কোন পথে রাজনীতি? by ড. হারুন রশীদ
সংলাপ না হলে সংঘাত- বর্তমানে রাজনীতি এমন
অবস্থায় দাঁড়িয়ে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের মেয়াদ
শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচন অত্যাসন্ন। এ অবস্থায় দিন
দিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে পাঁচ সিটি নির্বাচনে
মহাজোট প্রার্থীদের ভরাডুবির পর রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে।
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর অবস্থার
দিকে যাচ্ছে। তাতে জনমনে নানা শংকার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের
জন্য রাজনীতিকদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার কথা বলা হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে।
একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এর কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
নিতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষকে রক্ত দিতে
হয়েছে। অথচ লাখ লাখ মানুষের রক্তস্রোতের বিনিময়েই এদেশ স্বাধীন হয়েছে।
স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র মজবুত ভিত্তি পাবে- এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু
স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র বারবার বিপন্ন হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে
ভূলুণ্ঠিত করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্ষমতা দখল করেছে। চেপে বসা স্বৈরশাসন
গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু
উপেক্ষা করে এদেশের মানুষ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে। অথচ গণতান্ত্রিক শাসন
ব্যবস্থার সময়ও গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার পথ খুব একটা সুগম হয়নি। উল্টো
নেতানেত্রীদের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ ও অসহনশীল মনোভাবই দেশের
রাজনীতির প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। দায়িত্বশীল পদে থেকেও এমন সব আচরণ
করা হয়, কথাবার্তা বলা হয় যা সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। এতে গণতান্ত্রিক
চর্চা ব্যাহত হয়। কিন্তু মানুষ দেখতে চায়, জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো
অভিন্ন সুরে কথা বলছে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে
গণতন্ত্রকামী মানুষ চায়, সভা-সমাবেশের নামে রাজপথ গরম না করে, জনভোগান্তি
না বাড়িয়ে, মাঠে-ময়দানে দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য না দিয়ে সংসদে গিয়ে সব
বিষয়ে আলোচনা করা হোক, সংসদই হোক সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
দেশে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শান্তিকামী মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা রাজনৈতিক সংঘাতকেই এদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করেন। রাজনৈতিক অবিশ্বাস ও বিভক্তি এ দেশে অনেক গভীরে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংঘর্ষ আর বিভক্তির রাজনীতি থেকে দেশকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দেশ চললেও এখানে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র পরমতসহিষ্ণুতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এছাড়া সংসদ বর্জনের রীতি এখানে রীতিমতো কালচারে পরিণত হয়েছে। এটিও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সংসদই হওয়ার কথা ছিল সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার চার দশক পরও এখনও তা হয়ে ওঠেনি।
শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতায়ই নয়, নেতানেত্রীদের কথাবার্তায়ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীল মনোভাবের অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাষাতেও রয়েছে শিষ্টাচারের যথেষ্ট অভাব। বিগত বাজেট অধিবেশনে কিছু সংসদ সদস্য যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা নিয়ে মানুষ ছিঃ ছিঃ করেছে। দুঃখজনক হচ্ছে, কে কার চেয়ে বড় কিংবা কাকে কিভাবে ছোট করা যায়- সব সময় এ ধরনের অসহিষ্ণু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় রাজনীতিকদের কথাবার্তায়। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও মানসিকতা কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াই আসলে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমাদের দেশে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের চর্চা যত বাড়বে, গণতন্ত্রের ভিত্তি ততই মজবুত হবে। প্রসঙ্গত ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করতে হয়। তিনি বলেছিলেন, আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মতামত প্রকাশের অধিকারের জন্য জীবনও দিতে পারি। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের মানসিকতা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বৈরিতাপূর্ণ সমাজে বাকসংযম এবং তাতে শালীনতা রক্ষা অপরিহার্য। দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা কথাবার্তায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন এমনটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝেমধ্যেই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। এবং তা প্রায়ই ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি পর্যন্ত গিয়ে গড়ায়।
দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ প্রায়ই একে অপরের প্রতি উসকানিমূলক বক্তব্য রাখেন। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে গিয়েই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আসলে কেউ দায়িত্ব নিতে চান না। কথার ফানুস উড়িয়েই চমক সৃষ্টি করতে চান। সংসদে, জনসভায় কিংবা টিভি টকশোতে জনতার হাততালি কুড়াতে অনেকেই কথার লাগাম টানতে চান না। এতে কেউ কৌতুক বোধ করেন, কেউ বা সস্তা আমোদও পান। কিন্তু বক্তার ব্যক্তিত্ব যে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটা কি সংশ্লিষ্টরা বুঝতে অক্ষম?
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যদিও এবারের বাজেট অধিবেশনে যোগ দিয়েছে, কিন্তু এর আগে তারা লাগাতার সংসদ বর্জন করেছেন। আওয়ামী লীগও বিরোধী দলে থাকার সময় লাগাতার সংসদ বর্জন করেছে। বিরোধী দলের সংসদ বর্জন কখনও গণতান্ত্রিক রীতিসিদ্ধ হতে পারে না। সংসদীয় রীতিতে বিরোধী দলের দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই বিরোধী দল ছায়া সরকার গঠন করে। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে তাদের ভুলত্র“টি ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করে তারা। এটাই গণতান্ত্রিক রীতি। এক্ষেত্রে বয়কট-বর্জনের কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে সরকারি দলেরও দায়িত্ব রয়েছে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়ার। বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনাকে ভালোভাবে নিতে হবে। সেই অনুযায়ী ভুলত্র“টি শুধরে জনকল্যাণে কাজ করে যেতে হবে। এজন্য পরমতসহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই। তবে মনে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে সব পক্ষেরই দায়িত্ব রয়েছে। এককভাবে কারও ওপর দোষ চাপিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এখানে একটি বিষয়ে আমরা ঐক্য লক্ষ্য করছি। সেটি হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার প্রশ্নে (নাম যাই হোক না কেন) সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়েই আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে সরকার বলছে, এ আলোচনা হতে হবে সংসদে। কিন্তু বিরোধী দল পূর্বশর্ত জুড়ে দিয়েছে যে, কেবল তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে আলোচনার নিশ্চয়তা দিলেই তারা সংসদে এ নিয়ে আলোচনা করবেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদে যোগ দেয়া বিরোধী দলের নেতাদের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে কোনো শর্তারোপ করা গণতান্ত্রিক রীতিসিদ্ধ নয়।
সংসদকে কার্যকর করতে হলে সবার অংশগ্রহণেই তা করতে হবে। সংসদ যদি কার্যকর না হয়, তাহলে এর দায় বিরোধী দলও এড়াতে পারবে না। আর সংসদ কার্যকর না হলে গণতন্ত্রের ভিত্তিও মজবুত হবে না। গণতান্ত্রিক আবহ ছাড়া রাজনীতিরও কোনো চরিত্রগত পরিবর্তন হবে না। আর সেটি না হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমবে না। ফলে বাধাগ্রস্ত হবে সব ধরনের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড, উন্নয়ন-অগ্রগতি। তাই সব পক্ষকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে একটি গুণগত পরিবর্তনের জন্য।
নব্বইয়ের পর দেশে নতুন করে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হলে আশা করা গিয়েছিল, রাজনীতিতে একটি সুবাতাস বইবে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাষা এবং নেতানেত্রীদের আচরণে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তা হচ্ছে না। বৈরিতা ও বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতিরই দাপট এখনও। সবচেয়ে দুঃখজনক, রাজনীতিতে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো উপেক্ষিত হচ্ছে। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে- মূলত এ নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতি। ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার রাজনীতিই প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংকট, যানজটে নাকাল মানুষ। রমজানেও উচ্চ দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। বিরোধী দল জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এ ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বললে জনসাধারণ উপকৃত হতো। কিন্তু তা না করে তারা শুধু রাজনৈতিক ইস্যু নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয় এমন কিছু করা থেকে রাজনীতিকদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। বিরোধী দলের সংসদ বর্জন, আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি সরকারি দলের অগণতান্ত্রিক আচরণও মেনে নেয়া যায় না। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সঠিক আচরণ না করে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে, তাহলে গণতন্ত্র আবারও যে বিপন্ন হবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মাসুল যে শুধু সাধারণ মানুষকে দিতে হবে তাই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোও এ থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। কথায় আছে- নগর পুড়লে দেবালয়ও এড়ায় না। কাজেই অর্থপূর্ণ সংলাপের মধ্যেই সমঝোতা খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো পক্ষেরই কোনো শর্তারোপ বা গোঁ ধরা উচিত হবে না। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রমজানের পর আন্দোলন তীব্র করার কথা বলেছেন। অন্যদিকে সরকারও তার অবস্থানে যদি অটল থাকে, তাহলে সেটা হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। মনে রাখতে হবে, দেশের মানুষকে জিম্মি করার অধিকার কারও নেই। আর জনসাধারণই সবচেয়ে বেশি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ক্ষমতায় বসানোর ক্ষমতা তাদের হাতেই।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট
দেশে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শান্তিকামী মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা রাজনৈতিক সংঘাতকেই এদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করেন। রাজনৈতিক অবিশ্বাস ও বিভক্তি এ দেশে অনেক গভীরে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংঘর্ষ আর বিভক্তির রাজনীতি থেকে দেশকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দেশ চললেও এখানে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র পরমতসহিষ্ণুতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এছাড়া সংসদ বর্জনের রীতি এখানে রীতিমতো কালচারে পরিণত হয়েছে। এটিও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সংসদই হওয়ার কথা ছিল সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার চার দশক পরও এখনও তা হয়ে ওঠেনি।
শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতায়ই নয়, নেতানেত্রীদের কথাবার্তায়ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীল মনোভাবের অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাষাতেও রয়েছে শিষ্টাচারের যথেষ্ট অভাব। বিগত বাজেট অধিবেশনে কিছু সংসদ সদস্য যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা নিয়ে মানুষ ছিঃ ছিঃ করেছে। দুঃখজনক হচ্ছে, কে কার চেয়ে বড় কিংবা কাকে কিভাবে ছোট করা যায়- সব সময় এ ধরনের অসহিষ্ণু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় রাজনীতিকদের কথাবার্তায়। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও মানসিকতা কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াই আসলে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমাদের দেশে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের চর্চা যত বাড়বে, গণতন্ত্রের ভিত্তি ততই মজবুত হবে। প্রসঙ্গত ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করতে হয়। তিনি বলেছিলেন, আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মতামত প্রকাশের অধিকারের জন্য জীবনও দিতে পারি। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের মানসিকতা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বৈরিতাপূর্ণ সমাজে বাকসংযম এবং তাতে শালীনতা রক্ষা অপরিহার্য। দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা কথাবার্তায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন এমনটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝেমধ্যেই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। এবং তা প্রায়ই ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি পর্যন্ত গিয়ে গড়ায়।
দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ প্রায়ই একে অপরের প্রতি উসকানিমূলক বক্তব্য রাখেন। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে গিয়েই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আসলে কেউ দায়িত্ব নিতে চান না। কথার ফানুস উড়িয়েই চমক সৃষ্টি করতে চান। সংসদে, জনসভায় কিংবা টিভি টকশোতে জনতার হাততালি কুড়াতে অনেকেই কথার লাগাম টানতে চান না। এতে কেউ কৌতুক বোধ করেন, কেউ বা সস্তা আমোদও পান। কিন্তু বক্তার ব্যক্তিত্ব যে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটা কি সংশ্লিষ্টরা বুঝতে অক্ষম?
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যদিও এবারের বাজেট অধিবেশনে যোগ দিয়েছে, কিন্তু এর আগে তারা লাগাতার সংসদ বর্জন করেছেন। আওয়ামী লীগও বিরোধী দলে থাকার সময় লাগাতার সংসদ বর্জন করেছে। বিরোধী দলের সংসদ বর্জন কখনও গণতান্ত্রিক রীতিসিদ্ধ হতে পারে না। সংসদীয় রীতিতে বিরোধী দলের দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই বিরোধী দল ছায়া সরকার গঠন করে। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে তাদের ভুলত্র“টি ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করে তারা। এটাই গণতান্ত্রিক রীতি। এক্ষেত্রে বয়কট-বর্জনের কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে সরকারি দলেরও দায়িত্ব রয়েছে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়ার। বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনাকে ভালোভাবে নিতে হবে। সেই অনুযায়ী ভুলত্র“টি শুধরে জনকল্যাণে কাজ করে যেতে হবে। এজন্য পরমতসহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই। তবে মনে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে সব পক্ষেরই দায়িত্ব রয়েছে। এককভাবে কারও ওপর দোষ চাপিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এখানে একটি বিষয়ে আমরা ঐক্য লক্ষ্য করছি। সেটি হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার প্রশ্নে (নাম যাই হোক না কেন) সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়েই আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে সরকার বলছে, এ আলোচনা হতে হবে সংসদে। কিন্তু বিরোধী দল পূর্বশর্ত জুড়ে দিয়েছে যে, কেবল তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে আলোচনার নিশ্চয়তা দিলেই তারা সংসদে এ নিয়ে আলোচনা করবেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদে যোগ দেয়া বিরোধী দলের নেতাদের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে কোনো শর্তারোপ করা গণতান্ত্রিক রীতিসিদ্ধ নয়।
সংসদকে কার্যকর করতে হলে সবার অংশগ্রহণেই তা করতে হবে। সংসদ যদি কার্যকর না হয়, তাহলে এর দায় বিরোধী দলও এড়াতে পারবে না। আর সংসদ কার্যকর না হলে গণতন্ত্রের ভিত্তিও মজবুত হবে না। গণতান্ত্রিক আবহ ছাড়া রাজনীতিরও কোনো চরিত্রগত পরিবর্তন হবে না। আর সেটি না হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমবে না। ফলে বাধাগ্রস্ত হবে সব ধরনের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড, উন্নয়ন-অগ্রগতি। তাই সব পক্ষকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে একটি গুণগত পরিবর্তনের জন্য।
নব্বইয়ের পর দেশে নতুন করে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হলে আশা করা গিয়েছিল, রাজনীতিতে একটি সুবাতাস বইবে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাষা এবং নেতানেত্রীদের আচরণে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তা হচ্ছে না। বৈরিতা ও বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতিরই দাপট এখনও। সবচেয়ে দুঃখজনক, রাজনীতিতে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো উপেক্ষিত হচ্ছে। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে- মূলত এ নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতি। ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার রাজনীতিই প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংকট, যানজটে নাকাল মানুষ। রমজানেও উচ্চ দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। বিরোধী দল জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এ ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বললে জনসাধারণ উপকৃত হতো। কিন্তু তা না করে তারা শুধু রাজনৈতিক ইস্যু নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয় এমন কিছু করা থেকে রাজনীতিকদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। বিরোধী দলের সংসদ বর্জন, আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি সরকারি দলের অগণতান্ত্রিক আচরণও মেনে নেয়া যায় না। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সঠিক আচরণ না করে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে, তাহলে গণতন্ত্র আবারও যে বিপন্ন হবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মাসুল যে শুধু সাধারণ মানুষকে দিতে হবে তাই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোও এ থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। কথায় আছে- নগর পুড়লে দেবালয়ও এড়ায় না। কাজেই অর্থপূর্ণ সংলাপের মধ্যেই সমঝোতা খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো পক্ষেরই কোনো শর্তারোপ বা গোঁ ধরা উচিত হবে না। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রমজানের পর আন্দোলন তীব্র করার কথা বলেছেন। অন্যদিকে সরকারও তার অবস্থানে যদি অটল থাকে, তাহলে সেটা হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। মনে রাখতে হবে, দেশের মানুষকে জিম্মি করার অধিকার কারও নেই। আর জনসাধারণই সবচেয়ে বেশি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ক্ষমতায় বসানোর ক্ষমতা তাদের হাতেই।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট
No comments