিতর্ককে কেন্দ্র করে আত্মজিজ্ঞাসার জাগরণ ঘটুক, সেটাই প্রার্থনা করি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments