’৯৯-এর নির্বাচনী ফল ধরে বাজি by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতের সেরা পার্বণ লোকসভা ভোটের
তাপ-উত্তাপ চৈত্রের দাবদাহের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। নতুন ভোট মানে
নতুন সরকার। নতুন সরকারের সম্ভাব্য স্থিতিশীলতার প্রভাব পড়েছে দেশের
অর্থনীতির ওপরেও। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ভারতের অর্থনীতির মূল্যায়ন
নতুনভাবে করেছে। হতাশার বদলে সেই চালচিত্রে এখন সোনালি ইঙ্গিত। কারেন্ট
অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট উল্লেখযোগ্য কমে গেছে।
শেয়ারবাজার
ঘুরে দাঁড়িয়ে তেজিয়ান। ডলারের তুলনায় রুপির শক্তি বাড়ছে হইহই করে। ৬৮
থেকে, ৬৯ থেকে উঠে ৬০-এর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে রুপি। প্রধানমন্ত্রী
মনমোহন সিং ও অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের ঠোঁটের ফাঁকে তৃপ্তির ঝিলিক।
ভাবখানা এমন যে আমাদের ঠিক নীতি ও সিদ্ধান্তের কারণেই এই ঘুরে দাঁড়ানো
সম্ভবপর হলো। কিন্তু সেই তৃপ্তিও তাঁরা উপভোগ করতে পারছেন না দেশজোড়া
সমীক্ষা বা জরিপে কংগ্রেসের করুণ ভবিষ্যতের ছবি ফুটে ওঠায়। লোকজন বলাবলি
করছে, বাজি ধরাও শুরু হয়েছে দুটি বিষয় নিয়ে। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনী ফলকে
বিজেপি ছাপিয়ে যেতে পারবে কি না, কংগ্রেস ওই বছরের চেয়েও খারাপ অবস্থায়
পৌঁছাবে কি না।
কী হয়েছিল ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটের ফল? অটল বিহারী বাজপেয়ি ও লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্ব এবং কার্গিলের যুদ্ধ জয় বিজেপিকে দিয়েছিল ১৮২টি আসন। সরকার গড়েছিল বিজেপি। এবার নরেন্দ্র মোদিতে ভর দেওয়া বিজেপি একাই ২০০ টপকানোর স্বপ্নে বিভোর। পারবেন কি মোদি তাঁর দুই রাজনৈতিক গুরুকে পিছিয়ে দিয়ে নতুন ইতিহাস গড়তে? এটা যদি প্রথম আগ্রহ হয়, দ্বিতীয়টাও তাহলে প্রথমের সঙ্গেই লটকে রয়েছে। ওই ১৯৯৯ সালেই কংগ্রেস পেয়েছিল তার সবচেয়ে কম আসন। ১১৪টি। এবার সেঞ্চুরি হবে কি হবে না, বাজি ধরা হচ্ছে তা নিয়েই।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে গত দুই দশকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করছে। এটা গণতন্ত্রের সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয়। এ জন্য কোনো একজন মানুষকে যদি কৃতিত্ব দিতে হয়, তাহলে তিনি টি এন সেশন। তিনিই ‘ট্রেন্ড সেটার’। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর এই প্রতিষ্ঠানটি তার মেরুদণ্ড খুঁজে পায়। সেই থেকে একটির পর একটি বছর কেটেছে, নির্বাচন কমিশনও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে খুঁজে পেয়েছে তার স্বকীয়তা। আজ এমন একটিও দল নেই বা একজনও নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে পার পেয়ে যাবেন কিংবা নির্বাচন কমিশনকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখেন। নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই), সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন (সিভিসি), কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) এবং গণতন্ত্রের তৃতীয় খাম্বা বিচার বিভাগ। এ দেশের কোনো সরকারের পক্ষেই আজ এসব সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি ইচ্ছামতো ব্যবহার কিংবা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এই পরিবর্তনে অবশ্যই বড় ভাগীদার ভারতের মিডিয়া। গত দুই দশকের ভারতে এটাই নিঃশব্দ বিপ্লব।
