বাংলাদেশ কি থিনিড হবে? by পাভেল পার্থ
থিনিডভিল শহরের কোথাও কোনো জীবিত গাছ নেই।
সব প্লাস্টিক, সব মেশিনে চলে। রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম চাপলেই গাছ নাচে,
দোল খায়, রঙ বদলায়। রাতে আলোও জ্বালায়। মাঝে মধ্যে ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে
আবার নতুন ব্যাটারি ভরে গাছকে চাঙ্গা করতে হয়। ও'হেয়ার নামের একটি কোম্পানি
মূলত থিনিড শহরটি চালায়। যেহেতু শহরে কোনো গাছ নেই, ও'হেয়ার কোম্পানিটিই
বোতলে ভরে অক্সিজেন বিক্রি করে। শহরের এ অবস্থাটি মূলত তৈরি হয়েছে
ওয়ান্স-লারের জন্য। গরিব ওয়ান্স-লার একদিন খুঁজে পায় হরেক রকম গাছ আর
প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এক অনিন্দ্যসুন্দর অঞ্চল। গাছ কেটে সেখানেই থিনিড
শহর বানানোর পরিকল্পনা করে সে। অরণ্য ও প্রকৃতির রক্ষক লোরাক্স
ওয়ান্স-লারকে বৃক্ষহত্যা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানায়। বনের
পশুপাখি-মাছেরা মিলে ওয়ান্স-লারের কাছে গাছের প্রাণভিক্ষা চায়। কিন্তু
ওয়ান্স-লার সেসব কানে নেয় না। উন্মত্ত হয়ে ওঠে, শেষ জীবিত গাছটিও কেটে
ফেলে। তৈরি হয় গাছবিহীন এক নতুন শহুর থিনিডভিল। ততদিনে ওয়ান্স-লার থেকে
শহরের মালিকানা দখল করে ও'হেয়ার ও তার পোষা মাস্তান বাহিনী। থিনিড শহরের এক
ছোট্ট ছেলে টেড উইগিনস ও ছোট্ট মেয়ে অদ্রি। অদ্রি সত্যিকারের গাছেদের ছবি
আঁকে, টেড অদ্রিকে একটি সত্যিকারের গাছ উপহার দিতে চায়। কিন্তু কোথাও কোনো
গাছ নেই আর। টেডের দিদিমা তাকে ওয়ান্স-লারের সন্ধান দেয়। জীবনের ঝুঁকি
নিয়ে, ও'হেয়ারের কড়া নিরাপত্তাবলয় মাড়িয়ে টেড ওয়ান্স-লারের কাছে পেঁৗছে।
ততদিনে প্রবীণ ওয়ান্স-লার নিজের সর্বনাশা কাজের জন্য অনুতপ্ত। বুঝতে পেরেছে
গাছহত্যার কী করুণ নির্মম পরিণতি হতে পারে। ওয়ান্স-লারের কাছে ট্রাফুলা
গাছের একটিমাত্র বীজ ছিল। টেডকে উপহার দেয় সে, বলে থিনিড শহরের
কেন্দ্রস্থলে একে রোপণ করতে হবে। হয়তো এভাবে আবারও মানুষের কাছে সত্যিকারের
গাছের গুরুত্ব তৈরি হবে। কাজটি সহজ হয় না। ও'হেয়ার কোনোভাবেই শহরে কোনো
সত্যিকারের গাছ লাগাতে দিতে নারাজ। কারণ গাছ বিনামূল্যে অক্সিজেন জোগায়, আর
সে অক্সিজেন ব্যবসা করে। প্লাস্টিক জীবনে অভ্যস্ত মানুষও প্রথম সত্যিকারের
গাছ লাগানোর বিপক্ষে যায়। তারপর শহরের অতিষ্ঠ জনতাই ও'হেয়ারের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়ায় এবং সবাই মিলে থিনিডে আবারও ফিরিয়ে আনে সত্যিকারের বৃক্ষপ্রাণ।
ওপরের এ কাহিনীটি সত্যি নয়, ২০১২ সালে ইউনিভার্সাল স্টুডিও থেকে নির্মিত
'দ্য লোরাক্স' নামের একটি কার্টুন অ্যানিমেশন ছবির সংক্ষিপ্ত বিবরণ। ড.
সিউসের কাহিনী থেকে ক্রিস রিনাউড এটি নির্মাণ করেছেন।
২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপিসহ ১৮ দল এবং হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে নির্বিচার বৃক্ষহত্যা কর্মসূচি দেখে 'দ্য লোরাক্স' ছবির কথা মনে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে, রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গাছ কাটা একটি কর্মসূচিতে পরিণত হলে বাংলাদেশের অবস্থাও লোরাক্স ছবির থিনিডের মতোই হবে। হয়তো তখন আর কোনো গরিব মানুষ থাকবে না, লুটেরা ধনী দুর্বৃত্ত টাকার মালিকরাই বোতলজাত অক্সিজেন বিক্রি ও ব্যবহার করবে। গাছ বাঁচিয়ে রাখলে গরিবের উপকার হয়। গরিব বিনা পয়সায় জীবনের দম পায়, জ্বালানির জন্য লাকড়ি ও ঝরা পাতা, জীবনের জন্য খাবার, বেঁচে থাকার জন্য ওষুধপথ্য, মাথার ওপরের ছাউনি ও শরীর ঢাকার কাপড়। ধনী ও দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদদের হয়তো গাছের কোনোই দরকার নেই। গাছ না থাকলেও তাদের কিছুই যায়-আসবে না হয়তো। টাকা দিয়ে কিছুদিন চলতে-ফিরতে পারার মতো অক্সিজেন, খাবার, পানি সবই কৃত্রিমভাবে তৈরি করে একটা জীবন তারা পাড়ি দিতে পারবেন বা দেশকে জ্বালিয়ে-মাড়িয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাবেন। নির্বিচার গাছ হত্যার বিরুদ্ধে কেউই জোরদারভাবে রুখে দাঁড়াননি। রাজনৈতিক সহিংসতায় ১০ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে খুন হয় কক্সবাজারের টেকনাফ-বাহারছড়া সড়কে শিলখালী অরণ্যের শত বছরের গর্জন মাতৃবৃক্ষ। ৫ মে ২০১৩ ঢাকায় হেফাজতে ইসলাম নির্বিচারে রক্তাক্ত করে পাবলিক বৃক্ষগুলো। বছরজুড়ে চলে এ নির্মম হত্যাকাণ্ড। অথচ পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে, 'আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপকস্ফ শস্যরাজি উদ্গত করি (সুরা কাফ, আয়াত : ৭ ও ৯)। অনর্থক বৃক্ষনিধন ও বন উজাড়কে ইসলামে গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধে রওনা হওয়ার সময় রাসূলে করিম (সা.) সৈন্যদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিতেন, যাতে কেউ কোনো গাছপালা ও শস্যক্ষেত ধ্বংস না করে। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে বরই গাছ কেটেছে তাকে আল্লাহ মাথা নিচু করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন (আবু দাউদ)। কিন্তু ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বৃক্ষহত্যাকালে রাজনৈতিক সহিংসতাগুলো কোনো ধর্ম, দর্শন, প্রথা, রীতি, নিষেধাজ্ঞা, আইন, নীতি কি জনসংস্কৃতির তোয়াক্কা করেনি। এ সময়টাতে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপিসহ ১৮ দলের হরতাল-অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে নৃশংস কায়দায় খুন হয়েছে দেশের অগণিত পাবলিক বৃক্ষ। বট, আম, শিশু, অর্জুন, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, মেহগনি, কড়ই, বৃষ্টিগাছ, সেগুন, কাঁঠাল গাছ নিহত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এমনকি চুনাতি অভয়ারণ্যের দুইশ' বছরের এক গর্জন মাতৃবৃক্ষও রেহাই পায়নি এ নৃশংস রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে।
