এই সংসদ ও সরকারের মেয়াদ কতদিন? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
৯
জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা শপথ গ্রহণ
করেছেন। ১২ জানুয়ারি রোববার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ
গ্রহণ করবে। মন্ত্রিসভার আকার ও কতজন পুরনো মুখ এবং কতজন নতুন মুখ এই
মন্ত্রিসভায় দেখা যাবে তা একদিন আগেও জানা সম্ভব হয়নি। অনুমাননির্ভর
মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, এই নতুন মন্ত্রিসভা
আকারে মাঝারি সাইজের হবে এবং গত সরকারের আমলে যেসব মন্ত্রী, উপদেষ্টা
দুর্নীতি ও অন্যান্য অপকর্মে দুর্নাম কুড়িয়েছেন, তাদের বাদ দেওয়া হবে। গত
পাঁচ বছর হাসিনা সরকার দেশের প্রভূত উন্নয়ন ঘটিয়েছে; কিন্তু দেশকে গুড
গভর্ন্যান্স বা সুশাসন উপহার দিতে পারেনি। এবার এই সুশাসন অবশ্যই উপহার
দিতে হবে। এই সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপরই এই সংসদ ও সরকারের মেয়াদ নির্ভর করে।
এই সরকার ও সংসদ বৈধ কিনা তা নিয়ে আমাদের সুশীল সমাজের একটি মতলববাজ অংশ
বিতর্ক সৃষ্টি করে রাখতে চাইছে। এটা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বর্ণিত
নস্যি নাকে ঢুকিয়ে এক শ্রেণীর পণ্ডিতপ্রবরের 'পাত্রাধার কি পাত্র' নিয়ে
পণ্ডিতি তর্ক করার মতো। এই নির্বাচন যে বিএনপি-জামায়াতের হিংস্র বিরোধিতা,
ইউনূস-শিবির, সুশীল সমাজ ও বিগ মিডিয়ার একাংশের সম্মিলিত বাধাদান এবং তাদের
পৃষ্ঠপোষক বিদেশি শক্তির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে অনুষ্ঠিত হতে পেরেছে,
এখানেই এই নির্বাচনের ও এই নির্বাচন দ্বারা গঠিত সংসদ ও সরকারের বৈধতা।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে (অবিভক্ত) একটি দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকার ও তারপরই ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জাকে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে জেনারেল আইয়ুব যখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং তাকে বিপ্লব আখ্যা দেন, তখন সুপ্রিম কোর্টে তার এই ক্ষমতা গ্রহণকে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস মুনীর রায় দিয়েছিলেন, 'কোনো বিপ্লব সফল হলে ওই সাফল্যই তাকে বৈধতা দেয়। সফল না হলে তা বৈধতা পায় না।' সেই থেকে পাকিস্তানে প্রতিবছর ২৮ অক্টোবর বিপ্লব দিবস পালিত হতো। আইয়ুব যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন, ততদিন তার ক্ষমতা গ্রহণের দিনটি পাকিস্তানে বিপ্লব দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে।
বাংলাদেশে এবার শেখ হাসিনা কোনো ক্যু ঘটিয়ে ক্ষমতায় বসেননি। তিনি একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় রয়ে গেছেন। এ কথা সত্য, নির্বাচনটি স্বাভাবিকভাবে (হড়ৎসধষ) অনুষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, দেশের অবস্থাও স্বাভাবিক ছিল না এবং এখনও পুরো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। বিরোধী দল বিএনপি গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের বিরোধিতায় না নেমে যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী দল জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছিল।
এই অবস্থায় অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশ হলে সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, সব নাগরিক অধিকার স্থগিত রেখে, সর্বশক্তি নিয়ে সন্ত্রাস দমনে এগিয়ে যেত। বাংলাদেশেও এবার হাসিনা সরকার সন্ত্রাস দমনে এগিয়ে গেছে; কিন্তু জরুরি অবস্থা ঘোষণা বা নাগরিক অধিকার স্থগিত না করে সাধারণ আইন ও তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সহায়তাতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। এখানেই হাসিনা সরকারের গণতান্ত্রিক ক্রেডিবিলিটি।
তদুপরি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি বিরোধী দলের দাবি মানার ব্যাপারে দশ পা এগিয়ে গেছেন। সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেছেন। বিরোধী দল এক পা এগোয়নি। বরং সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও সরকারি কর্মচারীদের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উস্কানি দিয়েছে। হেফাজতিদের ঢাকায় ডেকে এনে মহাতাণ্ডব সৃষ্টি করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বল প্রয়োগে সরকার উৎখাতের হুঙ্কার দিয়েছে।
শেখ হাসিনা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধানবহির্ভূত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি মানেননি; কিন্তু বিরোধী দলের দাবিকে সম্মান দেখানোর জন্য শুধু প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে নিজে পদত্যাগ না করে সর্বদলীয় সরকার গঠনে রাজি হয়েছেন এবং বিরোধী দলকে গুরুত্বপর্ণ মন্ত্রী পদ দিতে চেয়েছেন। তাতেও তারা রাজি হয়নি। খালেদা জিয়া সমঝোতার পথে নয়, সহিংসতা দ্বারাই হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পারবেন ভেবেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, জনসমর্থন ছাড়াই জামায়াতের সন্ত্রাস, ইউনূস-শিবির, সুশীল সমাজ, একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া ও টক শোর বাকশক্তি এবং কতিপয় বিদেশি শক্তির সহায়তায় কিল্লা ফতে করে ফেলবেন।
শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। হাসিনা সরকার বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য শেষ পর্যন্ত দুয়ার খোলা রেখেছে। তারা স্বেচ্ছায় না আসায় যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। দেশি-বিদেশি বিশাল বাধার মুখে এবং নির্বাচনের দিনেও রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাস মোকাবেলায় এই নির্বাচনটি অনুষ্ঠান করতে পারাই হচ্ছে তার বৈধতা। এই নির্বাচন দ্বারা গঠিত সংসদ ও সরকারও তাই বৈধ। অস্বাভাবিক সময়ের অস্বাভাবিক নির্বাচনে এই সংসদ ও সরকারের জন্ম। ফলে তার বৈধতায় সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল নয়। নৈতিক ভিত্তিটি হচ্ছে, এই নির্বাচনটি না হতে পারলে স্বাধীনতা যুদ্ধের মৌল আদর্শ এবং তার অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধ্বংস হতো এবং মধ্যযুগীয় জঙ্গি মৌলবাদের হিংস্র থাবা দেশটিকে গ্রাস করার পথে এগিয়ে যেত।
এই নির্বাচন সেই আশঙ্কা দূর করেছে এবং তার গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে এখন পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পেরেছে। টিকটিকি মারা যাওয়ার পরও তার লেজ যেমন লাফাতে থাকে, তেমনি নির্বাচন বানচাল করার সন্ত্রাসে ব্যর্থ হওয়ার পরও বিএনপি মুখ রক্ষার জন্য হরতাল ও অবরোধের ডাক দেওয়া কিছুদিন অব্যাহত রাখতে পারে। তাতে দেশের মানুষ সাড়া দেবে না। মৃত টিকটিকির লেজের লাফালাফিও এক সময় থেমে যাবে।
এই পরিস্থিতিতেও আমি শেখ হাসিনাকে সবিনয়ে একটি অনুরোধ জানাব। তিনি যেন এই নির্বাচনের ফলকে তার সরকারের জন্য পাঁচ বছর দেশ শাসনের গণরায় ও গণম্যান্ডেট বলে মনে না করেন। দেশের মানুষ সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়নি এবং ৪০ শতাংশের মতো ভোটদাতা ভোট দিতে এগিয়ে এসেছেন একটি মাত্র কারণে। তা হলো তারা শেখ হাসিনাকে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এবং তার গত সরকারের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার একটা সুযোগ দিতে চায়। এই নির্দিষ্ট কাজগুলো দেড় কি বড়জোর দু'বছরের মধ্যে শেষ করে অথবা শেষ করার পথে এগিয়ে দিয়ে এই সরকারকে অবশ্যই একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে এই সরকার শুধু বিরোধী দলগুলোর নয়, দেশবাসীরও প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে।
দেশের মানুষ এবার কয়েকটি বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য হাসিনা সরকারকে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে ও ক্ষমতায় থাকতে সমর্থন জুগিয়েছে। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক বা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় আকৃষ্ট হয়ে এই সমর্থন যে জানায়নি, তার প্রমাণ বেশ কয়েকটি আসনেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়। এসব আসনে বিরোধী দলের প্রার্থী থাকলে কী হতো তা সহজেই অনুমেয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের বিতর্কিত সদস্য, একাত্তরের বিতর্কিত ব্যক্তি কাজী জাফরউল্যাহর নির্বাচনে পরাজয়। তাকে জেতানোর জন্য শেখ হাসিনাকে দু'দু'বার তার নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে সভা করতে হয়েছে। তারপরও কাজী জাফরউল্যাহ নির্বাচনে জেতেননি। ভোটদাতারা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটা থেকেও নতুন হাসিনা সরকারকে দেশের নির্বাচকমণ্ডলীর 'মুড' সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
ভারত ভাগের সময় (১৯৪৭) সদ্য গঠিত পাকিস্তানে একটি গণপরিষদ (ঈড়হংঃরঃঁবহঃ ধংংবসনষু) গঠিত হয়েছিল শুধু দেশের সংবিধান রচনার জন্য। সংবিধান তৈরি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা ছিল এই গণপরিষদ ভেঙে যাবে এবং নতুন নির্বাচন হবে। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের সদস্যরা ক্ষমতার লোভে এই কাজটি করেননি। তারা সংবিধান প্রণয়ন না করে আট বছর ধরে পদ ও ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন। এর ফলে পুঞ্জীভূত গণঅসন্তোষ এবং পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে বিপর্যয়ের ফলে তাদের ভরাডুবি ঘটে।
বাংলাদেশের বর্তমান সংসদ ও সরকারেরও দায়িত্ব হবে তাদের ওপর অর্পিত কতিপয় জরুরি দায়িত্ব পালন সম্ভাব্য দ্রুত সময়ে শেষ করা এবং দেশকে একটি মধ্যবর্তীকালীন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা। তা না হলে ঈশান কোণে বিপদের মেঘ পুঞ্জীভূত হবে। এখন প্রশ্ন_ এই সংসদ ও সরকারের জন্য প্রথমেই যে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা, সেগুলো কী কী?
অনেকের সঙ্গে আমার ধারণা, দেশবাসী চায়_ ক. '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অতিদ্রুত শেষ করা এবং দণ্ড কার্যকর করা; খ. সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে জামায়াত ও সংশ্লিষ্ট জঙ্গিবাদী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোকে তাদের আওতামুক্ত করা এবং জঙ্গি দমনের জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও চিরুনি অভিযান চালানো; গ. সন্ত্রাস দমন অভিযানের সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, দুদকের পুনর্গঠন ও শক্তি বৃদ্ধি করা, দলের দুর্নীতিবাজদের বহিষ্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা এবং হলমার্ক, ডেসটিনি থেকে শুরু করে শেয়ারবাজারে ধসের নায়কদের দ্রুত বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা; ঘ. সাংবাদিক দম্পতি হত্যার (সাগর-রুনি) অমীমাংসিত রহস্য অবিলম্বে উদ্ঘাটন; ঙ. নারী নির্যাতন বন্ধ করার জন্য আরও কঠোর আইন করা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী গঠন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের মোতায়েন করার ব্যবস্থা; চ. সামাজিক অপরাধ দমনের জন্য পুলিশের বিশেষ স্কোয়াড গঠন এবং তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি। এক কথায় দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাসহ সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা।
দেশে এই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার হবে একটি সুশাসক গোষ্ঠী। শেখ হাসিনা এবার যদি তার মন্ত্রী ও উপদেষ্টা বাছাইয়ে আবার ভুল করেন, তাহলে তার দল, সরকার ও দেশের জন্য বিপদ ঘনিয়ে আসতে দেরি হবে না। দুর্নীতিবাজ এবং সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের পৃষ্ঠপোষকদের সরকার থেকে অবশ্যই দূরে রাখতে হবে। মন্ত্রিসভা গঠনে অবশ্যই ফেরেশতা পাওয়া যাবে না। কিন্তু সৎ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ মানুষ তিনি পাবেন। প্রধানমন্ত্রীর চারপাশ থেকে অযোগ্য ও চাটুকারদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে। মন্ত্রিসভাটি ছোট, বড়জোর মাঝারি গোছের হলে ভালো হয়। কথায় বলে, ফার্স্ট ইমপ্রেশন লাস্ট লঙ। রোববার যে মন্ত্রিসভা শপথ নেবে, তা যদি তুলনামূলকভাবে ভালো ও সৎ মানুষের মন্ত্রিসভা বলে প্রথমেই জনগণের মনে একটি ইমেজ তৈরি করে, তাহলে এই সরকার শুধু বৈধতার বিতর্কই অতিক্রম করবে না, তার জনসমর্থন ও নৈতিক শক্তির ভিত্তিও দৃঢ় হবে।
এই সংসদ ও সরকারের মেয়াদ দেড় থেকে দু'বছর, বড়জোর আড়াই বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। এই সময়ের মধ্যে তাদের ওপর অর্পিত বিশেষ দায়িত্বগুলো শেষ করতে হবে। অথবা শেষ করার জন্য নতুন করে গণম্যান্ডেট নিতে হবে। এখন সবই নির্ভর করছে শেখ হাসিনার সুবিবেচনা ও সুসিদ্ধান্তের ওপর। তিনি অতীত থেকে কতটা শিক্ষা নিয়েছেন তার প্রমাণ পাওয়া যাবে রোববার তার নতুন মন্ত্রিসভার নাম ও পরিচয় জানার পর। প্রার্থনা করি, শেখ হাসিনা যেন জনগণের প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারেন।
লন্ডন, ১০ জানুয়ারি শুক্রবার, ২০১৪
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে (অবিভক্ত) একটি দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকার ও তারপরই ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জাকে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে জেনারেল আইয়ুব যখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং তাকে বিপ্লব আখ্যা দেন, তখন সুপ্রিম কোর্টে তার এই ক্ষমতা গ্রহণকে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস মুনীর রায় দিয়েছিলেন, 'কোনো বিপ্লব সফল হলে ওই সাফল্যই তাকে বৈধতা দেয়। সফল না হলে তা বৈধতা পায় না।' সেই থেকে পাকিস্তানে প্রতিবছর ২৮ অক্টোবর বিপ্লব দিবস পালিত হতো। আইয়ুব যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন, ততদিন তার ক্ষমতা গ্রহণের দিনটি পাকিস্তানে বিপ্লব দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে।
বাংলাদেশে এবার শেখ হাসিনা কোনো ক্যু ঘটিয়ে ক্ষমতায় বসেননি। তিনি একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় রয়ে গেছেন। এ কথা সত্য, নির্বাচনটি স্বাভাবিকভাবে (হড়ৎসধষ) অনুষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, দেশের অবস্থাও স্বাভাবিক ছিল না এবং এখনও পুরো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। বিরোধী দল বিএনপি গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের বিরোধিতায় না নেমে যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী দল জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছিল।
এই অবস্থায় অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশ হলে সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, সব নাগরিক অধিকার স্থগিত রেখে, সর্বশক্তি নিয়ে সন্ত্রাস দমনে এগিয়ে যেত। বাংলাদেশেও এবার হাসিনা সরকার সন্ত্রাস দমনে এগিয়ে গেছে; কিন্তু জরুরি অবস্থা ঘোষণা বা নাগরিক অধিকার স্থগিত না করে সাধারণ আইন ও তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সহায়তাতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। এখানেই হাসিনা সরকারের গণতান্ত্রিক ক্রেডিবিলিটি।
তদুপরি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি বিরোধী দলের দাবি মানার ব্যাপারে দশ পা এগিয়ে গেছেন। সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেছেন। বিরোধী দল এক পা এগোয়নি। বরং সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও সরকারি কর্মচারীদের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উস্কানি দিয়েছে। হেফাজতিদের ঢাকায় ডেকে এনে মহাতাণ্ডব সৃষ্টি করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বল প্রয়োগে সরকার উৎখাতের হুঙ্কার দিয়েছে।
শেখ হাসিনা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধানবহির্ভূত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি মানেননি; কিন্তু বিরোধী দলের দাবিকে সম্মান দেখানোর জন্য শুধু প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে নিজে পদত্যাগ না করে সর্বদলীয় সরকার গঠনে রাজি হয়েছেন এবং বিরোধী দলকে গুরুত্বপর্ণ মন্ত্রী পদ দিতে চেয়েছেন। তাতেও তারা রাজি হয়নি। খালেদা জিয়া সমঝোতার পথে নয়, সহিংসতা দ্বারাই হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পারবেন ভেবেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, জনসমর্থন ছাড়াই জামায়াতের সন্ত্রাস, ইউনূস-শিবির, সুশীল সমাজ, একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া ও টক শোর বাকশক্তি এবং কতিপয় বিদেশি শক্তির সহায়তায় কিল্লা ফতে করে ফেলবেন।
শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। হাসিনা সরকার বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য শেষ পর্যন্ত দুয়ার খোলা রেখেছে। তারা স্বেচ্ছায় না আসায় যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। দেশি-বিদেশি বিশাল বাধার মুখে এবং নির্বাচনের দিনেও রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাস মোকাবেলায় এই নির্বাচনটি অনুষ্ঠান করতে পারাই হচ্ছে তার বৈধতা। এই নির্বাচন দ্বারা গঠিত সংসদ ও সরকারও তাই বৈধ। অস্বাভাবিক সময়ের অস্বাভাবিক নির্বাচনে এই সংসদ ও সরকারের জন্ম। ফলে তার বৈধতায় সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল নয়। নৈতিক ভিত্তিটি হচ্ছে, এই নির্বাচনটি না হতে পারলে স্বাধীনতা যুদ্ধের মৌল আদর্শ এবং তার অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধ্বংস হতো এবং মধ্যযুগীয় জঙ্গি মৌলবাদের হিংস্র থাবা দেশটিকে গ্রাস করার পথে এগিয়ে যেত।
এই নির্বাচন সেই আশঙ্কা দূর করেছে এবং তার গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে এখন পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পেরেছে। টিকটিকি মারা যাওয়ার পরও তার লেজ যেমন লাফাতে থাকে, তেমনি নির্বাচন বানচাল করার সন্ত্রাসে ব্যর্থ হওয়ার পরও বিএনপি মুখ রক্ষার জন্য হরতাল ও অবরোধের ডাক দেওয়া কিছুদিন অব্যাহত রাখতে পারে। তাতে দেশের মানুষ সাড়া দেবে না। মৃত টিকটিকির লেজের লাফালাফিও এক সময় থেমে যাবে।
এই পরিস্থিতিতেও আমি শেখ হাসিনাকে সবিনয়ে একটি অনুরোধ জানাব। তিনি যেন এই নির্বাচনের ফলকে তার সরকারের জন্য পাঁচ বছর দেশ শাসনের গণরায় ও গণম্যান্ডেট বলে মনে না করেন। দেশের মানুষ সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়নি এবং ৪০ শতাংশের মতো ভোটদাতা ভোট দিতে এগিয়ে এসেছেন একটি মাত্র কারণে। তা হলো তারা শেখ হাসিনাকে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এবং তার গত সরকারের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার একটা সুযোগ দিতে চায়। এই নির্দিষ্ট কাজগুলো দেড় কি বড়জোর দু'বছরের মধ্যে শেষ করে অথবা শেষ করার পথে এগিয়ে দিয়ে এই সরকারকে অবশ্যই একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে এই সরকার শুধু বিরোধী দলগুলোর নয়, দেশবাসীরও প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে।
দেশের মানুষ এবার কয়েকটি বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য হাসিনা সরকারকে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে ও ক্ষমতায় থাকতে সমর্থন জুগিয়েছে। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক বা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় আকৃষ্ট হয়ে এই সমর্থন যে জানায়নি, তার প্রমাণ বেশ কয়েকটি আসনেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়। এসব আসনে বিরোধী দলের প্রার্থী থাকলে কী হতো তা সহজেই অনুমেয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের বিতর্কিত সদস্য, একাত্তরের বিতর্কিত ব্যক্তি কাজী জাফরউল্যাহর নির্বাচনে পরাজয়। তাকে জেতানোর জন্য শেখ হাসিনাকে দু'দু'বার তার নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে সভা করতে হয়েছে। তারপরও কাজী জাফরউল্যাহ নির্বাচনে জেতেননি। ভোটদাতারা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটা থেকেও নতুন হাসিনা সরকারকে দেশের নির্বাচকমণ্ডলীর 'মুড' সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
ভারত ভাগের সময় (১৯৪৭) সদ্য গঠিত পাকিস্তানে একটি গণপরিষদ (ঈড়হংঃরঃঁবহঃ ধংংবসনষু) গঠিত হয়েছিল শুধু দেশের সংবিধান রচনার জন্য। সংবিধান তৈরি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা ছিল এই গণপরিষদ ভেঙে যাবে এবং নতুন নির্বাচন হবে। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের সদস্যরা ক্ষমতার লোভে এই কাজটি করেননি। তারা সংবিধান প্রণয়ন না করে আট বছর ধরে পদ ও ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন। এর ফলে পুঞ্জীভূত গণঅসন্তোষ এবং পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে বিপর্যয়ের ফলে তাদের ভরাডুবি ঘটে।
বাংলাদেশের বর্তমান সংসদ ও সরকারেরও দায়িত্ব হবে তাদের ওপর অর্পিত কতিপয় জরুরি দায়িত্ব পালন সম্ভাব্য দ্রুত সময়ে শেষ করা এবং দেশকে একটি মধ্যবর্তীকালীন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা। তা না হলে ঈশান কোণে বিপদের মেঘ পুঞ্জীভূত হবে। এখন প্রশ্ন_ এই সংসদ ও সরকারের জন্য প্রথমেই যে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা, সেগুলো কী কী?
অনেকের সঙ্গে আমার ধারণা, দেশবাসী চায়_ ক. '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অতিদ্রুত শেষ করা এবং দণ্ড কার্যকর করা; খ. সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে জামায়াত ও সংশ্লিষ্ট জঙ্গিবাদী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোকে তাদের আওতামুক্ত করা এবং জঙ্গি দমনের জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও চিরুনি অভিযান চালানো; গ. সন্ত্রাস দমন অভিযানের সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, দুদকের পুনর্গঠন ও শক্তি বৃদ্ধি করা, দলের দুর্নীতিবাজদের বহিষ্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা এবং হলমার্ক, ডেসটিনি থেকে শুরু করে শেয়ারবাজারে ধসের নায়কদের দ্রুত বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা; ঘ. সাংবাদিক দম্পতি হত্যার (সাগর-রুনি) অমীমাংসিত রহস্য অবিলম্বে উদ্ঘাটন; ঙ. নারী নির্যাতন বন্ধ করার জন্য আরও কঠোর আইন করা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী গঠন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের মোতায়েন করার ব্যবস্থা; চ. সামাজিক অপরাধ দমনের জন্য পুলিশের বিশেষ স্কোয়াড গঠন এবং তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি। এক কথায় দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাসহ সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা।
দেশে এই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার হবে একটি সুশাসক গোষ্ঠী। শেখ হাসিনা এবার যদি তার মন্ত্রী ও উপদেষ্টা বাছাইয়ে আবার ভুল করেন, তাহলে তার দল, সরকার ও দেশের জন্য বিপদ ঘনিয়ে আসতে দেরি হবে না। দুর্নীতিবাজ এবং সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের পৃষ্ঠপোষকদের সরকার থেকে অবশ্যই দূরে রাখতে হবে। মন্ত্রিসভা গঠনে অবশ্যই ফেরেশতা পাওয়া যাবে না। কিন্তু সৎ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ মানুষ তিনি পাবেন। প্রধানমন্ত্রীর চারপাশ থেকে অযোগ্য ও চাটুকারদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে। মন্ত্রিসভাটি ছোট, বড়জোর মাঝারি গোছের হলে ভালো হয়। কথায় বলে, ফার্স্ট ইমপ্রেশন লাস্ট লঙ। রোববার যে মন্ত্রিসভা শপথ নেবে, তা যদি তুলনামূলকভাবে ভালো ও সৎ মানুষের মন্ত্রিসভা বলে প্রথমেই জনগণের মনে একটি ইমেজ তৈরি করে, তাহলে এই সরকার শুধু বৈধতার বিতর্কই অতিক্রম করবে না, তার জনসমর্থন ও নৈতিক শক্তির ভিত্তিও দৃঢ় হবে।
এই সংসদ ও সরকারের মেয়াদ দেড় থেকে দু'বছর, বড়জোর আড়াই বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। এই সময়ের মধ্যে তাদের ওপর অর্পিত বিশেষ দায়িত্বগুলো শেষ করতে হবে। অথবা শেষ করার জন্য নতুন করে গণম্যান্ডেট নিতে হবে। এখন সবই নির্ভর করছে শেখ হাসিনার সুবিবেচনা ও সুসিদ্ধান্তের ওপর। তিনি অতীত থেকে কতটা শিক্ষা নিয়েছেন তার প্রমাণ পাওয়া যাবে রোববার তার নতুন মন্ত্রিসভার নাম ও পরিচয় জানার পর। প্রার্থনা করি, শেখ হাসিনা যেন জনগণের প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারেন।
লন্ডন, ১০ জানুয়ারি শুক্রবার, ২০১৪
No comments