বিচারপতি মোরশেদের খ্যাতি বহুদূর বিস্তৃত হয়েছিল by আনিসুজ্জামান

আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ঢাকায় রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য মূল যে কমিটি গঠিত হয়, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ তার সভাপতি ছিলেন। তিনি তখন ঢাকা হাইকোর্টের একজন বিচারক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের একজন সদস্য। কমিটি গঠনের জন্য যে সভা আহূত হয় তা এবং কমিটির প্রাথমিক কয়েকটি সভা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষের অফিস কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিচারপতি মোরশেদ সোৎসাহে সবক'টি সভায় যোগ দিয়েছিলেন। একদিন তিনি বলেন, অনুষ্ঠানের জন্য কেউ যেন চাঁদা না তোলে, প্রয়োজনীয় অর্থ তিনিই সংগ্রহ করে দেবেন। এতে আমরা বেশ অবাক হয়েছিলাম। পরে ভেতরের ঘটনা জানতে পারি। সরকারি মহল থেকে তাকে বলা হয়েছিল, রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপনের সব প্রয়াসের মূলে রয়েছে একটি বিদেশি দূতাবাসের সক্রিয়তা এবং এ উপলক্ষে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানও দিচ্ছে তারা। বিচারপতি মোরশেদকে এ রকম অমূলক কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল, উদযাপন কমিটির সঙ্গে তার সম্পর্কচ্ছেদ করা। কিন্তু সেই ফাঁদে তিনি ধরা দেননি। তিনি নিজেই অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব নেবেন_ এ কথা সরকারি মহলকেও জানিয়ে দিয়েছিলেন। বিচারপতি হিসেবে কারও কাছে চাঁদা চাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যতদূর জানি, সে কাজের ভার তিনি দিয়েছিলেন পুলিশের তদানীন্তন ইন্সপেক্টর জেনারেল হাফিজ উদ্দিনকে। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেখা যায়, কিছু অর্থের অকুলান হচ্ছে। তখন বিচারপতি মোরশেদ আবার হাফিজ উদ্দিনকে ফোন করে দেন। হাফিজ উদ্দিন তার এক আত্মীয়কে অনুরোধ করেন। তার কাছ থেকে টাকা এনে ঋণ শোধ করা হয়। এ ঘটনা থেকে বিচারপতি মোরশেদের মানসিক দৃঢ়তার প্রমাণ যেমন আমরা পেয়েছিলাম, তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির জন্য তার গভীর ভালোবাসার পরিচয়ও পাওয়া গিয়েছিল। শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তার ভাষণও ছিল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। সংস্কৃতির প্রতি দরদ ছিল তার সহজাত। ইংরেজি, বাংলা, উর্দু ও ফরাসির সংস্কৃতি প্রবাহের, উত্তরাধিকার তিনি লাভ করেছিলেন খানিকটা পারিবারিক সূত্রে; কিন্তু অনেকটা ব্যক্তিগত চর্চার মাধ্যমে। তার বাবা ও মায়ের পরিবারে শিক্ষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য ছিল দীর্ঘকালের। তার বাবা সৈয়দ আবদুস সালেক ছাত্রজীবনে মেধার পরিচয় দিয়ে পরে বঙ্গীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্যপদ লাভ করেছিলেন। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ছিলেন বিচারপতি মোরশেদের মামা।
১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি মুর্শিদাবাদে বিচারপতি মোরশেদের জন্ম হয়। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯২৬ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন প্রথম বিভাগে। রাজশাহী বিভাগের সব সফল ম্যাট্রিক প্রার্থীর মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতি বিষয়ে তিনি অনার্সসহ বিএ এবং এমএ পাস করেন যথাক্রমে ১৯৩০ ও ১৯৩২ সালে। ১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে আইন পাস করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি লিনকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। দেশে ফিরে এসে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬২-৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা হাইকার্টের প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি এই পদ ত্যাগ করেন।
আইনজীবী হিসেবে তিনি যথেষ্ট যশ অর্জন করেছিলেন। তবে বিচারক হিসেবেই তার খ্যাতি বহুদূর বিস্তৃত হয়েছিল। আইয়ুব খানের শাসনকালে যখন গণতান্ত্রিক অধিকার বাধাগ্রস্ত হয়েছিল, সেই সময়ে মানুষের মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসনের জন্য আদালতের আসন থেকেই তিনি সংগ্রাম করেছিলেন। প্রাদেশিক গভর্নর মোনায়েম খানের প্রশাসনের সঙ্গে তার সংঘাতের কথা তখন সুবিদিত ছিল। বিচারপতির মর্যাদা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য তিনি কঠোর প্রয়াস চালিয়েছিলেন। গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করা এ সময়ে তার জীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করার পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়েছিলেন তিনি।
শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.