গাছ সব সমাজে, সব ধর্মে ও সংস্কৃতিতে কেন্দ্রীয় আরাধনার বিষয়। আদিবাসী মান্দি পুরাণ মতে, দেবতা বাগবা-বরম্বির তলপেট থেকে জন্ম নিয়েছে গাছ। সাঁওতাল কাহিনীমতে, দুনিয়ার প্রথম মানুষ পিলচু হরম ও পিলচু বুড়ির সঙ্গে পয়লা সখ্য হয় আদি বৃক্ষপ্রাণের। ত্রিপুরা আদিবাসীদের জন্মকাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাতিয়ান গাছ, বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঘরের কাছে এ গাছ লাগানো হয়। অনেক জাতির গোত্রপ্রতীক গাছ, যা তারা কখনও কাটে না। সাঁওতালদের হেমব্রম গোত্রের প্রতীক সুপারি গাছ ও মারাণ্ডীদের দূর্বা। আদি ধর্ম পালনকারী জেন্টিল খাসি ও জৈন্তিয়াদের সুরং গোত্র রম্বুই গাছ কখনও কাটে না, এটি তাদের সামাজিক নিষেধাজ্ঞা। হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রে নবরত্নের অন্যতম রূপ কল্পবৃক্ষ, বৃক্ষ পূজিত হয় সর্বব্যাপী সত্তা হিসেবে। বৌদ্ধ ধর্মেও বোধিবৃক্ষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক অনন্য ব্যঞ্জনা। এমনকি মান্দিদের ভেতর স্বপ্নে গাছ কাটা দেখাও অশুভ লক্ষণ। বৃক্ষের প্রতি এই জনপদে এ রকম শতসহস্র দরদি নির্দেশনা ও পবিত্র বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও তাহলে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে একের পর এক নির্বিচারে কারা কোন বিশ্বাসে গাছগুলো খুন করল? উল্টেপাল্টে দিল স্থানীয় প্রতিবেশীয় বাস্তুসংস্থান?
গাছকে ঘিরেই আমাদের জীবন-মরণের সংসার। গাছকে নিয়ে, গাছকে ঘিরে অবশ্যই রাজনীতি হবে। প্রাকৃতিক শালবন উপড়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক যখন রাবার গাছ বা আগ্রাসী বৃক্ষের বাগান চাপিয়ে দেবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই গাছেদের সপক্ষে সত্যিকারের রাজনীতি। দেশীয় বেগুনে বিটি জিন ঢুকিয়ে সর্বনাশা বিটিবেগুন মারদাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো গাছ নিয়ে রাজনীতি। গর্জন মাতৃবৃক্ষকে পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে বাঁচানোই সত্যিকারের রাজনীতি। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের নামে একটির পর একটি গাছ খুন হবে, এটি অন্যায়, এটি কোনোভাবেই কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়। একে থামাতে হবে। এটি নিশ্চয়ই কোনোভাবে জয়বাংলা কি জিন্দাবাদের সঙ্গে জড়িত কোনো বিষয় নয়। এর সঙ্গে নিশ্চয়ই ভারত-পাকিস্তান বা কোনো মার্কিন দালালি নেই। জন কেরি, তারানকো, পংকজ শরণ বা ইমরান খান কেউ নিশ্চয়ই অন্তত গাছ কাটার পক্ষে দূতিয়ালি করবেন না। বাংলাদেশ বেগুন, বাঁশ, গভীর পানির ধান, কচু ও হরেক রকম লতাগুল্মের আদি জন্মভূমি। গাছেদের জিনলিপিতে আঁকা আছে আমাদের মেলা ও না-মেলা সব রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর। আসুন গাছের পাশে দাঁড়াই, রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে বৃক্ষপ্রাণ রক্ষায় দেশজুড়ে গড়ে তুলি ন্যায়বিচারের বলয়। থিনিড নয়, আমাদের দেশ বাংলাদেশ। গাছ কেটে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে কোনোভাবেই করপোরেট কোম্পানির দাসত্বে পরিণত করা যাবে না। কারণ এ দেশের নিম্নবর্গ গাছের জন্য প্রাণ দিয়েছে। গাছের সুরক্ষায় নিজের রক্ত ঝরিয়ে চলেছে অবিরাম। আমরা বহন করে চলেছি বৃক্ষ-মানুষ-প্রকৃতির এক জটিল সম্পর্কের বিজ্ঞান। আমরাই দুনিয়ায় প্রথম প্রমাণ করেছি 'গাছের প্রাণ আছে'। রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে গাছের প্রাণ সুরক্ষায় আবারও প্রমাণ করি, আসুন এক সত্যিকারের বৃক্ষরাজনীতি।
গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
animistbnagla@gmail.com
২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপিসহ ১৮ দল এবং হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে নির্বিচার বৃক্ষহত্যা কর্মসূচি দেখে 'দ্য লোরাক্স' ছবির কথা মনে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে, রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গাছ কাটা একটি কর্মসূচিতে পরিণত হলে বাংলাদেশের অবস্থাও লোরাক্স ছবির থিনিডের মতোই হবে। হয়তো তখন আর কোনো গরিব মানুষ থাকবে না, লুটেরা ধনী দুর্বৃত্ত টাকার মালিকরাই বোতলজাত অক্সিজেন বিক্রি ও ব্যবহার করবে। গাছ বাঁচিয়ে রাখলে গরিবের উপকার হয়। গরিব বিনা পয়সায় জীবনের দম পায়, জ্বালানির জন্য লাকড়ি ও ঝরা পাতা, জীবনের জন্য খাবার, বেঁচে থাকার জন্য ওষুধপথ্য, মাথার ওপরের ছাউনি ও শরীর ঢাকার কাপড়। ধনী ও দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদদের হয়তো গাছের কোনোই দরকার নেই। গাছ না থাকলেও তাদের কিছুই যায়-আসবে না হয়তো। টাকা দিয়ে কিছুদিন চলতে-ফিরতে পারার মতো অক্সিজেন, খাবার, পানি সবই কৃত্রিমভাবে তৈরি করে একটা জীবন তারা পাড়ি দিতে পারবেন বা দেশকে জ্বালিয়ে-মাড়িয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাবেন। নির্বিচার গাছ হত্যার বিরুদ্ধে কেউই জোরদারভাবে রুখে দাঁড়াননি। রাজনৈতিক সহিংসতায় ১০ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে খুন হয় কক্সবাজারের টেকনাফ-বাহারছড়া সড়কে শিলখালী অরণ্যের শত বছরের গর্জন মাতৃবৃক্ষ। ৫ মে ২০১৩ ঢাকায় হেফাজতে ইসলাম নির্বিচারে রক্তাক্ত করে পাবলিক বৃক্ষগুলো। বছরজুড়ে চলে এ নির্মম হত্যাকাণ্ড। অথচ পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে, 'আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপকস্ফ শস্যরাজি উদ্গত করি (সুরা কাফ, আয়াত : ৭ ও ৯)। অনর্থক বৃক্ষনিধন ও বন উজাড়কে ইসলামে গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধে রওনা হওয়ার সময় রাসূলে করিম (সা.) সৈন্যদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিতেন, যাতে কেউ কোনো গাছপালা ও শস্যক্ষেত ধ্বংস না করে। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে বরই গাছ কেটেছে তাকে আল্লাহ মাথা নিচু করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন (আবু দাউদ)। কিন্তু ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বৃক্ষহত্যাকালে রাজনৈতিক সহিংসতাগুলো কোনো ধর্ম, দর্শন, প্রথা, রীতি, নিষেধাজ্ঞা, আইন, নীতি কি জনসংস্কৃতির তোয়াক্কা করেনি। এ সময়টাতে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপিসহ ১৮ দলের হরতাল-অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে নৃশংস কায়দায় খুন হয়েছে দেশের অগণিত পাবলিক বৃক্ষ। বট, আম, শিশু, অর্জুন, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, মেহগনি, কড়ই, বৃষ্টিগাছ, সেগুন, কাঁঠাল গাছ নিহত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এমনকি চুনাতি অভয়ারণ্যের দুইশ' বছরের এক গর্জন মাতৃবৃক্ষও রেহাই পায়নি এ নৃশংস রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে।
গাছ সব সমাজে, সব ধর্মে ও সংস্কৃতিতে কেন্দ্রীয় আরাধনার বিষয়। আদিবাসী মান্দি পুরাণ মতে, দেবতা বাগবা-বরম্বির তলপেট থেকে জন্ম নিয়েছে গাছ। সাঁওতাল কাহিনীমতে, দুনিয়ার প্রথম মানুষ পিলচু হরম ও পিলচু বুড়ির সঙ্গে পয়লা সখ্য হয় আদি বৃক্ষপ্রাণের। ত্রিপুরা আদিবাসীদের জন্মকাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাতিয়ান গাছ, বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঘরের কাছে এ গাছ লাগানো হয়। অনেক জাতির গোত্রপ্রতীক গাছ, যা তারা কখনও কাটে না। সাঁওতালদের হেমব্রম গোত্রের প্রতীক সুপারি গাছ ও মারাণ্ডীদের দূর্বা। আদি ধর্ম পালনকারী জেন্টিল খাসি ও জৈন্তিয়াদের সুরং গোত্র রম্বুই গাছ কখনও কাটে না, এটি তাদের সামাজিক নিষেধাজ্ঞা। হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রে নবরত্নের অন্যতম রূপ কল্পবৃক্ষ, বৃক্ষ পূজিত হয় সর্বব্যাপী সত্তা হিসেবে। বৌদ্ধ ধর্মেও বোধিবৃক্ষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক অনন্য ব্যঞ্জনা। এমনকি মান্দিদের ভেতর স্বপ্নে গাছ কাটা দেখাও অশুভ লক্ষণ। বৃক্ষের প্রতি এই জনপদে এ রকম শতসহস্র দরদি নির্দেশনা ও পবিত্র বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও তাহলে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে একের পর এক নির্বিচারে কারা কোন বিশ্বাসে গাছগুলো খুন করল? উল্টেপাল্টে দিল স্থানীয় প্রতিবেশীয় বাস্তুসংস্থান?
গাছকে ঘিরেই আমাদের জীবন-মরণের সংসার। গাছকে নিয়ে, গাছকে ঘিরে অবশ্যই রাজনীতি হবে। প্রাকৃতিক শালবন উপড়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক যখন রাবার গাছ বা আগ্রাসী বৃক্ষের বাগান চাপিয়ে দেবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই গাছেদের সপক্ষে সত্যিকারের রাজনীতি। দেশীয় বেগুনে বিটি জিন ঢুকিয়ে সর্বনাশা বিটিবেগুন মারদাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো গাছ নিয়ে রাজনীতি। গর্জন মাতৃবৃক্ষকে পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে বাঁচানোই সত্যিকারের রাজনীতি। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের নামে একটির পর একটি গাছ খুন হবে, এটি অন্যায়, এটি কোনোভাবেই কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়। একে থামাতে হবে। এটি নিশ্চয়ই কোনোভাবে জয়বাংলা কি জিন্দাবাদের সঙ্গে জড়িত কোনো বিষয় নয়। এর সঙ্গে নিশ্চয়ই ভারত-পাকিস্তান বা কোনো মার্কিন দালালি নেই। জন কেরি, তারানকো, পংকজ শরণ বা ইমরান খান কেউ নিশ্চয়ই অন্তত গাছ কাটার পক্ষে দূতিয়ালি করবেন না। বাংলাদেশ বেগুন, বাঁশ, গভীর পানির ধান, কচু ও হরেক রকম লতাগুল্মের আদি জন্মভূমি। গাছেদের জিনলিপিতে আঁকা আছে আমাদের মেলা ও না-মেলা সব রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর। আসুন গাছের পাশে দাঁড়াই, রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে বৃক্ষপ্রাণ রক্ষায় দেশজুড়ে গড়ে তুলি ন্যায়বিচারের বলয়। থিনিড নয়, আমাদের দেশ বাংলাদেশ। গাছ কেটে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে কোনোভাবেই করপোরেট কোম্পানির দাসত্বে পরিণত করা যাবে না। কারণ এ দেশের নিম্নবর্গ গাছের জন্য প্রাণ দিয়েছে। গাছের সুরক্ষায় নিজের রক্ত ঝরিয়ে চলেছে অবিরাম। আমরা বহন করে চলেছি বৃক্ষ-মানুষ-প্রকৃতির এক জটিল সম্পর্কের বিজ্ঞান। আমরাই দুনিয়ায় প্রথম প্রমাণ করেছি 'গাছের প্রাণ আছে'। রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে গাছের প্রাণ সুরক্ষায় আবারও প্রমাণ করি, আসুন এক সত্যিকারের বৃক্ষরাজনীতি।
গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
animistbnagla@gmail.com
No comments