স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন : মাছ ও মুরগি তত্ত্ব by কারার মাহমুদুল হাসান
চার
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বলা যায় মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত
হয়েছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন এলাকাগুলোসহ
সারাদেশে হানাহানির আশংকা অনেকে করেছিলেন এবং এ আশংকা করার মতো আলামতও
চারদিকে যথেষ্ট বিদ্যমান ছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট চার সিটি
কর্পোরেশনে আগের চার মেয়রকেই আবার নির্বাচন করার জন্য সমর্থন দিয়েছিল। আর এ
সমর্থন প্রদানের প্রক্রিয়ায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাদের
স্ব স্ব সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ী করার জন্য যা যা আয়ত্তের মধ্যে ছিল, তার
সবই করেছিলেন। ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট আশা করেছিল, গত চার বছরে চার সিটি
কর্পোরেশন এলাকায় প্রায় হাজার কোটিরও বেশি টাকা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে
ব্যয় করার সুবাদে সংশ্লিষ্ট ভোটাররা হয়তো সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের বিপুল
ভোটে জয়ী করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথে আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করবে।
অন্যদিকে বিএনপির নেতৃতে ১৮ দলীয় জোট নিজেদের বিশেষত বিএনপির অভ্যন্তরীণ
কোন্দল যথাসম্ভব মিটিয়ে ফেলে চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেই অত্যন্ত
পরিকল্পিত ও সুশৃংখল কায়দায় মিছিল-স্লোগান ইত্যাদির মাধ্যমে ঘরে ঘরে তাদের
মেয়র প্রার্থীর জন্য ভোট প্রার্থনা করে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি সিটি মেয়র
নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। শুধু তা-ই নয়, কাউন্সিলর পদেও বিএনপি ও ১৮
দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে জয়ের মালা ছিনিয়ে
আনতে সক্ষম হন।
ওই চার সিটি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, ভোট কেনাবেচা, জোরজবরদস্তি এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে সরকারি দল তাদের সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, এমনটি বিএনপি ও শরিক দলগুলো হরহামেশা বলে আসছিল বিভিন্ন সভা-সমাবেশে। এ ধরনের বিধিবহির্ভূত কাজ করলে সেসব জনগণ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে- এমন হুংকার দিয়েও কর্মীদের উজ্জীবিত রাখার কৌশল অনুসরণ করেছে বিএনপি। নির্বাচনের আগের দিন এমনকি নির্বাচনের দিনও আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মাহবুবউল হক হানিফ টিভি ক্যামেরা, সাংবাদিক ও অন্যদের সামনে জোর গলায় বলে বেরিয়েছেন, বিএনপি সব সিটি নির্বাচনে করুণভাবে হারবে- এটা নিশ্চিতভাবে জেনেই ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না’ ইত্যাদি নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ এখন সবরকম ‘অবসাদ ও কষ্ট’ ঝেরে বলতে শুরু করেছে, আগে অনুষ্ঠিত অন্যূন পাঁচ সহস্রাধিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতো চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন ও সরকার। এ কারণে এ নির্বাচনগুলোতে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা হারলেও ইসি ও সরকার নিরপেক্ষতার সর্বোত্তম নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আর সে কারণেই আগামী সংসদ নির্বাচনও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং তাতে গণতন্ত্রেরই জয়জয়কার হবে। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওই একই ধাঁচের কথাবার্তা প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সভা-মাহফিলে বলছেন। তিনি আগের মতো আরও বলে চলেছেন যে, বিএনপির দাবি অনুযায়ী যদি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতির কাঁধে চেপে বসে, তবে সেই অগণতান্ত্রিক সরকার কোনো নির্বাচনই দেবে না এবং সরকারি ও বিরোধী দলের নেত্রীদ্বয়কে জেলে পাঠাবে। শুধু তা-ই নয়, তারা খালেদা জিয়াকে প্রথমে জেলে পাঠাবে আর তার দুই ছেলেকে আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো চরম শাস্তি দেবে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূত বিরোধী দলের নেত্রীর মাথা থেকে সরাতে হবে এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে বিদ্যমান সরকারের অধীনে (ক্ষমতা কিছুটা কাটছাঁট করে) নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও আগামী সংসদ নির্বাচন সেভাবেই হবে। তাছাড়া মহামান্য উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তো বাতিলই করে দিয়েছেন। সুতরাং আইনিভাবে সেই বাতিলকৃত সরকার আর ফেরত আনা যাবে না এবং তার কোনো সুযোগও নেই।