অবশ্য এখনো অনেক রাস্তা হাঁটা বাকি। বিশেষ করে ভারতের নির্বাচন কমিশনের। এখনো রাষ্ট্রীয় তহবিলে ভোটের ব্যবস্থা করা গেল না। এখনো রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। রাজনীতি যে দেদার টাকা লোটার জায়গা এবং রাজনৈতিক নেতা মানেই সাত খুন মাপ, সেই ধারণাও সম্পূর্ণ বদলানো যায়নি। তবে নির্বাচন কমিশন চেষ্টার খামতি রাখছে না। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন কমিশন নানা আঞ্চলিক ভাষায় বড় বড় হোর্ডিং দিয়েছে। তাতে লেখা, ‘আজ কেউ যদি আপনার ভোট কেনার চেষ্টা করে, আগামীকাল তাহলে সে দুর্নীতিগ্রস্ত হবে।’ বছরের পর বছর এ ধরনের প্রচারে লাভ যে হয়নি, তা নয়। তবে এটাও ঠিক যে নির্বাচন কমিশনের বজ্র আঁটুনি সত্ত্বেও ভোটে কালোটাকার ঝনঝনানি থেমে যায়নি। কিংবা নেতাদের সম্পদের বহরবৃদ্ধি ঠেকানো যায়নি।
নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পত্তির পরিমাণ জানানো বাধ্যতামূলক। আশ্চর্যের বিষয় এটাই, ভোটে দাঁড়িয়ে যাঁরা জেতেন বা হারেন, পাঁচ বছরে তাঁদের সম্পত্তি অদ্ভুতভাবে বেড়ে যায়। হলফনামায় সম্পত্তির পরিমাণ জানানোর বিধান থাকায় ভোটারদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে হয়তো। কেননা কে কেমন লুটেছে তা জানা যাচ্ছে, কিন্তু প্রার্থীদের সম্পদের পরিমাণ কমার কোনো লক্ষণ নেই। অথচ, কমিশন আরেকটু সাহসী ও উদ্যোগী হলে এই রোগটা কিন্তু সারানো যায়।
কী করে? কমিশনকে নির্দেশ দিতে হবে, শুধু স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ জানালেই হবে না, কোন উপায়ে তা অর্জিত, সেই তথ্যও জানাতে হবে। কমিশনের অধীনে আয়কর বিভাগ, এনফোর্সমেন্ট বিভাগ ও সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের যোগ্য অফিসারদের রাখতে হবে, যাঁরা সেই তথ্য খতিয়ে দেখবেন। আয় সংগতিহীন সন্দেহ হলে কমিশন তদন্তের নির্দেশ দেবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত ও বিচার শেষ করতে হবে। দোষী প্রতিপন্নদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে।
এই উপায় না থাকলে প্রার্থীরা স্রেফ হলফনামা দিয়েই খালাস। বছরের পর বছর প্রার্থীদের আয়ও গগনচুম্বী হতে থাকবে। বাংলাদেশে গত নির্বাচনে দেখা গেছে, কারও কারও সম্পত্তি কয়েক শ গুণ বেড়েছে। ভারতে এবারের ভোটে চারজন প্রার্থীর সম্পত্তির হিসাবও বেশ কৌতূহলের। সাবেক হকি ক্যাপ্টেন দিলীপ টিরকে ওডিশার সুন্দরগড় থেকে বিজু জনতা দলের টিকিটে প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। ২০১২ সালে তাঁর ও স্ত্রীর সম্পত্তির মোট পরিমাণ ছিল দুই কোটি ২৬ লাখের মতো, এক বছরে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় পৌনে ছয় কোটি রুপি। মানেকা গান্ধী বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়েছেন উত্তর প্রদেশের আঁওলা থেকে। ২০০৯ সালে তাঁর মোট সম্পত্তি ছিল ১৮ কোটি ২৮ লাখ রুপি। চার বছরে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি রুপি। কংগ্রেসের জয়রাজ সিং দাঁড়িয়েছেন রাজস্থানের কোটা কেন্দ্র থেকে। পাঁচ বছরে তাঁর সম্পত্তি সাড়ে ১৭ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮ কোটি রুপি। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে দীপেন্দ্র সিং হুডা কংগ্রেসের টিকিটে এবারও লড়ছেন রোহতক থেকে। ২০০৯ সালে তাঁর সম্পত্তি ছিল সাড়ে ছয় কোটি রুপি। চার বছরে তার বৃদ্ধি ঘটেছে ছয় গুণ। হয়েছে প্রায় ৩৬ কোটি রুপি। হলফনামায় তিনি অবশ্য একটা ‘ফুটনোট’ দিয়েছেন। উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর স্ত্রী পেয়েছেন নয় কোটি রুপি।
ভোট দিয়ে শুরু করেছিলাম, ভোটের রঙ্গ দিয়েই শেষ করি। ‘হর হর মহাদেব’-এর আদলে ‘হর হর মোদি, ঘর ঘর মোদি’ স্লোগান নিয়ে ভারতের গো বলয়ে এখন তুলকালাম চলছে। মোদির নিন্দুকেরা বলাবলি করছে, মোদি শুধু বারানসি থেকেই দাঁড়াচ্ছেন না, নিজেকে তিনি বাবা বিশ্বনাথ ভেবে নিয়েছেন! তাই হর হর মহাদেবের জায়গায় হর হর মোদি স্লোগান শোনাচ্ছেন। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে নালিশও হয়েছে। কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিংয়ের সঙ্গে বিজেপির সুষমা স্বরাজের বেশ টক্কর চলল দিন কয়েক ধরে। দিগ্বিজয় বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে মোদির চেয়ে সুষমা স্বরাজ ঢের বেশি যোগ্য।’ শুনে সুষমা নিশ্চিতই আনন্দ পেয়েছেন। তবে ভোটের বাজার তো, তাই পাল্টা শোনালেন, ‘রাহুল গান্ধীর চেয়েও দিগ্বিজয় অনেক ভালো ও যোগ্য নেতা।’ ভোট-রঙ্গে এগুলো হলো ঢিলের বদলে পাটকেল।
তবে মজার ঘটনাটা ঘটেছে ছত্তিশগড়ে। এই রাজ্যে মহাসমুন্দ নামে একটি কেন্দ্র আছে। ২০০৪ সালে সেই কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন রাজ্যের সাবেক কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী অজিত যোগী। ২০০৯ সালে অজিত ভোটে লড়েননি কিন্তু এবার লড়ছেন। সেবার জিতেছিলেন বিজেপির চন্দুলাল সাহু। এবারও তিনিই বিজেপির প্রার্থী। মনোনয়ন পেশের পরে তালিকা দেখে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। মোট ৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে ১১ জনের নাম চন্দুলাল সাহু অথবা চন্দুরাম সাহু! বিজেপির চন্দুলাল মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। এতগুলো চন্দুলাল ও চন্দুরামে ভোটাররা যে ভিরমি
খেয়ে যাবেন? শাপশাপান্ত করছেন তিনি অজিত যোগীর। আর অজিত মিটিমিটি হাসছেন। কে জানে বলছেনও হয়তো, ‘অল ইজ
ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।’ ভোট তো যুদ্ধই।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
কী হয়েছিল ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটের ফল? অটল বিহারী বাজপেয়ি ও লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্ব এবং কার্গিলের যুদ্ধ জয় বিজেপিকে দিয়েছিল ১৮২টি আসন। সরকার গড়েছিল বিজেপি। এবার নরেন্দ্র মোদিতে ভর দেওয়া বিজেপি একাই ২০০ টপকানোর স্বপ্নে বিভোর। পারবেন কি মোদি তাঁর দুই রাজনৈতিক গুরুকে পিছিয়ে দিয়ে নতুন ইতিহাস গড়তে? এটা যদি প্রথম আগ্রহ হয়, দ্বিতীয়টাও তাহলে প্রথমের সঙ্গেই লটকে রয়েছে। ওই ১৯৯৯ সালেই কংগ্রেস পেয়েছিল তার সবচেয়ে কম আসন। ১১৪টি। এবার সেঞ্চুরি হবে কি হবে না, বাজি ধরা হচ্ছে তা নিয়েই।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে গত দুই দশকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করছে। এটা গণতন্ত্রের সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয়। এ জন্য কোনো একজন মানুষকে যদি কৃতিত্ব দিতে হয়, তাহলে তিনি টি এন সেশন। তিনিই ‘ট্রেন্ড সেটার’। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর এই প্রতিষ্ঠানটি তার মেরুদণ্ড খুঁজে পায়। সেই থেকে একটির পর একটি বছর কেটেছে, নির্বাচন কমিশনও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে খুঁজে পেয়েছে তার স্বকীয়তা। আজ এমন একটিও দল নেই বা একজনও নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে পার পেয়ে যাবেন কিংবা নির্বাচন কমিশনকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখেন। নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই), সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন (সিভিসি), কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) এবং গণতন্ত্রের তৃতীয় খাম্বা বিচার বিভাগ। এ দেশের কোনো সরকারের পক্ষেই আজ এসব সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি ইচ্ছামতো ব্যবহার কিংবা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এই পরিবর্তনে অবশ্যই বড় ভাগীদার ভারতের মিডিয়া। গত দুই দশকের ভারতে এটাই নিঃশব্দ বিপ্লব।
অবশ্য এখনো অনেক রাস্তা হাঁটা বাকি। বিশেষ করে ভারতের নির্বাচন কমিশনের। এখনো রাষ্ট্রীয় তহবিলে ভোটের ব্যবস্থা করা গেল না। এখনো রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। রাজনীতি যে দেদার টাকা লোটার জায়গা এবং রাজনৈতিক নেতা মানেই সাত খুন মাপ, সেই ধারণাও সম্পূর্ণ বদলানো যায়নি। তবে নির্বাচন কমিশন চেষ্টার খামতি রাখছে না। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন কমিশন নানা আঞ্চলিক ভাষায় বড় বড় হোর্ডিং দিয়েছে। তাতে লেখা, ‘আজ কেউ যদি আপনার ভোট কেনার চেষ্টা করে, আগামীকাল তাহলে সে দুর্নীতিগ্রস্ত হবে।’ বছরের পর বছর এ ধরনের প্রচারে লাভ যে হয়নি, তা নয়। তবে এটাও ঠিক যে নির্বাচন কমিশনের বজ্র আঁটুনি সত্ত্বেও ভোটে কালোটাকার ঝনঝনানি থেমে যায়নি। কিংবা নেতাদের সম্পদের বহরবৃদ্ধি ঠেকানো যায়নি।
নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পত্তির পরিমাণ জানানো বাধ্যতামূলক। আশ্চর্যের বিষয় এটাই, ভোটে দাঁড়িয়ে যাঁরা জেতেন বা হারেন, পাঁচ বছরে তাঁদের সম্পত্তি অদ্ভুতভাবে বেড়ে যায়। হলফনামায় সম্পত্তির পরিমাণ জানানোর বিধান থাকায় ভোটারদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে হয়তো। কেননা কে কেমন লুটেছে তা জানা যাচ্ছে, কিন্তু প্রার্থীদের সম্পদের পরিমাণ কমার কোনো লক্ষণ নেই। অথচ, কমিশন আরেকটু সাহসী ও উদ্যোগী হলে এই রোগটা কিন্তু সারানো যায়।
কী করে? কমিশনকে নির্দেশ দিতে হবে, শুধু স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ জানালেই হবে না, কোন উপায়ে তা অর্জিত, সেই তথ্যও জানাতে হবে। কমিশনের অধীনে আয়কর বিভাগ, এনফোর্সমেন্ট বিভাগ ও সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের যোগ্য অফিসারদের রাখতে হবে, যাঁরা সেই তথ্য খতিয়ে দেখবেন। আয় সংগতিহীন সন্দেহ হলে কমিশন তদন্তের নির্দেশ দেবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত ও বিচার শেষ করতে হবে। দোষী প্রতিপন্নদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে।
