দমনপীড়ন ও আঁতাতের রাজনীতি বন্ধ হোক by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
পাঁচ
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল মনে হয় রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে দেবে।
শুরু হবে রাজনীতিতে চূড়ান্ত খেলা, বদলে যাবে রাজনৈতিক কৌশল; শত্রু হয়ে
যাবে মিত্র আর মিত্র হয়ে যাবে শত্রু। রাজনীতির চূড়ান্ত খেলায় ক্ষমতাসীরা
অত্যন্ত নিচু স্তরে নেমে যাবে বলে প্রতীয়মান হয়; ক্ষমতার জন্য হেন কোনো কাজ
নেই যা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ করতে পারে না। এরই মধ্যে তাদের রাজনীতিতে
নিচু স্তরে নেমে যাওয়ার প্রাথমিক আলামত দেখা যাচ্ছে। জামায়াতের সঙ্গে
ক্ষমতাসীন দলের একটা গোপন সমঝোতার প্রক্রিয়া জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এ নিয়ে
রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের
সহায়তায় তার গুলশানের বাসায় জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের তিন নেতার
সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের গোপন বৈঠক হয়েছে বলে রাজনীতিতে জোর গুঞ্জন রয়েছে।
আসলে দমন-পীড়নে সিদ্ধহস্ত হলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যে কত
অসহায়, তার একটা নমুনা দেখে গেছে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। দেশে
অল্প দিনের ব্যবধানে পরপর পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এর প্রত্যেকটিতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় প্রার্থী প্রতিপক্ষের কাছে বিপুল
ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। বিশেষ করে গাজীপুরের পরাজয়টা আওয়ামী লীগের
নেতাকর্মীদের কাছে বিস্ময়ের মতো মনে হয়েছে। কেননা গাজীপুরকে বলা হয় আওয়ামী
লীগের দুর্গ। গোপালগঞ্জের পরই গাজীপুর আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতে
বিপর্যয়ে গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সর্বস্তরে। এই পরাজয়ে
তারা বিমর্ষ, বিধ্বস্ত, স্তম্ভিত ও হতবাক; তারা এখন অকপটে স্বীকার করছেন
ক্ষমতাসীন দলের জনসমর্থনে ব্যাপক ধস নামার কথা। আগামী নির্বাচনের আগে এই
জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের কোনো সম্ভাবনাও তারা দেখছেন না। তাদের এখন একমাত্র
সান্ত্বনা দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় আসার
স্বপ্ন দেখা। তাই তারা এখন বিপজ্জনক আঁতাতের রাজনীতি শুরু করেছে। জামায়াতের
সঙ্গে আঁতাত করে ও জাতীয় পার্টিকে কোনোরকমে ম্যানেজ করে একটা যেনতেন
নির্বাচনের পথে ক্ষমতাসীন দল হাঁটছে। এই বিপজ্জনক আঁতাতের রাজনীতি
ক্ষমতাসীন দলের কবর রচনা করবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বলাবাহুল্য রাজনীতিতে হঠকারী সিদ্ধান্তে জামায়াতের কোনো জুরি নেই। জন্মের পর থেকে জামায়াত রাজনীতিতে যতগুলো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইতিহাস বলে, তার সবগুলোই ছিল হঠকারী ও ভুল। দলটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করে ভুল করেছে, ভুল করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করেও। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি ভুল করেছে, পরবর্তীকালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এই ভুলের সংশোধনের চেষ্টা করেছে। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিয়ে দলটি পরে হায় হায় করেছে; মাত্র তিনটি আসন তারা ওই নির্বাচানে পেয়েছে। তা ছাড়া এক-এগারোতে দলটির রহস্যজনক ভূমিকাও ভুল ছিল বলে জনশ্র“তি আছে। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপিকে প্ররোচিত করেও জামায়াত ভুল করেছে। এখনও জামায়াত যদি কোনো আঁতাতের রাজনীতির দিকে পা বাড়ায়, তাহলে এটি তাদের জন্য চূড়ান্তভাবে বুমেরাং হবে; তারা যে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে আন্দোলনে না হলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপির শক্তিশালী অবস্থান ফুটে উঠেছে। সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থ হলেও জনগণ বিএনপিকে সামনে পথ চলতে বন্ধুর মতো সাহায্য করেছে। জনগণের সাহায্যে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত; তাদের সব ব্যর্থতা নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢাকা পড়ে গেছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলও অনেকটা দূর হয়ে গেছে। তাছাড়া নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপি একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাও পেয়ে গেছে। এটি বিএনপির রাজনীতিকে পথ দেখিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ে যাবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। দমন-পীড়ন ও বন্দুকের নল যে ক্ষমতার উৎস নয়, এটি অনিবার্যভাবে প্রমাণ করেছে জনগণ। দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার এক নজিরবিহীন ইতিহাস স্থাপন করেছে। এই সরকারের পুলিশ মানুষকে দৌড়ে পালানো অবস্থায়ও পেছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করেছে, যা টিভি চ্যানেলে মানুষ দেখেছে। পুলিশ শুধু মানুষের ওপর গুলিই চালায়নি, সন্ত্রাসী কায়দায় ন্যক্কারজনক ও অকল্পনীয়ভাবে দখল করেছে রাজনৈতিক দলের প্রধান কার্যালয়ও। সেখানে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে ইতিহাসে স্থাপন করেছে এক অনন্য নজির, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ঘটনা নজিরবিহীন। এটি মানুষকে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করেছে, মানুষ ভোটের মাধ্যমে এর জবার দিয়েছে।
বাংলাদেশের জন্মের পর বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশের গুলিতে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে প্রচার হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তির ও গণমাধ্যমের এই যুগে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারের আচরণ এমন ভয়ানক হবে তা ভাবাই যায় না। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ; এই জনগণের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে রাজনীতিতে টিকে থাকা যে কঠি- সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এটি প্রমাণ হয়েছে। এখান থেকে শুধু ক্ষমতাসীন দলকেই নয়, শিক্ষা নিতে হবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও। গত সাড়ে চার বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচার, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুতে শাসক দল তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। ধর্ম, রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুখোমুখি অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। যেখানে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন ছিল, সেখানে তৈরি করেছে ভয়াবহ বিভক্তি। এই বিভক্তি এখন তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ ধর্মীয় চেতনায় বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ও; এই দুইয়ের মধ্যে বিরোধ অতীতে সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার এটি করেছে। অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর চলছে অবর্ণনীয় অত্যাচার, তাদের বাড়ি-ঘর ভাংচুর ও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে; পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মন্দির, যা অতীতে কখনও বাংলাদেশে হয়নি। এর জন্য সংখ্যালঘুরা সরকারকেই দায়ী করছে। যার জন্য সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগকে সেইভাবে ভোট দেননি।
শেয়ার মার্কেট, এমএলএম ব্যবসার নামে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সরকার কিছুই করেনি। এ ব্যাপারে মানুষ হতাশ। শেয়ার মার্কেটে ৩৫ লাখ পরিবার নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়েছে। হলমার্ক রাষ্ট্রের কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। কুইক রেন্টালের নামে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিলে মানুষ দিশেহারা। ঘরে ঘরে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল আসছে, যা আগের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি। এই মাত্রাতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল দিতে দিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মানুষ মনে করে সরকারের দুর্নীতিপরায়ণ ও অদূরদর্শী জ্বালানি নীতির কারণেই এমনটি হচ্ছে। এর জন্য তারা শাসক দলকেই দায়ী করছেন এবং ভোটের মাধ্যমে জবাব দিচ্ছেন। তাছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ আর্থিকভাবে শোষণের শিকার হয়েছেন। অনেকে নিজের ও আত্মীয়স্বজনের অর্থ খুইয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। এসব সংক্ষুব্ধ মানুষই সুযোগ পেয়ে ব্যালটের মাধ্যমে নীরব ভোট বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, রাজনীতির আকাশে শুধুই অশনি সংকেত। সবকিছু নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এক সর্বগ্রাসী সংকটের আবর্তে। মানুষের মনে আতংক, অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এই উৎকণ্ঠা সরকারকেই দূর করতে হবে। সামনের নির্বাচন নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে এটা স্বীকার করতে হবে। এটি স্বীকার করলেই সংকট দূর করার মনোবৃত্তি তৈরি হবে। সংকট নিরসনে এখন, এই মুহূর্তে উদ্যোগ নিতে হবে; সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সরকার যদি সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে, তাহলে তারা এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে। মানুষ তাদের নতুন চোখে দেখবে।
চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় শতাধিক নিরীহ মানুষ জীবন দিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন কয়েকজন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও। হাজার হাজার মামলায় বিরোধী দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে করা হয়েছে আসামি। সরকারের কাজ হল সমাজের বিভক্তি কমিয়ে আনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা করেছে ঠিক উল্টোটা। তারা দেশটাকে সুস্পষ্টভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। এটা কেবল যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে নয়, যারাই সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করছেন তাদেরকেই সরকার শত্র“ ভাবছে। এই বিভক্তিতে সরকারেরই ক্ষতি হয়েছে। নির্বাচনে তাদের প্রার্থী গোহারা হারছে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা জনগণকে উদ্দেশ করে বলছেন- ‘আমাদের ভুল সংশোধনের সুযোগ দিন।’ ক্ষমতাসীনদের মনে রাখতে হবে, দশটি ভালো কাজকে একটি মন্দ কাজই ক্ষতিগ্রস্ত করতে যথেষ্ট। হেফাজতের ওপর ক্র্যাকডাউন চালানোয় সরকারের সব ভালো কাজ ম্লান হয়ে গেছে। গভীর রাতের এই নারকীয় ঘটনাটি মানুষ কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তাই তারা নীরব ব্যালটের মাধ্যমে এর জবাব দিচ্ছেন। দমন-পীড়ন ও নিরীহ মানুষ হত্যা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না। এ ধরনের সরকার জনগণের ভোট কিছুতেই আশা করতে পারে না। জনগণের ভোট প্রত্যাশা করলে, সাধারণ মানুষের ওপর দমন-পীড়নের পথ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
ভীতি ও আস্থাহীনতা বিরাজ করছে মানুষের মধ্যে । বাংলাদেশ ঐক্যের দিক থেকে পৃথিবীতে একটা উদাহরণ ছিল। কিন্তু এটি ভেঙে চুরমার হয়েছে। এখন জাতি হিসেবে সবদিক দিয়ে আমরা বিভক্ত। ক্ষুদ্র একটি আঘাত সহ্য করার মতো শক্তিও আমাদের নেই। বিভক্ত জাতি সাহসহীন, আশাহীন বিপন্ন এক জাতিতে পরিণত হয়। সব কিছু বিপন্ন হওয়ার আগে সরকারের উচিত বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া এবং সংকট দূর করে দেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে ধাবিত করা। তাতে সরকারের হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। জনগণের কাছে যাওয়ার এই একটি মাত্র পথই ক্ষমতাসীন দলের জন্য খোলা আছে, যা তারা কাজে লাগাতে পারে।
সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি শাসক দলকে ত্যাগ করতে হবে, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন ও জুলুম-নির্যাতন এবং আঁতাতের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে, জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করতে হবে, হিংসা-বিদ্বেষ ও অনৈক্য-বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে বর্তমান ক্রান্তি সময় অতিক্রম করা শাসক দলের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। দমন-পীড়ন, হিংসা-বিদ্বেষ-অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতি কোনো কিছুরই সমাধান দিতে পারে না, এ থেকে কোনো পক্ষই লাভবান হয় না। এর ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তা থেকে লাভবান হয় বাইরের কোনো শক্তি।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বলাবাহুল্য রাজনীতিতে হঠকারী সিদ্ধান্তে জামায়াতের কোনো জুরি নেই। জন্মের পর থেকে জামায়াত রাজনীতিতে যতগুলো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইতিহাস বলে, তার সবগুলোই ছিল হঠকারী ও ভুল। দলটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করে ভুল করেছে, ভুল করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করেও। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি ভুল করেছে, পরবর্তীকালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এই ভুলের সংশোধনের চেষ্টা করেছে। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিয়ে দলটি পরে হায় হায় করেছে; মাত্র তিনটি আসন তারা ওই নির্বাচানে পেয়েছে। তা ছাড়া এক-এগারোতে দলটির রহস্যজনক ভূমিকাও ভুল ছিল বলে জনশ্র“তি আছে। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপিকে প্ররোচিত করেও জামায়াত ভুল করেছে। এখনও জামায়াত যদি কোনো আঁতাতের রাজনীতির দিকে পা বাড়ায়, তাহলে এটি তাদের জন্য চূড়ান্তভাবে বুমেরাং হবে; তারা যে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে আন্দোলনে না হলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপির শক্তিশালী অবস্থান ফুটে উঠেছে। সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থ হলেও জনগণ বিএনপিকে সামনে পথ চলতে বন্ধুর মতো সাহায্য করেছে। জনগণের সাহায্যে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত; তাদের সব ব্যর্থতা নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢাকা পড়ে গেছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলও অনেকটা দূর হয়ে গেছে। তাছাড়া নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপি একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাও পেয়ে গেছে। এটি বিএনপির রাজনীতিকে পথ দেখিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ে যাবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। দমন-পীড়ন ও বন্দুকের নল যে ক্ষমতার উৎস নয়, এটি অনিবার্যভাবে প্রমাণ করেছে জনগণ। দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার এক নজিরবিহীন ইতিহাস স্থাপন করেছে। এই সরকারের পুলিশ মানুষকে দৌড়ে পালানো অবস্থায়ও পেছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করেছে, যা টিভি চ্যানেলে মানুষ দেখেছে। পুলিশ শুধু মানুষের ওপর গুলিই চালায়নি, সন্ত্রাসী কায়দায় ন্যক্কারজনক ও অকল্পনীয়ভাবে দখল করেছে রাজনৈতিক দলের প্রধান কার্যালয়ও। সেখানে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে ইতিহাসে স্থাপন করেছে এক অনন্য নজির, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ঘটনা নজিরবিহীন। এটি মানুষকে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করেছে, মানুষ ভোটের মাধ্যমে এর জবার দিয়েছে।
বাংলাদেশের জন্মের পর বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশের গুলিতে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে প্রচার হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তির ও গণমাধ্যমের এই যুগে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারের আচরণ এমন ভয়ানক হবে তা ভাবাই যায় না। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ; এই জনগণের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে রাজনীতিতে টিকে থাকা যে কঠি- সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এটি প্রমাণ হয়েছে। এখান থেকে শুধু ক্ষমতাসীন দলকেই নয়, শিক্ষা নিতে হবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও। গত সাড়ে চার বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচার, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুতে শাসক দল তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। ধর্ম, রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুখোমুখি অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। যেখানে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন ছিল, সেখানে তৈরি করেছে ভয়াবহ বিভক্তি। এই বিভক্তি এখন তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ ধর্মীয় চেতনায় বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ও; এই দুইয়ের মধ্যে বিরোধ অতীতে সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকার এটি করেছে। অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর চলছে অবর্ণনীয় অত্যাচার, তাদের বাড়ি-ঘর ভাংচুর ও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে; পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মন্দির, যা অতীতে কখনও বাংলাদেশে হয়নি। এর জন্য সংখ্যালঘুরা সরকারকেই দায়ী করছে। যার জন্য সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগকে সেইভাবে ভোট দেননি।
শেয়ার মার্কেট, এমএলএম ব্যবসার নামে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সরকার কিছুই করেনি। এ ব্যাপারে মানুষ হতাশ। শেয়ার মার্কেটে ৩৫ লাখ পরিবার নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়েছে। হলমার্ক রাষ্ট্রের কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। কুইক রেন্টালের নামে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিলে মানুষ দিশেহারা। ঘরে ঘরে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল আসছে, যা আগের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি। এই মাত্রাতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল দিতে দিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মানুষ মনে করে সরকারের দুর্নীতিপরায়ণ ও অদূরদর্শী জ্বালানি নীতির কারণেই এমনটি হচ্ছে। এর জন্য তারা শাসক দলকেই দায়ী করছেন এবং ভোটের মাধ্যমে জবাব দিচ্ছেন। তাছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ আর্থিকভাবে শোষণের শিকার হয়েছেন। অনেকে নিজের ও আত্মীয়স্বজনের অর্থ খুইয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। এসব সংক্ষুব্ধ মানুষই সুযোগ পেয়ে ব্যালটের মাধ্যমে নীরব ভোট বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, রাজনীতির আকাশে শুধুই অশনি সংকেত। সবকিছু নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এক সর্বগ্রাসী সংকটের আবর্তে। মানুষের মনে আতংক, অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এই উৎকণ্ঠা সরকারকেই দূর করতে হবে। সামনের নির্বাচন নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে এটা স্বীকার করতে হবে। এটি স্বীকার করলেই সংকট দূর করার মনোবৃত্তি তৈরি হবে। সংকট নিরসনে এখন, এই মুহূর্তে উদ্যোগ নিতে হবে; সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সরকার যদি সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে, তাহলে তারা এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে। মানুষ তাদের নতুন চোখে দেখবে।
চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় শতাধিক নিরীহ মানুষ জীবন দিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন কয়েকজন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও। হাজার হাজার মামলায় বিরোধী দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে করা হয়েছে আসামি। সরকারের কাজ হল সমাজের বিভক্তি কমিয়ে আনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা করেছে ঠিক উল্টোটা। তারা দেশটাকে সুস্পষ্টভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। এটা কেবল যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে নয়, যারাই সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করছেন তাদেরকেই সরকার শত্র“ ভাবছে। এই বিভক্তিতে সরকারেরই ক্ষতি হয়েছে। নির্বাচনে তাদের প্রার্থী গোহারা হারছে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা জনগণকে উদ্দেশ করে বলছেন- ‘আমাদের ভুল সংশোধনের সুযোগ দিন।’ ক্ষমতাসীনদের মনে রাখতে হবে, দশটি ভালো কাজকে একটি মন্দ কাজই ক্ষতিগ্রস্ত করতে যথেষ্ট। হেফাজতের ওপর ক্র্যাকডাউন চালানোয় সরকারের সব ভালো কাজ ম্লান হয়ে গেছে। গভীর রাতের এই নারকীয় ঘটনাটি মানুষ কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তাই তারা নীরব ব্যালটের মাধ্যমে এর জবাব দিচ্ছেন। দমন-পীড়ন ও নিরীহ মানুষ হত্যা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না। এ ধরনের সরকার জনগণের ভোট কিছুতেই আশা করতে পারে না। জনগণের ভোট প্রত্যাশা করলে, সাধারণ মানুষের ওপর দমন-পীড়নের পথ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
ভীতি ও আস্থাহীনতা বিরাজ করছে মানুষের মধ্যে । বাংলাদেশ ঐক্যের দিক থেকে পৃথিবীতে একটা উদাহরণ ছিল। কিন্তু এটি ভেঙে চুরমার হয়েছে। এখন জাতি হিসেবে সবদিক দিয়ে আমরা বিভক্ত। ক্ষুদ্র একটি আঘাত সহ্য করার মতো শক্তিও আমাদের নেই। বিভক্ত জাতি সাহসহীন, আশাহীন বিপন্ন এক জাতিতে পরিণত হয়। সব কিছু বিপন্ন হওয়ার আগে সরকারের উচিত বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া এবং সংকট দূর করে দেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে ধাবিত করা। তাতে সরকারের হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। জনগণের কাছে যাওয়ার এই একটি মাত্র পথই ক্ষমতাসীন দলের জন্য খোলা আছে, যা তারা কাজে লাগাতে পারে।
সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি শাসক দলকে ত্যাগ করতে হবে, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন ও জুলুম-নির্যাতন এবং আঁতাতের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে, জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করতে হবে, হিংসা-বিদ্বেষ ও অনৈক্য-বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে বর্তমান ক্রান্তি সময় অতিক্রম করা শাসক দলের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। দমন-পীড়ন, হিংসা-বিদ্বেষ-অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতি কোনো কিছুরই সমাধান দিতে পারে না, এ থেকে কোনো পক্ষই লাভবান হয় না। এর ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তা থেকে লাভবান হয় বাইরের কোনো শক্তি।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments