চালচিত্র-প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন by শুভ রহমান
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভেতর দিয়েই বাঙালির
এই বেদনাসিক্ত গণ-আকাঙ্ক্ষার কথাটি মূর্ত হয়ে ওঠে। বিপুল ত্যাগ-তিতিক্ষা ও
রক্তদানের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন ও একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য আজও অর্জিত হলো না।
চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সত্তরের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচন ও
পরিশেষে ২০০৮ ও আসন্ন ২০১৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সেই লক্ষ্য অর্জনের
প্রত্যাশাই জাতির সামনে তুলে ধরেছে। অতীতের সব কয়টি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট
হিসেবেই মহান ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা-ভিত্তিক গণ-অভ্যুত্থান,
স্বৈরশাসন উৎখাতের অভ্যুত্থান, জরুরি অবস্থা ও অনির্বাচিত সেনা সমর্থিত
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অবসান ঘটানো, ইত্যাকার ঐতিহাসিক পর্যায় রয়েছে। এখন
অধিকতর জটিল পর্ব অতিক্রম করছে জাতি। নানা রকম ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত
গণতান্ত্রিক মহাজোট সরকারের জায়গায় একটি সর্বতোভাবে সফল হতে পারে, এমন
গণতান্ত্রিক শাসন কায়েমের নতুন প্রত্যাশায় বাঙালি জাতির এ এক সুদীর্ঘ
পথযাত্রা।
সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পাঁচ সিটি করপোরেশনের ধুন্ধুমার ভোটযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্থানীয় পর্যায় ছাপিয়ে জাতীয় পর্যায়ের সুশাসন ও গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে সুনির্দিষ্ট রায় ঘোষিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চোখকে মন ঠারার কোনো অবকাশই নেই। অতীতেও এ রকম সংকেত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেওয়া হয়েছিল এবং জাতীয় নির্বাচনে তার অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন ঘটেছে। ২০০৮-এর ঐতিহাসিক নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার আগে অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রায়ের সুস্পষ্ট প্রতিফলনই ঘটেছিল। কোনো শক্তিই তা ঠেকাতে পারেনি। এবারও তার পুনরাবৃত্তি না ঘটার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
তার পরও অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও ঐতিহ্যের পতাকা সমুন্নত রেখে সিরিজ পরাজয়েও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে, ভেঙে না পড়ে মহাজোটনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্ভীক ও দক্ষ জেনারেলের মতোই সামনের জাতীয় নির্বাচন মোকাবিলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। লন্ডন ও বেলারুশ থেকে ঘুরে এসেই কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপিদের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আগামী সংসদ নির্বাচনে 'আমরাই জিতব' বলে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। তাঁর জন্য এটি নেপোলিয়নের 'ওয়াটারলুর যুদ্ধ' হবে কি না সে ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপহীন থেকেই তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা ও উদ্যোগও তিনি গ্রহণ করছেন। দলের বিশেষ কাউন্সিলও ডাকা হচ্ছে।
এদিকে পর পর পাঁচ সিটিতে জিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও তার ১৮ দলীয় জোট স্বভাবতই কিছুটা আত্মতুষ্টির পাশাপাশি আত্মশক্তিতে অধিকতর বলীয়ান হয়ে শুধু নির্বাচনী যুদ্ধের সাংগঠনিক প্রস্তুতিই নিচ্ছে না, প্রকাশিত খবর অনুযায়ী অনেক উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়ে চলতি ইফতার রাজনীতির শুরুতেই মহাজোট শরিক আওয়ামী লীগকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে ভোলেনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রথমে সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে গেছেন। বিএনপির এই প্রথম 'পিস অফেন্সিভ' নিঃসন্দেহে সর্বমহলে অভিনন্দিত হয়েছে এবং আমাদের বিশ্বাস, অচিরেই আওয়ামী লীগকে ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক বৈঠকে তাদের আমন্ত্রণ পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনের মতো ভোটযুদ্ধে জাতীয় প্রশ্নে যে পক্ষই কোনো রকম তুষ্টিভাব পোষণ করবে, তারই একটা প্রাথমিক সেটব্যাক ঘটতে বাধ্য। রাজনৈতিক দিক থেকে পরিপক্ব কোনো শক্তিরই নার্ভের যুদ্ধে হারলে চলবে না। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতার তুলনা নেই। তাকে তাই বর্তমান জটিল ও স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে আরো সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে।
পাঁচ সিটিতে উপর্যুপরি সিরিজ পরাজয়কে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত একদিকে যেমন স্টেটসম্যানশিপ বা রাষ্ট্রনায়োকোচিত প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে নিজেদের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতা দূর করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে হবে, নিছক প্রতিপক্ষের অপপ্রচারকে দায়ী না করে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির পথ অবলম্বন করতে হবে, অন্যদিকে আবার গণমানুষের প্রকৃত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার গভীরেও দৃষ্টি দিতে হবে। যে গভীর অনাস্থা ও বিশ্বাসভঙ্গের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে জনগণের মনে, তা সর্বান্তকরণে দূর করার আন্তরিক চেষ্টা চালাতে হবে। সব কিছুকেই প্রতিপক্ষের 'অপপ্রচারের দেয়াল' মনে করলে ভুলই হবে। কারণ 'অপপ্রচারের দেয়াল' গড়ে ওঠার ভিত্তিটা তো মহাজোট নিজেই তৈরি করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ নিছক অপপ্রচারের পেছনে ছোটেনি, তাদের আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে একটি দোষত্রুটি- অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত, লোভ-লালসামুক্ত প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও নাগরিক মূল্যবোধসংবলিত সুশাসন। সাড়ে চার বছরাধিককাল ক্ষমতায় থেকেও মহাজোট সরকার প্রধানত তা জনগণকে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ মানুষের বঞ্চনা, প্রতারণা, হতাশা, আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি, ছাত্র ও যুব সংগঠনের পাণ্ডাদের নৃশংসতা, সন্ত্রাস, এমপি-মন্ত্রী দলীয় কর্মকর্তাদের লুটপাট, দুর্বৃত্তায়ন, জিনিসপত্রের অনিয়ন্ত্রিত দাম, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট নিয়ে চরম দুর্ভোগ, যোগাযোগ-অব্যবস্থা, যানজট ইত্যাদির ভোগান্তি এইই দীর্ঘস্থায়ী ও দুঃসহ যে অন্য যেসব ক্ষেত্রে উন্নয়নের কিছু সোনালি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েও সেগুলো মানুষকে তুলনামূলকভাবে আর তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। এটাই সারা দেশের সাধারণ অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের প্রক্রিয়া এই দীর্ঘ মেয়াদে মানুষকে মহাজোটমুখী করে রাখতে পারেনি। এর ওপর স্পষ্টতই নেপথ্যের ইন্ধনে একদিকে চিহ্নিত মৌলবাদী অপশক্তি, অন্যদিকে মৌলবাদের নতুন সংস্করণ হেফাজতের পরিকল্পিত আবির্ভাব ও তাণ্ডব গণমানুষকে চরমভাবে বিভ্রান্ত ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিলতর করে ফেলেছে।
সাধারণ মানুষ এত কিছুর ভেতরেও কিন্তু সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে মূলত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শাসন-ব্যবস্থার পক্ষেই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে, নিছক স্থানীয় রাজনীতির মধ্যে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ না রেখে অধিকতর রাজনৈতিক সচেতনতারই পরিচয় দিয়ে মূল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থাটি কেমন হওয়া উচিত, মাত্র তারই পক্ষে রায় দিয়েছে। তাই সিটি নির্বাচনে তাদের ব্যক্ত আকাঙ্ক্ষার সঠিক মূল্যায়নে ব্যর্থ হলে চলবে না, ক্ষমতায় যারাই আসুক, তাদের অবশ্যই শোষণ বঞ্চনা-নিপীড়ন-দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন কায়েম করার মতো প্রকৃত গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।
ইতিমধ্যে সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের সচেতন মহল সুদীর্ঘকাল ধরেই গণতন্ত্রের লড়াই চালিয়ে আসছে, স্বচ্ছ ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনের প্রশ্নে আপসহীন রয়েছে এবং কোনোভাবেই কোনো রকম ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িক লেবাসে তাদের সে প্রত্যাশাকে আবারও হারিয়ে যেতে দেবে না।
আগামী দশম জাতীয় নির্বাচন আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নির্ধারণের জন্য ঠেকে থাকবে বলে আমরা মনে করি না। ইতিমধ্যে রাজনীতির ময়দানে সাংগঠনিক তৎপরতা রোজার মাসে সাময়িকভাবে সীমিত হয়ে পড়লেও ইফতার রাজনীতির ব্যাপক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যে রকম তৎপরতা শুরু হয়েছে, তাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই নির্ধারিত সময়সীমার বাইরে চলে যাবে এবং সাংবিধানিক সংকট দেখা দেবে- এ রকম আশঙ্কা হবে সম্পূর্ণ অমূলক। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে মতপার্থক্য এখনো বিরাজ করছে, তা সময় থাকতেই নিজ নিজ সাংগঠনিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে দূর করা হবে এবং সার্বিক নির্বাচনী প্রস্তুতিও জোরেশোরে শুরু হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক মহলের এ রকম ধারণাকে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকেই অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ২০০৮-এর জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালেও নির্বাচনী তফসিল নিয়ে বড় রকম মতপার্থক্য দীর্ঘসময় ধরেই ঝুলে ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দ্রুত একমত হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুস্পষ্ট একটি তারিখ নির্ধারণে একমত হয়ে যায়। আজকের পরিস্থিতিও যতই জটিল মনে হোক, সময় থাকতেই নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে- এ রকম প্রত্যাশাই বাস্তবসম্মত। বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই বিরোধী জোট ময়দানের রাজনীতিতে চরম অসহিষ্ণুতা, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সংসদেই ফিরে গেছে এবং সংসদীয় নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণও করে চলেছে। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক আদর্শগত দিক থেকেও দেশের মুষ্টিমেয় কিছু সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন বাদে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রের পথই আঁকড়ে ধরে আছে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বীকৃত পন্থা নির্বাচনের মাধ্যমে ছাড়া অন্য কোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়ারও চিন্তা করে না।
দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখেই জাতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অবশেষে জাতির দুঃখের রজনী ভোর হবেই। এ দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সফল হবেই।
১৪.৭.২০১৩
সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পাঁচ সিটি করপোরেশনের ধুন্ধুমার ভোটযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্থানীয় পর্যায় ছাপিয়ে জাতীয় পর্যায়ের সুশাসন ও গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে সুনির্দিষ্ট রায় ঘোষিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চোখকে মন ঠারার কোনো অবকাশই নেই। অতীতেও এ রকম সংকেত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেওয়া হয়েছিল এবং জাতীয় নির্বাচনে তার অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন ঘটেছে। ২০০৮-এর ঐতিহাসিক নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার আগে অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রায়ের সুস্পষ্ট প্রতিফলনই ঘটেছিল। কোনো শক্তিই তা ঠেকাতে পারেনি। এবারও তার পুনরাবৃত্তি না ঘটার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
তার পরও অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও ঐতিহ্যের পতাকা সমুন্নত রেখে সিরিজ পরাজয়েও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে, ভেঙে না পড়ে মহাজোটনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্ভীক ও দক্ষ জেনারেলের মতোই সামনের জাতীয় নির্বাচন মোকাবিলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। লন্ডন ও বেলারুশ থেকে ঘুরে এসেই কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপিদের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আগামী সংসদ নির্বাচনে 'আমরাই জিতব' বলে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। তাঁর জন্য এটি নেপোলিয়নের 'ওয়াটারলুর যুদ্ধ' হবে কি না সে ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপহীন থেকেই তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা ও উদ্যোগও তিনি গ্রহণ করছেন। দলের বিশেষ কাউন্সিলও ডাকা হচ্ছে।
এদিকে পর পর পাঁচ সিটিতে জিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও তার ১৮ দলীয় জোট স্বভাবতই কিছুটা আত্মতুষ্টির পাশাপাশি আত্মশক্তিতে অধিকতর বলীয়ান হয়ে শুধু নির্বাচনী যুদ্ধের সাংগঠনিক প্রস্তুতিই নিচ্ছে না, প্রকাশিত খবর অনুযায়ী অনেক উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়ে চলতি ইফতার রাজনীতির শুরুতেই মহাজোট শরিক আওয়ামী লীগকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে ভোলেনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রথমে সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে গেছেন। বিএনপির এই প্রথম 'পিস অফেন্সিভ' নিঃসন্দেহে সর্বমহলে অভিনন্দিত হয়েছে এবং আমাদের বিশ্বাস, অচিরেই আওয়ামী লীগকে ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক বৈঠকে তাদের আমন্ত্রণ পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনের মতো ভোটযুদ্ধে জাতীয় প্রশ্নে যে পক্ষই কোনো রকম তুষ্টিভাব পোষণ করবে, তারই একটা প্রাথমিক সেটব্যাক ঘটতে বাধ্য। রাজনৈতিক দিক থেকে পরিপক্ব কোনো শক্তিরই নার্ভের যুদ্ধে হারলে চলবে না। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতার তুলনা নেই। তাকে তাই বর্তমান জটিল ও স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে আরো সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে।
পাঁচ সিটিতে উপর্যুপরি সিরিজ পরাজয়কে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত একদিকে যেমন স্টেটসম্যানশিপ বা রাষ্ট্রনায়োকোচিত প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে নিজেদের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতা দূর করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে হবে, নিছক প্রতিপক্ষের অপপ্রচারকে দায়ী না করে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির পথ অবলম্বন করতে হবে, অন্যদিকে আবার গণমানুষের প্রকৃত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার গভীরেও দৃষ্টি দিতে হবে। যে গভীর অনাস্থা ও বিশ্বাসভঙ্গের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে জনগণের মনে, তা সর্বান্তকরণে দূর করার আন্তরিক চেষ্টা চালাতে হবে। সব কিছুকেই প্রতিপক্ষের 'অপপ্রচারের দেয়াল' মনে করলে ভুলই হবে। কারণ 'অপপ্রচারের দেয়াল' গড়ে ওঠার ভিত্তিটা তো মহাজোট নিজেই তৈরি করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ নিছক অপপ্রচারের পেছনে ছোটেনি, তাদের আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে একটি দোষত্রুটি- অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত, লোভ-লালসামুক্ত প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও নাগরিক মূল্যবোধসংবলিত সুশাসন। সাড়ে চার বছরাধিককাল ক্ষমতায় থেকেও মহাজোট সরকার প্রধানত তা জনগণকে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ মানুষের বঞ্চনা, প্রতারণা, হতাশা, আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি, ছাত্র ও যুব সংগঠনের পাণ্ডাদের নৃশংসতা, সন্ত্রাস, এমপি-মন্ত্রী দলীয় কর্মকর্তাদের লুটপাট, দুর্বৃত্তায়ন, জিনিসপত্রের অনিয়ন্ত্রিত দাম, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট নিয়ে চরম দুর্ভোগ, যোগাযোগ-অব্যবস্থা, যানজট ইত্যাদির ভোগান্তি এইই দীর্ঘস্থায়ী ও দুঃসহ যে অন্য যেসব ক্ষেত্রে উন্নয়নের কিছু সোনালি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েও সেগুলো মানুষকে তুলনামূলকভাবে আর তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। এটাই সারা দেশের সাধারণ অবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের প্রক্রিয়া এই দীর্ঘ মেয়াদে মানুষকে মহাজোটমুখী করে রাখতে পারেনি। এর ওপর স্পষ্টতই নেপথ্যের ইন্ধনে একদিকে চিহ্নিত মৌলবাদী অপশক্তি, অন্যদিকে মৌলবাদের নতুন সংস্করণ হেফাজতের পরিকল্পিত আবির্ভাব ও তাণ্ডব গণমানুষকে চরমভাবে বিভ্রান্ত ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিলতর করে ফেলেছে।
সাধারণ মানুষ এত কিছুর ভেতরেও কিন্তু সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে মূলত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শাসন-ব্যবস্থার পক্ষেই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে, নিছক স্থানীয় রাজনীতির মধ্যে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ না রেখে অধিকতর রাজনৈতিক সচেতনতারই পরিচয় দিয়ে মূল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থাটি কেমন হওয়া উচিত, মাত্র তারই পক্ষে রায় দিয়েছে। তাই সিটি নির্বাচনে তাদের ব্যক্ত আকাঙ্ক্ষার সঠিক মূল্যায়নে ব্যর্থ হলে চলবে না, ক্ষমতায় যারাই আসুক, তাদের অবশ্যই শোষণ বঞ্চনা-নিপীড়ন-দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন কায়েম করার মতো প্রকৃত গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।
ইতিমধ্যে সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের সচেতন মহল সুদীর্ঘকাল ধরেই গণতন্ত্রের লড়াই চালিয়ে আসছে, স্বচ্ছ ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনের প্রশ্নে আপসহীন রয়েছে এবং কোনোভাবেই কোনো রকম ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িক লেবাসে তাদের সে প্রত্যাশাকে আবারও হারিয়ে যেতে দেবে না।
আগামী দশম জাতীয় নির্বাচন আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নির্ধারণের জন্য ঠেকে থাকবে বলে আমরা মনে করি না। ইতিমধ্যে রাজনীতির ময়দানে সাংগঠনিক তৎপরতা রোজার মাসে সাময়িকভাবে সীমিত হয়ে পড়লেও ইফতার রাজনীতির ব্যাপক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যে রকম তৎপরতা শুরু হয়েছে, তাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই নির্ধারিত সময়সীমার বাইরে চলে যাবে এবং সাংবিধানিক সংকট দেখা দেবে- এ রকম আশঙ্কা হবে সম্পূর্ণ অমূলক। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে মতপার্থক্য এখনো বিরাজ করছে, তা সময় থাকতেই নিজ নিজ সাংগঠনিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে দূর করা হবে এবং সার্বিক নির্বাচনী প্রস্তুতিও জোরেশোরে শুরু হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক মহলের এ রকম ধারণাকে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকেই অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ২০০৮-এর জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালেও নির্বাচনী তফসিল নিয়ে বড় রকম মতপার্থক্য দীর্ঘসময় ধরেই ঝুলে ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দ্রুত একমত হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুস্পষ্ট একটি তারিখ নির্ধারণে একমত হয়ে যায়। আজকের পরিস্থিতিও যতই জটিল মনে হোক, সময় থাকতেই নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে- এ রকম প্রত্যাশাই বাস্তবসম্মত। বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই বিরোধী জোট ময়দানের রাজনীতিতে চরম অসহিষ্ণুতা, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সংসদেই ফিরে গেছে এবং সংসদীয় নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণও করে চলেছে। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক আদর্শগত দিক থেকেও দেশের মুষ্টিমেয় কিছু সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন বাদে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রের পথই আঁকড়ে ধরে আছে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বীকৃত পন্থা নির্বাচনের মাধ্যমে ছাড়া অন্য কোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়ারও চিন্তা করে না।
দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখেই জাতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অবশেষে জাতির দুঃখের রজনী ভোর হবেই। এ দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সফল হবেই।
১৪.৭.২০১৩
No comments