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে সরকারি প্রার্থীদের করুণ পরাজয়ের বিষয়ে সিপিবি নেতা হায়দার আকবর রনো অবশ্য বলেছেন, সরকারের সাড়ে চার বছরের কর্মকাণ্ডের জবাব দিয়েছে জনগণ। অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেছেন, মেয়র নির্বাচনে বিপর্যয় সরকারের জন্য অশনিসংকেত। অন্যদিকে রাজশাহীর সরকার সমর্থিত মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র নির্বাচনে বেসরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণার একপর্যায়ে মিডিয়া ক্যুর অভিযোগ আনেন। আর বরিশালের সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী তার পরাজয়ের জন্য দোষ চাপিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক চিফ হুইপ ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ওপর। এর পর দু’দিনের মাথায় জেলা আওয়ামী লীগ সভা করে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।
সরকারের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে করা হয়নি- এ বক্তব্যের বিপরীতে নির্বাচনের দিন দৈনিক ইত্তেফাকে ‘শেষ মুহূর্তে চার মিনিটে ব্যাপক ধরপাকড়’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়, চার সিটি নির্বাচনের আগের দিন ব্যাপক ধরপাকড় করেছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ ও টাকা বিলির অভিযোগে কয়েকজনকে আটক করার তথ্য স্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট বাহিনী। তবে বিএনপির একাধিক নেতার অভিযোগ, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে আতংক ছড়ানোর জন্য এই ধরপাকড় করা হয়েছে। গত ১৪.০৬.১৩ তারিখ রাত পর্যন্ত রাজশাহীতে ৩০ জন, খুলনায় ১৫ জন, সিলেটে ১০ জন এবং বরিশালে ২৫ জনকে আটকের সংবাদ পাওয়া গেছে মর্মে ওই পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে।
একই পত্রিকায় ‘আলালের বাসায় র্যাব পুলিশের অভিযান’ শিরোনামে প্রকাশিত (১৫.০৬.১৩) খবরে বলা হয়, যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বটতলার বাসভবনে বৃহস্পতিবার রাতে দফায় দফায় অভিযান চালিয়েছে র্যাব ও পুলিশ। আলাল ইত্তেফাককে জানান, রাতে তিন দফায় র্যাব ও পুলিশ গিয়ে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বরিশাল ত্যাগ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। আলাল তখন র্যাব ও পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেন, তিনি তার নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। এ বাড়িতে থেকেই তিনি বাবুগঞ্জ-উজিরপুর আসনে একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, তখনও তাকে বাবুগঞ্জ বা উজিরপুর এলাকা ছেড়ে যেতে বলা হয়নি। অথচ র্যাব-পুলিশ তাকে ঢাকায় মোহাম্মদপুর চলে যেতে বলেন। না গেলে পরবর্তীকালে লিখিত আদেশ নিয়ে তাকে বরিশাল ছাড়া করা হবে বলে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আলালকে জানিয়ে দেন। আগের দিন শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত আলাল বরিশাল নগরীতে অবস্থান করেছিলেন। দুপুরে তিনি বিএনপি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন। একই রাতে র্যাব কাউনিয়া এলাকা থেকে মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামালের সমর্থক কাউনিয়ার বিএনপি নেতা বাবলা, করিম কুটির থেকে আল-আমিন ও গতকাল আমানতগঞ্জ এলাকা থেকে সাইদুল ইসলাম পলুকে গ্রেফতার করে। বিএনপি নেতা এবায়দুল হক চাঁন ইত্তেফাককে জানান, র্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত তিনজনকে অস্ত্র দিয়ে চালান দিয়েছে র্যাব। পুলিশ জানিয়েছে, কোতোয়ালি থানায় আল-আমিনকে ও কাউনিয়া থানায় বাবলাকে অস্ত্রসহ সোপর্দ করেছে র্যাব-৮। র্যাবের গ্রেফতার অভিযান থাকায় অধিকাংশ বিএনপি নেতাকর্মী গা-ঢাকা দিয়েছেন। বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মাঝে চরম আতংক দেখা দিয়েছে।
এ ধরনের পুলিশি উৎপাত সংক্রান্ত আরও বিভিন্ন খবরাখবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচনের ঠিক আগে। সুতরাং সরকার সিটি নির্বাচনে কোনো ধরনের উৎপাত করেনি এটা বলা সমীচীন নয়। তবে নির্বাচনের ফলাফল সর্বতোভাবে বিএনপি সমর্থিতদের পক্ষে চলে যাওয়ায় এ ব্যাপারে পরে বিএনপির পক্ষ থেকে আর কোনো উচ্চবাচ্য করা হয়নি বলে প্রতীয়মান।
নির্বাচনের দু’দিন পর ১৭.০৬.১৩ তারিখে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ মর্মে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় যে, একটি নির্বাচিত সরকারই আরেকটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। যতই হুমকি-ধামকি দেয়া হোক, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে না। কোনো শক্তির কাছে মাথানত করবে না সরকার। নির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারই আগামী নির্বাচন পরিচালনা করবে এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এছাড়া সংসদের বাইরে কোনো সংলাপে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। ১৬.০৬.১৩ তারিখ রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে কার্যনির্বাহী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত ছিলেন। বর্ধিত সভায় জেলা নেতাদের এমন প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রস্তাবটি অনুমোদন দিয়েছে কার্যনির্বাহী সংসদ। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়েই গঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকার। ইচ্ছা করলে ওই সরকারে অংশ নিতে পারে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক নয়, সংলাপ হতে পারে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা নিয়ে। তবে সংলাপ হলে তা হবে জাতীয় সংসদে, অন্য কোথাও নয়- এটাই কার্যনির্বাহী কমিটির শেষ কথা।
সে যাই হোক, চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে খোদ আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ে। তবে বামপন্থী রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো, যিনি ছাত্রজীবন থেকে গত ৪০-৪৫ বছর ধরে সৎ রাজনীতি করে এখনও দেশী-বিদেশী রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সহি মতামত দিতে সক্ষম, তার এ সংক্রান্ত মন্তব্যটি অনেকটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন, সাড়ে চার বছরে সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, পদ্মা সেতু কেলেংকারি, শেয়ারবাজার কেলেংকারি, সোনালী ব্যাংক দুর্নীতি, খুন-গুম, টেন্ডারবাজি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের দাপট, গার্মেন্ট শ্রমিকদের নির্যাতন সবকিছুর জবাব জনগণ দিয়েছে এ সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, এতে নতুনত্বের কিছু নেই। এর আগে বিএনপি সরকারও একই অবস্থা করেছিল বলে গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জনগণ বেছে নিয়েছিল। এবার আবার আওয়ামী লীগ বিএনপির মতো একই আচরণ করায় জনগণ বিএনপির দিকে ঝুঁকেছে। আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষ হতাশ হয়েছে।
বিএনপি মনে করে, এ সরকারের অধীনে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিরোধী দল ১৪ দলের কোনো ফাঁদে পা দিতে চায় না। বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত ১৮ দলসহ দেশের জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশ- সুশীল সমাজ, রাজনীতি পর্যবেক্ষণকারী নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করছেন সর্বদা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন জনমতেও একই ধারণার প্রকাশ ঘটেছে। ১৯৯৩ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বিএনপির অধীনে হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা মেয়র পদে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগ বিএনপির অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়নি। তখন তাদের দাবিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। সেভাবেই বিএনপি ও ১৮ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করবে বলে মনে
করছেন তারা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, যদিও বাস্তবে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কায়দায় এসব নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে উৎসাহবোধ করে থাকে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন তথা সংসদ নির্বাচন আবশ্যিকভাবেই রাজনৈতিক এবং এ নির্বাচনের মূল অংশগ্রহণকারী হল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিনিধি (চেয়ারম্যন, মেম্বার, মেয়র, কাউন্সিলর ইত্যাদি) নির্বাচনের জন্য যেমন নির্বাচন করতে হয়, জাতীয় তথা সংসদ নির্বাচনের জন্যও ভিন্নতর আঙ্গিকে নির্বাচন করতে হয়। দু’ধরনের এ নির্বাচনের পার্থক্য অনেকটা মাছ ও মুরগির মতো। মাছ ও মুরগি প্রাণী দুটি আকারে ছোট, তবে প্রায় একই রকম এবং সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে এ দু’ধরনের প্রাণীই রান্না করে খাবার টেবিলে পরিবেশন করা হয়। কিন্তু এ দুই প্রাণীর আচরণ ও বিচরণস্থলের মধ্যে ফারাক অনেক- একটির বিচরণক্ষেত্র ডাঙায় এবং অপরটির পানিতে। ঠিক সে রকম পার্থক্য স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে। তাছাড়া মাছের ধরন অগণিত এবং গতিপ্রকৃতিও নানা ধরনের- অনেকটা স্থানীয় সরকারের মতো। চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র, কাউন্সিলরদের বিভিন্ন ইউনিটে ভিন্ন ভিন্ন পদে নির্বাচন করতে হয়। পানিতে বসবাসকারীর সংখ্যা যেমন বিপুল, তেমনি স্থানীয় সরকারের ইউনিটের সংখ্যাও বিপুল- যেখানে স্থানীয় ভিত্তিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়। এ ধরনের নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না। অন্যদিকে মুরগির আদল বা গতিপ্রকৃতি প্রায় একই ধাঁচের. অনেকটা জাতীয় সংসদের সদস্যদের মতো। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের কাজের ধরন ও প্রকৃতি প্রায় একই রকম। সেজন্য স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ প্রতিনিধিদের নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। একটির সঙ্গে অন্যটির তুলনা খোঁজার সুযোগ নেই বললেই চলে।
এ বাস্তবতার আলোকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আবশ্যিকভাবেই (বাংলাদেশের বিগত দুই দশকের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে) দলনিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধাঁচের কাঠামোর অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া সমীচীন। এর ভিন্ন কিছু হলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে নিঃসন্দেহে। আশা করি, বর্তমান শাসক জোটসহ দলমত নির্বিশেষে সবাই বিষয়টি অতিশয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে কালবিলম্ব না করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপর হবেন।
কারার মাহ্মুদুল হাসান : সাবেক সচিব; প্রেসিডেন্ট, চাটার্ড ইন্সটিটিউট অব লজেস্টিকস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট, বাংলাদেশ কাউন্সিল
ওই চার সিটি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, ভোট কেনাবেচা, জোরজবরদস্তি এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে সরকারি দল তাদের সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, এমনটি বিএনপি ও শরিক দলগুলো হরহামেশা বলে আসছিল বিভিন্ন সভা-সমাবেশে। এ ধরনের বিধিবহির্ভূত কাজ করলে সেসব জনগণ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে- এমন হুংকার দিয়েও কর্মীদের উজ্জীবিত রাখার কৌশল অনুসরণ করেছে বিএনপি। নির্বাচনের আগের দিন এমনকি নির্বাচনের দিনও আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মাহবুবউল হক হানিফ টিভি ক্যামেরা, সাংবাদিক ও অন্যদের সামনে জোর গলায় বলে বেরিয়েছেন, বিএনপি সব সিটি নির্বাচনে করুণভাবে হারবে- এটা নিশ্চিতভাবে জেনেই ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না’ ইত্যাদি নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ এখন সবরকম ‘অবসাদ ও কষ্ট’ ঝেরে বলতে শুরু করেছে, আগে অনুষ্ঠিত অন্যূন পাঁচ সহস্রাধিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতো চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন ও সরকার। এ কারণে এ নির্বাচনগুলোতে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা হারলেও ইসি ও সরকার নিরপেক্ষতার সর্বোত্তম নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আর সে কারণেই আগামী সংসদ নির্বাচনও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং তাতে গণতন্ত্রেরই জয়জয়কার হবে। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওই একই ধাঁচের কথাবার্তা প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সভা-মাহফিলে বলছেন। তিনি আগের মতো আরও বলে চলেছেন যে, বিএনপির দাবি অনুযায়ী যদি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতির কাঁধে চেপে বসে, তবে সেই অগণতান্ত্রিক সরকার কোনো নির্বাচনই দেবে না এবং সরকারি ও বিরোধী দলের নেত্রীদ্বয়কে জেলে পাঠাবে। শুধু তা-ই নয়, তারা খালেদা জিয়াকে প্রথমে জেলে পাঠাবে আর তার দুই ছেলেকে আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো চরম শাস্তি দেবে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূত বিরোধী দলের নেত্রীর মাথা থেকে সরাতে হবে এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে বিদ্যমান সরকারের অধীনে (ক্ষমতা কিছুটা কাটছাঁট করে) নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও আগামী সংসদ নির্বাচন সেভাবেই হবে। তাছাড়া মহামান্য উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তো বাতিলই করে দিয়েছেন। সুতরাং আইনিভাবে সেই বাতিলকৃত সরকার আর ফেরত আনা যাবে না এবং তার কোনো সুযোগও নেই।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে সরকারি প্রার্থীদের করুণ পরাজয়ের বিষয়ে সিপিবি নেতা হায়দার আকবর রনো অবশ্য বলেছেন, সরকারের সাড়ে চার বছরের কর্মকাণ্ডের জবাব দিয়েছে জনগণ। অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেছেন, মেয়র নির্বাচনে বিপর্যয় সরকারের জন্য অশনিসংকেত। অন্যদিকে রাজশাহীর সরকার সমর্থিত মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র নির্বাচনে বেসরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণার একপর্যায়ে মিডিয়া ক্যুর অভিযোগ আনেন। আর বরিশালের সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী তার পরাজয়ের জন্য দোষ চাপিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক চিফ হুইপ ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ওপর। এর পর দু’দিনের মাথায় জেলা আওয়ামী লীগ সভা করে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।
সরকারের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে করা হয়নি- এ বক্তব্যের বিপরীতে নির্বাচনের দিন দৈনিক ইত্তেফাকে ‘শেষ মুহূর্তে চার মিনিটে ব্যাপক ধরপাকড়’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়, চার সিটি নির্বাচনের আগের দিন ব্যাপক ধরপাকড় করেছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ ও টাকা বিলির অভিযোগে কয়েকজনকে আটক করার তথ্য স্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট বাহিনী। তবে বিএনপির একাধিক নেতার অভিযোগ, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে আতংক ছড়ানোর জন্য এই ধরপাকড় করা হয়েছে। গত ১৪.০৬.১৩ তারিখ রাত পর্যন্ত রাজশাহীতে ৩০ জন, খুলনায় ১৫ জন, সিলেটে ১০ জন এবং বরিশালে ২৫ জনকে আটকের সংবাদ পাওয়া গেছে মর্মে ওই পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে।
একই পত্রিকায় ‘আলালের বাসায় র্যাব পুলিশের অভিযান’ শিরোনামে প্রকাশিত (১৫.০৬.