গাজীপুরে গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা by মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার
সদ্যসমাপ্ত চারটি সিটি কর্পোরেশন
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গোহারা হেরেছে। আসন্ন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন
নির্বাচনেও সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও গাজীপুরের এ নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলের প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তাদের সমর্থিত প্রার্থী আজমত
উল্লাহ খান ১৭ বছর ধরে টঙ্গী পৌরসভার কর্ণধার। উপরন্তু, ১৯৮৬ সালে গাজীপুর
পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কখনও বিএনপি জয় পায়নি। অন্যদিকে বিএনপি তথা ১৮
দল সমর্থিত প্রার্থী এমএ মান্নান দীর্ঘদিন স্থানীয় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়
ছিলেন। যদিও তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।
তবে ওই নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তাকে আর স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে খুব
বেশি সক্রিয় হতে দেখা যায়নি, গণমাধ্যম সূত্রে আমরা এমন খবরই পাচ্ছি। ২০০১
সালে যখন সারাদেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের প্রার্থীদের জয়জয়কার,
তখন গাজীপুরে এমএ মান্নানের পরাজিত হওয়াটা প্রমাণ করেছে, গাজীপুরে আওয়ামী
লীগের একটা শক্ত ভিত্তি আছে।
তবে এবারের নির্বাচন কাগজে-কলমে নির্দলীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হলেও পারতপক্ষে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর জাতীয় রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট। তাছাড়া স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিকদের আনাগোনা ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। ফলে ওই নির্বাচনগুলো আর স্থানীয় নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিকদের সরব উপস্থিতির কারণে স্থানীয় ইস্যুগুলোর পরিবর্তে জাতীয় ইস্যুই প্রধানত সামনে চলে আসছে। ফলে খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীনরা আগের তুলনায় বেশি উন্নয়ন করলেও জাতীয় ইস্যুর জোয়ারে সেই উন্নয়ন ভেসে গেছে। তাই তাদের ভরাডুবি ঠেকানো সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দল এবং বিএনপি তথা ১৮ দল উভয়েই গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। তবে সেই শক্তি যতটুকু না স্থানীয় তার চেয়ে বেশি কেন্দ্রীয়। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের ৭০ জন সংসদ সদস্য, অর্ধশত কেন্দ্রীয় নেতা মাঠে নেমেছেন। তারা আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী করতে মরিয়া। অন্যদিকে বিএনপি তথা ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও বসে নেই। তারাও মাঠে নেমেছেন তাদের প্রার্থীদের পক্ষে। তাই এ নির্বাচন স্থানীয় নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ইতিমধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তকমা গায়ে লাগিয়েছে। ফলে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা থেকে সর্বশেষ ভোটের হিসাব-নিকাশ সবক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ের প্রভাব থাকবে বলেই মনে হয়।
আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা যখন প্রচারণায় অংশ নেবেন, তখন পারতপক্ষে জাতীয় সংকটগুলো তারা না চাইলেও সামনে চলে আসবে। তাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে কম-বেশি তার ছোঁয়াও থাকবে। অন্যদিকে মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনী প্রচারে থাকায় সরকারের সংকট ও কেলেংকারিগুলোও নতুন মাত্রা পাবে। বিরোধী পক্ষ সেই সুবিধা নেবে। তারা স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হতে সরকারের নানা দুর্নীতি ও কেলেংকারি তাদের প্রচারণা, বক্তৃতা-বিবৃতিতে তুলে ধরবে, যা ভোটারদের প্রভাবিত করলেও করতে পারে। আর নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের মূল কারিগর ভোটাররা যদি সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়, তবে সুদীর্ঘকাল পর গাজীপুরে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীর জয়ী হওয়াটা নিশ্চিত হয়ে যাবে। চার সিটি নির্বাচনের ফলাফলে এমনটিই লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেয়ায় স্থানীয় ইস্যুগুলো চাপা পড়ে জাতীয় ইস্যু তথা সরকারের দুর্নীতি-কেলেংকারির ঘটনাগুলোই প্রধানত জয়-পরাজয় নির্ধারণ করেছে। গাজীপুরও এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। সেখানেও ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থীকে পদ্মা সেতু কেলেংকারি, গুম-হত্যার রাজনীতি, রেলের কালো বিড়ালখ্যাত সুরঞ্জিত, রানা প্লাজা ধস প্রভৃতি বিষয় মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা প্রকাশ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণ করায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমর্থন পাওয়া আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কঠিন হবে। উপরন্তু গাজীপুরে জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ায় আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীর জন্য তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হতে পারে। স্থানীয় হোক আর জাতীয়ই হোক, দেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি তথা এরশাদ যে একটি ফ্যাক্টর এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বিগত নির্বাচনগুলোয় এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও তার সমর্থকরা জোরপূর্বক তাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করার ঘটনাটিকে ভালোভাবে নেয়নি। ফলে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কম-বেশি রয়েই যাবে, যা আজমত উল্লাহর জয়ের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দুই
স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যু প্রাধান্য পাওয়াটাই যৌক্তিক, গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনকও বটে। তবে সরকারি ও বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের জোরালো সম্পৃক্ততার কারণে স্থানীয় নির্বাচন আর স্থানীয় নির্বাচনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেখানে এখন জাতীয় নির্বাচনের মতো দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়ছে। সরকারের ভালো-মন্দ কর্মকাণ্ড ভোটের ফলাফল নির্ধারণের নিয়ামক হয়ে উঠছে। এমনটি ঘটছে প্রধানত স্থানীয় পর্যায়ে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতির কারণে। তবে স্থানীয় ইস্যু প্রাধান্য না পেয়ে জাতীয় ইস্যু প্রাধান্য পাওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে কোনো পক্ষের জন্য লাভজনক হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব তৃণমূল গণতন্ত্রের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না, এটা হলফ করে বলা যায়।
অন্যদিকে স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের প্রচার-প্রচারণা তৃণমূল নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় নেতাদের জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল করে তুলছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন দেখা যাবে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার নির্বাচনের সময়ও মন্ত্রী-এমপিরা দল বেঁধে প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় নির্বাচনে কোনো দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সরব উপস্থিতি অথবা মন্ত্রী-এমপিদের প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণ এ নির্বাচনের নির্দলীয় চরিত্রকে মারাÍকভাবে ক্ষুন্ন করে। তৃণমূলের গণতন্ত্রের জন্য যা হুমকিস্বরূপ। তাই প্রস্তাব থাকবে, যদি স্থানীয় নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের তথা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তবে এ নির্বাচনকে নামমাত্র নির্দলীয় উপাধিতে ভূষিত না করে তাকে প্রকাশ্য দলীয় নির্বাচন হিসেবে ঘোষণা করা হোক।
পরিশেষে গাজীপুর সিটি নির্বাচনও যেন সদ্যসমাপ্ত চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো সুষ্ঠু হয়, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছে সেই দাবি জানাচ্ছি। ইতিমধ্যে একজন প্রার্থী কয়েকজন প্রিসাইডিং অফিসারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচন কমিশন বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বলে আশা করি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে কোন দল বা জোট সমর্থিত প্রার্থী জয়ী বা পরাজিত হল, তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, গণতন্ত্র যেন কলংকিত না হয়। কোনো দলের কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনকে যেন কলংকিত করতে না পারেন, সেদিকে নজর দিতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করছি।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
তবে এবারের নির্বাচন কাগজে-কলমে নির্দলীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হলেও পারতপক্ষে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর জাতীয় রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট। তাছাড়া স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিকদের আনাগোনা ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। ফলে ওই নির্বাচনগুলো আর স্থানীয় নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিকদের সরব উপস্থিতির কারণে স্থানীয় ইস্যুগুলোর পরিবর্তে জাতীয় ইস্যুই প্রধানত সামনে চলে আসছে। ফলে খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীনরা আগের তুলনায় বেশি উন্নয়ন করলেও জাতীয় ইস্যুর জোয়ারে সেই উন্নয়ন ভেসে গেছে। তাই তাদের ভরাডুবি ঠেকানো সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দল এবং বিএনপি তথা ১৮ দল উভয়েই গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। তবে সেই শক্তি যতটুকু না স্থানীয় তার চেয়ে বেশি কেন্দ্রীয়। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের ৭০ জন সংসদ সদস্য, অর্ধশত কেন্দ্রীয় নেতা মাঠে নেমেছেন। তারা আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী করতে মরিয়া। অন্যদিকে বিএনপি তথা ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও বসে নেই। তারাও মাঠে নেমেছেন তাদের প্রার্থীদের পক্ষে। তাই এ নির্বাচন স্থানীয় নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ইতিমধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তকমা গায়ে লাগিয়েছে। ফলে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা থেকে সর্বশেষ ভোটের হিসাব-নিকাশ সবক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ের প্রভাব থাকবে বলেই মনে হয়।
আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা যখন প্রচারণায় অংশ নেবেন, তখন পারতপক্ষে জাতীয় সংকটগুলো তারা না চাইলেও সামনে চলে আসবে। তাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে কম-বেশি তার ছোঁয়াও থাকবে। অন্যদিকে মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনী প্রচারে থাকায় সরকারের সংকট ও কেলেংকারিগুলোও নতুন মাত্রা পাবে। বিরোধী পক্ষ সেই সুবিধা নেবে। তারা স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হতে সরকারের নানা দুর্নীতি ও কেলেংকারি তাদের প্রচারণা, বক্তৃতা-বিবৃতিতে তুলে ধরবে, যা ভোটারদের প্রভাবিত করলেও করতে পারে। আর নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের মূল কারিগর ভোটাররা যদি সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়, তবে সুদীর্ঘকাল পর গাজীপুরে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীর জয়ী হওয়াটা নিশ্চিত হয়ে যাবে। চার সিটি নির্বাচনের ফলাফলে এমনটিই লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেয়ায় স্থানীয় ইস্যুগুলো চাপা পড়ে জাতীয় ইস্যু তথা সরকারের দুর্নীতি-কেলেংকারির ঘটনাগুলোই প্রধানত জয়-পরাজয় নির্ধারণ করেছে। গাজীপুরও এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। সেখানেও ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থীকে পদ্মা সেতু কেলেংকারি, গুম-হত্যার রাজনীতি, রেলের কালো বিড়ালখ্যাত সুরঞ্জিত, রানা প্লাজা ধস প্রভৃতি বিষয় মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা প্রকাশ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণ করায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমর্থন পাওয়া আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কঠিন হবে। উপরন্তু গাজীপুরে জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ায় আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীর জন্য তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হতে পারে। স্থানীয় হোক আর জাতীয়ই হোক, দেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি তথা এরশাদ যে একটি ফ্যাক্টর এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বিগত নির্বাচনগুলোয় এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও তার সমর্থকরা জোরপূর্বক তাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করার ঘটনাটিকে ভালোভাবে নেয়নি। ফলে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কম-বেশি রয়েই যাবে, যা আজমত উল্লাহর জয়ের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দুই
স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যু প্রাধান্য পাওয়াটাই যৌক্তিক, গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনকও বটে। তবে সরকারি ও বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের জোরালো সম্পৃক্ততার কারণে স্থানীয় নির্বাচন আর স্থানীয় নির্বাচনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেখানে এখন জাতীয় নির্বাচনের মতো দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়ছে। সরকারের ভালো-মন্দ কর্মকাণ্ড ভোটের ফলাফল নির্ধারণের নিয়ামক হয়ে উঠছে। এমনটি ঘটছে প্রধানত স্থানীয় পর্যায়ে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতির কারণে। তবে স্থানীয় ইস্যু প্রাধান্য না পেয়ে জাতীয় ইস্যু প্রাধান্য পাওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে কোনো পক্ষের জন্য লাভজনক হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব তৃণমূল গণতন্ত্রের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না, এটা হলফ করে বলা যায়।
অন্যদিকে স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের প্রচার-প্রচারণা তৃণমূল নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় নেতাদের জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল করে তুলছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন দেখা যাবে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার নির্বাচনের সময়ও মন্ত্রী-এমপিরা দল বেঁধে প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় নির্বাচনে কোনো দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সরব উপস্থিতি অথবা মন্ত্রী-এমপিদের প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণ এ নির্বাচনের নির্দলীয় চরিত্রকে মারাÍকভাবে ক্ষুন্ন করে। তৃণমূলের গণতন্ত্রের জন্য যা হুমকিস্বরূপ। তাই প্রস্তাব থাকবে, যদি স্থানীয় নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের তথা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তবে এ নির্বাচনকে নামমাত্র নির্দলীয় উপাধিতে ভূষিত না করে তাকে প্রকাশ্য দলীয় নির্বাচন হিসেবে ঘোষণা করা হোক।
পরিশেষে গাজীপুর সিটি নির্বাচনও যেন সদ্যসমাপ্ত চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো সুষ্ঠু হয়, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছে সেই দাবি জানাচ্ছি। ইতিমধ্যে একজন প্রার্থী কয়েকজন প্রিসাইডিং অফিসারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচন কমিশন বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বলে আশা করি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে কোন দল বা জোট সমর্থিত প্রার্থী জয়ী বা পরাজিত হল, তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, গণতন্ত্র যেন কলংকিত না হয়। কোনো দলের কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনকে যেন কলংকিত করতে না পারেন, সেদিকে নজর দিতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করছি।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments