অনিশ্চিত গন্তব্যে বাংলাদেশ by মোঃ মাহমুদুর রহমান
দেশকে
ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে একদম সচেতন
সাধারণ মানুষ সবার একই প্রশ্ন। কিন্তু এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কারও জানা
নেই। শেষ গন্তব্য কোথায় তা কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। তবে যাত্রার
গতি প্রকৃতি দেখে সবাই একমত যে, দেশ ঐক্য, সংহতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে
এগোচ্ছে না। দেশের যাত্রা পথ অবিশ্বাস, ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভেদ, সংঘাত,
সংঘর্ষ ও অন্ধকারের দিকে। কিন্তু কেন? যে জাতি লাখ লাখ মানুষের আত্মাহুতির
মাধ্যমে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের
জন্ম দিল গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, তাদের কাছে অর্থনৈতিক মুক্তি
আজ সুদূরপরাহত, গণতন্ত্র মৃতপ্রায়। এতদিন শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র
তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। ভবিষ্যতে তাও আর থাকবে কিনা তা নিয়ে অনেকের
সন্দেহ রয়েছে। কারণ প্রধান বিরোধী দলবিহীন ছোট ছোট কয়েকটি দল নিয়ে অনেকটা
একদলীয় নির্বাচন করা আর নির্বাচন না করে ক্ষমতায় থাকা অনেকটা সমার্থক বলে
মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল।
রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও জনগণের সেবা করা। অন্যান্য পেশায় দেশ এবং জনগণের সেবার বিষয়টি রাজনীতির মতো প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়। যেমন একজন আইনজীবী আইন পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন, সঙ্গে সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশকে সহযোগিতা করে থাকেন। একজন ব্যাংকার অর্থ উপার্জনের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সহায়তা করে থাকেন। কিন্তু রাজনীতিকদের দেশ এবং জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকতে হয়, যার বিপরীতে কোনো অর্থ উপার্জনের সুযোগ নেই। নিজস্ব সম্পদ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য আলাদা আয়ের উৎস না থাকলে সার্বক্ষণিক রাজনীতি করা কষ্টকর। কারণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে একজন রাজনীতিক জনগণের কাছ থেকে শুধু সম্মান, সুনাম ও সুখ্যাতির অধিকারী হন, অর্থ-বিত্তের নয়। রাজনীতিকরা সবচেয়ে বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য। কারণ, অন্যরা যেখানে নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত, সেখানে তারা তাদের মেধা, শ্রম ও সময় ব্যয় করছেন দেশ ও জনগণের জন্য।
এরকম একজন ত্যাগী রাজনীতিকের কাছে নির্বাচন তার জনসেবার পরীক্ষা। জনগণ যদি তার সেবায় তুষ্ট হয়, তাহলে তাকে নির্বাচিত করে দেশ শাসনের ভার দিয়ে তার উপর আরও গুরুদায়িত্ব¡ অর্পণ করতে পারে। গণতন্ত্রে ভোট না পেলে জনগণের সঙ্গে শত্র“তা কিংবা ভোট পেলে জনগণের ওপর প্রভুত্ব¡ করার সুযোগ নেই। সর্বাবস্থায়ই জনসেবায় নিয়োজিত থাকতে হয় যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়। আমাদের মতো সমস্যাজর্জরিত দেশে যারা নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসনের সুযোগ পান তাদের রাত-দিন পরিশ্রম করতে হয়, চিন্তামগ্ন থাকতে হয়। কারণ সীমিত সম্পদ দিয়ে জনগণের হাজারও সমস্যা সমাধান করা সত্যিই কষ্টকর। তাই জনমতের বিপরীতে সংবিধান সংশোধন করে, বিভিন্ন রকম ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার কিংবা যেনতেন ভাবে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তাই হচ্ছে।
কেন এমন হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায় রাজনীতির মতো মহৎ কাজটি বেশির ভাগ নেতাকর্মী জনসেবার মানসিকতা নিয়ে করেন না, অর্থবিত্ত অর্জন ও ক্ষমতার জন্য করে থাকেন। ফলে ত্যাগের পরিবর্তে ভোগের মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করা হয়। এ ভোগ কিংবা অর্থ উপার্জন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়া পরিপূর্ণতা পায় না। এ জন্য কেউ ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। অন্যভাবে বলা যায়, কেউ ক্ষমতার বাইরে থাকতে চায় না। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর পরই শুরু হয় ক্ষমতাসীন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের অবৈধ উপার্জনের মহোৎসব। এ জন্য ক্ষমতার শেষ দিকে তাদের দুই ধরনের ভয় পেয়ে বসে। একটি হচ্ছে অবাধ অর্থবিত্ত উপার্জনের সুযোগ হাত ছাড়া হওয়ার ভয়। অন্যটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট এবং অন্যান্য অপকর্মের কারণে জনরোষ ও পরবর্তী সরকারের দ্বারা আইনের আওতায় আসার ভয়। তাই তারা ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। অপর পক্ষে বিরোধী দলও অপেক্ষায় থাকে ভোগের পেয়ালা কখন হাতে পাবে। তাই ক্ষমতাসীনদের সরানোর জন্য যে কোনো পথ অবলম্বন করতে দ্বিধা করে না, তাতে জনগণের যত কষ্টই হোক। বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক সমস্যা যাকে আমরা সাংবিধানিক সমস্যায় রূপান্তরিত করেছি তার মূল ভিত্তি হচ্ছে আমাদের এ ভোগের নেশায় মত্ত রাজনীতি। আর লুটপাট ও ভোগের রাজত্ব স্থায়ী করার জন্য প্রয়োজন প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা। তাই বিরোধী দলকে নির্যাতন-নিপীড়ন করতে হয়। মিটিং মিছিল ও জনসভা করার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করতে হয়। প্রতিপক্ষকে হত্যার চেষ্টা করতে হয়। নিজে অথবা নিজের পছন্দের মানুষের অধীনে নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করতে হয়। দেশের সব মানুষকে বোকা ভেবে সরকারি দল সব সময় সংবিধানের জন্য মায়া কান্না প্রদর্শন করতে থাকে। যদিও তারা প্রত্যেকেই নিজেদের প্রয়োজনে সংবিধানের গায়ে ছুরি চালাতে দ্বিধা করেননি। এ যেন ‘মুখে শেখ ফরিদ- বগলমে ইট’।
আরও মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যে রয়েছে স্ববিরোধিতা। ক্ষমতায় থাকতে যে কথা বলেন, বিরোধী দলে গেলে ঠিক তার বিপরীত কথা বলেন। ক্ষমতায় থাকলে নির্দলীয় সরকার কারও ভালো লাগে না। বিরোধী দলে থাকলে এর প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে টের পান। ফলে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সময়ের সরকার প্রধানের বক্তব্য, আজকের বক্তব্যের ঠিক বিপরীত। একইভাবে তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা যিনি আজকের প্রধানমন্ত্রী তার তখনকার বক্তব্য, আর আজকের বক্তব্য পুরোপুরি বিপরীত। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে গিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত আন্দোলনে অনেক জীবন ও সম্পদ ক্ষয় হয়েছে। অথচ তারই নেতৃত্বে¡ আদালতের রায়ের অজুহাতে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থাকে হত্যা করা হল। এটা যেন মায়ের হাতে নিজ সন্তান হত্যার মতো ঘটনা। জনগণ এটাকে ভালো চোখে দেখেনি বলে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও সাম্প্রতিক জরিপে তারা সরকারকে ‘না’ বলেছে।
রাজনীতি জনসেবার পরিবর্তে রাজ-ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণে আমাদের দেশ স্থায়ী সমস্যায় নিপতিত হয়েছে। এ থেকে সহজ মুক্তি নেই, পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ব্যতীত। তবে বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি নিজেকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানের পদটি ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিলেই সমঝোতা হতে পারে। সব দলকে নিয়ে একটি নির্বাচন হলে জাতি আপাত সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে মুক্তি পাবে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা কেটে যাবে। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনও এ ঘোষণা দেননি। সহজে দেবেন বলেও মনে হচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ ঘোষণা আদায়ের জন্য বিরোধী দল চূড়ান্ত আন্দোলনে যাচ্ছে। সরকারি দল, পুলিশ ও বিরোধী দলের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হতে পারে। কে জিতবে, কে হারবে বলা না গেলেও এ ধরনের সংঘর্ষের কারণে দেশ ও দেশের জনগণই হারে। সরকার এরই মধ্যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। অনেকটা জরুরি অবস্থার মতো। এভাবে হয়তো বিরোধী দলের আন্দোলন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে। তবে বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। আর সমস্যাটা প্রলম্বিত হবে এ জন্যই।
সরকার হয়তো আশা করছে, কোনোভাবে একদলীয় একটা নির্বাচন করতে পারলেই হল। এ জন্য তারা বৈধ-অবৈধ সব শক্তি নিয়োগ করছে। কিন্তু বিরোধী দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে এবং সামর্থ্য অনুযায়ী আন্দোলন চালিয়ে যায় তাহলে দেশে স্থিতিশীলতা আসবে না। তারা ধীরে ধীরে আইন অমান্যের দিকে চলে যাচ্ছে। আজকে তাদের পক্ষ থেকে একজন দার্শনিকের ভাষায় বলা হয়েছে, ‘হোয়েন অর্ডার ব্রিংস ইনজাস্টিস, ডিসঅর্ডার ইজ দি বিগিনিং অব জাস্টিস।’ এভাবে দেশের কিছু মানুষ যদি আইন-শৃংখলা অমান্য করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আশায় আর বেশির ভাগ মানুষ তা সমর্থন করে তা হলে দেশ কতদিন চালানো সম্ভব হবে সরকারের পক্ষে তা বিবেচনা করা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন। এছাড়া বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেছেন, এ সরকার ২৪ অক্টোবরের পর অবৈধ, তাই জনগণকে আহ্বান করেছেন সরকারকে ক্ষমতা থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে হটানোর জন্য। তার আহ্বানটি থমাস পেইনের মতো, ‘ইট ইজ দি ডিউটি অব দি পেট্রিয়ট টু প্রটেক্ট হিজ কান্ট্রি ফ্রম ইটস গভর্নমেন্ট’। থমাস পেইন আজ আর বেঁচে নেই, থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, তার এ উক্তি কি বর্তমানে আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য?
সমস্যা হচ্ছে আমাদের অর্থনীতিকে নিয়ে। রাজনীতির মতো পুলিশ, র্যাব ও লাঠিয়াল দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অর্থনীতি এখনও চলে ক্ল্যাসিকাল, নিও ক্ল্যাসিকাল ও কিনসিয়ান তত্ত্ব অনুযায়ী। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগ পরিবেশ বিঘ্নিত করবে। ফলে আমাদের যাত্রা হবে অন্ধকারের দিকে, যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও জনগণের সেবা করা। অন্যান্য পেশায় দেশ এবং জনগণের সেবার বিষয়টি রাজনীতির মতো প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়। যেমন একজন আইনজীবী আইন পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন, সঙ্গে সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশকে সহযোগিতা করে থাকেন। একজন ব্যাংকার অর্থ উপার্জনের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সহায়তা করে থাকেন। কিন্তু রাজনীতিকদের দেশ এবং জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকতে হয়, যার বিপরীতে কোনো অর্থ উপার্জনের সুযোগ নেই। নিজস্ব সম্পদ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য আলাদা আয়ের উৎস না থাকলে সার্বক্ষণিক রাজনীতি করা কষ্টকর। কারণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে একজন রাজনীতিক জনগণের কাছ থেকে শুধু সম্মান, সুনাম ও সুখ্যাতির অধিকারী হন, অর্থ-বিত্তের নয়। রাজনীতিকরা সবচেয়ে বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য। কারণ, অন্যরা যেখানে নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত, সেখানে তারা তাদের মেধা, শ্রম ও সময় ব্যয় করছেন দেশ ও জনগণের জন্য।
এরকম একজন ত্যাগী রাজনীতিকের কাছে নির্বাচন তার জনসেবার পরীক্ষা। জনগণ যদি তার সেবায় তুষ্ট হয়, তাহলে তাকে নির্বাচিত করে দেশ শাসনের ভার দিয়ে তার উপর আরও গুরুদায়িত্ব¡ অর্পণ করতে পারে। গণতন্ত্রে ভোট না পেলে জনগণের সঙ্গে শত্র“তা কিংবা ভোট পেলে জনগণের ওপর প্রভুত্ব¡ করার সুযোগ নেই। সর্বাবস্থায়ই জনসেবায় নিয়োজিত থাকতে হয় যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়। আমাদের মতো সমস্যাজর্জরিত দেশে যারা নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসনের সুযোগ পান তাদের রাত-দিন পরিশ্রম করতে হয়, চিন্তামগ্ন থাকতে হয়। কারণ সীমিত সম্পদ দিয়ে জনগণের হাজারও সমস্যা সমাধান করা সত্যিই কষ্টকর। তাই জনমতের বিপরীতে সংবিধান সংশোধন করে, বিভিন্ন রকম ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার কিংবা যেনতেন ভাবে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তাই হচ্ছে।
কেন এমন হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায় রাজনীতির মতো মহৎ কাজটি বেশির ভাগ নেতাকর্মী জনসেবার মানসিকতা নিয়ে করেন না, অর্থবিত্ত অর্জন ও ক্ষমতার জন্য করে থাকেন। ফলে ত্যাগের পরিবর্তে ভোগের মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করা হয়। এ ভোগ কিংবা অর্থ উপার্জন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়া পরিপূর্ণতা পায় না। এ জন্য কেউ ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। অন্যভাবে বলা যায়, কেউ ক্ষমতার বাইরে থাকতে চায় না। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর পরই শুরু হয় ক্ষমতাসীন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের অবৈধ উপার্জনের মহোৎসব। এ জন্য ক্ষমতার শেষ দিকে তাদের দুই ধরনের ভয় পেয়ে বসে। একটি হচ্ছে অবাধ অর্থবিত্ত উপার্জনের সুযোগ হাত ছাড়া হওয়ার ভয়। অন্যটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট এবং অন্যান্য অপকর্মের কারণে জনরোষ ও পরবর্তী সরকারের দ্বারা আইনের আওতায় আসার ভয়। তাই তারা ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। অপর পক্ষে বিরোধী দলও অপেক্ষায় থাকে ভোগের পেয়ালা কখন হাতে পাবে। তাই ক্ষমতাসীনদের সরানোর জন্য যে কোনো পথ অবলম্বন করতে দ্বিধা করে না, তাতে জনগণের যত কষ্টই হোক। বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক সমস্যা যাকে আমরা সাংবিধানিক সমস্যায় রূপান্তরিত করেছি তার মূল ভিত্তি হচ্ছে আমাদের এ ভোগের নেশায় মত্ত রাজনীতি। আর লুটপাট ও ভোগের রাজত্ব স্থায়ী করার জন্য প্রয়োজন প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা। তাই বিরোধী দলকে নির্যাতন-নিপীড়ন করতে হয়। মিটিং মিছিল ও জনসভা করার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করতে হয়। প্রতিপক্ষকে হত্যার চেষ্টা করতে হয়। নিজে অথবা নিজের পছন্দের মানুষের অধীনে নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করতে হয়। দেশের সব মানুষকে বোকা ভেবে সরকারি দল সব সময় সংবিধানের জন্য মায়া কান্না প্রদর্শন করতে থাকে। যদিও তারা প্রত্যেকেই নিজেদের প্রয়োজনে সংবিধানের গায়ে ছুরি চালাতে দ্বিধা করেননি। এ যেন ‘মুখে শেখ ফরিদ- বগলমে ইট’।
আরও মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যে রয়েছে স্ববিরোধিতা। ক্ষমতায় থাকতে যে কথা বলেন, বিরোধী দলে গেলে ঠিক তার বিপরীত কথা বলেন। ক্ষমতায় থাকলে নির্দলীয় সরকার কারও ভালো লাগে না। বিরোধী দলে থাকলে এর প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে টের পান। ফলে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সময়ের সরকার প্রধানের বক্তব্য, আজকের বক্তব্যের ঠিক বিপরীত। একইভাবে তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা যিনি আজকের প্রধানমন্ত্রী তার তখনকার বক্তব্য, আর আজকের বক্তব্য পুরোপুরি বিপরীত। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে গিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত আন্দোলনে অনেক জীবন ও সম্পদ ক্ষয় হয়েছে। অথচ তারই নেতৃত্বে¡ আদালতের রায়ের অজুহাতে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থাকে হত্যা করা হল। এটা যেন মায়ের হাতে নিজ সন্তান হত্যার মতো ঘটনা। জনগণ এটাকে ভালো চোখে দেখেনি বলে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও সাম্প্রতিক জরিপে তারা সরকারকে ‘না’ বলেছে।
রাজনীতি জনসেবার পরিবর্তে রাজ-ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণে আমাদের দেশ স্থায়ী সমস্যায় নিপতিত হয়েছে। এ থেকে সহজ মুক্তি নেই, পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ব্যতীত। তবে বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি নিজেকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানের পদটি ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিলেই সমঝোতা হতে পারে। সব দলকে নিয়ে একটি নির্বাচন হলে জাতি আপাত সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে মুক্তি পাবে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা কেটে যাবে। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনও এ ঘোষণা দেননি। সহজে দেবেন বলেও মনে হচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ ঘোষণা আদায়ের জন্য বিরোধী দল চূড়ান্ত আন্দোলনে যাচ্ছে। সরকারি দল, পুলিশ ও বিরোধী দলের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হতে পারে। কে জিতবে, কে হারবে বলা না গেলেও এ ধরনের সংঘর্ষের কারণে দেশ ও দেশের জনগণই হারে। সরকার এরই মধ্যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। অনেকটা জরুরি অবস্থার মতো। এভাবে হয়তো বিরোধী দলের আন্দোলন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে। তবে বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। আর সমস্যাটা প্রলম্বিত হবে এ জন্যই।
সরকার হয়তো আশা করছে, কোনোভাবে একদলীয় একটা নির্বাচন করতে পারলেই হল। এ জন্য তারা বৈধ-অবৈধ সব শক্তি নিয়োগ করছে। কিন্তু বিরোধী দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে এবং সামর্থ্য অনুযায়ী আন্দোলন চালিয়ে যায় তাহলে দেশে স্থিতিশীলতা আসবে না। তারা ধীরে ধীরে আইন অমান্যের দিকে চলে যাচ্ছে। আজকে তাদের পক্ষ থেকে একজন দার্শনিকের ভাষায় বলা হয়েছে, ‘হোয়েন অর্ডার ব্রিংস ইনজাস্টিস, ডিসঅর্ডার ইজ দি বিগিনিং অব জাস্টিস।’ এভাবে দেশের কিছু মানুষ যদি আইন-শৃংখলা অমান্য করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আশায় আর বেশির ভাগ মানুষ তা সমর্থন করে তা হলে দেশ কতদিন চালানো সম্ভব হবে সরকারের পক্ষে তা বিবেচনা করা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন। এছাড়া বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেছেন, এ সরকার ২৪ অক্টোবরের পর অবৈধ, তাই জনগণকে আহ্বান করেছেন সরকারকে ক্ষমতা থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে হটানোর জন্য। তার আহ্বানটি থমাস পেইনের মতো, ‘ইট ইজ দি ডিউটি অব দি পেট্রিয়ট টু প্রটেক্ট হিজ কান্ট্রি ফ্রম ইটস গভর্নমেন্ট’। থমাস পেইন আজ আর বেঁচে নেই, থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, তার এ উক্তি কি বর্তমানে আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য?
সমস্যা হচ্ছে আমাদের অর্থনীতিকে নিয়ে। রাজনীতির মতো পুলিশ, র্যাব ও লাঠিয়াল দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অর্থনীতি এখনও চলে ক্ল্যাসিকাল, নিও ক্ল্যাসিকাল ও কিনসিয়ান তত্ত্ব অনুযায়ী। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগ পরিবেশ বিঘ্নিত করবে। ফলে আমাদের যাত্রা হবে অন্ধকারের দিকে, যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
No comments