১৩) খবরে বলা হয়, যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বটতলার বাসভবনে বৃহস্পতিবার রাতে দফায় দফায় অভিযান চালিয়েছে র্যাব ও পুলিশ। আলাল ইত্তেফাককে জানান, রাতে তিন দফায় র্যাব ও পুলিশ গিয়ে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বরিশাল ত্যাগ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। আলাল তখন র্যাব ও পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেন, তিনি তার নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। এ বাড়িতে থেকেই তিনি বাবুগঞ্জ-উজিরপুর আসনে একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, তখনও তাকে বাবুগঞ্জ বা উজিরপুর এলাকা ছেড়ে যেতে বলা হয়নি। অথচ র্যাব-পুলিশ তাকে ঢাকায় মোহাম্মদপুর চলে যেতে বলেন। না গেলে পরবর্তীকালে লিখিত আদেশ নিয়ে তাকে বরিশাল ছাড়া করা হবে বলে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আলালকে জানিয়ে দেন। আগের দিন শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত আলাল বরিশাল নগরীতে অবস্থান করেছিলেন। দুপুরে তিনি বিএনপি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন। একই রাতে র্যাব কাউনিয়া এলাকা থেকে মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামালের সমর্থক কাউনিয়ার বিএনপি নেতা বাবলা, করিম কুটির থেকে আল-আমিন ও গতকাল আমানতগঞ্জ এলাকা থেকে সাইদুল ইসলাম পলুকে গ্রেফতার করে। বিএনপি নেতা এবায়দুল হক চাঁন ইত্তেফাককে জানান, র্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত তিনজনকে অস্ত্র দিয়ে চালান দিয়েছে র্যাব। পুলিশ জানিয়েছে, কোতোয়ালি থানায় আল-আমিনকে ও কাউনিয়া থানায় বাবলাকে অস্ত্রসহ সোপর্দ করেছে র্যাব-৮। র্যাবের গ্রেফতার অভিযান থাকায় অধিকাংশ বিএনপি নেতাকর্মী গা-ঢাকা দিয়েছেন। বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মাঝে চরম আতংক দেখা দিয়েছে।
এ ধরনের পুলিশি উৎপাত সংক্রান্ত আরও বিভিন্ন খবরাখবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচনের ঠিক আগে। সুতরাং সরকার সিটি নির্বাচনে কোনো ধরনের উৎপাত করেনি এটা বলা সমীচীন নয়। তবে নির্বাচনের ফলাফল সর্বতোভাবে বিএনপি সমর্থিতদের পক্ষে চলে যাওয়ায় এ ব্যাপারে পরে বিএনপির পক্ষ থেকে আর কোনো উচ্চবাচ্য করা হয়নি বলে প্রতীয়মান।
নির্বাচনের দু’দিন পর ১৭.০৬.১৩ তারিখে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ মর্মে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় যে, একটি নির্বাচিত সরকারই আরেকটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। যতই হুমকি-ধামকি দেয়া হোক, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে না। কোনো শক্তির কাছে মাথানত করবে না সরকার। নির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারই আগামী নির্বাচন পরিচালনা করবে এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এছাড়া সংসদের বাইরে কোনো সংলাপে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। ১৬.০৬.১৩ তারিখ রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে কার্যনির্বাহী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত ছিলেন। বর্ধিত সভায় জেলা নেতাদের এমন প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রস্তাবটি অনুমোদন দিয়েছে কার্যনির্বাহী সংসদ। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়েই গঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকার। ইচ্ছা করলে ওই সরকারে অংশ নিতে পারে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক নয়, সংলাপ হতে পারে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা নিয়ে। তবে সংলাপ হলে তা হবে জাতীয় সংসদে, অন্য কোথাও নয়- এটাই কার্যনির্বাহী কমিটির শেষ কথা।
সে যাই হোক, চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে খোদ আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ে। তবে বামপন্থী রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো, যিনি ছাত্রজীবন থেকে গত ৪০-৪৫ বছর ধরে সৎ রাজনীতি করে এখনও দেশী-বিদেশী রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সহি মতামত দিতে সক্ষম, তার এ সংক্রান্ত মন্তব্যটি অনেকটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন, সাড়ে চার বছরে সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, পদ্মা সেতু কেলেংকারি, শেয়ারবাজার কেলেংকারি, সোনালী ব্যাংক দুর্নীতি, খুন-গুম, টেন্ডারবাজি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের দাপট, গার্মেন্ট শ্রমিকদের নির্যাতন সবকিছুর জবাব জনগণ দিয়েছে এ সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, এতে নতুনত্বের কিছু নেই। এর আগে বিএনপি সরকারও একই অবস্থা করেছিল বলে গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জনগণ বেছে নিয়েছিল। এবার আবার আওয়ামী লীগ বিএনপির মতো একই আচরণ করায় জনগণ বিএনপির দিকে ঝুঁকেছে। আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষ হতাশ হয়েছে।
বিএনপি মনে করে, এ সরকারের অধীনে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিরোধী দল ১৪ দলের কোনো ফাঁদে পা দিতে চায় না। বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত ১৮ দলসহ দেশের জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশ- সুশীল সমাজ, রাজনীতি পর্যবেক্ষণকারী নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করছেন সর্বদা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন জনমতেও একই ধারণার প্রকাশ ঘটেছে। ১৯৯৩ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বিএনপির অধীনে হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা মেয়র পদে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগ বিএনপির অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়নি। তখন তাদের দাবিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। সেভাবেই বিএনপি ও ১৮ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করবে বলে মনে
করছেন তারা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, যদিও বাস্তবে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কায়দায় এসব নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে উৎসাহবোধ করে থাকে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন তথা সংসদ নির্বাচন আবশ্যিকভাবেই রাজনৈতিক এবং এ নির্বাচনের মূল অংশগ্রহণকারী হল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিনিধি (চেয়ারম্যন, মেম্বার, মেয়র, কাউন্সিলর ইত্যাদি) নির্বাচনের জন্য যেমন নির্বাচন করতে হয়, জাতীয় তথা সংসদ নির্বাচনের জন্যও ভিন্নতর আঙ্গিকে নির্বাচন করতে হয়। দু’ধরনের এ নির্বাচনের পার্থক্য অনেকটা মাছ ও মুরগির মতো। মাছ ও মুরগি প্রাণী দুটি আকারে ছোট, তবে প্রায় একই রকম এবং সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে এ দু’ধরনের প্রাণীই রান্না করে খাবার টেবিলে পরিবেশন করা হয়। কিন্তু এ দুই প্রাণীর আচরণ ও বিচরণস্থলের মধ্যে ফারাক অনেক- একটির বিচরণক্ষেত্র ডাঙায় এবং অপরটির পানিতে। ঠিক সে রকম পার্থক্য স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে। তাছাড়া মাছের ধরন অগণিত এবং গতিপ্রকৃতিও নানা ধরনের- অনেকটা স্থানীয় সরকারের মতো। চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র, কাউন্সিলরদের বিভিন্ন ইউনিটে ভিন্ন ভিন্ন পদে নির্বাচন করতে হয়। পানিতে বসবাসকারীর সংখ্যা যেমন বিপুল, তেমনি স্থানীয় সরকারের ইউনিটের সংখ্যাও বিপুল- যেখানে স্থানীয় ভিত্তিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়। এ ধরনের নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না। অন্যদিকে মুরগির আদল বা গতিপ্রকৃতি প্রায় একই ধাঁচের. অনেকটা জাতীয় সংসদের সদস্যদের মতো। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের কাজের ধরন ও প্রকৃতি প্রায় একই রকম। সেজন্য স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ প্রতিনিধিদের নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। একটির সঙ্গে অন্যটির তুলনা খোঁজার সুযোগ নেই বললেই চলে।
এ বাস্তবতার আলোকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আবশ্যিকভাবেই (বাংলাদেশের বিগত দুই দশকের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে) দলনিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধাঁচের কাঠামোর অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া সমীচীন। এর ভিন্ন কিছু হলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে নিঃসন্দেহে। আশা করি, বর্তমান শাসক জোটসহ দলমত নির্বিশেষে সবাই বিষয়টি অতিশয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে কালবিলম্ব না করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপর হবেন।
কারার মাহ্মুদুল হাসান : সাবেক সচিব; প্রেসিডেন্ট, চাটার্ড ইন্সটিটিউট অব লজেস্টিকস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট, বাংলাদেশ কাউন্সিল
No comments