এই উপায় না থাকলে প্রার্থীরা স্রেফ হলফনামা দিয়েই খালাস। বছরের পর বছর প্রার্থীদের আয়ও গগনচুম্বী হতে থাকবে। বাংলাদেশে গত নির্বাচনে দেখা গেছে, কারও কারও সম্পত্তি কয়েক শ গুণ বেড়েছে। ভারতে এবারের ভোটে চারজন প্রার্থীর সম্পত্তির হিসাবও বেশ কৌতূহলের। সাবেক হকি ক্যাপ্টেন দিলীপ টিরকে ওডিশার সুন্দরগড় থেকে বিজু জনতা দলের টিকিটে প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। ২০১২ সালে তাঁর ও স্ত্রীর সম্পত্তির মোট পরিমাণ ছিল দুই কোটি ২৬ লাখের মতো, এক বছরে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় পৌনে ছয় কোটি রুপি। মানেকা গান্ধী বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়েছেন উত্তর প্রদেশের আঁওলা থেকে। ২০০৯ সালে তাঁর মোট সম্পত্তি ছিল ১৮ কোটি ২৮ লাখ রুপি। চার বছরে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি রুপি। কংগ্রেসের জয়রাজ সিং দাঁড়িয়েছেন রাজস্থানের কোটা কেন্দ্র থেকে। পাঁচ বছরে তাঁর সম্পত্তি সাড়ে ১৭ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮ কোটি রুপি। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে দীপেন্দ্র সিং হুডা কংগ্রেসের টিকিটে এবারও লড়ছেন রোহতক থেকে। ২০০৯ সালে তাঁর সম্পত্তি ছিল সাড়ে ছয় কোটি রুপি। চার বছরে তার বৃদ্ধি ঘটেছে ছয় গুণ। হয়েছে প্রায় ৩৬ কোটি রুপি। হলফনামায় তিনি অবশ্য একটা ‘ফুটনোট’ দিয়েছেন। উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর স্ত্রী পেয়েছেন নয় কোটি রুপি।
ভোট দিয়ে শুরু করেছিলাম, ভোটের রঙ্গ দিয়েই শেষ করি। ‘হর হর মহাদেব’-এর আদলে ‘হর হর মোদি, ঘর ঘর মোদি’ স্লোগান নিয়ে ভারতের গো বলয়ে এখন তুলকালাম চলছে। মোদির নিন্দুকেরা বলাবলি করছে, মোদি শুধু বারানসি থেকেই দাঁড়াচ্ছেন না, নিজেকে তিনি বাবা বিশ্বনাথ ভেবে নিয়েছেন! তাই হর হর মহাদেবের জায়গায় হর হর মোদি স্লোগান শোনাচ্ছেন। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে নালিশও হয়েছে। কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিংয়ের সঙ্গে বিজেপির সুষমা স্বরাজের বেশ টক্কর চলল দিন কয়েক ধরে। দিগ্বিজয় বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে মোদির চেয়ে সুষমা স্বরাজ ঢের বেশি যোগ্য।’ শুনে সুষমা নিশ্চিতই আনন্দ পেয়েছেন। তবে ভোটের বাজার তো, তাই পাল্টা শোনালেন, ‘রাহুল গান্ধীর চেয়েও দিগ্বিজয় অনেক ভালো ও যোগ্য নেতা।’ ভোট-রঙ্গে এগুলো হলো ঢিলের বদলে পাটকেল।
তবে মজার ঘটনাটা ঘটেছে ছত্তিশগড়ে। এই রাজ্যে মহাসমুন্দ নামে একটি কেন্দ্র আছে। ২০০৪ সালে সেই কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন রাজ্যের সাবেক কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী অজিত যোগী। ২০০৯ সালে অজিত ভোটে লড়েননি কিন্তু এবার লড়ছেন। সেবার জিতেছিলেন বিজেপির চন্দুলাল সাহু। এবারও তিনিই বিজেপির প্রার্থী। মনোনয়ন পেশের পরে তালিকা দেখে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। মোট ৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে ১১ জনের নাম চন্দুলাল সাহু অথবা চন্দুরাম সাহু! বিজেপির চন্দুলাল মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। এতগুলো চন্দুলাল ও চন্দুরামে ভোটাররা যে ভিরমি
খেয়ে যাবেন? শাপশাপান্ত করছেন তিনি অজিত যোগীর। আর অজিত মিটিমিটি হাসছেন। কে জানে বলছেনও হয়তো, ‘অল ইজ
ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।’ ভোট তো যুদ্ধই।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments