সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি থাকা উচিত কি? by আবদুল লতিফ মণ্ডল
সরকারি
চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে চাকরিপ্রার্থী এবং ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আন্দোলনে
করছে। চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবি বেশ কয়েক বছরের পুরনো হলেও
সম্প্রতি ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পরই তা নতুন
রূপ ধারণ করেছে। পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, ৮ জুলাই পাবলিক সার্ভিস
কমিশন (পিএসসি) ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ
করে। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ অন্য বছরগুলোতে যেখানে বিজ্ঞাপিত পদের ১০ থেকে
১৫ ভাগ পরীক্ষার্থীকে পাস করিয়ে লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত করা হতো,
সেখানে এবার মাত্র ৫ ভাগ পরীক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ করা হয়। তারা আরও অভিযোগ
করেছে যে, এবারের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফলে কোটা পদ্ধতি চালু করা
হয়েছে। ফলে কোটাধারী প্রায় ৫৮ ভাগ পরীক্ষার্থী সাধারণ পরীক্ষার্থীদের
তুলনায় কম স্কোর করলেও তাদের মেধা তালিকায় অনেক বেশি রাখা হয়েছে। তাই ৩৪তম
বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর আন্দোলন শুরু করে চান্স
না পাওয়া পরীক্ষার্থীরা। আন্দোলন-প্রতিবাদের মুখে ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি
পরীক্ষার ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। এভাবে শুরু হওয়া
আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে রূপ নেয় এবং তা আন্দোলন আকারে
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালুর
উদ্দেশ্য হল নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ বা সম্প্রদায় যাতে চাকরিতে উপযুক্ত
প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন সেজন্য তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধি-বিধান
প্রণয়ন। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে বেসামরিক প্রশাসনে
‘আনকভিনেন্টেড’ ক্যাডার সৃষ্টিকে অনেকটা কোটা পদ্ধতি চালু বলে আখ্যায়িত করা
যেতে পারে। তবে এটির মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার
জন্য ‘কভিনেন্টেড ক্যাডারের’ তুলনায় ‘নিুশ্রেণীর আনকভিনেন্টেড ক্যাডারে’
ভারতীয়দের ব্যাপকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। পাকিস্তান আমলে কোটা পদ্ধতির প্রসার
ঘটে। সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক গৃহীত পরীক্ষার মাধ্যমে
নিয়োগকৃত অল-পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (যেমন- সিএসপি, পিএসপি) এবং
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসগুলোতে (যেমন-পাকিস্তান অডিট
অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিস, পাকিস্তান ট্যাক্সেশন সার্ভিস, পাকিস্তান
কাস্টমস অ্যান্ড এক্সসাইজ সার্ভিস, সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিস,
পোস্টাল সার্ভিস) কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। সাবর্ডিনেট সার্ভিসের
পদগুলোতে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন সেজন্য তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধি প্রণয়নের বিধান করা হয়। এছাড়া কোনো ধর্মীয় বা উপসম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে ওই ধর্মাবলম্বী বা উপসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করার বিধান করা হয়। নারী বা পুরুষের কাজের বিশেষ প্রকৃতি বিবেচনায় যে কোনো শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণেও সংবিধান রাষ্ট্রকে ক্ষমতা প্রদান করে। এসব বিধান সংবিধানে এখনও বহাল রয়েছে।
সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগেই সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি শুরু হয়। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে সব শূন্য পদ জেলাগুলোর জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূরণ করতে হবে। যদি পদসংখ্যা এমন হয় যে, সব জেলার জন্য তা বণ্টন করা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে বিভাগের জনসংখ্যার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই আদেশে আরও বলা হয়, জেলা/বিভাগীয় পদের কোটা নির্ধারিত হবে পদের শ্রেণী ভিত্তিতে। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম শ্রেণীর শূন্য পদের ৩০ ভাগ মেধা এবং বাকি পদ জেলা/বিভাগীয় কোটার ভিত্তিতে পূরণের নির্দেশ দেয়া হয়। চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা এবং নির্যাতিত মহিলাদের কোটা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩০ ভাগ এবং ১০ ভাগ।
সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরেও জেলা/বিভাগীয় কোটা চালু থাকে। অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ, রশীদের নেতৃত্বাধীন ১৯৭৭ সালের পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশনের একজন সদস্য এমএম জামান (পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব) ব্যতীত অন্য সব সদস্য জেলা কোটা না রাখার পক্ষে মত দেন। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, `This policy (district quota) will have serious repercussion on the quality of the service particularly in positions which are meant to have nationwide function.' তবে কমিশন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে জেলা কোটায় আপত্তি করেনি। জনাব এমএম জামান তার নোটে উল্লেখ করেন, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে বাস করলেও সচিবালয়ের ১৬ শতাংশ, রেলওয়ের ১০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশ পদে এ দুটি বিভাগের লোক নিয়োজিত। এর জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসম শিক্ষা সুযোগকে দায়ী করেন এং অনুন্নত অঞ্চলগুলোতে ভালো স্কুল, কলেজ এবং যথোপযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। এসব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে তিনি পরবর্তী দশ বছরে জেলা কোটার হার ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার কথা বলেছিলেন। ওই সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকার কথা নয়।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এইচএম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৫ সালের এক আদেশে চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বিন্যাস করা হয়। এ আদেশের মাধ্যমে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, কর্পোরেশন ইত্যাদিতে ১ম ও ২য় শ্রেণীর পদে মেধাভিত্তিক কোটা ৪৫ ভাগে উন্নীত করা হয়, যা এখন পর্যন্ত চালু আছে। ২১টি জেলার জনসংখ্যা অনুযায়ী বিশেষ কোটার (মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা, উপজাতীয়, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা সদস্য) পদ বিতরণের পরিবর্তে জনসংখ্যা অনুযায়ী ৬৪টি জেলার পদ বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়। নন-গেজেটেড পদে সর্বপ্রথম জেলাভিত্তিতে পদ পূরণের পর বিশেষ কোটায় মেধা ভিত্তিতে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়, যা এখনও বহুলাংশে বহাল রয়েছে। পরিবর্তনটি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা না পাওয়া গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা কোটা সুবিধা (৩০ শতাংশ) পাবে।
কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে অভিযোগ হল, এতে মেধার অবমূল্যায়ন হয়। অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা নিয়োগ পায়। ফলে রাষ্ট্র মেধাবীদের সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। এ যুক্তির সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ বা বিশেষ শ্রেণীর জন্য চাকরিতে কোটার প্রয়োজনীয়তা এ মুহূর্তে একটি বাস্তব সত্য। সরকারি চাকরিতে এ ধরনের কোটা আমাদের পাশের দেশগুলোতেও রয়েছে। তাই হয়তো আন্দোলনকারীদের একাংশ কোটা পদ্ধতি পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানিয়েছে। তাদের সুনির্দিষ্ট দাবিগুলো হচ্ছে- জেলাভিত্তিক কোটা বাতিল, মুক্তিযোদ্ধা/ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটা শতকরা ১০ ভাগ এবং মুক্তিযোদ্ধা/ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটাসহ সব কোটা ২০ ভাগে নামিয়ে আনা। তবে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড’ নামে দুটি সংগঠন কোটা বাতিলের দাবিকে ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের শতকরা ৩০ ভাগ কোটা হ্রাসের বিরোধিতা করেছে। সুশীল সমাজের কেউ কেউ বিদ্যমান জেলা কোটাকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ সম্পর্কে সংবিধানের নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে অভিহিত করেছেন। তারা আরও মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা শুধু গরিব ও দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। এছাড়া প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সমাজের অনগ্রসর অংশকে চিহ্নিত করা। সময় এসেছে কোটা পদ্ধতি আর কতদিন বহাল থাকবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো জড়িত আছে। তাই তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না। উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সরকার একটি কমিশন গঠন বিবেচনা করতে পারে। কমিশন প্রাসঙ্গিক সবদিক বিবেচনা করে সরকারের কাছে তাদের সুপারিশ পেশ করবে। সরকার তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন সেজন্য তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধি প্রণয়নের বিধান করা হয়। এছাড়া কোনো ধর্মীয় বা উপসম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে ওই ধর্মাবলম্বী বা উপসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করার বিধান করা হয়। নারী বা পুরুষের কাজের বিশেষ প্রকৃতি বিবেচনায় যে কোনো শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণেও সংবিধান রাষ্ট্রকে ক্ষমতা প্রদান করে। এসব বিধান সংবিধানে এখনও বহাল রয়েছে।
সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগেই সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি শুরু হয়। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে সব শূন্য পদ জেলাগুলোর জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূরণ করতে হবে। যদি পদসংখ্যা এমন হয় যে, সব জেলার জন্য তা বণ্টন করা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে বিভাগের জনসংখ্যার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই আদেশে আরও বলা হয়, জেলা/বিভাগীয় পদের কোটা নির্ধারিত হবে পদের শ্রেণী ভিত্তিতে। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম শ্রেণীর শূন্য পদের ৩০ ভাগ মেধা এবং বাকি পদ জেলা/বিভাগীয় কোটার ভিত্তিতে পূরণের নির্দেশ দেয়া হয়। চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা এবং নির্যাতিত মহিলাদের কোটা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩০ ভাগ এবং ১০ ভাগ।
সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরেও জেলা/বিভাগীয় কোটা চালু থাকে। অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ, রশীদের নেতৃত্বাধীন ১৯৭৭ সালের পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশনের একজন সদস্য এমএম জামান (পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব) ব্যতীত অন্য সব সদস্য জেলা কোটা না রাখার পক্ষে মত দেন। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, `This policy (district quota) will have serious repercussion on the quality of the service particularly in positions which are meant to have nationwide function.' তবে কমিশন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে জেলা কোটায় আপত্তি করেনি। জনাব এমএম জামান তার নোটে উল্লেখ করেন, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে বাস করলেও সচিবালয়ের ১৬ শতাংশ, রেলওয়ের ১০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশ পদে এ দুটি বিভাগের লোক নিয়োজিত। এর জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসম শিক্ষা সুযোগকে দায়ী করেন এং অনুন্নত অঞ্চলগুলোতে ভালো স্কুল, কলেজ এবং যথোপযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। এসব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে তিনি পরবর্তী দশ বছরে জেলা কোটার হার ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার কথা বলেছিলেন। ওই সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকার কথা নয়।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এইচএম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৫ সালের এক আদেশে চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বিন্যাস করা হয়। এ আদেশের মাধ্যমে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, কর্পোরেশন ইত্যাদিতে ১ম ও ২য় শ্রেণীর পদে মেধাভিত্তিক কোটা ৪৫ ভাগে উন্নীত করা হয়, যা এখন পর্যন্ত চালু আছে। ২১টি জেলার জনসংখ্যা অনুযায়ী বিশেষ কোটার (মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা, উপজাতীয়, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা সদস্য) পদ বিতরণের পরিবর্তে জনসংখ্যা অনুযায়ী ৬৪টি জেলার পদ বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়। নন-গেজেটেড পদে সর্বপ্রথম জেলাভিত্তিতে পদ পূরণের পর বিশেষ কোটায় মেধা ভিত্তিতে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়, যা এখনও বহুলাংশে বহাল রয়েছে। পরিবর্তনটি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা না পাওয়া গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা কোটা সুবিধা (৩০ শতাংশ) পাবে।
কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে অভিযোগ হল, এতে মেধার অবমূল্যায়ন হয়। অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা নিয়োগ পায়। ফলে রাষ্ট্র মেধাবীদের সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। এ যুক্তির সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ বা বিশেষ শ্রেণীর জন্য চাকরিতে কোটার প্রয়োজনীয়তা এ মুহূর্তে একটি বাস্তব সত্য। সরকারি চাকরিতে এ ধরনের কোটা আমাদের পাশের দেশগুলোতেও রয়েছে। তাই হয়তো আন্দোলনকারীদের একাংশ কোটা পদ্ধতি পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানিয়েছে। তাদের সুনির্দিষ্ট দাবিগুলো হচ্ছে- জেলাভিত্তিক কোটা বাতিল, মুক্তিযোদ্ধা/ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটা শতকরা ১০ ভাগ এবং মুক্তিযোদ্ধা/ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটাসহ সব কোটা ২০ ভাগে নামিয়ে আনা। তবে ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড’ নামে দুটি সংগঠন কোটা বাতিলের দাবিকে ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের শতকরা ৩০ ভাগ কোটা হ্রাসের বিরোধিতা করেছে। সুশীল সমাজের কেউ কেউ বিদ্যমান জেলা কোটাকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ সম্পর্কে সংবিধানের নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে অভিহিত করেছেন। তারা আরও মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা শুধু গরিব ও দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। এছাড়া প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সমাজের অনগ্রসর অংশকে চিহ্নিত করা। সময় এসেছে কোটা পদ্ধতি আর কতদিন বহাল থাকবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো জড়িত আছে। তাই তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না। উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সরকার একটি কমিশন গঠন বিবেচনা করতে পারে। কমিশন প্রাসঙ্গিক সবদিক বিবেচনা করে সরকারের কাছে তাদের সুপারিশ পেশ করবে। সরকার তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments