আমরা কি যুক্তিবাদী হওয়ার চেষ্টা করব না? by বিভুরঞ্জন সরকার
দেশের
রাজনীতি থেকে যুক্তির চর্চা উঠে যাচ্ছে। রাজনীতিকরা যেমন অধিকাংশ সময়
যুক্তিহীন ঢালাও মন্তব্য করেন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য যখন যে যুক্তি
সুবিধাজনক মনে হয় সেটাই তুলে ধরেন, তেমনি বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ আজকাল
রাজনীতিকদের মতোই সস্তা বাহবা কুড়ানোর মতো কথাবার্তা বলতে পছন্দ করছেন।
কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীর মধ্যে রাজনীতি চর্চার প্রবণতা এত প্রবল হয়ে উঠেছে
যার জন্য অনেক সময় বুঝতে অসুবিধা হয়, কোনটা রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য আর
কোনটা বুদ্ধিজীবীর। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সম্মানজনক
পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাও যখন রাজনৈতিক দলের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মীর মতো কথা
বলেন, আচরণ করেন তখন রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আশা দুরাশায় পরিণত না হয়ে
পারে না। বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে তার জন্য অনেকেই দুই
নেত্রীকে দায়ী করে থাকেন। যত দোষ নন্দ ঘোষ। যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন,
কেষ্টা বেটাই চোর। আমরাও আমাদের রাজনীতির সব বালা-মুসিবতের জন্য দুই
নেত্রীকে দায়ী করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। দুই নেত্রীকে এক পাল্লায় তুলে সমান
গালাগাল দিয়ে পাবলিকের কাছে বাহবা পাওয়া যায়Ñ নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি তৈরি হয়।
কিন্তু তাতে সংকটের সমাধান হয় না। যারা সব অনিষ্টের জন্য দুই নেত্রীকে দায়ী
করেন, তাদের যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের দেশে না হয় দুই নেত্রী আছেন, তারা
সংকট তৈরি করছেন, সমস্যা জিইয়ে রাখছেন কিন্তু যেসব দেশে দুই নেত্রী নেই
সেসব দেশে রাজনীতিতে সংকট-সমস্যার জন্য তবে দায়ী কে? পাকিস্তান, নেপালসহ
যেসব দেশ তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রম করছে, সেসব দেশে তো
দুই নেত্রী নেই। তাহলে ওসব দেশ সংকট কাটাতে পারছে না কেন? আমাদের দেশে যদি
আওয়ামী লীগ থেকে শেখ হাসিনা বাদ যান এবং বিএনপি থেকে ঝরে পড়েন খালেদা জিয়া
তাহলে রাজনীতিতে কি কোনো সমস্যা থাকবে না? রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য
কোনটা জরুরিÑ ব্যবস্থা বা সিস্টেম, নাকি ব্যক্তির বদল? আসলে আমরা অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই সমস্যার গভীরে যেতে চাই না, চিন্তাভাবনা করতে চাই না। স্রোতের
শ্যাওলা হয়ে ভেসে বেড়াতে যাদের আনন্দ, তাদের চোখে রাজনীতি দেখলে রাজনীতিতে
আদর্শের যে সংকট চলছে তা দূর হবে না।
কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ টানাও আমাদের অনেকের এক ধরনের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু একটা ঘটলেই বলা হয় দুনিয়ার কোথাও এমন ঘটে নাই। অথচ খোঁজখবর নিলে হয়তো দেখা যাবে দুনিয়ার অনেক দেশেই ওইরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে। ওই দেশে তো এরকম হয় না, আমাদের দেশে এরকম কেনÑ এমন মন্তব্য যারা করি, তারা কিন্তু আমাদের দেশের আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বিবেচনায় রাখি না। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষÑ এমন বিতর্ক দুনিয়ার অনেক দেশেই নেই। সে জন্য আমাদের দেশে তা থাকবে না? যারা অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করে সরল মন্তব্য করেন তারা ভুলে যান যে, দুনিয়ার খুব কম দেশকেই আমাদের মতো স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র লড়াই করতে হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, প্রায় তিন লাখ নারীকে চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে, লাখ লাখ বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে, এক কোটি মানুষকে শরণার্থী জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে দীর্ঘ নয় মাস অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হয়েছে, দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর মতো ঘাতক দল গঠন করা হয়েছে।
স্বাধীনতা লাভের এতদিন পর স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজনকে যারা অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত মনে করেন, তারা ভুলে যান যে, একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তারা কিন্তু পরে একবারের জন্যও নিজেদের ভুল স্বীকার করেননি, একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেননি এবং দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েও স্বাধীন দেশের মাটিতে অবাধে রাজনীতি করার অধিকার পেয়েছে, এমন কোনো দেশের কথা কি কেউ বলতে পারবেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের দেশে যে সস্তা বিতর্কের সূত্রপাত করা হয়েছে তার শেষ কোথায়, তা কেউ বলতে পারছেন না। বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে নাÑ যারা বলছেন তারা কোন অভিজ্ঞতার আলোকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন? আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে মাত্র দুটি। একটি ১৯৭৩ সালে। অন্যটি ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্র“য়ারিতে। ১৯৭৩ সালে নির্বাচন হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের সরকার তখন ক্ষমতায়। ’৭৩-এর নির্বাচন একেবারে বিতর্কমুক্ত ছিলÑ এ দাবি করা যাবে না। কয়েকটি আসনে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার অভিযোগ তখন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছিল। কিন্তু এমন কথা কেউ বলেননি যে, ওই নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণযোগ্য ছিল না। অর্থাৎ ওই সময় আওয়ামী লীগের বদলে অন্য কোনো দলের সরকার গঠনের সম্ভাবনা ছিলÑ সে রকম দাবি কোনো মহল থেকেই ওঠেনি। ’৭৩-এর নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বিস্তারের সীমা এতটা প্রসারিত ছিল না, যা থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।এরপর আসে ১৯৯৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের নির্বাচন প্রসঙ্গ। ওই নির্বাচন হয়েছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারে আমলে। ওই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্য কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় ওটা হয়েছিল একতরফা নির্বাচন। ওই একটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কি যথার্থ যে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়?
ওই দুই নির্বাচন ছাড়া আর নির্বাচন হয়েছে জিয়াউর রহমান এবং এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনামলে। জিয়া-এরশাদ আমলের নির্বাচনকে নিশ্চয়ই কেউ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বলবেন না। বস্তুত সামরিক শাসনের আমলেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার বারোটা বাজানো হয়েছিল। ভুতুড়ে ভোটার, ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু ইত্যাদি শুরু করেছিল সামরিক শাসকরা এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ওই অপধারার চর্চা খালেদা জিয়ার নির্বাচিত সরকার আমলেও অব্যাহত থাকার কারণেই মূলত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার পক্ষে দেশে একটি রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি হয় এবং এ ব্যাপারে জনমত গড়ে ওঠে। বেগম জিয়ার বিএনপি সরকারের সময় যদি মাগুরা এবং মিরপুরের উপনির্বাচনে জবরদস্তির আশ্রয় নেয়া না হতো তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালো হতো না।
এবার আসা যাক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের অভিজ্ঞতায়। এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত যে সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনকেই বলা যায় দেশে প্রথমবারের মতো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। একানব্বইয়ের নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ বলেই মনে করা হয়। অথচ ওই নির্বাচনে হেরে গিয়ে শেখ হাসিনা সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ এনেছিলেন। দেশের অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দল যে নির্বাচনের ফলাফল সহজভাবে মেনে নিতে পারে না, সে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে অন্যরা যত সার্টিফিকেটই দিক, তা যে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখে না, এটা স্বীকার না করে উপায় আছে?
বেগম জিয়ার আমলে মাগুরা এবং মিরপুর উপনির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির কারণে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশে প্রবল আন্দোলন হয় এবং সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান চালু করতে বাধ্য হয় বিএনপি। এর পর ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুটি নির্বাচন হয়। ওই দুই নির্বাচনের একটিতে আওয়ামী লীগ এবং আরেকটিতে বিএনপি জয়লাভ করে। দুই নির্বাচনেই বিজয়ী পক্ষ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে মেনে নিলেও পরাজিত পক্ষ তা মানেনি। সে জন্যই পর্যায়ক্রমে দেশের রাজনীতিতে অচলাবস্থা বেড়েছে। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিট রাজনৈতিক ফল হচ্ছে, বিরোধী দলের সংসদ বর্জন এবং দেশে সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতির গোড়া পত্তন।
রাজনীতিকদের পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস-অনাস্থার কারণেই মূলত নির্বাচন পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক বা দলীয় সরকারের বিরোধিতা করা হচ্ছে। পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজনীতিবিদের ওপর আমরা আস্থা স্থাপন করতে পারছি, কিন্তু তিন মাসের নির্বাচন পরিচালনার জন্য পারছি না। নির্বাচনকে প্রভাবিত করবেÑ এ আশংকায় যাদের বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, তাদের ওপর পাঁচ বছরের জন্য দেশবাসীর ভাগ্য পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার ঝুঁকি আমরা নিচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই দেশের রাজনৈতিক সংকটের যে সমাধান হয়ে যাচ্ছে, তাও তো নয়। পরাজিতরা সংসদে যায় না। সংসদ বর্জন স্থায়ী রূপ পাচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়ছে। নাগরিকদের জীবন ও সম্পদ অনিরাপদ হয়ে উঠছে। আমরা এটাও দেখছি, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নির্বাচনের ফলে যারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসছে, তারা আগের আমলের চেয়ে পরের বার আরও খারাপভাবে দেশ শাসন করছে। আমরা কি ক্রমাগত খারাপ শাসনকেই মেনে নিতে থাকব? আমাদের জন্য কোনটা জরুরিÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকার; নাকি সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দলের ভেতরে সংস্কার? আÍঘাতী, হুজুগপ্রিয় এবং আবেগপ্রবণÑ এ বিশেষণগুলো বাঙালির বৈশিষ্ট্য থেকে দূর করে যুক্তিবাদী হওয়ার কোনো চেষ্টাই কি আমরা করব না?
ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরির ফলে ভুয়া ভোটার হওয়ার আশংকা দূর হয়েছে। ভোট নিয়ে জনসচেতনতাও এখন অনেক বেড়েছে। মিডিয়া এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সতর্ক ও তৎপর। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলো করবে না, সেটা শতভাগ নিশ্চিত কেউ করতে পারবে না। তবে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করা, ভোট ডাকাতি করে কিংবা মিডিয়া ক্যু করে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া এখন আর কারও পক্ষে সহজ নয়। কাজেই রাজনৈতিক বা দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু বা ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়Ñ এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের সরে এসে এ নিয়ে প্রচারণা বন্ধ করা উচিত। এ প্রচারণায় রাজনীতিরই ক্ষতি হচ্ছে। অরাজনীতি বা বিরাজনীতিকে উৎসাহিত করে আর যাই হোক দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা যাবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ টানাও আমাদের অনেকের এক ধরনের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু একটা ঘটলেই বলা হয় দুনিয়ার কোথাও এমন ঘটে নাই। অথচ খোঁজখবর নিলে হয়তো দেখা যাবে দুনিয়ার অনেক দেশেই ওইরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে। ওই দেশে তো এরকম হয় না, আমাদের দেশে এরকম কেনÑ এমন মন্তব্য যারা করি, তারা কিন্তু আমাদের দেশের আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বিবেচনায় রাখি না। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষÑ এমন বিতর্ক দুনিয়ার অনেক দেশেই নেই। সে জন্য আমাদের দেশে তা থাকবে না? যারা অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করে সরল মন্তব্য করেন তারা ভুলে যান যে, দুনিয়ার খুব কম দেশকেই আমাদের মতো স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র লড়াই করতে হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, প্রায় তিন লাখ নারীকে চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে, লাখ লাখ বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে, এক কোটি মানুষকে শরণার্থী জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে দীর্ঘ নয় মাস অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হয়েছে, দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর মতো ঘাতক দল গঠন করা হয়েছে।
স্বাধীনতা লাভের এতদিন পর স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজনকে যারা অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত মনে করেন, তারা ভুলে যান যে, একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তারা কিন্তু পরে একবারের জন্যও নিজেদের ভুল স্বীকার করেননি, একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেননি এবং দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েও স্বাধীন দেশের মাটিতে অবাধে রাজনীতি করার অধিকার পেয়েছে, এমন কোনো দেশের কথা কি কেউ বলতে পারবেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের দেশে যে সস্তা বিতর্কের সূত্রপাত করা হয়েছে তার শেষ কোথায়, তা কেউ বলতে পারছেন না। বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে নাÑ যারা বলছেন তারা কোন অভিজ্ঞতার আলোকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন? আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে মাত্র দুটি। একটি ১৯৭৩ সালে। অন্যটি ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্র“য়ারিতে। ১৯৭৩ সালে নির্বাচন হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের সরকার তখন ক্ষমতায়। ’৭৩-এর নির্বাচন একেবারে বিতর্কমুক্ত ছিলÑ এ দাবি করা যাবে না। কয়েকটি আসনে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার অভিযোগ তখন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছিল। কিন্তু এমন কথা কেউ বলেননি যে, ওই নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণযোগ্য ছিল না। অর্থাৎ ওই সময় আওয়ামী লীগের বদলে অন্য কোনো দলের সরকার গঠনের সম্ভাবনা ছিলÑ সে রকম দাবি কোনো মহল থেকেই ওঠেনি। ’৭৩-এর নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বিস্তারের সীমা এতটা প্রসারিত ছিল না, যা থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।এরপর আসে ১৯৯৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের নির্বাচন প্রসঙ্গ। ওই নির্বাচন হয়েছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারে আমলে। ওই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্য কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় ওটা হয়েছিল একতরফা নির্বাচন। ওই একটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কি যথার্থ যে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়?
ওই দুই নির্বাচন ছাড়া আর নির্বাচন হয়েছে জিয়াউর রহমান এবং এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনামলে। জিয়া-এরশাদ আমলের নির্বাচনকে নিশ্চয়ই কেউ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বলবেন না। বস্তুত সামরিক শাসনের আমলেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার বারোটা বাজানো হয়েছিল। ভুতুড়ে ভোটার, ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু ইত্যাদি শুরু করেছিল সামরিক শাসকরা এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ওই অপধারার চর্চা খালেদা জিয়ার নির্বাচিত সরকার আমলেও অব্যাহত থাকার কারণেই মূলত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার পক্ষে দেশে একটি রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি হয় এবং এ ব্যাপারে জনমত গড়ে ওঠে। বেগম জিয়ার বিএনপি সরকারের সময় যদি মাগুরা এবং মিরপুরের উপনির্বাচনে জবরদস্তির আশ্রয় নেয়া না হতো তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালো হতো না।
এবার আসা যাক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের অভিজ্ঞতায়। এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত যে সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনকেই বলা যায় দেশে প্রথমবারের মতো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। একানব্বইয়ের নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ বলেই মনে করা হয়। অথচ ওই নির্বাচনে হেরে গিয়ে শেখ হাসিনা সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ এনেছিলেন। দেশের অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দল যে নির্বাচনের ফলাফল সহজভাবে মেনে নিতে পারে না, সে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে অন্যরা যত সার্টিফিকেটই দিক, তা যে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখে না, এটা স্বীকার না করে উপায় আছে?
বেগম জিয়ার আমলে মাগুরা এবং মিরপুর উপনির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির কারণে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশে প্রবল আন্দোলন হয় এবং সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান চালু করতে বাধ্য হয় বিএনপি। এর পর ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুটি নির্বাচন হয়। ওই দুই নির্বাচনের একটিতে আওয়ামী লীগ এবং আরেকটিতে বিএনপি জয়লাভ করে। দুই নির্বাচনেই বিজয়ী পক্ষ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে মেনে নিলেও পরাজিত পক্ষ তা মানেনি। সে জন্যই পর্যায়ক্রমে দেশের রাজনীতিতে অচলাবস্থা বেড়েছে। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিট রাজনৈতিক ফল হচ্ছে, বিরোধী দলের সংসদ বর্জন এবং দেশে সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতির গোড়া পত্তন।
রাজনীতিকদের পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস-অনাস্থার কারণেই মূলত নির্বাচন পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক বা দলীয় সরকারের বিরোধিতা করা হচ্ছে। পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজনীতিবিদের ওপর আমরা আস্থা স্থাপন করতে পারছি, কিন্তু তিন মাসের নির্বাচন পরিচালনার জন্য পারছি না। নির্বাচনকে প্রভাবিত করবেÑ এ আশংকায় যাদের বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, তাদের ওপর পাঁচ বছরের জন্য দেশবাসীর ভাগ্য পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার ঝুঁকি আমরা নিচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই দেশের রাজনৈতিক সংকটের যে সমাধান হয়ে যাচ্ছে, তাও তো নয়। পরাজিতরা সংসদে যায় না। সংসদ বর্জন স্থায়ী রূপ পাচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়ছে। নাগরিকদের জীবন ও সম্পদ অনিরাপদ হয়ে উঠছে। আমরা এটাও দেখছি, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নির্বাচনের ফলে যারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসছে, তারা আগের আমলের চেয়ে পরের বার আরও খারাপভাবে দেশ শাসন করছে। আমরা কি ক্রমাগত খারাপ শাসনকেই মেনে নিতে থাকব? আমাদের জন্য কোনটা জরুরিÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকার; নাকি সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দলের ভেতরে সংস্কার? আÍঘাতী, হুজুগপ্রিয় এবং আবেগপ্রবণÑ এ বিশেষণগুলো বাঙালির বৈশিষ্ট্য থেকে দূর করে যুক্তিবাদী হওয়ার কোনো চেষ্টাই কি আমরা করব না?
ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরির ফলে ভুয়া ভোটার হওয়ার আশংকা দূর হয়েছে। ভোট নিয়ে জনসচেতনতাও এখন অনেক বেড়েছে। মিডিয়া এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সতর্ক ও তৎপর। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলো করবে না, সেটা শতভাগ নিশ্চিত কেউ করতে পারবে না। তবে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করা, ভোট ডাকাতি করে কিংবা মিডিয়া ক্যু করে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া এখন আর কারও পক্ষে সহজ নয়। কাজেই রাজনৈতিক বা দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু বা ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়Ñ এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের সরে এসে এ নিয়ে প্রচারণা বন্ধ করা উচিত। এ প্রচারণায় রাজনীতিরই ক্ষতি হচ্ছে। অরাজনীতি বা বিরাজনীতিকে উৎসাহিত করে আর যাই হোক দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা যাবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
No comments