খালেদা জিয়ার রাজনীতি, এখন... by ফরহাদ মজহার
শেষাবধি ২৫ অক্টোবর...
এই লেখা লিখছি বহু প্রতীক্ষার ২৫ অক্টোবর, শুক্রবারে। বাংলাদেশের রাজনীতি কোনদিকে যেতে চাইছে তার কিছুটা আন্দাজ আমরা আজ সন্ধ্যার মধ্যে করতে পারব। যেহেতু গতকাল অবধি দুই পক্ষের মধ্যে তথাকথিত ‘সমঝোতা’ বা ‘আপস’ হয়নি অতএব রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়েই সম্ভবত নিষ্পন্ন হতে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা আইন-আদালত, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবিসহ রাষ্ট্রের সব শক্তি প্রয়োগের প্রতিষ্ঠানকে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কৌশল ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি কেমন সেটা আমরা সম্ভবত দেখতে শুরু করব আরও স্পষ্টভাবে। বলাবাহুল্য, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বলপ্রয়োগের ক্ষমতাই রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা পালন করবে। তবে এর পরিণতি নির্ভর করবে সমাজে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার মাত্রার ওপর। এ মুহূর্তে খালেদা জিয়া সামগ্রিক রাজনীতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তার মূল্যায়নের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে কী ধরনের নীতি ও কৌশল এই প্রতিরোধ-পর্বে তিনি গ্রহণ করবেন। এখানে ভুল করলে বিশাল খাদে তিনি পড়ে যেতে পারেন। সেখান থেকে তার পক্ষে উঠে আসা খুবই কঠিন হবে।
এটা ২০০৭ সাল নয়, ২০১৩ সাল। এক-এগারোর নায়কেরা একটি সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক দল ছিল না। তারা সুশীলদের সুবিধাবাদী রাজনীতির ধারক হলেও আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের মতো কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে ঐক্যবদ্ধ ছিল না। ক্ষমতাসীন মহাজোটের রাজনৈতিক মতাদর্শ হচ্ছে ইসলাম-বিদ্বেষ, ফ্যাসিবাদ ও বাংলাদেশকে দিল্লির অধীনস্থ করা। জনগণের সঙ্গে তাদের বিরোধের মূল জায়গাগুলো এখানে। একে জনগণ সমাজের নানান স্তর থেকে মোকাবেলা করছে। কেউ ঈমান-আকিদার জায়গা থেকে, কেউ জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই হিসেবে, আবার কেউ বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাস ও সংস্কৃতি হিসেবে। একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসেবে ইসলাম প্রশ্নে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি আসলে কী সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। তাদের মধ্যে কেউ শাহবাগের সমর্থক, আবার কেউ শাপলা চত্বরের। অনেকে মাঝখানে পেন্ডুলামের মতো একবার বামদিকে একবার ডানদিকে হেলছে। এ ধরনের দল নিয়ে বড় কোনো নীতিগত আন্দোলন করা যায় না। রাজনৈতিক উদারবাদও না। কিন্তু নানান কারণে বাংলাদেশের জনগণের বিশাল একটি অংশ খালেদা জিয়ার ওপর নতুন করে ভরসা করছে। এই ভরসা কতটুকু বাহ্যিক অথবা সারবস্তু সম্পন্ন সেটা আমরা এখন দেখতে থাকব। আসলে নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেয়া আর আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের ওপর ভরসা করার মধ্যে পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগ বিএনপির শত্র“, ইসলামপন্থীদেরও বটে। কিন্তু শত্র“র শত্র“ আমার মিত্র, এই কৌশল যথেষ্ট নয়। সুনির্দিষ্ট নীতি ও সঙ্গতিপূর্ণ কৌশল দরকার।
দ্বিতীয়ত, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর ছাড়া বাংলাদেশে ন্যূনতম লিবারেল বা উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনও এখন অসম্ভব- সেটা শুধু বিএনপি ও তার জোটের শরিকদের নয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব নাগরিককেই বুঝতে হবে। আর খালেদা জিয়াকে বুঝতে হবে, আন্দোলনের যে কোনো পর্যায়ে আপস করে তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারবেন, কিন্তু ফ্যাসিবাদের মতাদর্শিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক খুঁটি উপড়ে ফেলতে না পারলে তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না। মিসরের ঘটনাবলী থেকে তিনি কিছুটা শিক্ষা নিতে পারেন।
তৃতীয়ত রয়েছে দিল্লিকে মোকাবেলার প্রশ্ন। সেটা নিছকই দিল্লির সঙ্গে সুসম্পর্ক নয়, নতুনভাবে একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। মহাজোট সরকার গত পাঁচ বছরে সেটা ধ্বংস করে দিয়েছে। তার জোটের শরিকদের মধ্যে এ ধরনের উপলব্ধি যেন না হয় যে তিনি তার রাজনৈতিক স্বার্থে জোটের শরিকদের ব্যবহার করছেন, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষার প্রশ্নে সবার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট নীতি ও কৌশল গড়ে তোলা তার অনেক আগেই জরুরি ছিল। শুধু বক্তৃতা যথেষ্ট নয়। লড়াই সুস্পষ্টভাবে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম হিসেবে হাজির হতে থাকবে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার রাজনীতি তিনি কিভাবে হাজির করেন, তার ওপর তার নেতৃত্বের নিশ্চয়তা নির্ভর করছে।
এ সরকার অবৈধ
খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে এই সরকারের বৈধতার সীমা ২৪ অক্টোবর বেঁধে দিয়েছিলেন। অপরিসীম দমন-পীড়ন, নির্যাতন ও উস্কানির মুখেও তিনি নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বাইরে যাননি। এই কৌশলের একটা তাৎপর্যপূর্ণ ফল হচ্ছে সাধারণ মানুষ ২৪ অক্টোবরের পর এই সরকারকে অবৈধ সরকার হিসেবে গণ্য করছে। বৃহস্পতিবার শিক্ষক-কর্মচারীদের সভায় খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবেই আবার বললেন, এই সরকার বৈধ সরকার নয়, অতএব একে হটানো জনগণের কর্তব্য, নাগরিকদের দায়। এর মানে হচ্ছে, এই সরকারকে মানতে জনগণ যেমন বাধ্য নয়, ঠিক তেমনি প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব বা সেনাবাহিনীও মানতে বাধ্য নয়।
ক্ষমতাসীনদের পক্ষে বলা হচ্ছে, এটা ঠিক না। শেখ হাসিনা ‘বৈধ’ সরকার। তারা আসলে বৈধতা (legitimacy) এবং আইনি দাবির (legality) মধ্যে গোলমাল করে ফেলেছেন। শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তিনি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান বদলিয়ে ফেলেছেন। তিনি নিজে আইন করে এখন বলছেন, আমাদের তা মানতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তিনি নাগরিক ও মৌলিক অধিকার হরণ করে নিয়েছেন। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইন প্রণয়ন করলেই সেটা বৈধ হয়ে যায় না। গণতন্ত্র একটি রাষ্ট্রের ধরন। সেই রাষ্ট্রে নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত ও বলবৎ করা না গেলে সে রাষ্ট্র আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থাকে না। সেটা তখন অবৈধ রাষ্ট্র, তার সংবিধানও অবৈধ। এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক জনগণের বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু যেহেতু গায়ের জোরে আইন করা হয়েছে, অতএব সেই কালো আইনের জোরে তাকে ‘আইনি’ বলা যায়, কিন্তু সে আইন আসলে জংলি আইন। জংলি আইন বৈধ আইন তো নয়ই। কোনো আইনই নয়। এ ধরনের রাষ্ট্র ও সরকার কোনো নৈতিক বা দর্শনগত বৈধতার জোরে টিকে থাকে না। টিকে থাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জোরে, নগ্নভাবে বল প্রয়োগের মাধ্যমে। এর কোনো নৈতিক বা আদর্শগত ভিত্তি নাই। একে বল প্রয়োগের মাধ্যমেই মোকাবেলা করতে হয়, ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। এ ধরনের রাষ্ট্র বা সরকারের সঙ্গে সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সামরিক শাসনের কোনো প্রভেদ নাই। তুলনায় সামরিক আইনের চেয়েও ফ্যাসিবাদ ভয়ংকর। সামরিক একনায়কতন্ত্রের কোনো জনসমর্থন থাকে না, কিন্তু ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্রের পক্ষে বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম ও সমাজের উগ্র একটি অংশের সমর্থন থাকে।
খালেদা জিয়া এই সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।
আমরা এখন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যের পর্যালোচনা করব।
পরাশক্তির মুখাপেক্ষী হওয়া বিপজ্জনক
গত ২১ অক্টোবর বেগম খালেদা জিয়া হোটেল ওয়েস্টিনের সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বক্তব্য পেশ করেছেন। একই সঙ্গে সম্ভাব্য নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হতে পারে তার একটা প্রস্তাবও দিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রান্তিকালীন রাজনৈতিক মুহূর্তের কারণে তার বক্তব্য ও প্রস্তাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে তার প্রশংসা করেছেন। প্রশংসার ধরন অনেকটা এরকম- ক্ষমতাসীনরা খেলার বোর্ড যেভাবে সাজানোর চেষ্টা করছে তার বিপরীতে বিরোধীদলীয় নেতা একটা ‘চাল’ চেলেছেন। কথাটা কেউ সরাসরি বলেছেন, কেউ বলেছেন প্রচ্ছন্নভাবে। বাংলাদেশের বর্তমান অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে তার বক্তব্যের এই মূল্যায়নটা প্রশংসাসূচক হলেও ইতিবাচক নয়। অর্থাৎ রাজনীতির বর্তমান মুহূর্তে বিরোধীদলীয় নেতার কাছ থেকে জনগণ রাজনৈতিক ‘চাল’ চাইছে না, সুনির্দিষ্ট নীতি ও দিকনির্দেশনা প্রত্যাশা করে। প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণও চাল ছাড়া কিছুই ছিল না। বাংলাদেশের এখনকার রাজনৈতিক মুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে জনগণের চোখে দুই নেত্রীর বক্তব্য, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেত্রীর বক্তব্য যদি ‘চাল’ কিংবা রাজনৈতিক চালাকি বলে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সেটা খুবই বিপজ্জনক। তার নিজের জন্য যেমন, বাংলাদেশের জনগণের জন্যও তেমনি।
আবারও বলছি, বাংলাদেশের জনগণ দেশের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে রাজনৈতিক নির্দেশনা চেয়ে আসছে। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশের জনগণকে কী দিতে পারেন বা কী দেবেন সেটা এখনকার সংকট তৈরি হওয়ার অনেক আগেই স্পষ্ট করে বলা দরকার ছিল। তিনি বলেননি। ইতিমধ্যে খুবই দেরি হয়ে গেছে। এখন তিনি নির্বাচনের সময় সরকারের ধরন নিয়ে যে প্রস্তাব করেছেন, সেটা অনেকের মতো আমার কাছেও ‘অবাস্তব’ মনে হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম না ধরে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের জন্য বাংলাদেশে তিনি পুরনো লোক ছাড়া নতুন কাউকে খুঁজে পেলেন না। কৌশলগত হলেও সেটাও ঠিক মনে হয়নি। তার রাজনৈতিক প্রভাব সমাজে পড়ে। যেমন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তৈরির সময় এই ধারণা দেশের মানুষকে দেয়া হয়েছিল যে একমাত্র বিচারকরাই বাংলাদেশে ফেরেশতা, তাদেরই প্রধান উপদেষ্টা বানাতে হবে। এর ফল বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ হয়েছে। এ প্রস্তাবের একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, ১৬ কোটির এই দেশে মাত্র বিশজন লোকই আছেন, মরা কিংবা জীবিত, যারা নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারেন। আর ইতিবাচকভাবে বিচার করলে তিনি বলতে চেয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি আমলে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়েছে, অন্যটায় বিএনপি নির্বাচিত হয়েছে, কাজেই এদের ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। এই ভেবে তিনি সহজ অবস্থান নিতে গিয়ে এ বিষয়টাকে খামাখা আরও জটিল করে ফেলেছেন। এখন সবাই অংক মেলাচ্ছেন, কতজন বেঁচে আছেন, কতজন অসুস্থ, কতজন রাজি হবেন, ইত্যাদি করতে গিয়ে শেষতক লোম বাছতে কম্বল উজাড় হচ্ছে। বাংলাদেশের সুশীল নাগরিক সমাজ কিছুটা ক্ষুব্ধ হতে পারে, কারণ নির্দলীয় নিরপেক্ষ মুহূর্তগুলোর দিকে তারা তাকিয়ে থাকে। এর চেয়ে ভালো কোনো প্রস্তাব দিলেও যে তা শেখ হাসিনার কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতো এমন কোনো গ্যারান্টি নাই। আসলে শেখ হাসিনার প্রস্তাবের বিপরীতে তিনি কোনো প্রস্তাব দিচ্ছেন না কেন বলে যারা তার সমালোচনা করছিল ও চাপ দিচ্ছিল, তিনি তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন।
২১ অক্টোবরের প্রেস কনফারেন্সকে তিনি আন্দোলন আরও শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর সুযোগ হিসেবে নিতে পারতেন। গ্রামেগঞ্জে চায়ের দোকানে রেডিও-টেলিভিশনে তার বক্তব্য শোনার জন্য লোকের ভিড় ছিল, যদি কোনো আন্দোলনের ঘোষণা আসে এই আশায়। তারা হতাশ হয়েছে এবং তার দোদুল্যমানতাকে পছন্দ করেনি। সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে মনে হয়েছে তিনি দেশের জনগণকে নয়, বরং পরাশক্তিগুলোকে সন্তুষ্ট করার দিকেই অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে ফেলেছেন। ফলে মনে হয়েছে, সময় ও সুযোগের উপযুক্ত ব্যবহার তিনি করেননি।
যে দিকটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে যতটুকু বলা দরকার, অতি উৎসাহী হয়ে তিনি তার চেয়েও অনেক বেশি বলেছেন। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্থানীয় বরকন্দাজ হতে চান, যে যুদ্ধ মূলত পরিচালিত হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে, তিনি সেই যুদ্ধে পাশ্চাত্য শক্তির অংশীদার হতে চান, তাদের হাত মজবুত করতে চান। পাশ্চাত্যের হয়ে তিনি এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে লড়তে চান। যে র্যাবকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ‘ঘাতক বাহিনী’ আখ্যা দিয়েছে, তিনি তার জন্য গর্বিত। এর আগেও তিনি এ ধরনের ভুল গর্বে গর্বিত হয়েছেন। নাগরিক ও মানবাধিকার লংঘনের দায় তার ওপর কালো ছায়ার মতো ঝুলছে। আজ যখন জনগণ মানবিক ও নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য লড়ছে, তখন তার চরম মানবাধিকারবিরোধী অবস্থান নেয়া ঠিক হয়নি। এই অবস্থান তার রাজনৈতিক শক্তি ও সমর্থনের ভিত্তিকে দুর্বল করবে।
তাছাড়া বেগম জিয়া ভুলে যাচ্ছেন, তিনি যতই চেষ্টা করেন না কেন, বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সেনাপতি শেখ হাসিনা। তিনি শত চেষ্টা করেও শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি ফ্যাসিস্ট হতে পারবেন না। এবং ফ্যাসিস্টরাই পরাশক্তির পছন্দ। শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র এটা নয়। বরং ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইটাই তার জায়গা। সেই জায়গা তিনি অলংকৃত করতে না চাইলে তা খালি থাকবে না। আমি বারবারই বলে আসছি, তাকে ঘিরে আছে এমন কিছু শক্তি যারা তাকে পরাশক্তির ইচ্ছামতো পরিচালিত করতে চায়। এতে তাদের নিজেদেরও লাভ আছে। তারা তাকে সারাক্ষণই বিভ্রান্ত করছে ও ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে বাংলাদেশের জনগণের বিপরীতে দাঁড় করাচ্ছে। কিন্তু তিনি যদি সত্যিই দেশনেত্রী হতে চান তাহলে তাকে এদের জাল ছিন্ন করে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। তিনি শেখ হাসিনাকে টালবাহানা বন্ধ করার কথা বলেছেন, এক্ষেত্রে তাকেও টালবাহানা বন্ধ করতে হবে।
তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইছিলেন। তার দিক থেকে এই দাবির যুক্তি আছে। প্রথমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভালো হোক কী মন্দ হোক, বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতির ভিত্তিতেই সংবিধানে যুক্ত। দ্বিতীয়ত, প্রতিকূল পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে তিনি নির্বাচনে যেতে চান না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তার দলের ক্ষমতায় যাওয়ার দাবি। এই দাবি জনগণের কাছে কোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্র“তি নয়। কিংবা বাংলাদেশের বর্তমান অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার বা রূপান্তর ঘটিয়ে নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠন করার কর্মসূচিও নয়। বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে তিনি কিভাবে গড়ে তুলতে চান- সেই কর্মসূচি কই? নিদেনপক্ষে একটি সহনশীল শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার ন্যূনতম নীতিমালা কী হতে পারে, সে বিষয়েও তার কাছ থেকে জনগণ কোনো নির্দেশনা পায়নি।
বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ধরনের দল উদার রাজনৈতিক (ষরনবৎধষ) দল বলে পরিচিত। তারপরও সীমিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এ দলটি অনেক কিছুই করতে পারে। করার আছে। যেমন নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা, বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার স্বীকার করা এবং কারখানায় তাদের প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা, প্রাণ ও পরিবেশের ক্ষতি না করা, দুর্নীতি না করা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করা, দিল্লির আগ্রাসন থেকে রক্ষা, অবাধ বাজারের নামে সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন বন্ধ করা ইত্যাদি। বিএনপি এই ন্যূনতম কাজগুলো করবে জনগণ সেই প্রতিশ্র“তি তার কাছ থেকে চায়। এখন আওয়ামী লীগ যদি হঠাৎ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে বসে তাহলে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও এই প্রতিশ্র“তি দেয়ার সময় পাবে না। কিন্তু তিনি এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্র“তি দেননি। মনে রাখা দরকার, আমরা অবাস্তব নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি ও প্রোপাগান্ডামূলক কর্মসূচির কথা বলছি না। বলছি এমন কিছু নীতিগত সংস্কারের কথা যা জনগণকে আশার বাণী শোনায় এবং যার বাস্তবায়ন তার দল বা ১৮ দলীয় জোটের পক্ষে করা সম্ভব। যেমন পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যে অগণতান্ত্রিক, নাগরিক ও মানবাধিকারবিরোধী সংবিধান আমাদের ঘাড়ের ওপর বাঘের হিংস্র নখের মতো বসে রয়েছে আর আমাদের ক্রমাগত রক্তক্ষরণ ঘটছে, তিনি কিভাবে তার সংস্কার করবেন। কিংবা আদৌ করবেন কিনা আমরা এখনও জানি না। গণমাধ্যমের ওপর যে নিপীড়ন চলছে সেই নিপীড়নের বিবিধ কালো আইন তিনি বাতিল করবেন কিনা। তিনি মাহমুদুর রহমান, আদিলুর রহমান খানের ওপর দমন-নিপীড়নের কথা বলেছেন, অবশ্যই। কিন্তু এই নিপীড়ন বন্ধ করতে হলে তাকে তো বিচারব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে, দুষ্ট বিচারকদের হাত থেকে নাগরিকদের মুক্তি দিতে হবে, পুলিশ ও প্রশাসনের ট্রিগার হ্যাপি সন্ত্রাসীদের শাস্তি দিতে হবে ইত্যাদি। তিনি এসব সুনির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে কিছুই বলেননি। তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি করবেন না বলেছেন, সেটা খুবই ভালো নীতি। একথা তার বারবার বলা দরকার। কিন্তু যারা গণহত্যা করেছে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, মানুষ গুম করেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, আলেম-ওলামাদের আলো নিভিয়ে নির্বিচারে হত্যা করেছে, নিজেরা কোরআন শরিফ পুড়িয়ে আলেম-ওলামাদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছে, তাদের ক্ষমা করে দেয়ার অধিকার তো জনগণ তাকে দেয়নি। প্রতিহিংসা অবশ্যই নয়, কিন্তু ন্যায়সঙ্গত বিচার থেকে কাউকে রেহাই দেয়ার অধিকার তার নেই। কারোরই নেই। এই প্রত্যাশাগুলোকেই তিনি লম্বা দাবিনামা বা অনর্থক বিশাল তালিকা না বানিয়ে সহজে বলতে পারেন যে একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা। তিনি ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের সেই ঘোষণাই বাস্তবায়িত করবেন। আসলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করতে চাইছি। জয় শাহবাগ!
এটা সত্য যে, তিনি ‘নতুন ধারার রাজনীতি’র কথা বলেছেন এবং বিমূর্ত হলেও তার কিছু রূপরেখা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ওর মধ্যে আবেগ ও আশা আছে, কিন্তু নতুন ভবিষ্যৎ তৈরির কোনো সুচিন্তিত সূত্র নেই। তবু তিনি যখন নিজের ভুলত্র“টি অকপটে স্বীকার করেন, তখন তাকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। তিনি বলেছেন, ‘প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, মানুষ ভুল-ত্র“টির ঊর্ধ্বে নয়। এবং একথা স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই যে, অতীতে আমাদেরও ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে। তবে একই সঙ্গে আমি বলতে চাই যে, আমরা ওই সব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আগামীতে একটি উজ্জ্বল, অধিক স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমরা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমি সেই প্রবচনের সঙ্গে একমত যে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই আমরা অতীতের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করব না।’ একথাগুলো আমাদের সোনার অক্ষরে খোদাই করে রাখা দরকার। কারণ একথার ওপর দাঁড়িয়েই আগামী দিনে জনগণ তাকে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, বিদেশীদের সন্তুষ্ট রাখার ভুল ও হীনমন্য নীতি তিনি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। স্বীকার করি, পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাকে কৌশলী হতে হবে। কিন্তু সেটা দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে নয়।
তিনি এতদিন শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে আসছেন। আমি অনেকবারই তার সমালোচনা করেছি। তিনি ক্ষমতার রাজনীতি করেন, ক্ষমতায় যেতে চান, এতে কোনো অসুবিধা নেই। সেটা অন্যায়ও নয়। আমরা অনেকেই বারবার তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি, বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, ফলে এতটুকুই বিএনপির কাছে আশা করা ন্যায্য যে তারা অতীতের দুর্নীতিপরায়ণ চরিত্র ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা থেকে যথাসম্ভব নিজেদের সংশোধন করে একটা উদার কিন্তু গণতান্ত্রিক নীতির চর্চা করবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাও কঠিন কাজ। এর অর্থ হচ্ছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানের যে দুর্দশা ঘটেছে সেই সংবিধান বহাল রেখে গণতন্ত্র কায়েম ও চর্চা রীতিমতো অসম্ভব। এই সত্য মাথায় রেখেই তাকে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। গণঅভ্যুত্থান ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সামনে আর কোনো পথ ক্ষমতাসীনরা রাখেনি। তিনি চান বা না চান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেদিকে যাওয়ারই সমূহ সম্ভাবনা। বুর্জোয়া দল হিসেবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকলেও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে তিনি নিজেকে গৌণ শক্তিতে পরিণত করবেন। ষাট ও সত্তর দশকে শেখ মুজিবুর রহমান আইনি পরিমণ্ডলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিই করেছিলেন। কিন্তু তা আইন ও নিয়মতান্ত্রিকতার সীমা অতিক্রম করে গণঅভ্যুত্থান ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না ঠিক, কিন্তু ফল পেকে গেলে সেটা পাড়তে না পারলে সেই ফল বাদুড়ের খাদ্য হয়।
বাংলাদেশের মানুষ এখন বেগম জিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি কী বলবেন না বলবেন সেটা তাকে অনেক সাবধানে ও বহু কিছু বিবেচনা করে বলতে হবে। পরাশক্তি তাকে ক্ষমতায় আনবে না, জনগণই আনবে। যদি তারা চায়। পরাশক্তি যদি কাউকে আনে, তবে তারা হচ্ছে তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তি’। তিনি নন। যারা এলে এবার দুই বছর নয়, আরও দীর্ঘকাল থাকবে। আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তথাকথিত তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সব সময়ই থাকবে। অতএব ঢাকার কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে সৌহার্দ্য থাকুক, কিন্তু তাদের হাত ধরে চলার নীতি বেগম জিয়াকে ত্যাগ করতে হবে। বিশেষত তিনি যদি বলেন যে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্যায়, সহিংস ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধে তিনি বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে লড়বেন, তাহলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের জনগণ তার পেছনে দাঁড়াবে কেন? শেখ হাসিনা এই নীতি নিয়েছেন বলেই জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করছে। আর যারা এই নীতির সমর্থক তারাই বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। এই সরল কাণ্ডজ্ঞান আমরা যেন না হারাই।
এই লেখা লিখছি বহু প্রতীক্ষার ২৫ অক্টোবর, শুক্রবারে। বাংলাদেশের রাজনীতি কোনদিকে যেতে চাইছে তার কিছুটা আন্দাজ আমরা আজ সন্ধ্যার মধ্যে করতে পারব। যেহেতু গতকাল অবধি দুই পক্ষের মধ্যে তথাকথিত ‘সমঝোতা’ বা ‘আপস’ হয়নি অতএব রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়েই সম্ভবত নিষ্পন্ন হতে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা আইন-আদালত, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবিসহ রাষ্ট্রের সব শক্তি প্রয়োগের প্রতিষ্ঠানকে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কৌশল ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি কেমন সেটা আমরা সম্ভবত দেখতে শুরু করব আরও স্পষ্টভাবে। বলাবাহুল্য, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বলপ্রয়োগের ক্ষমতাই রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা পালন করবে। তবে এর পরিণতি নির্ভর করবে সমাজে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার মাত্রার ওপর। এ মুহূর্তে খালেদা জিয়া সামগ্রিক রাজনীতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তার মূল্যায়নের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে কী ধরনের নীতি ও কৌশল এই প্রতিরোধ-পর্বে তিনি গ্রহণ করবেন। এখানে ভুল করলে বিশাল খাদে তিনি পড়ে যেতে পারেন। সেখান থেকে তার পক্ষে উঠে আসা খুবই কঠিন হবে।
এটা ২০০৭ সাল নয়, ২০১৩ সাল। এক-এগারোর নায়কেরা একটি সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক দল ছিল না। তারা সুশীলদের সুবিধাবাদী রাজনীতির ধারক হলেও আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের মতো কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে ঐক্যবদ্ধ ছিল না। ক্ষমতাসীন মহাজোটের রাজনৈতিক মতাদর্শ হচ্ছে ইসলাম-বিদ্বেষ, ফ্যাসিবাদ ও বাংলাদেশকে দিল্লির অধীনস্থ করা। জনগণের সঙ্গে তাদের বিরোধের মূল জায়গাগুলো এখানে। একে জনগণ সমাজের নানান স্তর থেকে মোকাবেলা করছে। কেউ ঈমান-আকিদার জায়গা থেকে, কেউ জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই হিসেবে, আবার কেউ বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাস ও সংস্কৃতি হিসেবে। একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল হিসেবে ইসলাম প্রশ্নে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি আসলে কী সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। তাদের মধ্যে কেউ শাহবাগের সমর্থক, আবার কেউ শাপলা চত্বরের। অনেকে মাঝখানে পেন্ডুলামের মতো একবার বামদিকে একবার ডানদিকে হেলছে। এ ধরনের দল নিয়ে বড় কোনো নীতিগত আন্দোলন করা যায় না। রাজনৈতিক উদারবাদও না। কিন্তু নানান কারণে বাংলাদেশের জনগণের বিশাল একটি অংশ খালেদা জিয়ার ওপর নতুন করে ভরসা করছে। এই ভরসা কতটুকু বাহ্যিক অথবা সারবস্তু সম্পন্ন সেটা আমরা এখন দেখতে থাকব। আসলে নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেয়া আর আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের ওপর ভরসা করার মধ্যে পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগ বিএনপির শত্র“, ইসলামপন্থীদেরও বটে। কিন্তু শত্র“র শত্র“ আমার মিত্র, এই কৌশল যথেষ্ট নয়। সুনির্দিষ্ট নীতি ও সঙ্গতিপূর্ণ কৌশল দরকার।
দ্বিতীয়ত, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর ছাড়া বাংলাদেশে ন্যূনতম লিবারেল বা উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনও এখন অসম্ভব- সেটা শুধু বিএনপি ও তার জোটের শরিকদের নয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব নাগরিককেই বুঝতে হবে। আর খালেদা জিয়াকে বুঝতে হবে, আন্দোলনের যে কোনো পর্যায়ে আপস করে তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারবেন, কিন্তু ফ্যাসিবাদের মতাদর্শিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক খুঁটি উপড়ে ফেলতে না পারলে তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না। মিসরের ঘটনাবলী থেকে তিনি কিছুটা শিক্ষা নিতে পারেন।
তৃতীয়ত রয়েছে দিল্লিকে মোকাবেলার প্রশ্ন। সেটা নিছকই দিল্লির সঙ্গে সুসম্পর্ক নয়, নতুনভাবে একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। মহাজোট সরকার গত পাঁচ বছরে সেটা ধ্বংস করে দিয়েছে। তার জোটের শরিকদের মধ্যে এ ধরনের উপলব্ধি যেন না হয় যে তিনি তার রাজনৈতিক স্বার্থে জোটের শরিকদের ব্যবহার করছেন, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষার প্রশ্নে সবার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট নীতি ও কৌশল গড়ে তোলা তার অনেক আগেই জরুরি ছিল। শুধু বক্তৃতা যথেষ্ট নয়। লড়াই সুস্পষ্টভাবে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম হিসেবে হাজির হতে থাকবে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার রাজনীতি তিনি কিভাবে হাজির করেন, তার ওপর তার নেতৃত্বের নিশ্চয়তা নির্ভর করছে।
এ সরকার অবৈধ
খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে এই সরকারের বৈধতার সীমা ২৪ অক্টোবর বেঁধে দিয়েছিলেন। অপরিসীম দমন-পীড়ন, নির্যাতন ও উস্কানির মুখেও তিনি নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বাইরে যাননি। এই কৌশলের একটা তাৎপর্যপূর্ণ ফল হচ্ছে সাধারণ মানুষ ২৪ অক্টোবরের পর এই সরকারকে অবৈধ সরকার হিসেবে গণ্য করছে। বৃহস্পতিবার শিক্ষক-কর্মচারীদের সভায় খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবেই আবার বললেন, এই সরকার বৈধ সরকার নয়, অতএব একে হটানো জনগণের কর্তব্য, নাগরিকদের দায়। এর মানে হচ্ছে, এই সরকারকে মানতে জনগণ যেমন বাধ্য নয়, ঠিক তেমনি প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব বা সেনাবাহিনীও মানতে বাধ্য নয়।
ক্ষমতাসীনদের পক্ষে বলা হচ্ছে, এটা ঠিক না। শেখ হাসিনা ‘বৈধ’ সরকার। তারা আসলে বৈধতা (legitimacy) এবং আইনি দাবির (legality) মধ্যে গোলমাল করে ফেলেছেন। শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তিনি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান বদলিয়ে ফেলেছেন। তিনি নিজে আইন করে এখন বলছেন, আমাদের তা মানতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তিনি নাগরিক ও মৌলিক অধিকার হরণ করে নিয়েছেন। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইন প্রণয়ন করলেই সেটা বৈধ হয়ে যায় না। গণতন্ত্র একটি রাষ্ট্রের ধরন। সেই রাষ্ট্রে নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত ও বলবৎ করা না গেলে সে রাষ্ট্র আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থাকে না। সেটা তখন অবৈধ রাষ্ট্র, তার সংবিধানও অবৈধ। এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক জনগণের বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু যেহেতু গায়ের জোরে আইন করা হয়েছে, অতএব সেই কালো আইনের জোরে তাকে ‘আইনি’ বলা যায়, কিন্তু সে আইন আসলে জংলি আইন। জংলি আইন বৈধ আইন তো নয়ই। কোনো আইনই নয়। এ ধরনের রাষ্ট্র ও সরকার কোনো নৈতিক বা দর্শনগত বৈধতার জোরে টিকে থাকে না। টিকে থাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জোরে, নগ্নভাবে বল প্রয়োগের মাধ্যমে। এর কোনো নৈতিক বা আদর্শগত ভিত্তি নাই। একে বল প্রয়োগের মাধ্যমেই মোকাবেলা করতে হয়, ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। এ ধরনের রাষ্ট্র বা সরকারের সঙ্গে সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সামরিক শাসনের কোনো প্রভেদ নাই। তুলনায় সামরিক আইনের চেয়েও ফ্যাসিবাদ ভয়ংকর। সামরিক একনায়কতন্ত্রের কোনো জনসমর্থন থাকে না, কিন্তু ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্রের পক্ষে বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম ও সমাজের উগ্র একটি অংশের সমর্থন থাকে।
খালেদা জিয়া এই সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।
আমরা এখন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যের পর্যালোচনা করব।
পরাশক্তির মুখাপেক্ষী হওয়া বিপজ্জনক
গত ২১ অক্টোবর বেগম খালেদা জিয়া হোটেল ওয়েস্টিনের সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বক্তব্য পেশ করেছেন। একই সঙ্গে সম্ভাব্য নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হতে পারে তার একটা প্রস্তাবও দিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রান্তিকালীন রাজনৈতিক মুহূর্তের কারণে তার বক্তব্য ও প্রস্তাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে তার প্রশংসা করেছেন। প্রশংসার ধরন অনেকটা এরকম- ক্ষমতাসীনরা খেলার বোর্ড যেভাবে সাজানোর চেষ্টা করছে তার বিপরীতে বিরোধীদলীয় নেতা একটা ‘চাল’ চেলেছেন। কথাটা কেউ সরাসরি বলেছেন, কেউ বলেছেন প্রচ্ছন্নভাবে। বাংলাদেশের বর্তমান অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে তার বক্তব্যের এই মূল্যায়নটা প্রশংসাসূচক হলেও ইতিবাচক নয়। অর্থাৎ রাজনীতির বর্তমান মুহূর্তে বিরোধীদলীয় নেতার কাছ থেকে জনগণ রাজনৈতিক ‘চাল’ চাইছে না, সুনির্দিষ্ট নীতি ও দিকনির্দেশনা প্রত্যাশা করে। প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণও চাল ছাড়া কিছুই ছিল না। বাংলাদেশের এখনকার রাজনৈতিক মুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে জনগণের চোখে দুই নেত্রীর বক্তব্য, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেত্রীর বক্তব্য যদি ‘চাল’ কিংবা রাজনৈতিক চালাকি বলে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সেটা খুবই বিপজ্জনক। তার নিজের জন্য যেমন, বাংলাদেশের জনগণের জন্যও তেমনি।
আবারও বলছি, বাংলাদেশের জনগণ দেশের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে রাজনৈতিক নির্দেশনা চেয়ে আসছে। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশের জনগণকে কী দিতে পারেন বা কী দেবেন সেটা এখনকার সংকট তৈরি হওয়ার অনেক আগেই স্পষ্ট করে বলা দরকার ছিল। তিনি বলেননি। ইতিমধ্যে খুবই দেরি হয়ে গেছে। এখন তিনি নির্বাচনের সময় সরকারের ধরন নিয়ে যে প্রস্তাব করেছেন, সেটা অনেকের মতো আমার কাছেও ‘অবাস্তব’ মনে হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম না ধরে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের জন্য বাংলাদেশে তিনি পুরনো লোক ছাড়া নতুন কাউকে খুঁজে পেলেন না। কৌশলগত হলেও সেটাও ঠিক মনে হয়নি। তার রাজনৈতিক প্রভাব সমাজে পড়ে। যেমন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তৈরির সময় এই ধারণা দেশের মানুষকে দেয়া হয়েছিল যে একমাত্র বিচারকরাই বাংলাদেশে ফেরেশতা, তাদেরই প্রধান উপদেষ্টা বানাতে হবে। এর ফল বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ হয়েছে। এ প্রস্তাবের একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, ১৬ কোটির এই দেশে মাত্র বিশজন লোকই আছেন, মরা কিংবা জীবিত, যারা নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারেন। আর ইতিবাচকভাবে বিচার করলে তিনি বলতে চেয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি আমলে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়েছে, অন্যটায় বিএনপি নির্বাচিত হয়েছে, কাজেই এদের ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। এই ভেবে তিনি সহজ অবস্থান নিতে গিয়ে এ বিষয়টাকে খামাখা আরও জটিল করে ফেলেছেন। এখন সবাই অংক মেলাচ্ছেন, কতজন বেঁচে আছেন, কতজন অসুস্থ, কতজন রাজি হবেন, ইত্যাদি করতে গিয়ে শেষতক লোম বাছতে কম্বল উজাড় হচ্ছে। বাংলাদেশের সুশীল নাগরিক সমাজ কিছুটা ক্ষুব্ধ হতে পারে, কারণ নির্দলীয় নিরপেক্ষ মুহূর্তগুলোর দিকে তারা তাকিয়ে থাকে। এর চেয়ে ভালো কোনো প্রস্তাব দিলেও যে তা শেখ হাসিনার কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতো এমন কোনো গ্যারান্টি নাই। আসলে শেখ হাসিনার প্রস্তাবের বিপরীতে তিনি কোনো প্রস্তাব দিচ্ছেন না কেন বলে যারা তার সমালোচনা করছিল ও চাপ দিচ্ছিল, তিনি তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন।
২১ অক্টোবরের প্রেস কনফারেন্সকে তিনি আন্দোলন আরও শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর সুযোগ হিসেবে নিতে পারতেন। গ্রামেগঞ্জে চায়ের দোকানে রেডিও-টেলিভিশনে তার বক্তব্য শোনার জন্য লোকের ভিড় ছিল, যদি কোনো আন্দোলনের ঘোষণা আসে এই আশায়। তারা হতাশ হয়েছে এবং তার দোদুল্যমানতাকে পছন্দ করেনি। সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে মনে হয়েছে তিনি দেশের জনগণকে নয়, বরং পরাশক্তিগুলোকে সন্তুষ্ট করার দিকেই অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে ফেলেছেন। ফলে মনে হয়েছে, সময় ও সুযোগের উপযুক্ত ব্যবহার তিনি করেননি।
যে দিকটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে যতটুকু বলা দরকার, অতি উৎসাহী হয়ে তিনি তার চেয়েও অনেক বেশি বলেছেন। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্থানীয় বরকন্দাজ হতে চান, যে যুদ্ধ মূলত পরিচালিত হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে, তিনি সেই যুদ্ধে পাশ্চাত্য শক্তির অংশীদার হতে চান, তাদের হাত মজবুত করতে চান। পাশ্চাত্যের হয়ে তিনি এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে লড়তে চান। যে র্যাবকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ‘ঘাতক বাহিনী’ আখ্যা দিয়েছে, তিনি তার জন্য গর্বিত। এর আগেও তিনি এ ধরনের ভুল গর্বে গর্বিত হয়েছেন। নাগরিক ও মানবাধিকার লংঘনের দায় তার ওপর কালো ছায়ার মতো ঝুলছে। আজ যখন জনগণ মানবিক ও নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য লড়ছে, তখন তার চরম মানবাধিকারবিরোধী অবস্থান নেয়া ঠিক হয়নি। এই অবস্থান তার রাজনৈতিক শক্তি ও সমর্থনের ভিত্তিকে দুর্বল করবে।
তাছাড়া বেগম জিয়া ভুলে যাচ্ছেন, তিনি যতই চেষ্টা করেন না কেন, বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সেনাপতি শেখ হাসিনা। তিনি শত চেষ্টা করেও শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি ফ্যাসিস্ট হতে পারবেন না। এবং ফ্যাসিস্টরাই পরাশক্তির পছন্দ। শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র এটা নয়। বরং ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইটাই তার জায়গা। সেই জায়গা তিনি অলংকৃত করতে না চাইলে তা খালি থাকবে না। আমি বারবারই বলে আসছি, তাকে ঘিরে আছে এমন কিছু শক্তি যারা তাকে পরাশক্তির ইচ্ছামতো পরিচালিত করতে চায়। এতে তাদের নিজেদেরও লাভ আছে। তারা তাকে সারাক্ষণই বিভ্রান্ত করছে ও ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে বাংলাদেশের জনগণের বিপরীতে দাঁড় করাচ্ছে। কিন্তু তিনি যদি সত্যিই দেশনেত্রী হতে চান তাহলে তাকে এদের জাল ছিন্ন করে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। তিনি শেখ হাসিনাকে টালবাহানা বন্ধ করার কথা বলেছেন, এক্ষেত্রে তাকেও টালবাহানা বন্ধ করতে হবে।
তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইছিলেন। তার দিক থেকে এই দাবির যুক্তি আছে। প্রথমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভালো হোক কী মন্দ হোক, বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতির ভিত্তিতেই সংবিধানে যুক্ত। দ্বিতীয়ত, প্রতিকূল পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে তিনি নির্বাচনে যেতে চান না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তার দলের ক্ষমতায় যাওয়ার দাবি। এই দাবি জনগণের কাছে কোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্র“তি নয়। কিংবা বাংলাদেশের বর্তমান অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার বা রূপান্তর ঘটিয়ে নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠন করার কর্মসূচিও নয়। বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে তিনি কিভাবে গড়ে তুলতে চান- সেই কর্মসূচি কই? নিদেনপক্ষে একটি সহনশীল শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার ন্যূনতম নীতিমালা কী হতে পারে, সে বিষয়েও তার কাছ থেকে জনগণ কোনো নির্দেশনা পায়নি।
বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ধরনের দল উদার রাজনৈতিক (ষরনবৎধষ) দল বলে পরিচিত। তারপরও সীমিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এ দলটি অনেক কিছুই করতে পারে। করার আছে। যেমন নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা, বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার স্বীকার করা এবং কারখানায় তাদের প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা, প্রাণ ও পরিবেশের ক্ষতি না করা, দুর্নীতি না করা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করা, দিল্লির আগ্রাসন থেকে রক্ষা, অবাধ বাজারের নামে সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন বন্ধ করা ইত্যাদি। বিএনপি এই ন্যূনতম কাজগুলো করবে জনগণ সেই প্রতিশ্র“তি তার কাছ থেকে চায়। এখন আওয়ামী লীগ যদি হঠাৎ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে বসে তাহলে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও এই প্রতিশ্র“তি দেয়ার সময় পাবে না। কিন্তু তিনি এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্র“তি দেননি। মনে রাখা দরকার, আমরা অবাস্তব নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি ও প্রোপাগান্ডামূলক কর্মসূচির কথা বলছি না। বলছি এমন কিছু নীতিগত সংস্কারের কথা যা জনগণকে আশার বাণী শোনায় এবং যার বাস্তবায়ন তার দল বা ১৮ দলীয় জোটের পক্ষে করা সম্ভব। যেমন পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যে অগণতান্ত্রিক, নাগরিক ও মানবাধিকারবিরোধী সংবিধান আমাদের ঘাড়ের ওপর বাঘের হিংস্র নখের মতো বসে রয়েছে আর আমাদের ক্রমাগত রক্তক্ষরণ ঘটছে, তিনি কিভাবে তার সংস্কার করবেন। কিংবা আদৌ করবেন কিনা আমরা এখনও জানি না। গণমাধ্যমের ওপর যে নিপীড়ন চলছে সেই নিপীড়নের বিবিধ কালো আইন তিনি বাতিল করবেন কিনা। তিনি মাহমুদুর রহমান, আদিলুর রহমান খানের ওপর দমন-নিপীড়নের কথা বলেছেন, অবশ্যই। কিন্তু এই নিপীড়ন বন্ধ করতে হলে তাকে তো বিচারব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে, দুষ্ট বিচারকদের হাত থেকে নাগরিকদের মুক্তি দিতে হবে, পুলিশ ও প্রশাসনের ট্রিগার হ্যাপি সন্ত্রাসীদের শাস্তি দিতে হবে ইত্যাদি। তিনি এসব সুনির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে কিছুই বলেননি। তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি করবেন না বলেছেন, সেটা খুবই ভালো নীতি। একথা তার বারবার বলা দরকার। কিন্তু যারা গণহত্যা করেছে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, মানুষ গুম করেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, আলেম-ওলামাদের আলো নিভিয়ে নির্বিচারে হত্যা করেছে, নিজেরা কোরআন শরিফ পুড়িয়ে আলেম-ওলামাদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছে, তাদের ক্ষমা করে দেয়ার অধিকার তো জনগণ তাকে দেয়নি। প্রতিহিংসা অবশ্যই নয়, কিন্তু ন্যায়সঙ্গত বিচার থেকে কাউকে রেহাই দেয়ার অধিকার তার নেই। কারোরই নেই। এই প্রত্যাশাগুলোকেই তিনি লম্বা দাবিনামা বা অনর্থক বিশাল তালিকা না বানিয়ে সহজে বলতে পারেন যে একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা। তিনি ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের সেই ঘোষণাই বাস্তবায়িত করবেন। আসলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করতে চাইছি। জয় শাহবাগ!
এটা সত্য যে, তিনি ‘নতুন ধারার রাজনীতি’র কথা বলেছেন এবং বিমূর্ত হলেও তার কিছু রূপরেখা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ওর মধ্যে আবেগ ও আশা আছে, কিন্তু নতুন ভবিষ্যৎ তৈরির কোনো সুচিন্তিত সূত্র নেই। তবু তিনি যখন নিজের ভুলত্র“টি অকপটে স্বীকার করেন, তখন তাকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। তিনি বলেছেন, ‘প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, মানুষ ভুল-ত্র“টির ঊর্ধ্বে নয়। এবং একথা স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই যে, অতীতে আমাদেরও ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে। তবে একই সঙ্গে আমি বলতে চাই যে, আমরা ওই সব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আগামীতে একটি উজ্জ্বল, অধিক স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমরা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমি সেই প্রবচনের সঙ্গে একমত যে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই আমরা অতীতের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করব না।’ একথাগুলো আমাদের সোনার অক্ষরে খোদাই করে রাখা দরকার। কারণ একথার ওপর দাঁড়িয়েই আগামী দিনে জনগণ তাকে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, বিদেশীদের সন্তুষ্ট রাখার ভুল ও হীনমন্য নীতি তিনি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। স্বীকার করি, পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাকে কৌশলী হতে হবে। কিন্তু সেটা দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে নয়।
তিনি এতদিন শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে আসছেন। আমি অনেকবারই তার সমালোচনা করেছি। তিনি ক্ষমতার রাজনীতি করেন, ক্ষমতায় যেতে চান, এতে কোনো অসুবিধা নেই। সেটা অন্যায়ও নয়। আমরা অনেকেই বারবার তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি, বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, ফলে এতটুকুই বিএনপির কাছে আশা করা ন্যায্য যে তারা অতীতের দুর্নীতিপরায়ণ চরিত্র ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা থেকে যথাসম্ভব নিজেদের সংশোধন করে একটা উদার কিন্তু গণতান্ত্রিক নীতির চর্চা করবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাও কঠিন কাজ। এর অর্থ হচ্ছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানের যে দুর্দশা ঘটেছে সেই সংবিধান বহাল রেখে গণতন্ত্র কায়েম ও চর্চা রীতিমতো অসম্ভব। এই সত্য মাথায় রেখেই তাকে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। গণঅভ্যুত্থান ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সামনে আর কোনো পথ ক্ষমতাসীনরা রাখেনি। তিনি চান বা না চান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেদিকে যাওয়ারই সমূহ সম্ভাবনা। বুর্জোয়া দল হিসেবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকলেও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে তিনি নিজেকে গৌণ শক্তিতে পরিণত করবেন। ষাট ও সত্তর দশকে শেখ মুজিবুর রহমান আইনি পরিমণ্ডলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিই করেছিলেন। কিন্তু তা আইন ও নিয়মতান্ত্রিকতার সীমা অতিক্রম করে গণঅভ্যুত্থান ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না ঠিক, কিন্তু ফল পেকে গেলে সেটা পাড়তে না পারলে সেই ফল বাদুড়ের খাদ্য হয়।
বাংলাদেশের মানুষ এখন বেগম জিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি কী বলবেন না বলবেন সেটা তাকে অনেক সাবধানে ও বহু কিছু বিবেচনা করে বলতে হবে। পরাশক্তি তাকে ক্ষমতায় আনবে না, জনগণই আনবে। যদি তারা চায়। পরাশক্তি যদি কাউকে আনে, তবে তারা হচ্ছে তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তি’। তিনি নন। যারা এলে এবার দুই বছর নয়, আরও দীর্ঘকাল থাকবে। আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তথাকথিত তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সব সময়ই থাকবে। অতএব ঢাকার কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে সৌহার্দ্য থাকুক, কিন্তু তাদের হাত ধরে চলার নীতি বেগম জিয়াকে ত্যাগ করতে হবে। বিশেষত তিনি যদি বলেন যে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্যায়, সহিংস ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধে তিনি বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে লড়বেন, তাহলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের জনগণ তার পেছনে দাঁড়াবে কেন? শেখ হাসিনা এই নীতি নিয়েছেন বলেই জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করছে। আর যারা এই নীতির সমর্থক তারাই বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। এই সরল কাণ্ডজ্ঞান আমরা যেন না হারাই।
No comments